পাখপাখালির গ্রামে

গাছের ডালের ফাঁকে ফাঁকে পাখির বাসা। সেখান থেকে আসছে পাখিছানার কিচিরমিচির আওয়াজ। পাশেই ডালে বসে বাবা পাখি ছানাগুলোকে পাহারা দিচ্ছে। মা পাখি দূরের কোথাও থেকে খাবার নিয়ে বাসায় ফিরতেই নড়েচড়ে উঠছে ছানারা। মা পাখি ছানাগুলোর হাঁ করা মুখের ভেতর ঠেলে দিচ্ছে খাবার। আনন্দে ছানাগুলো আরও জোরে কিচিরমিচির করে উঠছে। এরপর বাবা পাখিটি ছানাগুলোকে সঙ্গে নিয়ে এ ডাল থেকে ও ডাল, পাতা থেকে পাতায় ঘুরে উড়তে শেখাচ্ছে। চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার বেলগাছি গ্রামবাসীর কাছে এটি এখন খুবই পরিচিত দৃশ্য।

বেলগাছি গ্রামটিতে দেশীয় প্রজাতির রংবেরঙের নাম জানা অনেক পাখিরই দেখা মেলে। পাখির কলরবে এখানে ভোর হয়, সন্ধ্যাবেলার কলতান তৈরি করে সুরের মূর্ছনা। পাখির পাশাপাশি এখানে সহাবস্থান করে কাঠবিড়ালি, গুইসাপ, নেউল (বেজি), গিরগিটি, খরগোশ, শিয়াল ও কুকুর।

বেলগাছির পথে

চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের একটি গ্রাম বেলগাছি। শহরের প্রাণকেন্দ্র শহীদ হাসান চত্বর থেকে রিকশায় ২০ টাকা ভাড়ায় যাওয়া যায় গ্রামটিতে। নামে বেলগাছি হলেও সেখানে তেমন বেলগাছ নেই। তবে মাথার সিঁথির মতো মেঠোপথ আর রাস্তার দুই ধারে, পুকুরপাড়ে, ফসলের খেতে ও বাড়ির আঙিনায় রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। এ ছাড়া ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে তোলা বাগানও রয়েছে অনেকগুলো। প্রায় প্রতিটি গাছের মগডালে ঝুলছে হাজারো মাটির কলসি। এসব কলসিতেই খড়কুটো সাজিয়ে ঘরসংসার পেতেছে নানা প্রজাতির পাখি।

দেখো, ছবি তোলার জন্য কী সুন্দর বাসা থেকে বেরিয়ে এসে ক্যামেরার সামনে পোজ দিচ্ছে প্যাঁচাটি
দেখো, ছবি তোলার জন্য কী সুন্দর বাসা থেকে বেরিয়ে এসে ক্যামেরার সামনে পোজ দিচ্ছে প্যাঁচাটি

পাখপাখালির গ্রামে একদিন

গত ১৫ মার্চ মঙ্গলবার সকালে সরেজমিনে গ্রামটিতে পা রাখতেই পাখিদের কলরব শোনা যায়। স্থানীয় বাসিন্দাদের একজন রসিকতা করে বলেন, ‘আমাদের গ্রামের পাখিরা খুব অতিথিভক্ত। তারা গান গেয়ে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছে।’

গাছে বাঁধা কলসিগুলোতে চোখ রাখতেই দেখা মেলে নানা রঙের ও বর্ণের পাখি। এদের কোনোটা কলসির সরু গলা দিয়ে মুখ উঁচিয়ে ডানে-বাঁয়ে দেখছে। আবার কোনোটা উড়ে যাচ্ছে দূরে কোথাও, কোনোটা বাইরে থেকে বাসায় ফিরছে। চোখে পড়ে দোয়েল, কোয়েল, শ্যামা, টিয়া, কাঠঠোকরা, ঘুঘু, কাক, চিল, ফিঙে, মাছরাঙা, প্যাঁচাসহ নানা প্রজাতির পাখি। কয়েকটি কলসি দখল করে আছে গুইসাপ।  কবরস্থান এলাকায় দেখা গেল একটি কলসি নিয়ে শালিক ও বোলতার দখলযুদ্ধ। গাছের শরীর বেয়ে গিরগিটি ও কাঠবিড়ালির চঞ্চলতা মনে রাখার মতো। ঝোপঝাড়গুলোতে নেউলে ও খরগোশের দৌড়ঝাঁপ বেশ। বেলগাছি গ্রামের এসব পাখি ও বন্য প্রাণীরা মানুষকে ভয় পায় না। মানুষের প্রতি এদের এই আস্থা কেন? উত্তর মিলল খুব সহজেই। গ্রামটি ঘুরে দেখার সময় বেশ কয়েকটি জায়গায় চোখে পড়েছে সাইনবোর্ড, ‘এসো পাখির বন্ধু হই’, ‘পাখি ও বন্য প্রাণী শিকার নিষিদ্ধ—প্রচারে: বেলগাছি যুব সমাজ’।

যেভাবে শুরু

বেলগাছি গ্রামটি এমন ছিল না। শিকারির উত্পাত আর কীটনাশকের নেতিবাচক প্রভাবে পাখিরা গ্রাম ছেড়েছিল। খরগোশ-কাঠবিড়ালিরও দেখা মিলত না। পাখির কলরবে ঘুম ভাঙত না গ্রামবাসীর। এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে যুবক বখতিয়ার হামিদ বিপুল (বর্তমানে সদর উপজেলার গাইদঘাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক) সমমনা বন্ধুদের নিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন। বিপুলের ভাষায়, ‘২০০৭ সালে আমি তখন ডিগ্রির ছাত্র। বহিরাগত কয়েকজন ব্যক্তি মাঝেমধ্যেই গ্রামে এসে পাখি শিকার করতেন। নিরীহ পাখির রক্তাক্ত চেহারা দেখে খুুব খারাপ লাগে। প্রতিবাদ করলে শিকারিরা আমাকে লাঞ্ছিত করেন। এরপর বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলি।’ বিপুল বলেন, ‘শিকারিদের গ্রামে আসা বন্ধ হলেও দীর্ঘদিন পাখিদের দেখা মেলেনি। এরপর সমমনাদের নিয়ে প্রত্যেকের বাসায় মাটির কলসি দিয়ে বাসা তৈরি করে পাখিদের বসবাসের ব্যবস্থা করা হয়। পাখিরা আসতে শুরু করলে নিজেরাই তাদের খাবার দিতে থাকি। দিন দিন পাখির সংখ্যা বাড়তে থাকে।’

পৃথিবীর সব স্থানে নিষিদ্ধ হোক পাখি শিকার
পৃথিবীর সব স্থানে নিষিদ্ধ হোক পাখি শিকার

বিপুল জানান, ২০১১ সালে ৩৫ জন তরুণ মিলে গড়ে তোলেন বেলগাছি যুব সমাজ নামের সংগঠন। সে সময় টিউশনি করে পাওয়া টাকা খরচ করে গ্রামের রাস্তার দুই ধার ও কবরস্থানের গাছগুলোতে অন্তত এক হাজার কলসি বেঁধে দেয়। এরপর প্রতিবছর কলসির সংখ্যা বাড়ছেই। দিনে দিনে প্রতিটি কলসিই পাখিতে ভরে গেল। এরপর পাখির খাবার জোগাতে ধানসহ বিভিন্ন ফসলের খেতে বাঁশের মাচা ও পুরোনো ডাল পুঁতে পাখি বসার ব্যবস্থা করলেন। পাখিরা ডালে বসে ক্ষতিকর পোকা খেয়ে ফেলায় জমিতে কীটনাশকের ব্যবহারও কমতে থাকে। ২০১২ সালে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিরা আসতে শুরু করে গ্রামটিতে। শীতকালে দল বেঁধে আসে পরিযায়ী পাখিরা। আবার শীত শেষে নির্বিঘ্নে ফিরে যায় আপন ঠিকানায়।

পাখি ও প্রাণিকুলের দেখাশোনার পাশাপাশি বেলগাছি যুব সমাজ গ্রামের সব বয়সী মানুষকে অক্ষরজ্ঞান ও প্রকৃতি শিক্ষা দিতে গ্রামে গড়ে তুলেছেন নৈশ বিদ্যালয়। এ ছাড়া বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে পাখি ও প্রকৃতি রক্ষার বিষয়ে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিপুলদের এই উদ্যোগের খবরে প্রতিদিনই দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসে বেলগাছি গ্রামে। অনেকে ফিরে গিয়ে নিজেদের গ্রামে ছোট পরিসরে পাখির অভয়াশ্রম গড়ে তুলেছে।

বেলগাছির গাছে গাছে ঝুলছে পাখিদের বসবাসের জন্য এমন হাঁড়ির বাসা
বেলগাছির গাছে গাছে ঝুলছে পাখিদের বসবাসের জন্য এমন হাঁড়ির বাসা

উদ্যোগের সারথি

পাখি ও বন্য প্রাণীর অভয়াশ্রম তৈরিতে বেলগাছি যুব সমাজের ৩৫ সদস্যেরই ভূমিকা রয়েছে। তবে পেশাগত কারণে তাঁদের কেউ কেউ জেলার বাইরে অবস্থান করছেন। এখন যাঁরা নিরলস পরিশ্রম করে চলেছেন, তাঁরা হলেন বখতিয়ার হামিদ বিপুল, বখতিয়ার হোসেন, শাহীন কবীর, ডালিম মিয়া, এনায়েতুল্লাহ প্রিন্স, মাহমুদ হাসান, সবুজ হোসেন, ইখতিয়ার হোসেন ও নাজমুল হোসেন।

এঁদের সবাই কিশোর আলোর পাঠকদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তাঁদের গ্রামে। যাতে নিজে চোখে পাখপাখালির সুমধুর কলরব

শুনে তুমি তোমার নিজের এলাকাতেও নিতে পারো এমন উদ্যোগ।