দ্য ডোরস ও পিংক ফ্লয়েডের দুনিয়া জয়

রক মিউজিকের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যবসাসফল ও জনপ্রিয় ব্যান্ড হিসেবে চিরস্থায়ী আসনটা পাকা করে নিয়েছে পিংক ফ্লয়েড
রক মিউজিকের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যবসাসফল ও জনপ্রিয় ব্যান্ড হিসেবে চিরস্থায়ী আসনটা পাকা করে নিয়েছে পিংক ফ্লয়েড

এসিড রক ও সাইকেডেলিক রকের ক্ষেত্রে জিম মরিসনের ‘দ্য ডোরস’ আর ‘পিংক ফ্লয়েড’ দুই প্রবাদপ্রতিম ব্যান্ড। আমাদের তারুণ্যের শুরুতে যে এ ব্যান্ড দুটোর গান শোনেনি, সে কিছুই শোনেনি বলে মানা হতো। কী অদ্ভুত! এ আবেদন কিন্তু এখনো শেষ হয়নি। মরিসনের অকালমৃত্যুতে ডোরস তল্পি গুটালেও পিংক ফ্লয়েডের ক্ষেত্রে তা হয়নি। বুড়ো ডেভিড গিলমোর এখনো একদল ছানাপোনা নিয়ে বাজিয়ে যাচ্ছেন, শো করছেন। গাইছেন নস্টালজিক সব গান।

তবে মাদক এ দুই ব্যান্ডে কমন অনুষঙ্গ। কিন্তু তাদের পথচলা পুরোপুরি ভিন্নমাত্রার। ফিল্ম ইনস্টিটিউটের ছাত্র মরিসন শেষমেশ কবি হতে প্যারিস চলে গিয়েছিলেন। সেখানেই মৃত্যু। মাঝের সময়টায় গানপাগলদের দিয়ে গেছেন তাঁর অসামান্য প্রতিভার খানিকটা ঝলক।

জিম মরিসন
জিম মরিসন

জীবনযাত্রায় পুরোপুরি বোহেমিয়ান মরিসন তখন মাদকে তুমুল আসক্ত। ভেনিস বিচেই তাঁর সার্বক্ষণিক আনাগোনা। সেখানেই জন্ম ডোরসের। সময়টা ষাটের দশকের মাঝামাঝি ‘মুন লাইট ড্রাইভ’ নামের একটি কবিতাকে গীতে রূপ দেওয়ার প্রয়াস নেন মরিসনের ইউসিএলএ (ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, লস এঞ্জেলস) ক্লাসমেট রে মানজারেক। ড্রামার জন ডেন্সমোর ও গিটারিস্ট রবি ক্রিগারও যোগ দেন সঙ্গে। ডোরস নামটা কোত্থেকে নেওয়া, এ নিয়ে অনেক মত আছে। বলা হয়, আলডাউস হাক্সলির দ্য ডোরস অব পারসেপশন মরিসনের প্রিয় বইয়ের সুবাদে নামটা নেন তিনি। আবার তাঁর প্রিয় কবি উইলিয়াম রেইকের একটি লাইনও স্মরণীয়, ‘ইফ দ্য ডোরস অব পারসেপশন ওয়ার ক্লিনজড, এভরিথিং উড অ্যাপিয়ার টু ম্যান, এজ ইট ইজ, ইনফিনিট।’ মরিসনের ভরাট গলা, মানজেরেকের দুর্দান্ত কি-বোর্ড, ক্রিগারের ফ্ল্যামেঙ্কো ও ক্ল্যাসিক্যাল ব্লুজ স্টাইলের সঙ্গে ডেন্সমোরের উদ্দাম ড্রামবিট। আক্ষরিক অর্থেই রক এরেনায় বিপ্লব নিয়ে এল ডোরস। সুরিয়ালিস্ট লিরিকসে মিস্টিজম, পাগলামি, মৃত্যুর মতো নানা অনুষঙ্গের আলাদা সোয়াদ তাঁদের গানে। অবশ্য একক কৃতিত্ব মরিসনের নয়। ক্রিগারও ‘লাইট মাই ফায়ার’ এবং ‘টাচ মি’র মতো সুপারহিটগুলোর লেখক।

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে তথ্যটি তা হলো, সেই সময়েই মিউজিক ভিডিওর আদি রূপটা দেখিয়েছিল ডোরস। মরিসন-মানজারেক দুজনই ফিল্মের ছাত্র। ‘ব্রেক অন থ্রু টু দ্য আদার সাইড’-এর প্রোমো ডকুমেন্টারির পাশাপাশি ‘আননোন সোলজার’কে ধরা যেতে পারে রক অ্যান্ড রোলের প্রথম মিউজিক ভিডিও হিসেবে। এরপর ‘পিপল আর স্ট্রেঞ্জ’। ’৬৭ সালের মাঝামাঝি ‘লাইট মাই ফায়ার’ দিয়েই শ্রোতাপ্রিয়তা পায় ডোরস, গানটি উঠে যায় চার্টের এক নাম্বারে। দ্বিতীয় অ্যালবাম স্ট্রেঞ্জ ডেজ দিয়ে গোটা ইউএসও জয় করেন মরিসন ও তাঁর সঙ্গীরা।

পিংক ফ্লয়েডের ডেভিড গিলমোর এখনো গাইছেন নস্টালজিক সব গান
পিংক ফ্লয়েডের ডেভিড গিলমোর এখনো গাইছেন নস্টালজিক সব গান

ফ্যানদের প্রিয় ‘লিজার্ড কিং’ গলা পর্যন্ত গিলে কনসার্ট করতে গিয়ে রীতিমতো বিপাকে ফেলে দেন সতীর্থদের। এমনও হয়েছে, সটান পড়ে গেছেন মরিসন স্টেজে, মানজারেক এমনভাবে ‘লাইট মাই ফায়ার’ গাইলেন যেন মরিসনই গাইছেন। ’৬৯ সালে ব্যান্ডের ভাবমূর্তি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় মরিসনের এ ধরনের পাগলামিতে। পুলিশ তাঁকে প্রকাশ্যে অশ্লীলতার কারণে গ্রেপ্তার করে। পরিণতিতে অনেক কনসার্ট বাতিল করতে বাধ্য হয় ডোরস। এরপর মরিসন হোটেল, ওয়েটিং ফর দ্য সান, এল এ ওম্যান দিয়ে আবারও ফিরে আসেন। এল এ ওম্যান অ্যালবামের ‘রাইডার্স ইন দ্য স্টর্ম’ মিউজিক্যাল ইমপ্রোভাইজেশনের অসাধারণ এক উদাহরণ হয়ে আছে এর বিশেষ সাউন্ড ইফেক্টের জন্য।

মরিসন কি একটু বিকারগ্রস্ত ছিলেন? প্রশ্নটা অনেকবার উঠেছে। তাঁর বিশেষ একটি বক্তব্য নানা সাক্ষাত্কারে, গানে ও কবিতায় উঠে এসেছে। ছোটবেলায় এক দুর্ঘটনা পাশ কাটানোর সময় রেড ইন্ডিয়ান এক আত্মা নাকি ঢুকে যায় তাঁর শরীরে। এমন কোনো ঘটনা তাঁর পরিবার অস্বীকার করেছে, কিন্তু মরিসন জোর দিয়ে আউড়ে গেছেন তা।

১৯৭১ সালের মার্চে গানের জগত্ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে পুরোদস্তুর কবি হতে প্যারিস যান জেমস ডগলাস মরিসন ওরফে জিম মরিসন। সঙ্গে ছিল তাঁর বান্ধবী পামেলা কারসন। ৩ জুলাই বাথটাবে মরিসনের মৃতদেহ পাওয়া যায়। ড্রাগ ওভারডোজ নাকি আত্মহত্যা—এখনো নিশ্চিত নন কেউ।

তবে বিকারগ্রস্ততায় মরিসনের গুরু মানতে হবে সিড ব্যারেটকে। দ্য লিজেন্ডারি ব্যান্ড পিংক ফ্লয়েডের প্রতিষ্ঠাতা। ব্রিটিশ এই রক ব্যান্ড সাইকেডেলিয়া দিয়ে শুরু করে প্রগ্রেসিভ রকের নতুন এক ধারায় নিয়ে গেছেন নিজেদের। তাঁদের বিশেষত্ব আলাদা, নির্দিষ্ট কোনো ফরম্যাটে ফেলার নয়। রক মিউজিকের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যবসাসফল ও জনপ্রিয় ব্যান্ড হিসেবেই চিরস্থায়ী আসনটা পাকা করে নিয়েছেন তাঁরা। ঠিক পিংক ফ্লয়েড নামে কিন্তু শুরু হয়নি। ১৯৬৪ সালে বিচিত্র সব নাম নিয়ে পারফর্ম করত—সিগমা সিক্স, দ্য মেগাডেথস, দ্য স্ক্রিমিং অ্যাবড্যাবস, দ্য অ্যাবড্যাবস। একটা ভাঙন হলো তখন। গিটারিস্ট বব ক্লোজ, রজার ওয়াটার্স, ড্রামার নিক ম্যানস ও উইন্ড ইনস্ট্রুমেন্ট প্লেয়ার রিক রাইট ‘টি সেট’ নামে নতুন ব্যান্ড গড়লেন। গিটারিস্ট ও প্রাইমারি ভোকালিস্ট হিসেবে যোগ দিলেন ব্যারেট। টি সেট নামের আরেকটা ব্যান্ড ছিল তখন। ব্যারেট তখন হুট করে ব্যান্ডের নাম দিলেন ‘দ্য পিংক ফ্লয়েড সাউন্ড’ দুজন খ্যাতনামা ব্লুজ বাদক পিংক অ্যান্ডারসন ও ফ্লয়েড কাউন্সিলের নাম দিয়ে। পরে সাউন্ড নামটি বাতিল করে দেন তাঁরা। পিংক ফ্লয়েডের হিরো-ভিলেন দুটোই মানা হয় ব্যারেটকেই। ক্যামব্রিজের তিন বন্ধু ব্যারেট, ওয়াটার্স ও ক্লোস মিলে ব্যান্ড ফর্ম করেন, নিক ম্যানস ও রিচার্ড রাইট আরও ব্যাপ্তি দেন একে। শুরুতেই ব্যারেটকে এড়ানোর একটা চেষ্টা ছিল বটে, কিন্তু তা ঠেকানো হয় কারও না কারও সহমর্মিতায়—আরেকটু দেখি। ক্লোস চলে গেলেন ফটোগ্রাফার হতে। তখন ব্যান্ডের লাইনআপ দাঁড়ায় ব্যারেট গিটার, ওয়াটার্স বেজ, ম্যাসন ড্রামস ও রাইট সিনথেসাইজার। বলা হয়, নেশা ব্যারেটকে একদম শেষ করে দিয়েছিল। ভিন্নমত হচ্ছে, তিনি আগে থেকেই ছিলেন সিজোফ্রেনিয়া রোগী, এলএসডি তাঁর অবস্থাটা আরও খারাপ করে দিয়েছিল। তারপরও ব্রিটিশ সাইকেডেলিয়া এরেনায় ব্যারেটই প্রবাদপুরুষ। ১৯৬৭ সালের মাঝামাঝি পিংক ফ্লয়েড তাদের ডেব্যু অ্যালবাম বাজারে ছাড়ে দ্য পাইপারস অ্যাট দ্য গেটস অব ডন। মিউজিক ক্রিটিকরা এখনো একে অভিষেকে সবচেয়ে নজরকাড়া অ্যালবামগুলোর একটি বলে স্বীকৃতি দেন এবং এখনো ব্রিটিশ সাইকেডেলিক মিউজিকের শীর্ষ উদাহরণ মানা হয় অ্যালবামটিকে। এর মাস তিনেক আগে সি এমিলি প্লে ও আরনল্ড লেইন নামের দুটো সলো ট্র্যাক বাজারে ছেড়েছিলেন তাঁরা। সি এমিলি প্লে ইউকে বিলবোর্ডে ৬ নম্বর সিঙ্গলস হিসেবে জায়গা পায়, আরনল্ড লেইন ২০ নম্বর। সে সুবাদেই টিভি শো টপ অব ‘দ্য পপস’-এ প্রথম পারফর্ম করে পিংক ফ্লয়েড।

ইউএসএতে খুব একটা পাত্তা না পেলেও দ্য পাইপারস অ্যাট দ্য গেটস অব ডন ইউকে বিলবোর্ডে অ্যালবাম লিস্টে ৬ নাম্বারে ওঠে। গানগুলো বেশির ভাগই ব্যারেটের লেখা। পরাবাস্তব কাব্যময় লেখনীর সঙ্গে অসাধারণ এবং সে যুগের অত্যাধুনিক মিউজিক্যাল কম্পোজিশনের দ্যোতনায় তুমুল শ্রোতাপ্রিয়তা পায় তা। এই সময়টায় জিমি হ্যানড্রিক্সের সঙ্গে ট্যুর করত পিংক ফ্লয়েড, এতে পরিচিতি বাড়ে আরও।

এ ট্যুরেই হেনড্রিক্সের ডোপিং পার্টনার ব্যারেট সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যান বাকিদের। এমনও হয়েছে, কনসার্টের মাঝেই গান থামিয়ে আকাশপানে তাকিয়ে আছেন ব্যারেট—যেন এ মুহূর্তে সপ্তর্ষিমণ্ডল দেখাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ! কখনোবা স্ট্রামিং করতেন একটা কর্ড ধরে, বাকিদের আউলে যেত সব। কিংবা হঠাত্ই টিউনিং করা শুরু করলেন গিটার। তখন একটা রফায় এলেন বাকিরা। ঠিক আছে, ব্যারেট গান লিখবেন। কিন্তু তাঁর জায়গায় পারফর্ম করবেন ডেভিড গিলমোর। ক্যামব্রিজের ছেলে এবং এখন পর্যন্ত পিংক ফ্লয়েডকে টিকিয়ে রেখেছেন। যদিও কয়েক বছর আগে ঘোষণা দিয়েছেন ব্যান্ডের নাম ব্যবহার করে আর কনসার্ট করবেন না, মানছেনও তা। ওয়াটার্স অবশ্য আগেই সেই ৮৭-তে ঘোষণা দিয়ে দিয়েছিলেন পিংক ফ্লয়েড বলে কোনো ব্যান্ড আর থাকছে না। পরে এক চুক্তিতে তাঁর গানগুলোর কপিরাইট দেওয়ার বিনিময়ে ব্যান্ডের স্বত্ব হাতে রেখে দেন গিলমোর। সে গল্প পরে আসবে। ফিরে যাই ব্যারেটে। গান লিখতে গিয়েও জটিলতা! ‘হ্যাভ ইউ গট ইট ইয়েট’ নামের যেটি লিখলেন, তার পদে পদে মিউজিক চেঞ্জ মেলোডি আর কর্ডের রূপান্তর। ত্যক্ত হয়ে তাঁকে সাফ জানিয়ে দিলেন বাকিরা, ‘অনেক হয়েছে বাপু, এবার রাস্তা মাপো।’ ব্যারেট মারা গেছেন বছর দশেক আগে, ডায়াবেটিসে ভুগে। তার আগে ৩৫ বছর সুখে ঘর-সংসার করে গেছেন ক্যামব্রিজে তাঁর নিজের বাড়িতে। এ সময়টাতে মিডিয়া থেকে লুকিয়ে বেড়িয়েছেন। পিংক ফ্লয়েড নিয়ে উচ্চবাচ্য করেননি কখনোই।

যদিও গল্প আছে একটা। ’৭৫ সালে পিংক ফ্লয়েড তাদের অন্যতম সুপারহিট ‘উইশ ইউ ওয়ার হিয়ার’ ছাড়ে। ব্যারেটের সম্মানেই ওখানে রাখা হয় ‘শাইন অন ইউ ক্রেজি ডায়মন্ড’ গানটি। ব্যান্ডে তাঁর শেষকাল, তাঁর সময়ের কম্পোজিশন স্টাইল যেমন সি এমিলি প্লের কিছু নোট মিলিয়ে গানটি ছিল তাঁর প্রতি ট্রিবিউট। গানটি যখন স্টুডিওতে রেকর্ড করা হচ্ছিল, মাথা ও ভ্রু চাঁছা মোটাসোটা এক দীর্ঘদেহী ঢুকে পড়েন। ব্যান্ড সদস্যরা প্রথমে চিনতে পারেননি, হঠাত্ একজন বলল, ‘এই তো সিড ব্যারেট।’ তাঁকে আন্তরিকভাবে বুকে টেনে নেন সবাই। হাসিঠাট্টা ও আড্ডাবাজির পর ফুড়ুত করেই উধাও আবার! একটু পর সেদিন ডেভিড গিলমোরের বিয়ের অনুষ্ঠান ছিল। সেবারই শেষ ব্যান্ড মেম্বাররা তাঁকে দেখেন। গিলমোর এক সাক্ষাত্কারে ঘটনাটা সত্যি বলেই জানিয়েছেন। আর পিংক ফ্লয়েডের ‘দ্য ওয়াল’ মিউজিক ভিডিও যারা দেখেছ, তারা জেনে রাখো, ভ্রু চাঁছার ব্যাপারটা ব্যারেটকে উত্সর্গ করেই।