হায়ারোগ্লিফিকস: ফিরে পাওয়া লিপি!

১৭৯৯ সালের ১৫ জুলাই। প্রাচীন পৃথিবীর ভাষা অনুসন্ধিত্সুদের জন্য চমকপ্রদ ও আশীর্বাদময় একটি দিন। মিসরের বন্দরনগর রাশিদে উন্মোচিত হলো একটি শিলাখণ্ড। এটিই সেদিন সমাধান করেছিল পাঁচ হাজার বছরের পুরোনো এক লিপির রহস্যময়তাকে। এক সময় এই লিপির পঠনপদ্ধতি হারিয়ে গিয়েছিল কালের গর্ভে। একেই ধরা হয় পবিত্র লিপির নিদর্শন হিসেবে। এ কারণে এই লিপির নাম গ্রিকরা দিয়েছিল হায়ারোগ্লিফিক লিপি।

এ ঘটনার ঠিক এক বছর আগে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট তাঁর সমর বাহিনী নিয়ে হাজির হন নীল নদের কৃষ্ণভূমিতে। দখল করে নেন মিশরের রাশিদ শহরের জুলিয়ান দুর্গ। সে দুর্গেরই একটা অংশ ঠিক করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে একটি শিলাখণ্ড। শহরের নামের সঙ্গে মিল রেখে এটিই পরবর্তীতে রোসেটা স্টোন হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে সবার কাছে। শিগগিরই এ পাথরখণ্ডের স্থান হয় ব্রিটিশ মিউজিয়ামে। অবশ্য ফরাসিরা ব্রিটিশদের হাতে পরাজিত হওয়ার পর। তারও প্রায় ২০ বছর পর মিসরের হায়ারোগ্লিফিক লিপির প্রায় সম্পূর্ণ পাঠোদ্ধার সম্ভব হয়েছে এ পাথরের কল্যাণে। কিন্তু কী ছিল সে পাথরে?

তার আগে জেনে আসি হায়ারোগ্লিফিক লিপি সম্পর্কে। কীভাবে সেসময়ের মানুষ এত আকর্ষণীয় চিত্রময় লিপিতে বলে গেছেন তাঁদের কথা। কী ছিল সেসব কথায়? উপদেশ, দর্শন, জীবনবিধান, নাকি স্রেফ দিনলিপি!

গ্রিকদের দেওয়া হায়ারোগ্লিফ শব্দের অর্থ পবিত্র খোদাইকৃত লিপি। মিসরে এসে গ্রিকরা এই লিপির সঙ্গে পরিচিত হয়। তাদের ধারণা ছিল, এ লিপিতে ধর্মসংক্রান্ত বিষয়াবলি, পবিত্র বাণী সংকলিত হয়েছে। এ ধারণা থেকেই এ নামকরণ। যদিও পরে জানা যায় এটা সে রকম কিছু না। ফারাওদের রাজত্বকালের নানা ঘটনা, যুদ্ধবিগ্রহের কাহিনি লিখে রাখতেই বেশি ব্যবহূত হয়েছে এ লিপি।

হায়ারোগ্লিফিক লিপি কবে থেকে শুরু সেটা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। ধারণা করা হয়, ফারাও মেনেসের রাজত্বকালে এ লিপির সূচনা হয়। ভাষাবিদেরা বলেন, হায়ারোগ্লিফের শুরু সুমেরীয়দের আবিষ্কৃত লিখন পদ্ধতির পরপরই, বছরের হিসাবে বসালে ৩২০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। আনুমানিক ৪০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মানুষের কাছে এই লিপি বোধগম্য ছিল, তার পরপরই দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে এ চিত্রময় বর্ণগুলো। গুটি কয়েক মানুষ এদের অর্থ জানত। তারাও পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে পারেনি এই লিপির অন্তর্নিহিত অর্থ কিংবা পঠনপদ্ধতি। দৈনন্দিন আর দাপ্তরিক কাজে ব্যবহারের জন্য তত দিনে মানুষ আরও সহজে লেখা যায়, পড়া যায় এমন বর্ণমালায় অভ্যস্ত হয়ে যায়।  তাই হায়ারোগ্লিফিক লিখনপদ্ধতির আর প্রয়োজনও রইল না।

কিন্তু সন্ধিত্সু মানুষেরা আবার এ ঐতিহ্যবাহী লিখনপদ্ধতি বোঝার চেষ্টা করবে, সেটাই কাম্য। তত দিনে মিসরের পটভূমি বদলে গেছে অনেকবার। মহাপ্রতাপশালী ফারাওদের নির্মিত গগনচুম্বী স্থাপনাগুলো চাকচিক্য হারিয়েছে। আধুনিক মানুষ পুরোপুরি ভুলে গেছে সহস্র বছর আগের চিহ্নগুলো।

হায়ারোগ্লিফিক লিপির পুনঃপাঠোদ্ধারের প্রথম উল্লেখযোগ্য কাজ ছিল ঐতিহাসিক হোরাপোলোর হায়ারোগ্লিফিক বইটি। এতে প্রায় দুই শ হায়ারোগ্লিফিক প্রতীকের বর্ণনা দেন তিনি। কিন্তু এটা ছিল অনুমাননির্ভর আাার ভুলে ভরা। হায়ারোগ্লিফের পাঠোদ্ধারের আরেকটা উল্লেখযোগ্য বাধা ছিল স্বয়ং এ শব্দই। কারণ, এর অর্থ ‘পবিত্র খোদাইকৃত লিপি’ হওয়ায় এটা ভাষাবিদদের পবিত্রতা খুঁজতে উত্সাহিত করে। কিন্ত্তু সেটি হয়তো অনেক লিপিতেই অনুপস্থিত ছিল। তারপর আরও অনেকে এ সহস্র বছরের পুরোনো প্রতীকগুলো ব্যাখ্যা করেছেন। তাতে সুতার জট ধীরে ধীরে খুলতে থাকে। কিন্তু একসময় আটকে যায় প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাবে।

ঠিক এমন সময়ই মানুষের হাতে আসে রোসেটা স্টোন। এটা ছিল খ্রিস্টের জন্মের ১৯৬ বছর আগের একটি নির্দেশনামা। একটা কোনা ভাঙা এ শিলাখণ্ড বিশ্লেষণ করে দেখা গেল, এর নির্দেশনামায় একই কথা তিনটি ভাষায় লেখা আছে। সেগুলো হচ্ছে, হায়ারোগ্লিফিক, গ্রিক আর হায়েরাটিক লিপিতে। বাকি দুটো লিপি জানা থাকায় এ শিলাখণ্ড হায়ারোগ্লিফ পঠনের অভাবনীয় এক দ্বার খুলে দেয়। ভাষাবিদেরা  বুঝতে পারেন, এত দিন তাঁরা ভুল পথে হেঁটে এসেছেন।

হায়ারোগ্লিফিক্সে বিভিন্ন সংখ্যা লেখার পদ্ধতি
হায়ারোগ্লিফিক্সে বিভিন্ন সংখ্যা লেখার পদ্ধতি

হায়ারোগ্লিফের লিখনপদ্ধতি

হায়ারোগ্লিফে লেখার পদ্ধতি ছিল যথেষ্ট জটিল। এ লিখনপদ্ধতিতে ভিন্ন ধরনের প্রায় ২০০০ প্রতীক ছিল। কোনো স্বরবর্ণ ছিল না, ছিল না কোনো বিরতিচিহ্নের বালাই। স্বাভাবিকভাবেই এটা সেই সময়কার সাধারণ মানুষের জন্যও হয়ে ওঠেনি ব্যবহারবান্ধব। লেখা হতো ওপর থেকে নিচে, বাঁ থেকে ডানে বা ডান থেকে বাঁয়ে। আবার কোনো কোনো সময় ডান থেকে শুরু হয়ে পরের লাইনে আবার বাঁ থেকে। কোথা থেকে শুরু হচ্ছে তা বোঝার জন্য অবশ্য একটা নির্দেশনা থাকত। অঙ্কিত মানুষ বা পশুপাখির মুখ যেদিকে ফেরানো থাকত, সেদিকটা হতো সে লাইনের শুরু।

একই প্রতীক দিয়ে হায়ারোগ্লিফে তিন ধরনের ভাব প্রকাশ করতে সক্ষম ছিল। প্রতীকে যে প্রাণী বা বস্তুর ছবি থাকত, অনেক সময় হয়তো সরাসরি সেটাই বোঝাত। কখনো বোঝাত সেই প্রতীকের উচ্চারণ। আবার অন্য একটি প্রতীক কী অর্থে ব্যবহূত হচ্ছে, সেই ব্যাখ্যার জন্যও এটি ব্যবহূত হত। যেমন ধরা যাক, একটা প্রতীক আছে যেটা দেখতে ‘বাড়ি’-এর মতো। সেটা সরাসরি ঘরবাড়ি অর্থে ব্যবহূত হতে পারে, হতে পারে। আরেকটা প্রতীক ‘ধারা’-এর সঙ্গে যোগ হয়ে বাড়ি-ধারা বা ‘বারিধারা’ উচ্চারণ বোঝাচ্ছে। আবার এই বারিধারা বৃষ্টির পানি না বুঝিয়ে যদি স্থান বারিধারাকে বোঝায়, তাহলে স্থান বোঝাতে সক্ষম এমন এক প্রতীক তার সঙ্গে যুক্ত হবে।

তার মানে দাঁড়াচ্ছে, হায়ারোগ্লিফ পড়তে হলে ভাষাগত বিশ্লেষণ-সক্ষমতা থাকাটা জরুরি। তাই এটা সাধারণ মানুষের ভাষায় পরিণত হতে পারেনি।

হায়ারোগ্লিফিক লিপিকাররা সংখ্যা লেখার জন্য যে নিয়মটা ব্যবহার করত তা আমাদের দশভিত্তিক নিয়মের সঙ্গে কিছুটা মিল আছে। তবে পার্থক্য হলো তাদের সংখ্যার প্রতীকগুলোর স্থানীয় মান নেই, আছে নির্দিষ্ট মান। যেমন ধরা যাক, যে প্রতীক দিয়ে ১০ বোঝাচ্ছে, ২০ লেখার জন্য সেই প্রতীকটাই দুবার লিখতে হবে। আবার যেটা দিয়ে ১ বোঝাচ্ছে, ৫ লেখার জন্য সে প্রতীকটাই পাঁচবার লিখতে হবে। তার মানে ২৫ লিখতে হলে হায়ারোগ্লিফে আমাদের লিখতে হবে (১০) (১০) (১) (১) (১) (১) (১) এভাবে। যেখানে ১০-এর জন্য বা ১-এর জন্য আমাদের ব্যবহার করতে হবে নির্দিষ্ট প্রতীক। এভাবে শত বা হাজার বোঝাতে রয়েছে আলাদা প্রতীক।

জটিলতা ও সাধারণ মানুষের নিত্যদিনের জন্য ব্যবহার উপযোগী না হওয়ায় অপরূপ কারুকার্যময় এ লিখনপদ্ধতি আস্তে আস্তে বিবর্তিত হতে থাকে। তাতে প্রতীকগুলো সরল আর সহজে লেখার মতো করে পরিণত হতে থাকে হাতে হাতে। তখন সেটি নতুন এক লিখনপদ্ধতিতে পরিণত হয়। যাকে বলা হতো যাজকীয় লিপি বা হায়েরাটিক লিপি। একসময় এই লিপিও পরিবর্তিত হয়ে আরেকটি লিপি ডেমোটিক লিপিতে পরিণত হয়। সেটি চিত্রময়তা বৈশিষ্ট্য থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে হাতে লেখা লিপির আদলে চলে আসে। তাই এটি লেখাও যায় আগের চেয়ে সহজে ও দ্রুত। এখনকার গ্রিক বর্ণমালা লেখা হয় কপটিক লিপিতে। এটাও হায়ারোগ্লিফিক লিপিরই আরেকটি রূপ বলেও মনে করেন অনেক ভাষাবিদ।

সূত্র: বিবিসি হিস্ট্রি ম্যাগাজিন