চায়ের কাপে ঝড়

হেমন্তের মিষ্টি সকাল। সোনাঝরা রোদ ছড়িয়ে পড়েছে মাধবপুর লেকের বাঁকাজলে। শাঁই শাঁই শব্দে উড়ে আসে একঝাঁক বুনোহাঁস। লেকের জলে তাদের দিনভর আড্ডা। পাহাড়ে-টিলায় রাতের শিশিরের ছোঁয়া রয়ে গেছে তখনো। কণ্টকময় বেতের ঝোপ, বুনো গুল্মলতা আর বাঁশঝাড় দুর্ভেদ্য করে রেখেছে পাহাড়ের চূড়া থেকে উপত্যকা পর্যন্ত। তবে গোটা এলাকায় কিন্তু এমন ঝোপঝাড় নেই। একদিকে মাইলকে মাইল পাহাড়ের গায়ে সুন্দর করে ছাঁটা সাজানো-গোছানো চা-বাগান। ক্যালেন্ডারের ছবির মতো।

একদল নারী—মাথায় বিশাল আকারের টোকা, ছিন্নজীর্ণ পোশাক, পিঠে বড়সড় একটা খালি বোঁচকা। চলেছে চা-বাগানের দিকে। চেহারায় অতি দারিদ্র্যের ছাপ। এঁরাই আসলে চা-পাতার প্রথম কারিগর। সারা দিন খেটে চা তোলেন। দুটি পাতা আর একটি কুঁড়ি। কমপক্ষে ২৩ কেজি চা-পাতা তুলতে হয় দিনে। তবেই পান নির্ধারিত পারিশ্রমিক ৮৫ টাকা! গাছের পাতা বেশ হালকা! কচিপাতা আরও হালকা। ২৩ কেজি হতে কত পাতা লাগে ভাবা যায়? সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রোদে পুড়েও ২৩ কেজি পুরাতে পারেন না অনেকে। তখন পারিশ্রমিক থেকে কাটা যায় টাকা।

সন্ধ্যায় কাঁচা পাতা চলে যায় কারখানায়। কারখানা বাগানের ভেতরেই। কাঁচা পাতা সেখানে ফেলে রাখা হয় ৮-১০ ঘণ্টা। এতে চায়ের পাতার রসাল ভাবটা কমে যায়। রং ফিকে হয় খানিকটা। তারপর নানা রকম সব মেশিনে রোলিং করে, শুকিয়ে, ভেঙে গুঁড়ো করে, তৈরি হয় দানাদার চায়ের লিকার।

পৃথিবীর সেরা স্বাদের চা উত্পন্ন হয় এই বাংলাতেই। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিংয়ে। আমাদের দেশের সিলেট, চট্টগ্রাম ও উত্তরবঙ্গের পাহাড়ি এলাকার চা কিন্তু কম যায় না। তবে চায়ের আদিভূমি কিন্তু বাংলা বা ভারতবর্ষ নয়, চীন দেশ। প্রায় ৪ হাজার ৮০০ বছর আগের কথা।  চীনের সম্রাট তখন শান নাং। তাঁর খাবার পানি গরম করা হচ্ছিল। তখন দমকা বাতাসে উড়ে এসে সেই পানিতে পড়ল বুনো এক গাছের পাতা। সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে গেল গরম পানির রং। সুবাসও ছড়াল কিছুটা। সম্ভবত সম্রাট ময়লা হয়েছে ভেবে সেই পানি ফেলে দেননি। পান করেন এবং সেই পানীয়ের প্রেমে পড়ে যান। বুনো সেই পাতাটা হলো চায়ের পাতা। তারপর থেকেই নাকি চীন দেশে টুকটাক চায়ের ব্যবহার শুরু। তবে চা উত্পাদন ও ব্যবহার ব্যাপকভাবে শুরু হয় ১৬৫০-এর দশকে। আমাদের উপমহাদেশে প্রথম চায়ের চাষ হয় আসামে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ব্রিটিশরা চীন থেকে চায়ের বীজ এনে চাষ শুরু করে। কিন্তু চীনা চা এ দেশের আবহাওয়ায় বেশি দিন টিকতে পারেনি। তখনই আসাম ও সিলেট অঞ্চলে বুনো চা-গাছ আবিষ্কার হয়। বুনো জাতের সেই চা-ই এখন চাষ করা হয় উপমহাদেশের বাগানগুলোতে।

রেলস্টেশনে লাগানো চায়ের বিজ্ঞাপন
রেলস্টেশনে লাগানো চায়ের বিজ্ঞাপন

চা-গাছ বলতে ঝোপালো ছোট ছোট গাছ বুঝি আমরা। আসলে চা কিন্তু ধোপদস্তুর বৃক্ষ। ২০-২৫ ফুট পর্যন্ত উঁচু হয় এই গাছ। মৌলভীবাজারের মাধবপুর লেকে ঢুকতে বাঁ পাশে দেখা মেলে কমলালেবুর গাছের সমান বেশ কিছু চা-গাছের। এগুলোকে বলা হয় মাদার ট্রি। ফল-ফুল, বীজ হয় এসব গাছে। সেই বীজ থেকে নার্সারিতে চারা তৈরি করে বাগানে রোপণ করা হয়। কয়েক দিন পরপর ছেঁটে ছোট রাখা হয় বাগানের গাছ, সহজেই যাতে হাত দিয়ে চা-পাতা তোলা যায়।

চা-বাগান থেকে চায়ের বীজ নিয়ে এসে বাড়িতে লাগানোর কথা ভেবে কিন্তু লাভ নেই। চা-গাছ সব জায়গায় বাঁচতে পারে না। গড়ে ১৭৫-২৫০ সেন্টিমিটার বৃষ্টিপাতের প্রয়োজন হয় বছরে। আমাদের দেশে সিলেট ও মৌলভীবাজারে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়। তাই ওই এলাকায় চা-বাগানের সংখ্যা এত বেশি।

মাদার ট্রি থেকে চায়ের বীজ পাওয়া যায়
মাদার ট্রি থেকে চায়ের বীজ পাওয়া যায়

চা নিয়ে আমাদের দেশে ধুন্দুমার কাণ্ড ঘটে বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে। ব্রিটিশরা বাঙালিকে চায়ের নেশা ধরানোর জন্য অবলম্বন করে নানা পথ। ব্যবসায়িক কৌশল হিসেবে কলকাতা ও বরিশালে ফ্রি চায়ের দোকান বসায়। যে যার মতো চা খেতে পারত সেসব দোকানে। স্বদেশি আন্দোলন তখন জোরদার হতে শুরু করেছে। ব্রিটিশ সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে দিন দিন। সেই সঙ্গে বাড়ছে চায়ের জনপ্রিয়তাও। ঠিক তখন ‘স্বদেশি’ বিপ্লবীরা চায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেন। চায়ের বাগানগুলো সব ব্রিটিশ মালিকদের অধীনে। চায়ের শ্রমিকেরাও নিপীড়িত-বঞ্চিত। পর্যাপ্ত শ্রমের দাম পান না তাঁরা। কলম ধরলেন বিখ্যাত রসায়নবিদ আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়। পত্রিকায় লিখতে শুরু করলেন চায়ের অপকারিতা নিয়ে নানা প্রবন্ধ। চায়ের ব্রিটিশ মালিকেরাও কম যান না। তাঁরা আরেক বিখ্যাত বাঙালি বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার বাণী ও ছবিসংবলতি একটা চায়ের বিজ্ঞাপন ছড়িয়ে দিলেন পত্রিকায়। তবে মেঘনাদ সাহার অনুমতি নেয়া হয়েছিল কি না, তা জানা যায়নি। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের কারণে একবার স্কুল থেকে বহিস্কার হয়েছিলেন তিনি। সেই মেঘনাদই চায়ের পক্ষে ব্রিটিশদের চতুর প্রচারে অংশ নেবেন, বিশ্বাস করা কঠিন। এ ছাড়াও দেশের প্রায় প্রত্যেক রেলস্টেশনে সাঁটানো হয় চায়ের গুণকীর্তন করে বেশ কিছু বিজ্ঞাপন। তার কয়েকটা আজও টিকে আছে পাবনার ঈশ্বরদী ও রংপুরের কাউনিয়া রেলস্টেশনে।

চায়ের ফুল (বাঁয়ে) ও বীজ
চায়ের ফুল (বাঁয়ে) ও বীজ

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ছিল তীব্র চায়ের নেশা। একবার তিনি এসেছিলেন ফরিদপুরে কবি জসীমউদ্দীনের গ্রামের বাড়িতে। রাতভর গান হবে। কিন্তু বিদ্রোহী কবির চায়ের তেষ্টা পেল মাঝরাতে। ভারি মুশকিল! গাঁয়ের লোকে চা খেতে শেখেনি তখনো। তবু জসীমউদ্দীন সারা গ্রামের লোককে জাগিয়ে তুললেন, কারও বাড়িতে চা পাওয়া যায় কি না। অবশেষে এক ভদ্রলোকের ভাঁড়ারে পড়ে থাকা অবস্থায় পাওয়া গেল অল্প কিছু চায়ের লিকার। সেগুলো দিয়েই তেষ্টা মেটালেন নজরুল। তারপর রাতভর গান হলো।

চা নিয়ে বাঙালির বাড়াবাড়িটা এখন চরমে। সাতসকালেই গ্রামের চায়ের দোকানগুলোতে লোকের ভিড়ে গমগম করে। চা খেতে খেতে ডোনাল্ড ট্রাম্প থেকে গ্রামের নূরা পাগলার কীর্তি নিয়ে চলে তর্ক ও পর্যালোচনা। এসব তর্কের পোশাকি নাম ‘চায়ের কাপে ঝড়’! পাহাড়ি উপত্যকায় গরিব শ্রমিকের হাতে যে পানীয়টার জন্ম হয়, সেটার রেশ ফুরোয় শহরের ড্রয়িংরুমে আর গাঁয়ের চায়ের দোকানের ছোট্ট একটা কাপে ঝড় তুলে।

কৃতজ্ঞতা: মুহিত হাসান

তথ্যসূত্র: ফরমেশন অ্যান্ড এক্সপ্যানশন অব টি কালচার অব ইন্ডিয়া, গুরাং রোশান