সিনেমার সত্যজিৎ

কে না জানে—অসাধারণ সব গল্প লিখেছিলেন সত্যজিত্ রায়।  বিশেষ করে, ফেলুদা ও প্রফেসর শঙ্কুর তো কোনো জুড়ি নেই। তবে চিত্রনাট্য, প্রবন্ধও কিন্তু লিখতেন সত্যজিৎ।  আঁকতেন দারুণসব ছবি। তার প্রমাণ ফেলুদা, শঙ্কুর বইগুলোতেই আছে। বইয়ের প্রচ্ছদও এঁকেছেন। সম্পাদনা করেছেন সন্দেশ পত্রিকা । গান লিখতেন, দিতেন সুর। তবে এত সব পরিচয় ছাপিয়ে তিনি আসলে চলচ্চিত্রকার। তাঁর ছবি আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত করেছে বাংলা চলচ্চিত্রকে। সিনেমাতেও তিনি গল্পই বলেছেন। তাঁর সিনেমায় গল্প বলার নতুন উপায় পেল বাংলা চলচ্চিত্র। অদ্ভুত সুন্দর সব গল্প নিয়ে ছবি বানিয়েছেন সত্যজিৎ রায়। সেই গল্প কখনো অন্যের, আবার কখনো নিজেই হাতে তুলে নিয়েছেন কলম। এরই মধ্যে তাঁর কয়েকটি ছবির গল্পের সঙ্গে পরিচিত হব আমরা।

প্রথম গল্পটা পরেশ দত্তের। পরেশ দত্ত সামান্য কেরানি। জীবনে স্বাচ্ছন্দ্যের দেখা পাননি কখনো। এ নিয়ে গিন্নির খিটিমিটি লেগেই থাকে। আর হবেই না কেন, সামান্য মাইনেতে দুজনের খরচা তো চলে না। তাঁরা নিঃসন্তান। সন্তান থাকলে খরচ আরও বাড়ত। এরই মধ্যে আবার খবর এল, অফিসে নাকি অত মানুষের দরকার নেই। ছাঁটাই হবে!

এমন অনিশ্চয়তা নিয়েই পরেশ একদিন বিকেল পাঁচটায় কলকাতার অফিসপাড়া ডালহৌসি স্কয়ার থেকে বের হলেন। একটু পর মুষলধারে বৃষ্টি। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে আশ্রয় নিলেন এক পার্কের ছাউনিতে। ক্লান্ত শরীর ঠান্ডা পরিবেশ পেল, মুদে এল চোখ। কখন যে একটি মার্বেল পাথর এসে পায়ের কাছে পড়ল, পরেশ ঠিক ঠাওর করে উঠতে পারলেন না।

যা-ই হোক, বাড়িতে এসে মার্বেলটি পরেশ দিলেন প্রতিবেশীর ছোট ছেলে পল্টুকে। খানিক পরে পল্টু এসে বলল, ‘দাদু, এ তো ম্যাজিক পাথর!’ পরেশের সামনেই পল্টু তার লোহার খেলনার দিকে পাথরটি ছুড়ে মারল। আর সেটা সঙ্গে সঙ্গে সোনালি রং ধারণ করল। পরেশ বুঝলেন, এ একেবারে ২৪ ক্যারেট গোল্ড!

এতক্ষণ ধরে যে গল্পটা বলছিলাম, সেটি আসলে পরশ পাথর সিনেমার। পরশুরামের ছোটগল্প অবলম্বনে ছবিটি বানিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। কেরানি পরেশ দত্ত পরে হয়ে যান সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি। তুলসী চক্রবর্তীর অসাধারণ অভিনয়ে এ ছবিটি পায় ভিন্ন এক মাত্রা।

বাঙালি যেমন সাহিত্যের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ছাড়া অসম্পূর্ণ, তেমনি সিনেমার ক্ষেত্রে সত্যজিৎ ছাড়া। পরশ পাথর দিয়ে লোহাকে সোনা করার চমকপ্রদ কাহিনির ছবির বহু বছর পরে সত্যজিৎ বানিয়েছিলেন সোনার কেল্লা ছবিটি। তাঁর নিজের গল্প অবলম্বনে। সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় বাঙালি গোয়েন্দা চরিত্র ফেলুদার একটি গল্প এটি। ছয় বছরের ছেলে মুকুল হঠাৎ একদিন দাবি করে বসল, তার আগের জন্মের অনেক স্মৃতি মনে আছে! স্মৃতিতে সে দেখতে পায় সোনার কেল্লা। প্যারাসাইকোলজিস্ট ডক্টর হেমাঙ্গ হাজরা ছেলেটিকে জাতিস্মর ভেবে তাকে সঙ্গে করে নিয়ে যায় ভারতের রাজস্থানে। সেখানে অনেক কেল্লা আছে। আর সুযোগ বুঝে তাদের পিছু নেয় দুটো দুষ্ট লোক। তাদের ধারণা, মুকুলের সোনার কেল্লা থেকে গুপ্তধন পাওয়া যাবে। আর মুকুলের যাতে কোনো ক্ষতি না হয় এর জন্যই গোয়েন্দা ফেলুদা ও সহকারী তপসে সেখানে হাজির।

ফেলুদার আরেকটি গল্প নিয়ে সত্যজিৎ রায় ছবি করেছিলেন। নাম জয় বাবা ফেলুনাথ। বেনারসের বনেদি ঘোষালবাড়িতে আছে বহু মূল্যবান ছোট্ট এক গণেশমূর্তি। এর ওপর চোখ পড়েছে ফেলুদার চিরশত্রু মগনলাল মেঘরাজের। চুরি করেও নেয় সে। অন্যদিকে গঙ্গার ঘাটে আবির্ভাব হয় ভুয়া মছলিবাবার। মগনলালের কারবারে সেও জড়িত। এদের থেকে মূর্তিটি কীভাবে উদ্ধার করল ফেলুদা, সেটাই দেখা যাবে এই ছবিতে।

মছলিবাবার মতোই আরেক ভুয়া সাধুকে দেখা যায় মহাপুরুষ সিনেমায়। তার নাম বিরিঞ্চিবাবা। মূল গল্প পরশুরামের। স্ত্রীর মৃত্যুর পর কলকাতার নামকরা উকিল গুরুপদ মিত্র ভেঙে পড়েন। তীর্থযাত্রায় গিয়েও শান্তি মেলে না। কাশী থেকে ফেরার পথে ট্রেনে দেখা হলো বিরিঞ্চিবাবার সঙ্গে। বিরিঞ্চিবাবার দাবি, তিনি ত্রিকালজ্ঞ। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ—কিছুই তাঁর অজানা নয়। তাঁর কাছে নাকি আইনস্টাইন যেত! বাবাজিই নাকি আইনস্টাইনকে শিখিয়েছিলেন, ই ইক্যুয়েল টু এম সি স্কয়ার! বুদ্ধ, যিশুখ্রিষ্ট, প্লেটো—কার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়নি? এমন ভণ্ড বাবাজি কীভাবে ধরা খেলেন, সেটা জানতে হলে দেখতে হবে ছবিটি।

ফেলুদা ছাড়াও সত্যজিৎ রায় শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত আরেক বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র ব্যোমকেশ বক্সীকে নিয়ে ছবি বানিয়েছিলেন। ছবিটির নাম চিড়িয়াখানা। অভিনয় করেছিলেন মহানায়ক উত্তমকুমার। চিড়িয়াখানায়  গোলাপ কলোনির দুটি খুনের রহস্যের কিনারা করেন ব্যোমকেশ। কাহিনি হিসেবে আজও ব্যোমকেশ ও ফেলুদার মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের তুলনা চলে। উত্তম কুমার সত্যজিতের নায়ক ছবিতেও অভিনয় করেছিলেন।

সত্যজিতের আরও দুটি মজার ছবি গুপি গাইন বাঘা বাইন ও হীরক রাজার দেশে। প্রথম ছবির কাহিনি সত্যজিতের দাদা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর। দ্বিতীয়টির কাহিনি সত্যজিৎ নিজেই লিখেছেন। তো, গুপিনাথ গান গাইতে খুব ভালোবাসত। কিন্তু বেচারার গানের গলা ছিল না। পাড়ার লোকেদের কুপরামর্শে একদিন ভোরবেলা সে গান শোনাতে যায় রাজাকে। কর্কশ স্বরে রাজার ঘুম ভেঙে গেল। রাজা তাকে গাধার পিঠে চড়িয়ে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিলেন। গুপি গিয়ে হাজির হলো এক জঙ্গলে। সেখানে দেখা মিলল বাঘানাথের। বাজেভাবে ঢোল বাজানোর দায়ে তার গাঁয়ের রাজাও তাকে তাড়িয়েছেন। রাতে সে জঙ্গলে এল একদল ভূত। ভূতের রাজা গুপি-বাঘার ওপর খুশি হয়ে তাদের তিনটি বর দেয়। এই বরের জোরেই গুপি গাইন বাঘা বাইন ছবিতে তারা থামিয়ে দেয় শুণ্ডি ও হাল্লা রাজ্যের যুদ্ধ; হীরক রাজার দেশে ছবিতে অত্যাচারী হীরক রাজাকে গদি থেকে নামায়।

সত্যজিতের বাবা সুকুমার রায়ের কথা তো জানোই। হাস্যরসে তাঁর জুড়ি ভূ-ভারতে মেলা ভার। তাঁকে নিয়ে সত্যজিৎ একটি তথ্যচিত্র বানিয়েছিলেন। না, নিরস তথ্যে ঠাসা কোনো ছবি নয় সেটি, সুকুমারের হাস্যরসের পরিচয় পাওয়া যাবে এখানেও। ঝালাপালার একটি অংশে উৎপল দত্তের অভিনয় ও লক্ষ্মণের শক্তিশেল-এর একটি অংশে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় দারুণ অভিনয় করেছেন। একটি দৃশ্যে আছে হ-য-ব-র-ল-এর বিচিত্র জগৎ।

এ ছাড়া সত্যজিৎ পরিচালিত ছবি আছে অনেক। উল্লেখযোগ্য ছবিগুলোর মধ্যে আছে পথের পাঁচালী, অপরাজিত, অপুর সংসার, চারুলতা, শতরঞ্জ কি খিলাড়ি, কাঞ্চনজঙ্ঘা, দেবী, জলসাঘর। মোট ৩৭টি ছবি। তাঁর বেশির ভাগ ছবি ছোট থেকে বড় সবাই দেখতে পারে। মজার বিষয়, ছবিগুলো এমনই যে এক ছবি বিভিন্ন বয়সে দেখলে তার বিভিন্ন অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়। সত্যজিৎ রায়ের প্রায় সব ছবিই এখন পাওয়া যায় ইউটিউবে। আর বাজারে সিডি-ডিভিডি তো আছেই। তবে আর দেরি কেন? দেখে ফেলো সত্যজিতের ছবিগুলো। এমন সব ছবি কি না দেখে পারা যায়?