গণিতে ছন্দময় অমিত্রাক্ষর

পরীক্ষার হল। অঙ্ক করতে করতে সবার বেহাল দশা। কেউ তো পারলে খাতা জমা না দিয়েই পালাবে, কেউ কেউ কলম কামড়ে খেয়ে ফেলেছে প্রায়। অনেকে উদাস চোখে মাথার ওপরের পাখাটার দিকে তাকিয়ে আছে। অবশ্য সবার অবস্থা যে একই রকম, তা কিন্তু নয়। কেউ কেউ ঝড়ের বেগে সমাধান করে চলেছে একেকটা অঙ্কের।

এমন পরিস্থিতির সঙ্গে তোমরা অনেকেই পরিচিত। চলো তোমাদের বলি হার না-মানা এক বালকের কথা। রাজধানীর ধানমন্ডি গভ. বয়েজ হাইস্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র অমিত্রাক্ষর বিশ্বাসের গল্প।

কিশোর আলোর ২০১৮ সালের বর্ষসেরা উদীয়মান স্বেচ্ছাসেবক অমিত্রাক্ষর। ‘যে ছন্দে চরণদ্বয়ের অন্ত্যবর্ণের মিল থাকে না, তাকে অমিত্রাক্ষর ছন্দ বলে।’ ছন্দের সঙ্গে মিলিয়েই নামটা রেখেছিলেন অমিত্রাক্ষরের মা। এবারের ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংক-প্রথম আলো গণিত উৎসবে জুনিয়র ক্যাটাগরিতে জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয় সে।

শুরুর গল্পটা বলি তাহলে। ছোটবেলা থেকেই গণিতের প্রতি বেশ আগ্রহ ছিল অমিত্রাক্ষরের। কিন্তু ফাঁকিবাজির কারণে পঞ্চম শ্রেণিতে ওঠার পর অঙ্ক করা হত না বলা যায়। তোমরা অনেকেই হয়ত একই দলেরই লোক। যা হোক, এ সময় মেসোর হাত ধরে গণিতের জগতে আবার প্রবেশ ঘটে অমিত্রাক্ষরের। অবশ্য ছোটবেলায় গণিতের মূল বীজ বপন করে দেন দাদু। পিইসি পরীক্ষার পরও একইভাবে দাদুর কাছে অঙ্ক করা শুরু হলো। দুই সপ্তাহে সমাধান করল মাত্র দুটি অঙ্ক। অঙ্ক এত কঠিন লাগল যে অমিত্রাক্ষর খানিকটা হতাশই হয়ে গিয়েছিল বলতে পারো। কিন্তু দাদু আবার হাল ছাড়ার মানুষ না।

২০১৭ সাল। ওরা তখন থাকে গোপালগঞ্জে। উৎসবের আঞ্চলিক পর্যায় চলছে। পরীক্ষা দিয়ে খানিকটা মাথা নিচু করেই বের হলো অমিত্রাক্ষর। মাথায় রোদ নিয়ে মাঠের মধ্যে খানিকক্ষণ পায়চারি করল। বুঝতেই পারছ, পরীক্ষা মন মতো না হলে যেমন হয়। ফলাফল ঘোষণা শুরু হল। প্রাইমারি ক্যাটাগরিতে ফলাফল ঘোষণার সময় একে একে সেকেন্ড রানারআপ, ফার্স্ট রানারআপের নাম ডাকা হলো। ততক্ষণে অমিত্রাক্ষর বাড়ির পথে হাঁটা ধরেছে। এমন সময় মাইকে ঘোষণা এল চ্যাম্পিয়নের নাম। কাঁপতে কাঁপতে মঞ্চে উঠে এল অমিত্রাক্ষর। এরপরের ঘটনা ঘটে গেছে বেশ দ্রুত। জাতীয় পর্যায়ে এসে সেবার দ্বিতীয় রানারআপ হয় সে। গণিত উৎসবের যাত্রার গল্পটা শুরুটা হয় এখানেই।

এ বছরের কথা। ঢাকায় এসে নতুন স্কুলে ভর্তি হয়েছে অমিত্রাক্ষর। কিশোর আলোয় নিয়মিত স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করাও শুরু করেছে। মডেলিং, প্রুফ রিডিং থেকে শুরু করে সব কাজেই পাওয়া যায় তাকে। ‘ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়’ কথাটার অর্থ সে বুঝে নিয়েছে বেশ ভালোভাবে। হাল ছেড়ে দেবে দেবে সময়ে কিশোর আলোই তার কাঁধে বন্ধুত্বের হাতটা রেখেছে। গণিত অলিম্পিয়াডে আসা নিয়ে কিশোর আলো তার জীবনে কী ভূমিকা রেখেছে এমন এক প্রশ্নের উত্তরে সে জানায়, শুরুতে ধরে নিয়েছিলাম এসব আমাকে দিয়ে কিছু হবে না। কিন্তু কিআর প্রতিটি সংখ্যার অন্যদের সাফল্যের গল্প, কখনো রোবট কখনো ফিজিক্স কখনো বা গণিত নিয়েই অনেক লেখা ও আয়োজন প্রতিনিয়ত আমাকে আরো উদ্যমী করে তুলছিল। কিআড্ডাতেও অনেক সফলদের গল্প শুনে হিংসে হত একটু। তবে তার থেকেও বেশি উদ্যম খুঁজে পেতাম।

এবার আঞ্চলিক গণিত উৎসবের আগে জেলা পর্যায়ে সব জেলাতেই উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল। প্রস্তুতির জন্য অমিত্রাক্ষর রীতিমতো আদাজল খেয়ে লেগে পড়ল। ফলাফল, ফার্স্ট রানারআপ হিসেবে জাতীয় পর্যায়ে অংশগ্রহণ করার সুযোগ। এর চেয়েও মজার বিষয় হলো, আঞ্চলিক পর্যায়ে ফার্স্ট রানারআপ হলেও জাতীয় পর্যায়ে এসে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে সে!

অমিত্রাক্ষর যে শুধু গণিতেই ভালো, তা কিন্তু নয়। প্রোগ্রামিং নিয়েও আগ্রহ আছে তার। কয়েকটি অনলাইন ওয়েবসাইট বানানোর অভিজ্ঞতাও জমা হয়েছে ঝুলিতে। অমিত্রাক্ষরের কী হতে চায়? জানতে চেয়েছিলাম তার মুখ থেকেই। ‘আমার স্বপ্ন গুগলে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে কাজ করা। এমনকি সেই পর্যন্ত পৌঁছানোর একটা রোডম্যাপও আমি বানিয়ে ফেলেছি’।

ছবি: সৈয়দ আমীর হায়দার