শতাব্দী পরিবহন

প্রয়োজনে প্রশ্ন করতে ভয় পায় না শতাব্দী। এমন শতাব্দীতেই ভরে উঠুক দেশ। ছবি: আশরাফুল আলম
প্রয়োজনে প্রশ্ন করতে ভয় পায় না শতাব্দী। এমন শতাব্দীতেই ভরে উঠুক দেশ। ছবি: আশরাফুল আলম

‘মিনিস্টার, আই হ্যাভ এ কোয়েশ্চেন’।

কাঁধে ব্যাগ ঝোলানো কোনো স্কুলছাত্রী সরাসরি মন্ত্রীকে প্রশ্ন করছেন এমন দৃশ্য সিনেমায় দেখা যেতে পারে। তাই বলে বাস্তবে?

কিন্তু বাস্তব যে মাঝেমধ্যে সিনেমাকেও হার মানায়, সেটা প্রমাণ করে দেখাল শতাব্দী। কেবল মন্ত্রীকে সে প্রশ্নই করেনি। এক দিনের মধ্যেই তার সমস্যারও সমাধান হয়ে গেছে।

ঢাকার শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী শামসুন্নাহার শতাব্দী এখন সারা দেশের আলোচিত এক নাম। তার এক প্রশ্নে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে  গেছে। শতাব্দী ও তার বন্ধু এবং অন্য নারীরা নিশ্চিন্ত মনে এখন আলাদা বাসে যাতায়াত করছেন।

ঘটনা ১২ মার্চ শনিবার দুপুরের। মহানগরের গণপরিবহনের সার্বিক পরিস্থিতি দেখতে ঝটিকা সফরে কুড়িল বিশ্বরোডের পাশে শেওড়া বাসস্ট্যান্ডে যান যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। আর দশ দিনের মতোই বাড়ি ফিরছিল শতাব্দী। মন্ত্রীকে দেখে এগিয়ে গিয়ে সরাসরি শুরু করল কথা। একটি কিশোরী এভাবে মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলছে দেখে অনেকেই অবাক হন। তাকে থামিয়ে দেওয়ারও চেষ্টা করেন। কিন্তু মন্ত্রী কিছুটা সামনে এগিয়ে আসেন। এর পরেই শুরু হয় মন্ত্রীর সঙ্গে কথোপকথন।

শতাব্দী: আই হ্যাভ এ কোয়েশ্চেন।

মন্ত্রী: আর ইউ জার্নালিস্ট?

শতাব্দী: নো, আই অ্যাম এ স্টুডেন্ট।

মন্ত্রী: হোয়াট ইজ ইয়োর কোয়েশ্চেন?

শতাব্দী: মাই কোয়েশ্চেন ইজ আমি প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার সময় দীর্ঘক্ষণ বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকি। আমি যখন স্কুলে আসি, তখন গুলিস্তান-আবদুল্লাহপুরের ১২৩ নম্বর বাসগুলো মহিলা সিট নেই বলে উঠতে দেয় না। কন্ডাক্টররা বলেন, আপনাদের উঠতে দেওয়া যাবে না। তখন স্কুলে আসতে দেরি হয়ে যায়। আবার একইভাবে বাসায় ফিরতেও দেরি হয়। কখনো কখনো ক্লাসও মিস হয়। তাহলে মহিলাদের জন্য আলাদা বাসের কি প্রয়োজন নেই?

মন্ত্রী: মহিলাদের জন্য বিআরটিসির আলাদা বাস আছে। তুমি কোথা থেকে কোথায় স্কুলে যাও?

শতাব্দী: শেওড়া বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসে উঠে এমইএস পর্যন্ত।

শতাব্দীর অভিযোগের জবাব দিচ্ছেন যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। ছবি: সংগৃহীত
শতাব্দীর অভিযোগের জবাব দিচ্ছেন যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। ছবি: সংগৃহীত

এরপরের ঘটনা সিনেমার মতোই। ওবায়দুল কাদের শতাব্দীর কাছ থেকে তার স্কুলের সময় জেনে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন। পরদিন ঠিক সকাল ছয়টার দিকে শেওড়া বাসস্ট্যান্ডে বিআরটিসির মহিলা বাস এসে হাজির। আর শতাব্দীসহ অন্যরা সেই বাসে উঠে স্কুলে গেল। এ ঘটনার পরপরই নিজ স্কুলসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনায় উঠে এল শতাব্দী।

কিশোর আলোকে শতাব্দী বলল, ‘শুধু একটা প্রশ্ন করেছিলাম  যোগাযোগমন্ত্রীকে। তা সত্যি হবে চিন্তা করিনি। কিন্তু মন্ত্রীর পিএস শনিবার রাতে ফোন করে বাসের কথা জানিয়ে সকাল সাড়ে ছয়টায়  শেওড়া বাসস্ট্যান্ডে যেতে বলেন। পরদিন রোববার বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে  দেখি, বাসটা আমার জন্যই দাঁড়িয়ে আছে। বাসে করে ক্যান্টনমেন্টের কাছে এমইএস বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত যাই। স্কুলে যাওয়ার পর শিক্ষকেরাও আমার এ কাজের জন্য অনেক ধন্যবাদ জানিয়েছেন। বাসের মধ্যে এক আন্টিও বলেছেন, আমার জন্যই আজ আরামে বাসে যাতায়াত করতে পারলেন।’

শতাব্দীরা দুই বোন। ছোট বোন ক্লাস সিক্সে পড়ে। শতাব্দী  লেখাপড়ায়ও বেশ ভালো। পঞ্চম ও অষ্টম দুই শ্রেণিতেই জিপিএ-৫  পেয়েছে। এ ছাড়া সে ক্রিকেটও খেলে। ব্যাট করে। এখন পর্যন্ত তার সর্বোচ্চ স্কোর ৩২।

পরদিন শতাব্দীকে স্কুলে নিতে চলে এল আস্ত এক বিআরটিসি বাস। ছবি: মাহমুদ হোসেন
পরদিন শতাব্দীকে স্কুলে নিতে চলে এল আস্ত এক বিআরটিসি বাস। ছবি: মাহমুদ হোসেন

শতাব্দীর কাছে জানতে চেয়েছিলাম সেদিন যে প্রশ্ন করলে ভয় লাগেনি? শতাব্দীর জবাব, ‘অনেক পুলিশ ও লোকজন ছিল। একটু ভাবছিলাম।’ এক ফটোগ্রাফার ভাইয়াকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আমি কি প্রশ্ন করতে পারব।’ তিনি বললেন, ‘যাও করো।’ এরপর আর ভয় লাগেনি। তবে এটা ঠিক আমি ভাবিনি এক দিনেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’ তুমি তো তাহলে বেশ সাহসী। শতাব্দীর জবাব, ‘না, বেশি না, একটু সাহসী।’ বড় হয়ে কী হবে। শতাব্দীর জবাব, ‘ডাক্তার’।

কেন, মন্ত্রী হতে চাও না?

শতাব্দী: মন্ত্রীরা খালি ঢাকায় থাকে। গ্রামে যায় না। আমি ডাক্তার হয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরতে চাই।

শতাব্দীর বাবা শফিকুজ্জামান একজন ব্যবসায়ী। মা আকলিমা তরফদার একটা কোচিংয়ে বাচ্চাদের পড়ান। মেয়ে সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শতাব্দীকে নিয়ে আমি গর্বিত।’

মন্ত্রীকে প্রশ্ন করা ও বাস আসার ঘটনার পর থেকে শতাব্দীর নাম এখন সবার মুখে মুখে। কিছুদিন আগে স্কুলেরই এক বান্ধবীর বিয়ে হয়ে যাচ্ছিল। সেটি ঠেকাতে শতাব্দী ক্যান্টনমেন্ট থানায় গিয়েছিল। শতাব্দীর স্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. মনির উদ্দিন আহাম্মদ কিশোর আলোকে বলেন, শতাব্দী বিতর্ক করে, নাচে, গান গায়। আর সব সময় স্পষ্টবাদী। ক্লাসে সব সময় ও প্রশ্ন করে। কাজেই ও যে মন্ত্রীকে প্রশ্ন করেছে সেটা হঠাৎ​ করে এক দিনেই হয়নি। শতাব্দীকে অনেক অনেক অভিনন্দন। প্রতিটি ক্ষেত্রে মেয়েদের সাহস নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। আর শতাব্দীর মতো ছেলেমেয়েতে ভরে যাক এ দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।