অ্যানিমের কথকতা

অ্যানিমে কী?

এর উত্তর দুই রকম হতে পারে। নির্ভর করবে তুমি কোথায় আছো, তার ওপর। যদি জাপান ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোনো জায়গায় থাকো, তাহলে তোমার  জন্য অ্যানিমে মানে হচ্ছে জাপানিজ কার্টুন। অন্যভাবে বলা যায়, জাপানের টিভি, মুভি বা অন্য কোনো মিডিয়ায় প্রকাশিত যেকোনো ধরনের অ্যানিমেশন। আর জাপানে থাকলে অ্যানিমে মানে হচ্ছে যেকোনো ধরনের কার্টুন। যেহেতু এই লেখা বাংলাদেশি পাঠকদের জন্য, কাজেই আমরা অ্যানিমে বলতে জাপানিজ কার্টুনকেই বুঝব। কথা হচ্ছে কেন আমরা অ্যানিমে নিয়ে কথা বলছি? কারণ, সারা বিশ্বে এন্টারটেইনমেন্ট হিসেবে সব বয়সের মানুষের কাছে অ্যানিমে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। জনপ্রিয়তার সেই ঢেউয়ের ধাক্কা যে বাংলাদেশেও লেগেছে, সেটা ইন্টারনেট ঘাঁটলে বা কমিকনগুলোতে গেলেই বোঝা যায়। একদিকে কেউ অ্যানিমে ছাড়া কিছু বোঝে না, অন্যদিকে কেউ অ্যানিমে শব্দটাই সহ্য করতে পারে না। আবার কেউ কেউ হয়তো এই শব্দ বন্ধুবান্ধবের আড্ডায় শুনেছে, কিন্তু আরও জানতে যায় এ ব্যাপারে। তাদের সবার কথা চিন্তা করেই এবারের সংখ্যাটা বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে অ্যানিমে নিয়ে।

অ্যানিমের ইতিহাস

ব্যাপারটা শুনতে অবাক লাগে, কিন্তু পশ্চিমে ও জাপানে ট্র্যাডিশনাল অ্যানিমেশনের শুরু প্রায় কাছাকাছি সময়ে হয়েছিল। প্রথম অ্যানিমে ফিল্মের নাম ছিল ‘কাতশুদৌ শাশিন’। এই অ্যানিমে ফিল্ম বানানো হয় ১৯০৭ সালে। মাত্র তিন সেকেন্ডের এই ফিল্ম যে কার বানানো, তা অবশ্য অজানা। প্রথম বাণিজ্যিকভাবে এনিমে তৈরি হয় ১৯১৭ সালে, নাম ছিল ‘ইমোকাওয়া মুকুজো জেনকানবান নো মাকি’। বানিয়েছিলেন রাজনৈতিক ক্যারিকেচারিস্ট, কার্টুনিস্ট ওতেন শিমাকাওয়া। তিনি সব মিলিয়ে পাঁচটি অ্যানিমেটেড ফিল্ম বানিয়েছিলেন। এ ছাড়া একই সময়ে কার্টুনিস্ট জুনিচি কৌইচি এবং পেইন্টার সেন্তারো কিয়াতামা বেশ কিছু অ্যানিমেটেড ফিল্ম তৈরি করেন। এভাবে আস্তে আস্তে যখন জাপানি অ্যানিমেশন সামনে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন ১৯২৩ সালে আমেরিকায় যাত্রা শুরু করল দ্য ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানি। ডিজনির উন্নত মানের রঙিন অ্যানিমেশন, সাউন্ড ও পরিচালনার সামনে জাপানি অ্যানিমেশন হিমশিম খেতে শুরু করল। ফলে জাপানি অ্যানিমেশন ফিল্মের সংখ্যা অনেক কমে যায় এবং তার বদলে বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন, রাজনৈতিক ও শিক্ষা–সচেতনতামূলক প্রচারণা ভিডিওতে মনোযোগ দেন অ্যানিমেশন নির্মাতারা। এভাবেই চলছিল ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত। কিন্তু ওই বছরে জাপানে চলচ্চিত্র আইন প্রণয়নের পরে অ্যানিমেশন নির্মাতারা আবার উৎসাহী হয়ে ওঠেন। ছোট ছোট স্টুডিওগুলো একত্র হয়ে বড় স্টুডিও তৈরি করে, একই সঙ্গে মুভি স্টুডিওগুলোও অ্যানিমে তৈরিতে উৎসাহী হয়ে ওঠে। এর ফলে ১৯৪৩ সালে তৈরি হয় ‘কুমো তো চুরিপ্পু’ (‘দ্য স্পাইডার অ্যান্ড দ্য টিউলিপ’), যা অ্যানিমে ইতিহাসে এক মাস্টারপিস বলে স্বীকৃত। একই বছর তৈরি হয় ৩৭ মিনিটের ফিচার ফিল্ম ‘মোমোতারোস সি ইগল’। এর দুই বছর পরে আসে এর সিক্যুয়াল ‘মোমোতারোস ডিভাইন সি ওয়ারিয়রস’। ৭৩ মিনিটের এই মুভি ছিল জাপানের প্রথম ফিচার লেংথ অ্যানিমেশন। তবে এই মুভিগুলো তৈরি হয়েছিল জাপানের মিলিটারির অর্থায়নে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাগরিকদের জাপানি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করার জন্য। যুদ্ধে জাপানের পরাজয় হলেও অ্যানিমেশন ইন্ডাস্ট্রি থেমে থাকেনি, বরং জাপানের জীবন ও ঐতিহ্যকে বিশ্বে তুলে ধরার লক্ষ্যে অ্যানিমের নবজাগরণ তৈরি হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৮ সালে যাত্রা শুরু করে জাপানের ডিজনি-তোয়েই অ্যানিমেশন। প্রথমে এর নাম ছিল ‘তোয়েই স্টুডিও’। ১৯৫৬ সালে তারা ‘জাপান অ্যানিমেটেড ফিল্ম স্টুডিও’কে কিনে নেওয়ার পর তাদের নাম পরিবর্তন করে। ১৯৫৮ সালে তারা তৈরি করে জাপানের প্রথম রঙিন ও আধুনিক অ্যানিমে ‘দ্য টেল অব দ্য হোয়াইট সারপেন্ট’। আট মাস ধরে সাড়ে ১৩ হাজার কর্মীর অক্লান্ত পরিশ্রমে তৈরি হয় এই অ্যানিমে। পরের বছর একই স্টুডিও থেকে আসে ‘ম্যাজিক বয়’। এই দুটি অ্যানিমেই তৈরি করা হয়েছিল ডিজনির স্টাইল অনুসরণ করে এবং ১৯৬১ সালে দুটি অ্যানিমেই আমেরিকায় মুক্তি পায়।

ওসামু তেজুকা
ওসামু তেজুকা

১৯৬০ সালে মুক্তি পায় ‘অ্যালাকাজাম দ্য গ্রেট’। এটি বানানো হয়েছিল জাপানি কমিকস বা মাঙ্গার ধর্মপিতা বলে পরিচিত ওসামু তেজুকার মাই সন গোকুর ওপর ভিত্তি করে। এই মুভির কারণেই তেজুকা অ্যানিমেশনের ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। ১৯৬১ সালে তিনি নিজেই একটা স্টুডিও খুলে বসলেন। নাম—মুশি প্রডাকশন। তারপর ১৯৬৩ সালে প্রথমবারের মতন জাপানের টিভিপর্দায় যাত্রা শুরু করালেন এক অ্যানিমের, নাম ‘অ্যাসট্রো বয়’। সুপারহিরো জনরার গল্প জাপানের নিজস্ব কায়দায় প্রথম পরিবেশন করার মাধ্যমে তেজুকা অ্যানিমের জগতে নিয়ে এলেন নতুন জাগরণ। ১৯৬৫ সালে তেজুকা তৈরি করলেন ‘জাঙ্গল এমপেরর’, যা কিনা সারা বিশ্বে পরিচিত ‘কিম্বা: দ্য হোয়াইট লায়ন’ নামে (একসময় বিটিভিতে নিয়মিত দেখানো হতো)। এদিকে তোয়েইও থেমে নেই। ‘মেরিন বয়’, ‘সাইবর্গ ০০৯’–সহ বেশ কিছু অসাধারণ অ্যানিমে এই দশকে টিভি পর্দায় আসে টোয়েইয়ের কল্যাণে। এর সঙ্গে ছিল ‘মাক গো গো গো’, কার রেসিংয়ের যে অ্যানিমে সারা বিশ্বে জনপ্রিয় ‘স্পিড রেসার’ নামে।

মাকাতো শিনকাই
মাকাতো শিনকাই

জাপানিজ অ্যানিমের প্রথম দিকে ফ্যান্টাসি আর সাই-ফাইয়ের জনপ্রিয়তা বেশি ছিল। এ ক্ষেত্রে যে অ্যানিমের নাম বিশেষভাবে বিবেচনা করতে হবে, তা হচ্ছে ১৯৭৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত স্পেস ব্যাটেলশিপ ইয়ামোতো। এই অ্যানিমে সাই-ফাই জগতে তৈরি করে নতুন এক ধারার—স্পেস অপেরা। স্টার ওয়ার্সের সমসাময়িক এই অ্যানিমে প্রচারিত হয়েছে বিশ্বের অনেক দেশে ভিন্ন ভিন্ন নামে। মূলত এসব অ্যানিমে জাপানের নতুন প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করেছে অ্যানিমেশনের পর্দায় তাদের নিজের গল্পকে তুলে আনতে। এই নতুন প্রজন্মের হাত ধরেই পরবর্তী সময়ে এসেছে ‘ড্রাগন বল’, ‘কাউবয় বিবপ’, ‘ইভাঙ্গেলিয়ন’–এর মতো সব মাস্টারপিসের।

দ্য টেল অব দ্য হোয়াইট সারপেন্ট
দ্য টেল অব দ্য হোয়াইট সারপেন্ট
কিম্বা দ্য হোয়াইট লায়ন
কিম্বা দ্য হোয়াইট লায়ন

অ্যানিমে কেন এত জনপ্রিয়

অ্যানিমে কি জনপ্রিয়? ২০১৬ সালে জাপানের অ্যানিমে ইন্ডাস্ট্রি ১৮ বিলিয়নের মতো ডলার আয় করে এই মাধ্যম থেকে। গুগলের দৈনিক হিট এবং অন্য অ্যানিমে সাইটের হিটগুলো থেকে ধারণা করা হয়, বর্তমান বিশ্বে ১০০ মিলিয়নের মতো মানুষ অ্যানিমে দেখে। হয়তো গেমারদের সংখ্যা হিসাব করলে এটা তেমন কিছু নয়, কিন্তু এন্টারটেইনমেন্টের অন্য মাধ্যমগুলো হিসাব করলে এটা খুব বড় একটা সংখ্যা। কিন্তু কেন অ্যানিমে এত জনপ্রিয়? এর পেছনে একটি নয়, বেশ কিছু কারণ আছে। প্রথমত বলা যায় ভেরিয়েশনের কথা। এই জায়গায় অ্যানিমে কার্টুনের থেকে অনেক এগিয়ে থাকবে। হেন কোনো বিষয় নেই, যা নিয়ে অ্যানিমে বানানো হয়নি। যেকোনো ধরনের স্পোর্টস, যেকোনো ধরনের ফ্যান্টাসি সেটিং, লাইফের যেকোনো সমস্যা, সবকিছু নিয়েই বলা চলে কোনো না কোনো অ্যানিমে আছে। ক্যাম্পিং করা, ভিডিও গেমস খেলা, সরকারি অফিসে কাজ করা, রেস্টুরেন্টে কাজ করা, এমনকি ডিকশনারি বানানোর মতো বিষয় নিয়েও অ্যানিমে আছে। কাজেই তুমি যা–ই হও না কেন, তোমার পছন্দের কোনো না কোনো বিষয় নিয়ে বানানো অ্যানিমে একটু খোঁজাখুঁজি করলেই পেয়ে যাবে। অন্য কোনো মাধ্যমে এই ধরনের ভ্যারিয়েশন পাওয়া বেশ কষ্টকরই বলা চলে। অ্যানিমের জনপ্রিয়তার আরেকটা কারণ নিঃসন্দেহে এর স্টোরি টেলিং বা গল্প বলার ধরন। জাপানিরা সারা বিশ্বে পরিচিত তাদের ডিটেইলিং ও নিখুঁত কাজের জন্য। অ্যানিমেতেও তারা গল্পকে এত সুন্দর বা বিস্তারিতভাবে বলে যে তার প্রতি আকর্ষণ তৈরি হতে বাধ্য। একই সঙ্গে তাদের ক্যারেক্টারগুলোকেও অনেক যত্ন নিয়ে তৈরি ও ডেভেলপ করা হয়। ফলে দেখা যায় যে এই চরিত্রগুলোর প্রতি নিজের অজান্তেই ভালোবাসা তৈরি হয়ে যায়। অ্যানিমের দৈর্ঘ্যও এর জনপ্রিয়তায় প্রভাব ফেলেছে। ১৩, ২৬ অথবা ৫২ পর্বের অ্যানিমেতে একটা গল্প বলা হয়, যেখানে বছরের পর বছর চলে আসা কার্টুনে প্রতিটি পর্বে একটা করে গল্প থাকে। ফলে কার্টুনের চেয়ে অ্যানিমেতে দর্শক গল্পের শেষ জানার জন্য উদ্‌গ্রীব হয়ে থাকেন। এ ক্ষেত্রে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে কার্টুনের শেষে প্রায় সব সময়ই হ্যাপি এন্ডিং থাকে, কিন্তু অ্যানিমেতে এন্ডিং কী রকমের হবে, তা অধিকাংশ সময়েই আন্দাজ করা যায় না। দর্শক এই অনিশ্চয়তাকে পছন্দ করে। কার্টুনের আরেকটা বড় সমস্যা হচ্ছে, এটা একটা নির্দিষ্ট বয়সের দর্শকের জন্য, অন্যভাবে বললে ছোটদের জন্য (সিম্পসনের মতো কিছু সিরিজ বাদে), কিন্তু অ্যানিমেতে এ ক্ষেত্রেও ভ্যারিয়েশন আছে। কিছু অ্যানিমে বাচ্চাদের জন্য হলেও সব অ্যানিমে নয়। ফলে যেকোনো বয়সের দর্শক অ্যানিমে দেখে আনন্দ পাবে। এ ছাড়া অন্য যে ব্যাপারগুলো অ্যানিমেকে জনপ্রিয় করতে ভূমিকা রেখেছে, তা হচ্ছে দুর্দান্ত অ্যানিমেশন, সাউন্ড, মিউজিক, ডায়ালগ ও ভয়েস অ্যাক্টিং। বিশেষ করে অ্যানিমেশনের ক্ষেত্রে দুর্দান্ত সব কাজ হচ্ছে অ্যানিমেতে। ‘মাকোতো শিনকাই’ বা ‘ইউতাকা নাকামুরা’র অ্যানিমেশন ডিরেক্টররা এখন বিশ্বে সেলিব্রিটি পর্যায়ে জনপ্রিয়। অ্যানিমেতে কাজ করে জনপ্রিয়তা পাওয়া মিউজিক ডিরেক্টর, সংগীতশিল্পী বা ব্যান্ডের সংখ্যাও রীতিমতো কম নয়। এমনকি অ্যানিমেতে শুধু ভয়েস দিয়েই তারকা হয়ে গেছেন অনেকে। আর এটা কেবল সম্ভব হয়েছে অ্যানিমে তৈরির প্রতিটি পর্যায়কে যত্ন ও পেশাদারত্বের সঙ্গে পরিচালনা করার মাধ্যমে।

সবশেষে বলা যায়, অ্যানিমে হচ্ছে কেবলই একটা এন্টারটেইনমেন্ট মিডিয়া। মুভি, সিরিয়াল, গেমসের মতো মানুষকে বিনোদন দেওয়াই এই মিডিয়ার মূল লক্ষ্য। অন্য মিডিয়াগুলো থেকে এর পার্থক্য হচ্ছে বিশ্বব্যাপী প্রডাকশনের বদলে অ্যানিমে তৈরি হয় ১৩ কোটি মানুষের দেশ জাপানে। আর সেখান থেকেই এই মিডিয়াম সারা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষকে আনন্দ দিয়ে আসছে, জাপানের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে। অ্যানিমের কল্যাণে জাপানের সংস্কৃতি এখন পুরো বিশ্বের মানুষের কাছে পরিচিত। পেশাদারিত্ব, পরিশ্রম আর একাগ্রতা যে একটা নির্দিষ্ট এন্টারটেইনমেন্ট মিডিয়ার মাধ্যমে দেশকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে, তারই উদাহরণ জাপানের অ্যানিমে ইন্ডাস্ট্রি।