গল্প-ছবিতে রুখব সহিংসতা

অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া ছোট বোন মিতুর কথা শুনে অবাক হয় নীতু। মিতুদের ক্লাসে নাকি নতুন ধরনের একটা মেয়ে এসেছে। কয়েক দিন পেরিয়ে গেলেও মেয়েটার সাথে কেউ কথা বলে না। কেন কেউ কথা বলে না জিজ্ঞেস করলে মিতু জানায়, ‘আরে আপু, মেয়েটা অন্য রকম, ঠিক আমাদের মতো না।’ এই অন্য রকমের বিষয়টা কী, তা আরও বিস্তারিত জানতে গিয়ে বোঝা গেল, মেয়েটা সাঁওতাল, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর চেহারার যে বিশেষত্বগুলো রয়েছে, তা ওই মেয়েটির মধ্যেও রয়েছে। নীতু আন্দাজ করতে পারে, বাড়িতে বাংলার চর্চা হয়তো খুব বেশি নেই মেয়েটির, তাই তার বাংলা উচ্চারণে সাঁওতালি টান ও অনভ্যাসের জড়তা প্রকট।
চেহারা কিংবা ভাষার পার্থক্য কি আসলে ওই মেয়েটা আর মিতুর ক্লাসের মেয়েদের মধ্যে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে? ভেবে দেখো, তোমার সহপাঠীর বলা কথা যদি তোমার মতো না হয়, তার যদি নিজস্ব কোনো ভাষা থাকে, যদি তার শারীরিক গঠনে থাকে ভিন্নতা, সে যদি ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হয় বা অন্য কোনো আচার বা রীতিনীতি পালন করে, তাই বলে কি সে তোমার বন্ধু হতে পারে না? নিজেকে প্রশ্ন করো, লিঙ্গ-বর্ণ-ধর্ম-জাতিসত্ত্বা-ভাষা-আদর্শের পার্থক্য কি সত্যিই কোনো দুর্ভেদ্য দেয়াল? উত্তর পাচ্ছ না? বিভ্রান্ত না হয়ে মনের দেয়াল খোলো, শুরু করো আলোচনা, ভেবে বের করো, কোনটি ঠিক আর কোনটি বেঠিক।
ধরো, তুমি গেছ কানাডা বা আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়ায়। যে স্কুলে ভর্তি হয়েছ, সে স্কুলে তুমি একা বাঙালি। ভালো ইংরেজি পারো না, তোমার গায়ের রং শ্যামলা; তখন ওরা যদি তোমাকে আলাদা ভাবে, তোমার কেমন লাগবে?

এই ভাবনা-চিন্তা, আলোচনা করতে থাকো। আর তা করার ফাঁকেই জেনে নিতে পারো জগতের এ বৈচিত্র্যময়তাকে কীভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে শব্দে, গল্পে, সেলুলয়েডে। এরপর তুমি নিজেই দিতে পারবে এ প্রশ্নগুলোর উত্তর। 
জিন লুই স্কাউট। ১৯৬০ সালে প্রকাশিত কালজয়ী উপন্যাস টু কিল এ মকিংবার্ড-এর অন্যতম প্রধান চরিত্র। সদ্য স্কুলে যেতে শুরু করা এক দুরন্ত বালিকা সে। মেয়ে বলে কেন তাকে নিচু গলায় কথা বলতে হবে, প্রতিবেশী বু র‌্যাডলি কেন কখনো ঘর থেকে বের হয় না, সহপাঠী কানিংহাম কেন জুতো পরে না বা টিফিন আনে না—এমন হাজারো প্রশ্ন স্কাউট অকপটে করে ফেলে। শুধু প্রশ্ন করেই ক্ষান্ত হয় না সে, করে তর্কও। স্কাউটের সরল কিন্তু দৃঢ় উত্তর, ‘আমার মনে হয়, মানুষ শুধু এক প্রকারের হয়, আর সে প্রকারটি হলো মানুষ’—তখনকার সমাজে প্রকট হয়ে ওঠা বর্ণবাদী আচরণকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করে। পুলিৎজারজয়ী এ উপন্যাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি চরিত্র, প্রতিটি অধ্যায় নির্দ্বিধায় বলে যায় গায়ের রং, চেহারা, সামাজিক অবস্থান কখনোই মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরি করতে পারে না। উপন্যাসটির আলোকে নির্মিত চলচ্চিত্র টু কিল এ মকিংবার্ডও এক অনবদ্য সৃষ্টি। ছবিটির একটি অংশে যখন প্রচণ্ড দৃঢ়তার সঙ্গে অ্যাটিকাসের ভূমিকায় গুণী অভিনেতা গ্রেগরি পেক শত হুমকি-লাঞ্ছনা উপেক্ষা করে এক কৃষ্ণাঙ্গের ন্যায়বিচারের পক্ষে লড়াই করেন, তখনই দর্শক আরও একবার উপলব্ধি করে, মনুষ্যত্ববোধই মানুষের সবচেয়ে বড় পরিচয়।



স্কাউট বা অ্যাটিকাসের মতো ভাবে না সবাই, তাই মানুষে-মানুষে ভিন্নতা থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বিরোধ হয়, যুদ্ধ-বিগ্রহ-ধ্বংসের মিছিল চলতেই থাকে। কিন্তু তবু হাল ছেড়ে দেয় না সৃষ্টিশীল মানুষেরা, তাদের হাত ধরেই একে একে সৃষ্টি হয় উইজার্ড অব ওজ, মোয়ানা, পোকাহনতাস, দ্য ব্রেকফাস্ট ক্লাব, পার্সেপলিস–এর মতো চলচ্চিত্র কিংবা হেশোরাম হুশিয়ারের ডায়েরি, টি–রেক্সের সন্ধানে, অ্যানিমেল ফার্ম–এর মতো বই। যুগ যুগ পরেও যখন তোমাদের মতো কিশোর ও তরুণেরা এ চলচ্চিত্র বা বইগুলোর সংস্পর্শে আসবে, জানতে পারবে ওজ এক ভীষণ সুন্দর নগরী, কারণ তা বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ, শিখবে রাজকন্যার মূল শক্তি তার তুষারশুভ্র গায়ের রঙে নয় বরং দুর্বার সাহসে, বুঝতে পারবে অন্যকে বঞ্চিত বা আঘাত করে যে নীতি, তা কখনোই সঠিক হতে পারে না।
আমাদের দেশের সংবিধান ও ইতিহাসও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির শিক্ষা দেয়। সংবিধানের ২৮ (১) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।’ অর্থাৎ অসাম্প্রদায়িকতা আমাদের জাতীয় জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। শুধু তাই নয়, মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আজও আমাদের বারবার বলে, সব ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হতে। হুমায়ূন আহমেদের আগুনের পরশমণি কিংবা জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলিতে আমরা দেখি প্রাণের ভয় ভুলে, বাহ্যিক সব ভেদাভেদ ভুলে অন্যের সাহায্যে এগিয়ে আসার, অন্যের জন্য প্রাণ বাজি রাখার চিত্র। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও মানবতাবোধের সে সময়কে উপলব্ধি করতে চাইলেও তোমার বন্ধু হবে মুক্তিযুদ্ধের বই ও চলচ্চিত্র। জয়যাত্রা, শ্যামল ছায়া, একাত্তরের যীশু, গেরিলার মতো চলচ্চিত্রগুলো যুদ্ধদিনের ভয়াবহতার পাশাপাশি বলে চলে মানবতার গল্প। এক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্নে জীবন বাজি রাখা মুক্তিযোদ্ধাদের কথা বলে কিশোরীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ আগে ও পরে, মা, হাঙর নদী গ্রেনেড, জনযুদ্ধের গণযোদ্ধার মতো বইগুলো।


এমন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বা ধ্বংসের স্মৃতি রয়েছে প্রায় প্রতিটি ভূখণ্ডে, উগ্রবাদীদের সহিংসতা কেড়ে নিয়েছে অসংখ্য প্রাণ। সেসব আঘাতের ভয়াবহতা কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে সাহিত্য, নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র। টানা দুই বছরের বেশি সময় ধরে গুপ্তনিবাসে লুকিয়ে থাকা এক ১৩ বছরের কিশোরী লিখেছিল ডায়েরি। সে ডায়েরি আজ হিটলারের ইহুদিবিরোধী অভিযানের ভয়ংকর দিনগুলোর অকাট্য দলিল। ছোট্ট অ্যানি এবং তাঁর অসহায় পরিবারের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রামের কথা পড়তে পড়তে তোমরা উপলব্ধি করবে বন্দিজীবন আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মাঝেও মানুষ হাসে, কাঁদে, আনন্দে উড়তে থাকে, প্রেমে উদ্ভাসিত হয়, সর্বক্ষণ মাথার ওপর মৃত্যুর কালো ছায়াকে সঙ্গী করেও ভালোবাসা-স্নেহ-মমতায় জড়াজড়ি করে বাঁচে। প্রায় ৭০ বছর আগের এক মননশীল কিশোরী তোমাকে জানাবে, সহিংসতা কখনোই জীবনবোধকে দমিয়ে রাখতে পারে না। ধ্বংসের বিরুদ্ধে মানুষের সৃজনশক্তির উত্থান আরও স্পষ্ট হয় দ্য ক্যাচার ইন দ্য রাই, দ্য গ্রেট গ্যাটসবি, লর্ড অব দ্য ফ্লাইস, দ্য বুক থিফ, দ্য কাইট রানার, আ থাউজেন্ড স্প্লেন্ডিড বইগুলোতে। বাংলাদেশি সাহিত্যিকদের লেখা বইগুলোর মধ্যে হুমায়ূন আহমেদের সূর্যের দিন, শাহরিয়ার কবীরের নুলিয়াছড়ির সোনার পাহাড়, বার্চবনে ঝড়, মুহম্মদ জাফর ইকবালের আমার বন্ধু রাশেদ, বুবুনের বাবাসহ অসংখ্য বই কল্পিত পটভূমির সহায়তায় সহিংসতা রুখে দেয়ার কথাই বলে। সেলুলয়েডেও উঠে এসেছে সহিংসতাবিরোধী নানা গল্প। ইউনাইটেড নাইন্টি থ্রি, প্যারাডাইস নাউ, মিউনিখ–এর মতো যুগান্তকারী চলচ্চিত্রগুলো সুদৃঢ়ভাবে ঘোষণা করে ঐক্যবদ্ধতাই পারে সহিংসতাকে রুখে দিতে। কোনো কোনো চলচ্চিত্র আবার অনুসন্ধানী চোখে বিশ্লেষণ করে উগ্রবাদীদের মনোস্তত্ত্ব। অকালপ্রয়াত গুণী চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদের মাটির ময়না, রানওয়েতে উঠে এসেছে এ দেশের বিভিন্ন সামাজিক অবস্থানের মানুষেরা কেন উগ্রবাদকে সমর্থন করে, কেন সহিংসতার পথ বেছে নেয়, আর কী ভয়াবহ এ ভুলপথের পরিণতি।


প্রখ্যাত লেখকেরা, বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতারা তাঁদের সৃষ্টির মাধ্যমে বহুবার বলেছেন, ভিন্নতার মাঝেই নিহিত এ পৃথিবীর সৌন্দর্য। বৈচিত্র্যকে মেনে নিতে না পারার সংস্কৃতি থেকেই শুরু হয় সংঘাত। আর সংঘাত শুধু বয়ে আনে মৃত্যু আর ধ্বংস। অথচ আমরা সবাই–ই স্বপ্ন দেখি সৃষ্টির আনন্দে মুখর এক পৃথিবীর। বেড়ে ওঠার এ চমৎকার সময়টিতে তাই তোমার সঙ্গী হোক দারুণ কিছু বই ও চলচ্চিত্র, যা গড়ে তুলবে তোমাকে আর তুমি নিজেই দিতে পারবে লেখার শুরুতে করা প্রশ্নগুলোর উত্তর।