মায়ের চোখে সুখের কান্না

বাবলু,

আজ তোমাকে একটা বিশেষ কথা বলার জন্য এই চিঠিটা লিখছি।

তোমার বাবা কীভাবে মারা গিয়েছিলেন, জানো? আমরা তখন মিঠাপুকুরে। তোমার বাবা ছিলেন সার্কেল অফিসার। রাত দেড়টার দিকে তোমার বাবার বুকে ব্যথা করতে লাগল। তুমি তখন আমার পেটে। কী করব কিছুই বুঝছিলাম না। সরকারি কোয়ার্টার। নাইটগার্ড ছিল। তাকে ডাকলাম। রিকশায় করে তোমার বাবাকে নিয়ে যাওয়া হলো থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। সেখানে কোনো ডাক্তার ছিলেন না। তখন একটা মাইক্রোবাস জোগাড় করার চেষ্টা করা হলো। তারপর আমরা ছুটলাম রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

হাসপাতালের বেডে নেবার আগেই তোমার বাবা মারা গেলেন।

তুমি তাই মামাবাড়িতে জন্মেছ। মামাবাড়িতেই ছোটবেলা কেটেছে। আমি শিক্ষকতার চাকরি নিলাম। তোমাকে প্রথম সুযোগেই আমি পাঠিয়ে দিলাম ক্যাডেট কলেজে।

সেদিন থেকে আমি স্বপ্ন দেখছি, বড় হয়ে তুমি হবে ডাক্তার।

শুনেছি, বায়োলজি তোমার ভালো লাগে না। কিন্তু তুমি কি বাবা আমার কথাটা একবার ভাববে। তুমি কি বড় হয়ে ডাক্তার হবে?

তোমার জন্য একটা সোয়েটার বুনছি। এবার শীতের আগেই সেটা তোমার হাতে পৌঁছাবে।

ইতি, তোমার মা

চিঠিটা পড়ে সে স্তব্ধ হয়ে আছে। তার কিছু ভালো লাগছে না। বিকেলবেলা গল্পের বই পড়ার ক্লাসে স্তব্ধ হয়ে রইল। ১০ জনের একটা গ্রুপ। সবাই আলোচনা করছে জাহানারা ইমামের লেখা একাত্তরের দিনগুলি বইটি নিয়ে। তার প্রিয় শিক্ষক সিরাজ স্যার ব্যাপারটা খেয়াল করলেন। তিনি বললেন, কী বাবলু? তোমার কি শরীর খারাপ?

না স্যার।

তাহলে তুমি কিছু বলছ না কেন? সবাই আলোচনায় অংশ নিচ্ছে, তুমি চুপচাপ বসে আছো। বইটা ভালো লাগেনি?

ভালো লেগেছে স্যার। স্যার, আপনার সঙ্গে আমি কি একটু আলাদা করে কথা বলতে পারি?

নিশ্চয়ই।

সন্ধ্যার সময় স্যার নিজেই এলেন তাদের ছাত্রাবাসে। হোস্টেল সুপার মোজাম্মেল স্যারও ছিলেন। বাবলুকে ডেকে পাঠালেন সুপারের রুমে।

বাবলু, বলো, কী তোমার কথা।

বাবলু মায়ের চিঠিটা তুলে দিল সিরাজ স্যারের হাতে।

স্যার চিঠিটা পড়ে গম্ভীর হয়ে রইলেন।

তারপর মোজাম্মেল স্যারের উদ্দেশে বললেন, এই একটা সমস্যা। আমাদের গার্জিয়ানরা তাদের স্বপ্ন চাপিয়ে দেন সন্তানের ওপর। আমাদের বাবলু বায়োলজি পছন্দ করে না। তার প্রিয় হলো ফিজিকস। তার প্রিয় হলো গণিত। সে সবচেয়ে ভালো করবে ফিজিকস পড়লে। ইঞ্জিনিয়ারিংও তার একটা অপশন হতে পারে। অথচ মা চান সে ডাক্তার হোক।

বাবলুর মাকে ফোন করলেন সিরাজ স্যার। নিজের পরিচয় দিলেন। তারপর বললেন, ম্যাডাম, আপনি কি জানেন, সাকিব আল হাসানের বাবা তার ছেলের ক্রিকেট ব্যাট কেটে ফেলতেন। তাঁর শঙ্কা ছিল, ছেলে না বড় হয়ে ক্রিকেটার হয়ে যায়। কিন্তু ছেলে ক্রিকেট ছাড়ল না। বিকেএসপিতে ভর্তি হলো। শেষে হলো দুনিয়ার এক নম্বর অলরাউন্ডার। ছেলেমেয়ে যা হতে চায়, তাকে তা-ই হতে দিন, যে সাবজেক্ট পছন্দ করে, তাকে তা-ই পড়তে দিন। দেখবেন, ছেলে জীবনে শাইন করবে। আর কত ভালো ছেলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ডাক্তারি-ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গেছে, ভালো লাগেনি বলে আর পড়া শেষই করেনি। কাজেই দয়া করে ছেলের ওপরে জোর করবেন না।

এর ১৬ বছর পরের কথা। বাবলু এখন আমেরিকায়। এমআইটিতে ফিজিকসে পিএইচডি শেষ করে সেখানেই ল্যাবরেটরিতে গবেষণা করছে। আজ তার মা আসছেন বোস্টন এয়ারপোর্টে। বাবলু এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে আছে। প্লেনে মায়ের পাশে বসেছিলেন একজন আমেরিকান সাদা ভদ্রলোক। তিনি বাবলুর মায়ের সঙ্গে ইংরেজিতে গল্প করছিলেন। মা বললেন, আমার ছেলের নাম নাসের আলী। সে এমআইটির গবেষক।

ভদ্রলোক বললেন, আপনি জানেন, আপনার ছেলে আমাদের ইউনিভার্সিটির গৌরব। ও গবেষণা করছে মানুষের হার্টের ওপরেই। ওর গবেষণা মানুষের অনেক বড় কাজে লাগবে। শুনে বাবলুর মা চোখ মুছতে লাগলেন।

ভদ্রলোক বললেন, আপনি কাঁদছেন কেন। আমি কি আপনাকে কোনোভাবে আঘাত করলাম?

মা বললেন, আনন্দে কাঁদছি। ছেলের গৌরবের আনন্দে।

অলংকরণ: তুলি

সহযোগিতায় UNFPA