একটু আগে একপশলা বৃষ্টি হয়েছে। মৃদু বাতাস বইছে থেমে থেমে। বাতাসে শীতের আমেজ। খানাখন্দে ভরা কাঁচা রাস্তায় টক্কর খেতে খেতে যাচ্ছে রিকশাভ্যান। শেষ মাথায় পা ঝুলিয়ে বসেছে ফাহিম।
ভ্যানে আরও পাঁচজন যাত্রী যাচ্ছে। তারা সবাই গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষ। এতক্ষণ গল্পগুজব করছিল। এখন থেমে গেছে। গায়ে গামছা জড়িয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে তারা।
এই পাঁচজন থেকে ফাহিমকে সহজেই আলাদা করা যায়। গায়ে টি-শার্ট, পরনে জিনসের প্যান্ট, পায়ে কেডস। টগবগে এক তরুণ। তবে কৈশোরের চপলতা আছে ষোলো আনা। ঢাকা থেকে ২৫০ কিলোমিটার দূরে সীমান্তঘেঁষা এক গ্রামে যাচ্ছে ও। অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় ধরেছে ওকে। চুম্বকের মতো টানছে পিটুলি গ্রামের সেই রহস্য।
ঢাকার পরীবাগে থাকে ফাহিমরা। বাবা ব্যাংকার। মা একটা এনজিওর পরিচালক। বাবা-মায়ের সঙ্গ তেমন একটা পায়নি কোনো দিন। আয়া-বুয়ার সঙ্গ বাদ দিলে একলাই বড় হয়েছে ও। অ্যাডভেঞ্চার বই আর মুভি দেখতে দেখতে রক্তে ঢুকে গেছে নেশা। এখন কোথাও অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ পেলেই সেখানে ছুটে যায়। কেউ আটকাতে পারে না।
দিন তিনেক আগে একটা দৈনিকে পিটুলি গ্রামের রহস্য নিয়ে একটা প্রতিবেদন পড়েছে ফাহিম। কার্তিকের বিশেষ একটা দিনে, ভরা পূর্ণিমা রাতে ওই গ্রামে কোনো মানুষ থাকে না। ওই গ্রামে কিছু একটা ঘটে। মিরবাড়িকে ঘিরে এক রহস্য। কী ঘটে—তা জানা যায়নি। গ্রামের মানুষ ভয়ে মুখ খোলে না। আশপাশের গ্রামের মানুষও এ নিয়ে কিছু বলতে নারাজ। এই রহস্য উদ্্ঘাটনেই যাচ্ছে ফাহিম। কাল সেই বিশেষ দিন।
পিটুলি গ্রামের বেশ আগে একটা বাজারে ফাহিমকে নামিয়ে দিল ভ্যানচালক। বলল, ‘পারলে রাইতটা বাজারেই কোথাও কাটাইয়া দ্যান। দিনে ওই গ্রঋমে যাইবেন। তয় না যাওনই ভালা।’
রিকশাভ্যানের চালক এটুকু বলেই চলে গেল।
ফাহিম ওর ব্যাগটা পিঠে ঝুলিয়ে এগোল বাজারের দিকে। বাজারটা তেমন বড় নয়। তবে বেশ কিছু দোকান রয়েছে। এক পাশে ফলের আড়ত। সেখান থেকে পচে যাওয়া কলার গন্ধ আসছে।
মুঠোফোনে সময় দেখে নেয় ফাহিম। মাত্র আটটা বাজে। হাঁটতে হাঁটতে একটা হোটেলে গিয়ে বসে ও। টিউবলাইটের আলোতে ফকফকে ভেতরটা। কয়েকজন বসে চা-পুরি খাচ্ছে। ভ্রমণের ধকলে এর মধ্যে বেশ খিদে পেয়েছে ফাহিমের।
ময়লা গেঞ্জি পরা এক বয় এসে দাঁড়াল। জানতে চাইল, ‘কী দিমু, স্যার?’
‘ভাতটাত হবে?’
‘অইব। গরুর গোশ আর নলা মাছ আছে। কী দিতাম?’
‘উঁ-ম্-ম্, আচ্ছা, গরুর গোশই দাও। তার আগে আমার হাত-মুখ ধোয়ার ব্যবস্থা করো।’
গ্রামের হোটেল হলে কী হবে, ভালোই ফিটফাট। হাত-মুখ ধোয়ার জায়গায় টাইলস বসানো। মোটর দিয়ে ট্যাংকে পানি তোলা হয়। পানিতে অবশ্য একটা কাদা কাদা গন্ধ, তবু চোখে-মুখে পানি ছিটিয়ে একদম ঝরঝরে হয়ে গেল ফাহিম।
ভাতটা সুন্দর। মাংস বেশ ঝাল, তবে সুস্বাদু। সঙ্গে ডাল নিয়ে লেবু চিপে ভরপেট খেয়ে ফেলল ফাহিম। এখন আর নড়তে ইচ্ছা করছে না। নিজের এসি লাগানো রুমের বিছানাটা চোখে ভাসছে। হালকা ছোপের একটা সাদা চাদর বিছানো। একরত্তি ময়লা নেই। বুকটা চিনচিন করে উঠল। অ্যাডভেঞ্চার দূরের গ্রামে যতই টানুক, নিজের ঘর বলে কথা। এর চেয়ে শান্তি আর কোথাও নেই।
হোটেলের মালিক-ম্যানেজার একই লোক। ফাহিম তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘এখানে রাত কাটানোর ব্যবস্থা আছে?’
লোকটা বলল, ‘বাজারে একটা রাত্রি নিবাস আছে। তবে এখন সিট পাইবেন কি না, জানি না। আড়তের পাইকাররা দিন থাকতেই সব দখল কইরা লয়। তবু একবার দেইখা আসেন। জায়গা না থাকলে আমার কাছে আইসেন। ব্যবস্থা কইরা দিমুনে।’
হোটেল থেকে বেরিয়ে হাত তুলে রাত্রি নিবাস দেখিয়ে দিল মালিক। ফাহিম গিয়ে দেখে, বড়সড় একটা চৌচালা টিনের ঘর। ওপরে আবার নিচু ছাউনির দোতলা।
ভেতরে ঢুকতেই তেরো-চৌদ্দ বছরের এক কিশোরের সঙ্গে দেখা। একটা চৌকির ওপর ক্যাশবাক্স আগলে বসে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে—টেকনার হাড্ডি। এক পাশে কম দামি রঙিন টিভি। ওতে ‘টম অ্যান্ড জেরি’র কার্টুন ছবি চলছে। তাই দেখছে মন দিয়ে। ঘরটাতে ছাগলের উত্কট গন্ধ। এখানে ছাগলও নিশি যাপন করে?
ফাহিমের এ প্রশ্নের উত্তর দিতেই যেন ঘরের এক কোণে ব্যাঁ করে ডেকে উঠল একটা ছাগল। সঙ্গে আরও দুটো সুর মেলাল। নিশিকালে এমন ছাগ-সংগীত কার ভালো লাগে?
ফাহিমের দিকে একনজর তাকিয়ে আবার টিভির দিকে মন দিল কিশোর। টিভির পর্দায় চোখ রেখেই বলল, ‘কী চাইন, ভাই?’
ফাহিম জানতে চাইল, ‘এখানে থাকা যাবে?’
ছেলেটা তেমন আগ্রহ দেখাল না। বলল, ‘এইহানে কইলাম তেলিচোরা আর ছারপোকা আছে। ডিস্টাপ অইতে পারে।’
ভাবটা এমন যেন ফাহিম তার ঘাড়ের ওপর খাড়া আপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। খসাতে পারলে কার্টুন ছবিটা ভালো করে দেখা যায়।
ফাহিম বলল, ‘আচ্ছা, এখানে বড় কেউ নেই?’
এবার একটু নড়েচড়ে উঠল কিশোর। বলল, ‘চাচাজানে তো চা খাইত গেছে।’
কিশোরের কথা শেষ হতে না হতে গলা খাঁকারি শোনা গেল বাইরে। পরমুহূর্তে ঘরে ঢুকল এক মাঝবয়সী লোক। খাটো করে লুঙ্গি পরা। গায়ে ফতুয়া। এসেই কিশোরকে সে দাবড়ি মারল, ‘ওই ছেমড়া, আবার তুই বিলাই (টম) আর বাইতানের (জেরি) কেরামতি দেখতাছস? তোরে না কইছি এইগুল্যান একদম দেখবি না! এইগুল্যান দেইখা দেইখাই তো তুই বাইতানের মতো ফিচলা অইছস!’
কিশোর চট করে কার্টুন ছবি বদলে খবরের চ্যানেল দেয়। এর মধ্যে ফাহিমের দিকে নজর গেছে লোকটার। খানিকটা দ্বিধা নিয়ে সে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনে কেডায়? কী চান এইখানে?’
‘আমি ঢাকা থেকে এসেছি। রাত হয়ে গেল তো। তাই একটু থাকা দরকার।’
‘এইহানে থাকবেন!’
ফাহিমের চেহারাসুরত আর বেশভূষা দেখে বিশ্বাস হতে চাইছে না তার।
ফাহিম বলল, ‘এ ছাড়া আর উপায় কী? এই রাত করে কোথায় যাব, বলুন? এখানে আমার চেনাজানা বলতে তো কেউ নেই।’
এরপরও উসখুস করতে লাগল লোকটা। ফাহিম বলল, ‘এখানে আমি থাকলে কোনো অসুবিধা আছে?’
‘না, মানে এইহানে তো বুঝেনই, আমাদের বিছানা-বালিশ তেমন ভালা না। আপনের থাকতে কষ্ট অইব।’
‘ও কিছু না। একটা রাতই তো! কাটিয়ে দেব কোনোরকমে।’
এক রাতের ভাড়া শুনে ফাহিম অবাক। মাত্র ৫০ টাকা! ফাহিম ১০০ টাকার একটা নোট দিয়ে বলল, ‘আপনি পুরোটাই রাখুন।’
লোকটা এবার কৌতূহলী হলো, ‘আপনে আসলে যাইবেন কই?’
‘পিটুলি গ্রাম।’
‘কন কী!’ আঁতকে ওঠে সে।
ফাহিম হেসে বলল, ‘ভয় পেলেন নাকি?’
‘না, মানে, এই সময় ওই গ্রামে কেউ যায় না।’
‘কেন, বলুন তো?’
‘এই সব রাইত কইরা কইতে নাই।’
ফাহিমের সঙ্গে আর একটি কথাও বলল না লোকটা। কিশোরকে তাড়া দিল, ‘ওই ছেমড়া, যা, তাইনেরে দোতলায় নিয়া বিছানা পাইতা দে।’
কিশোরের নাম গজা। ওর সঙ্গে কাঠের নড়বড়ে একটা সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় চলে এল ফাহিম। নামেই দোতলা। সোজা হয়ে দাঁড়ানো যায় না। হার্ডবোর্ডের সিলিংয়ে মাথা ঠেকে। লম্বু ফাহিমকে কুঁজো হয়ে দাঁড়াতে হলো। দুই প্রান্তে দুটো ষাট ওয়াটের বাল্ব জ্বলছে। টিমটিমে আলো। এ আলোতে মোটেও অভ্যস্ত নয় ফাহিম। চোখে লাগছে। এর চেয়ে অন্ধকারই ভালো।
আটটা চৌকি পাতা আছে এখানে। চারটাতে চারজন কাঁথা মুড়ি দিয়ে লাশের মতো পড়ে আছে।
গজা কোণের একটা চৌকি দেখিয়ে বলল, ‘ওইটা আপনের। বেশি লড়াচড়া কইরেন না। পায়া নরম, ভাইঙা যাইতে পারে।’
বিছানা-বালিশ পেতে ভাঁজ করা একটা কাঁথা রেখে চলে গেল গজা। পান-তামাকের মিশেল একটা গন্ধে ভরে আছে ঘরটা। সিলিংয়ের ওপর কিসের একটা খচরমচর। আর যা-ই হোক, এই পরিবেশ ওর থাকার মোটেও উপযোগী নয়।
রাতটা বাইরে কোথাও বসে কাটালে কেমন হয়—ভাবল ফাহিম। এমন সময় কাঠের সিঁড়িতে পায়ের শব্দ। কাঠির মতো একটা লোক উঠে এল। তিরিশের ওপরে হবে বয়স। গায়ে ঢলঢলে একটা শার্ট। পরনে রং চিটে যাওয়া প্যান্ট।
ফাহিম দেখে কিছুটা অপ্রস্তুত হলো যেন। কয়েক সেকেন্ড বিমূঢ় থেকে মৃদু কণ্ঠে সালাম দিল। মাথা ঝাঁকাল ফাহিম।
রাজ্যের জড়তা নিয়ে লোকটা জানতে চাইল, ‘এইহানে কি থাকতে আইছেন, ভাই?’
‘তা ছাড়া আর কী কাজে আসব, বলুন।’
‘এইহানে থাকতে পারবেন না। এইডা তো গোয়াইল ঘরের থাইকাও খারাপ।’
‘তা আপনি থাকতে এসেছেন যে?’
হে হে করে হাসল লোকটা। বলল, ‘আমগোর কথা বাদ দেন। আমরা হইলাম আউলা-ঝাউলা মানুষ। যেইহানে রাইত, ওইহানেই কাইত।’
‘আপনি করেন কী?’
‘এই গট বেচি।’
‘গট?’
‘এই ছাগল আরকি। বিভিন্ন জায়গা থিকা ছাগল আইনা এইহানে বিক্রি করি।’
‘ও, আপনি ছাগল ব্যবসায়ী?’
এ সময় নিচে আবার ছাগলের ডাক শোনা গেল।
ফাহিম জিজ্ঞেস করল, ‘নিচের ওই ছাগলগুলো আপনার?’
‘ঠিকই ধরছেন। আপনে খুব ইনটেনজেন্ট, ভাই। জবর বুদ্ধি! দশটা ছাগল আনছিলাম। তিনটা বেচতে পারি নাই।’
সাধে কি আর মানুষকে মাঝেমধ্যে ছাগলের সঙ্গে তুলনা করা হয়? মনটাই খারাপ হয়ে গেল ফাহিমের। সিলিংয়ের ওপর কি যেন আবার খচরমচর করছে!
ফাহিমের মনোভাব টের পেয়ে লোকটা বলল, ‘এইগুলা জালালি কবুতর। চালের
ফাঁক দিয়া সিলিংয়ে ঢুকছে। ওইহানেই থাকে ওরা। বাচ্চা ফুডাইয়া দল ভারী করছে। রাইতে এই আজাবটা একটু সইতে অইব। আমগোর কুনো সমস্যা হয়
না। সারা দিন গাধার মতো খাটি তো রাইতে বলদের মতো ঘুমাই। কিছুই টের পাই না।’
‘আচ্ছা, রাতটা বাইরে কোথাও কাটানো যায় না? ধরুন, কোথাও চেয়ার পেতে বসে রাতটা কাটিয়ে দিলাম?’
‘এ্যাঁ, কন কী! রাতভর বইসা থাকবেন? তা থাকবেন কী কইরা? এইটা বাজার না? বারো বাটপারের আনাগোনা। কেউ আইসা আপনেরে কোন ফাঁদে ফালাইব, তার ঠিক আছে? তা ছাড়া রাইতে বিষ্টিও অইতে পারে। এর থাইকা রাইতটা কোনোমতে এইহানেই পার কইরা দেন।’
এই বলে লোকটা একটা চৌকিতে গিয়ে শুয়ে পড়ল। কাঁথা টেনে দিল মাথা পর্যন্ত। মাত্র এক মিনিটেই ঘুমিয়ে পড়ল সে। মিহি সুরে নাক ডাকছে তার।
ফাহিমও চেষ্টা করল বিছানায় যেতে। কিন্তু কিছুতেই পারল না। কাঠের মেঝেতে নেংটি ইঁদুর ছোটাছুটি করছে। এর মধ্যে ঘুমানোর কথা ভাবাই যায় না।
কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এল ফাহিম। টিভি বন্ধ হয়ে গেছে। চৌকিতে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে গজা। তবে ঘুমায়নি। আঙুল দিয়ে টুক টুক করে তবলা বাজাচ্ছে।
ক্যাশ খুলে টাকা গুনছে গজার মনিব। এ সময় অন্য কারও আসাটা মোটেও পছন্দ করে না সে। বিরক্তি চেপে সে বলল, ‘কোনো সমস্যা?’
‘না, মানে বলছিলাম কী, একটা চেয়ার নিয়ে বাইরে বসে যদি রাতটা কাটাই, কোনো আপত্তি আছে?’
‘আছে। এইহানে যারা থাকতে আসে, বেশির ভাগই ব্যবসায়ী। সবার লগে নগদ টেকা থাকে। দরজা খোলা পাইয়া ডাকাইতের দল যদি ঢুইকা পড়ে, দায় লইব কেডায়?’
কথা তো ঠিকই। সে রকম কিছু ঘটলে দায়টা ঠিক ফাহিমের ঘাড়েই চাপবে। ফাহিমের মুখে সহসা কোনো কথা জোগায় না।
লোকটা বলে, ‘আপনের সমস্যা ভালো কইরাই বুঝতাছি। এক কাম করি। দোতালায় একটা চেয়ার দেই। জানালার পাশে গিয়া বসেন। যতক্ষণ পারেন জাইগা থাকবেন। ঘুম আইলে বিছানায় যাবেন। আরে, ঘুমাইলে তো মানুষ মরা। কখন রাইত কাইটা যাইব, টেরই পাইবেন না।’
কথাটা ফাহিমের মনে ধরে। মনিবের নির্দেশে গজা একটা প্লাস্টিকের চেয়ার দিয়ে আসে দোতলায়। বাইরে রাস্তার দিকে মুখ করা তিনটা জানালা আছে। পোশাক পাল্টে একটা জানালার ধারে চেয়ার পেতে বসে পড়ে ফাহিম। জানালাটা ছোট। তবে বাতাস পাওয়া যায়। পুরোনো কাপড়ের একটা ময়লা পর্দা পতপত করে উড়ছে। পর্দাটা এক পাশে টেনে দিল ফাহিম।
এর মধ্যে আরেক পশলা বৃষ্টি হয়েছে। আকাশ এখন পরিষ্কার। ভরা চাঁদের জোছনায় ফকফকা চারদিক। সামনে একটা ঝাঁকড়া জামগাছ। চাঁদের দুধধোয়া আলোতে চিকচিক করছে জামগাছের পাতা।
ফাহিমের এতক্ষণে খেয়াল হলো, প্রায় ঘণ্টা তিনেক মোবাইল ফোনটা ব্যবহার করেনি। কোনো কলও আসেনি। পকেট থেকে মুঠোফোন যন্ত্রটা বের করে ও। অন করে দেখে এক গাদা মিসড কল জমে আছে। বাবা আর মা তো ফোন করেছেনই, কয়েকজন চেনাজানা মানুষও করেছে। মায়ের কলটাই বেশি। সাইলেন্ট করে রাখায় রিং বাজেনি।
সবার আগে মাকেই কলব্যাক করে ফাহিম। মাত্র একবার রিং বাজতেই ধরলেন মা। ধরেই ঝাড়ি, ‘কেমন আক্কেল তোর, বল তো! কী কথা ছিল—ভুলে গেছিস? প্রতি ঘণ্টায় তোর একবার করে ফোন করার কথা না? আমরা তো চিন্তায় অস্থির। তোর বাবার প্রেশার উঠে গেছে। যখন ছোট ছিলি, তখন বেশ ছিলাম। এখন বড় হয়ে হাড়ে-মাংসে জ্বালাচ্ছিস!’
একের পর এক মায়ের নানা প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে হাঁফ ধরে গেল ফাহিমের। কোথায় আছে, কখন পৌঁছেছে, কী খেয়েছে, কোথায় থাকছে, কবে ফিরবে—খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব কথা বের করে নিলেন মা। এরপর আবার বাবার জেরার মুখে পড়তে হলো। তাঁর এক কথা, ‘হয়েছে, বাবা, আর অ্যাডভেঞ্চারের দরকার নেই। কালই তুই ফিরে আয়!’
বাবা-মায়ের এই ব্যাকুলতা দেখে মনটা নরম হয়ে গেল ফাহিমের। ভাবল, নাহ্, এত কাঠখড় পুড়িয়ে এই অ্যাডভেঞ্চারের আর দরকার নেই। সকালে উঠেই ঢাকার দিকে রওনা দেবে ও।
রাত কত হয়েছে কে জানে? ক্লান্তিতে ভেঙে আসতে চাইছে শরীর। কিন্তু বিছানার দিকে তাকাতেই মন টানে না।
জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকায় ফাহিম। যত দূর যায়, দৃষ্টি মেলে দেয়। আকাশ ভেঙে জোছনা নেমেছে। সামনের বৃষ্টিধোয়া পথটা ফকফক করছে। মনটা কেমন উদাস হয়ে যায় ফাহিমের। এই জোছনার ভেতর বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছা করে। মাইলের পর মাইল কেবল হাঁটবে আর হাঁটবে।
হঠাত্ দুপদাপ ভারী কিছুর শব্দ। জামতলে ঘন ছায়ার ভেতর কী যেন নড়ছে! ভালো করে তাকাতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। বিশাল এক কালো ষাঁড়। যেন ছোটখাটো একটা হাতি। মাথা উঁচু করে এদিকে তাকিয়ে আছে। যেন একদৃষ্টে ফাহিমকে দেখছে। আশ্চর্য, এত রাতে পাহাড়ের মতো ষাঁড়টা এল কোত্থেকে? কোনো গোয়াল থেকে বাঁধন ছিঁড়ে এসেছে?
কোনো গরু ব্যবসায়ীর ষাঁড়ও হতে পারে এটা। হয়তো তাকে ফাঁকি দিয়ে চলে এসেছে। কাউকে ডেকে বলবে নাকি?
কিন্তু ষাঁড়টা ফাহিমকে সে সুযোগ দিল না। উল্টো দিকে ঘুরে ছুটতে শুরু করল। গুড়গুড় করে মাটি কেঁপে উঠল। টিনের পুরো দোতলা ঝনঝন করতে লাগল। ষাঁড় তো নয়, যেন এক আস্ত পাহাড় ছুটে চলেছে। শিগগিরই সামনের খোলা পথটায় গিয়ে পৌঁছাল ষাঁড়টা। চাঁদের আলো পিছল খাচ্ছে ওটার গায়ে। সোজা পুব দিকে ছুটে চলে গেল ষাঁড়টা।
অনেকক্ষণ ঝিম মেরে বসে রইল ফাহিম। তারপর কখন যে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেল, টেরই পেল না।
সকালে বেশ বেলা করেই ঘুম ভাঙল ফাহিমের। তা আবার গজার ডাকে। উঠে দেখে, যে বিছানা দেখে নাক সিটকেটে, সেটাতেই ঘুমিয়েছে।
সেই ষাঁড়ের কথা মনে পড়তেই নিচে নেমে এল। জামতলে গিয়ে দেখে, নরম মাটিতে গরুর খুরের বড় বড় ছাপ ফুটে আছে। সেখানে আবার ছোপ ছোপ রক্ত। কিছুদূর গিয়ে রক্তরেখা মিলিয়ে গেছে। এর রহস্য কী, কে জানে?
হাত-মুখ ধুয়ে তৈরি হয়ে নিল ফাহিম। রাতের সেই হোটেলে গিয়ে নাশতা সেরে নিল। এবার পিটুলি গ্রামে যাওয়ার পালা। বাজারে রিকশা, ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক, রিকশাভ্যান—সবই আছে, কিন্তু কেউ ওই গ্রামে যাবে না। বাজার থেকে গ্রামটা অবশ্য বেশি দূরে নয়। দুই কিলোমিটারের মতো হবে। কাজেই হেঁটে যাওয়া যাবে।
বেয়াড়া ধরনের এক ইজিবাইকচালক ফাহিমকে জিজ্ঞেস করল, ‘এই সময় ওই গেরামে মরতে যাইবেন ক্যান, ভাই? আইজ তো ওই গেরামে কেউ যাইব না। উল্টা ওই গেরাম থিকা সব মানুষ এই দিকে চইলা আসব।’
ফাহিম এ কথার জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা ভাই, বলুন তো ভয়টা কিসের? এ রহস্য জানতেই আমি ওই গ্রামে যাচ্ছি।’
চালক হাতজোড় করে বলল, ‘দোহাই আপনের, ভুলেও এই কাম কইরেন না। গেলে আর ফিরতে পারবেন না। আইজকার দিনটা পার হোক। কাইল সকালে যাইবেন। আমি আপনেরে দিয়া আমুনে। এহনে ক্ষান্ত দেন।’
ইজিবাইকচালকের কথায় ফাহিমের অজানাকে জানার নেশা আরও চাগিয়ে উঠল। ঢাকায় ফিরে যাবে বলে রাতে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সেটা ভুলে গেল একদম। হেঁটেই পিটুলি গ্রামের দিকে রওনা হলো ও। হাঁটতে লাগল সোজা পুব দিকে।
পিটুলি গ্রাম থেকে দলে দলে মানুষ আসছে। সবার চোখমুখ শুকনো। কোথাও দাঙ্গাহাঙ্গামা শুরু হলে যেমন বাড়িঘর ছেড়ে মানুষ পালায়, তেমনি একটা ব্যাপার যেন। একমাত্র ফাহিমই বিপরীত দিকে যাচ্ছে। ওকে এভাবে যেতে দেখে অনেকেই অবাক হলো। কিন্তু পেরেশান থাকায় কেউ কিছু জানতে চাইল না।
গ্রামে ঢোকার মুখে এক বুড়ো পথ আটকাল ফাহিমের। বলল, ‘বিষয়ডা কী, বাবা? আপনারে তো এই দিককার মানুষ বইলা মনে হয় না?’
‘জি, আপনি ঠিকই বলেছেন। আমি ঢাকা থেকে এসেছি।’
‘তা—ওই দিকে যান কই?’
‘মিরবাড়িতে যাব।’
‘মাথা খারাপ হইছে! আইজ তো ওই বাড়ির নাম নেওয়াও বিপদ। যান, অক্ষনই ফিরা যান।’
‘এত কষ্ট করে যখন এসেছি, মিরবাড়ির রহস্য না জেনে যাচ্ছি না।’
বুড়ো একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তারপর আবার হাঁটা দিল।
ফাহিমও পা বাড়াবে, অমনি পেছন থেকে ডাক, ‘একটু খাড়ান, বাবা!’
এ ডাকে এতটাই মমতা, সাড়া না দিয়ে পারল না ফাহিম। ঝোলা থেকে ছোট্ট একটা মোড়ক বের করল বুড়ো। ফাহিমের হাতটা সস্নেহে টেনে নিয়ে গুঁজে দিল জিনিসটা। চোখে চোখ রেখে বলল, ‘এই বুড়ার অন্তত এই কথাটা রাখেন, বাবা! এইটা খুইলা দেখার দরকার নাই। পকেটে রাখেন। যতক্ষণ এইটা আছে, আশা করি কোনো বিপদ হইব না।’
এই বলে আর দাঁড়াল না বুড়ো। তার কথায় যেন জাদু আছে। এড়াতে পারল না ফাহিম। প্যান্টের পকেটে রেখে দিল মোড়কটা। তারপর যেদিকে যাচ্ছিল, সেদিকেই পা বাড়াল।
খানিক পর পিটুলি গ্রামে ঢুকে পড়ল ফাহিম। একসময় খেয়াল করে দেখে, সে ছাড়া আর কোনো মানুষ নেই আশপাশে। বাতাস যেন থমকে আছে। গাছগাছালিতে একটা পাখি পর্যন্ত ডাকছে না। নিঝুম চারদিক। এবার সত্যিই গা ছমছম করতে লাগল। পা থেমে গেল ওর। দিন থাকতেই ফিরে যাবে নাকি?
এমন সময় ফাহিম দেখে, দূরে একটা লোক উপুড় হয়ে বসে কী যেন করছে। কৌতূহল দমাতে পারে না ও। এগিয়ে যায় সেখানে। একটা লোক কাস্তে দিয়ে একমনে ঘাস কেটে চলেছে। বড় বড় লম্বা ঘাস।
ফাহিম বলল, ‘আপনি রয়ে গেলেন যে?’
লোকটা মুখ তুলে ফাহিমের দিকে তাকাল। ফ্যাকাশে মুখ। ধূসর চোখ। ভাব দেখে মনে হলো, ওর কথা সে বুঝতে পারেনি।
ফাহিম বলল, ‘বলছিলাম যে আপনার বিপদের ভয় নেই?’
মৃদু হাসল লোকটা। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘কুনো বিপদ আমারে পায় না। ভয় পামু ক্যান?’
এবার তাকেই বুঝতে কষ্ট হচ্ছে ফাহিমের। ওর আমসি চেহারা দেখে হো হো করে হেসে উঠল লোকটা। এ যেন নিরেট কাঠের গুঁড়িতে করাতের খরখর। ফাহিমের গায়ের রোম দাঁড়িয়ে যায় ফড়ফড়।
লোকটা বলে, ‘আমি নিজেই বিপদের দুই কান্দে পা দিয়া চলি, ভাইজান। আমারে বিপদে পাইব ক্যামনে?’
লোকটাকে এবার আরও রহস্যময় মনে হয়। ফাহিম জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা, এখানে মিরবাড়িটা কোথায়?’
লোকটা সাগ্রহে বলল, ‘ও, আপনে মিরবাড়ি যাইবেন? আমি তো ওই বাড়িতেই থাকি। আহেন, আপনেরে নিয়া যাই।’
কেটে স্তূপ করে রাখা লম্বা ঘাসগুলো বড়সড় একটা আঁটিতে বাঁধল সে। সেটা মাথায় তুলে ফাহিমকে পিছু পিছু যেতে ইশারা করল। যেতে যেতে পরিচয় বিনিময় হলো। লোকটা জানাল, তার নাম রইজুদ্দিন। মিরবাড়ির অনেক দিনের পুরোনো রাখাল। পুরোনো দিনের আরও অনেক গল্প করল রইজুদ্দিন। এসবের মধ্যে অবশ্য রহস্যের কিছু পেল না ও।
মিনিট দশেক পর রইজুদ্দিনের সঙ্গে সেকেলে একটা ফটকের সামনে পৌঁছাল ফাহিম। এটাই মিরবাড়ি। ভেতরে ঢুকতেই মস্ত উঠান। ১০০ মিটার দৌড়ের আয়োজন করা যাবে। উঠানের পর অনেক দিন আগের একটা দালান। দেখতে অনেকটা পাকা স্কুলঘরের মতো। সামনে টানা বারান্দা রেখে একসঙ্গে বেশ কয়েকটা ঘর। দালানের হলদে রঙে প্রাচীন ঐতিহ্যের ছাপ।
সারা বাড়ি সুনসান। মানুষ দূরে থাক, একটা মুরগি পর্যন্ত কক্-কক্ করছে না। সবাই চলে গেছে, কিন্তু রইজুদ্দিন যায়নি কেন?
ঘাসের বোঝাটা উঠানের এক পাশে ধপাস করে ফেলল রইজুদ্দিন। ফাহিম খেয়াল করল, এত বড় একটা বোঝা নিয়ে আসার পরও রইজুদ্দিনের শরীরে কোনো ঘাম নেই। রইজুদ্দিন বলল, ‘এইবার বলেন, মিরবাড়িতে কী জন্য আইছেন?’
‘এখানে এসেছি রহস্যের টানে। আচ্ছা, বলুন তো, আজকের দিনে এই বাড়িতে কী ঘটে? আর গ্রামের মানুষই বা এক রাতের জন্য অন্য কোথাও যায় কেন?’
‘ও, এই কথা! এই সামান্য কিচ্ছাডা জানতে এত দূর! শুনেন তাইলে। অনেক দিন আগে এই গ্রামে একটা ষাঁড় আইছিল। মস্ত কুচকুচা কালা ষাঁড়! কোত্থিকা যে আইল, কেউ জানে না। কেউ কয় সীমান্ত পার অইয়া আইছে, আবার কেউ কয় এইটা ষাঁড় না, অন্য কিছু।’
‘হুঁ, তারপর।’
‘ষাঁড়টা যহন-তহন এরে ওরে দাবড়াইত। খেতের শস্য খাইয়া সাফ করত। তারপর একদিন—’
‘একদিন কী?’
‘মির সাবের হুকুমে গেরামের সবাই মিলা ফাঁদে ফালাইয়া ষাঁড়টারে আটকাইল। ঠিক হইল ওইটার মাংস দিয়া গ্রামের মানুষ জিয়াফত খাইব। পিকনিক আরকি। মিরসাব নিজে ছুরি নিয়া তৈয়ার। বিশ্বাস করবেন না, ভাই, গলা কাটা ষাঁড়টা সবাইরে ঝাঁকুনি দিয়া দিব্যি খাড়া হইয়া গেল! দৌড়াইয়া গেল খেতের দিকে। তারপর হাওয়া!’
‘তারপর?’
‘এই ঘটনা ঘটার পর থিকা পরতি বছর এই দিনে ষাঁড়টা এই গেরামে আসে। আকাশ ফাটা জোছনায় যহন চারদিক ভইরা যায়, ষাঁড়টা তহন দাবড়ায় গেরামের রাস্তায়। যে সামনে পড়ে, তার জীবন যায়।’
রইজুদ্দিনের কথা শেষ। ফাহিমের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে সে। বড়ই অস্বস্তিকর।
ফাহিম বলল, ‘আজ কি সেই দিন?’
‘জে, ভাইজান। আপনের পায়ে পড়ি, দিন থাকতে ফিরা যান। রাইত অইলে...’
কথা শেষ না করে থেমে যায় রইজুদ্দিন। গলা শুকিয়ে কাঠ ফাহিমের। রইজুদ্দিনের কাছে পানি খেতে চাইল ও। ওকে রেখে ভেতরে চলে গেল সে।
ফাহিমের খেয়াল হলো, রইজুদ্দিন এখনো এ বাড়িতে কেন পড়ে আছে—এটা জানা হয়নি এখনো। সে থেকে যাওয়ার কারণটা কী?
কিন্তু রইজুদ্দিন ফিরে আসার নাম নেই। ফাহিম গলা চড়িয়ে কয়েকবার ডাকল তাকে। কোনো সাড়া নেই।
রইজুদ্দিনের শেষ কথা ফাহিমের কানের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে। কাল রাতে জামগাছের নিচে যে বিশাল ষাঁড়টাকে দেখেছে, সেটাই কি এই যমদূত? ধুকপুক বেড়ে যায় ফাহিমের। ভেতর থেকে কে যেন তাড়া দিচ্ছে, ‘পালাও, পালাও, শিগগির পালাও!’
মিরবাড়ি থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসে ফাহিম। জোর কদমে পা চালায় ও। এবার পশ্চিম দিকে ছুটে চলে ও। সন্ধ্যা নামার আগেই ওই বাজারে পৌঁছাতে হবে। পারলে আজই ঢাকার দিকে রওনা দেবে।
এর মধ্যে আকাশের চেহারা বদলে গেছে। সাদা মেঘের জায়গা দখল করেছে ছাই মেঘ। দেখতে দেখতে তা ঘন কালো হয়ে গেল। এ যেন কার্তিক মাস নয়, ভরা আষাঢ়।
খানিক পর ঝেঁপে বৃষ্টি নামল। নিমেষে ফাহিম ভিজে একেবারে নেয়ে উঠল। কাঁচা মাটির সড়ক প্যাঁচপেঁচে হয়ে গেল কাদায়। হাঁটাই দায়। ঝাঁকড়া একটা কড়ইগাছের নিচে গিয়ে দাঁড়াল ও।
ঘণ্টা খানেক পর বৃষ্টি থামল ঠিকই, কিন্তু মেঘ কাটল না। গাছতলা থেকে বেরিয়ে ধাঁধায় পড়ে গেল ফাহিম। এখান থেকে পশ্চিম দিকে পথ চলে গেছে তিনটা। রইজুদ্দিনের সঙ্গে আসার সময় বক বক করায় ফিরে যাওয়ার পথটা চিনে রাখা হয়নি। কাউকে যে জিজ্ঞেস করবে, সে উপায় নেই। এখন কোন দিকে যাবে ও?
শেষে অনেকটা আন্দাজের ওপর ভর করেই একটা পথ বেছে নিল ফাহিম। কিন্তু কাদাভরা রাস্তায় হাঁটতে খুব কষ্ট হচ্ছে। কাদা লেগে ভারী হয়ে গেছে কেডস। আর পথেরও যেন শেষ নেই।
হঠাত্ মনে হলো, হ্যাঁ, ওর সঙ্গে মুঠোফোন তো আছে। এখানকার থানার ফোন নম্বরটা নিয়ে রেখেছে ও। সেখানে সাহায্য চাইলে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। কিন্তু সে গুড়ে বালি। বৃষ্টির পানি ঢুকে অচল হয়ে গেছে যন্ত্রটা। এতক্ষণে মনে হলো, বাবা-মায়ের কথা না শুনে এই গোঁয়ার্তুমি করাটা ঠিক হয়নি। মহা ভুল হয়েছে!
হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর চলে এল ফাহিম। এর মধ্যে দুপুর গড়িয়ে গেছে। খিদেয় চোঁ চোঁ করছে পেট। ক্লান্তিতে ভেঙে আসতে চাইছে শরীর। কিন্তু গন্তব্যের দেখা নেই।
সহসা আশার আলো দেখতে পেল ফাহিম। দূরে একটা দোকান দেখা যাচ্ছে। ওখানে গেলে নিশ্চয়ই সাহায্য পাওয়া যাবে।
পথের ধারে একচিলতে জায়গায় একটা দোকান। ঝাঁপের নিচে বাঁশের বেঞ্চিতে বসে আছে দুজন। ফাহিমকে দেখে কী বলে যেন ফিসফাস করল তারা। ফাহিম দমে গেল। এদের ভাবগতিক সুবিধার নয়। বিপদে সহায়তা না করে বরং সুযোগ নিতে পারে।
ফাহিম দোকানিকে বলল, ‘খাবারটাবার কিছু আছে, ভাই?’
ঝাঁপের নিচে বসা লোক দুজন মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। দোকানি বলল, ‘কী খাইবেন?’
ফাহিম শুকনো গলায় বলে, ‘মুড়িটুড়ি আছে?’
বেশ পুরোনো একটা বাটিতে করে মুড়ি দিল দোকানি। মুখে দিতেই ফাহিমের পেটে একটা ঘুঁটা দিল। মেটে মেটে ছাতলার গন্ধ। কত দিন আগের কে জানে? বেঞ্চিতে বসা লোক দুজন বেশ মজা পাচ্ছে। তাদের মুখে চাপা ফ্যাসফেসে হাসি।
দোকানি বলল, ‘আপনে কইথন আইছেন, ভাই?’
ফাহিম ভাবল, ঢাকা থেকে আসার কথাটা বলা ঠিক হবে না। মিরবাড়ির কথা বললে এরা ওকে সমঝে চলতে পারে। তাই বলল, ‘মিরবাড়ি থেকে।’
দোকানিও একই ঢঙে হাসল। বলল, ‘ওইহানে কী করতে গেছিলেন? ওই বাড়িতে তো এহন কেউ নাই!’
‘না, আছে। রইজুদ্দিন ভাইয়ের সঙ্গে তো একটু আগে কথা বলে এলাম।’
বেঞ্চিতে বসা দুজন এবার কিট্ কিট্ করে হাসল। বলল, ‘কী যে কন না! রইজুদ্দিনরে পাইবেন কই? হে তো কবেই মইরা গেছে!’
‘কী বলছেন! আমি তো কথা বলে এলাম!’
বেঞ্চিতে বসা দুজনের একজন দাঁড়িয়ে গেল। গায়ের শার্ট খুলে বুকটা উদোম করল। সেখানে পাশাপাশি দুটো কালো গভীর গর্ত। দাঁত বের করে সে বলল, ‘কালা গরুর এমন গুঁতা খাইলে কেউ জ্যান্ত থাকে!’
মাথায় বোঁ করে পাক দিয়ে উঠল ফাহিমের। পাঁই করে উল্টো দিকে ঘুরে ছুটতে শুরু করল। পেছনে কিট্ কিট্ হাসি চলতেই থাকল। ছুটতে ছুটতে বার দুয়েক আছাড় খেল ফাহিম। তবু থামল না। এ মুহূর্তে নিরাপদ একটা আশ্রয়ের বড্ড দরকার।
কখন যে সন্ধ্যা নেমে এল, টেরও পেল না ফাহিম। তবু ভালো যে মেঘ কেটে গেছে। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। চরাচর আলোতে হাসছে। এই আলো ফাহিমের জন্য এখন এক বিপত্সংকেত। এমন সময়ই বের হয় সেই কালো ষাঁড়।
সামনেই একটা বাড়ি দেখা যাচ্ছে। ওখানে নিশ্চয়ই আশ্রয় মিলবে।
ছুটতে ছুটতে ওই বাড়িতে ঢুকে পড়ল ফাহিম। কারও কোনো সাড়া নেই। ছবির মতো সব স্থির। তবে ঘরদোর কেমন চেনা চেনা লাগছে। বিশাল দালানের পাশ দিয়ে সরু পথটা পেরিয়ে বেশ বড় একটা উঠানে চলে এল ও।
শিগগিরই ফাহিম টের পেল—এটা সেই মিরবাড়ি! পেছন দিয়ে ঢুকেছে বলে এতক্ষণ টের পায়নি। ওই তো, উঠানে রইজুদ্দিনের রেখে যাওয়া ঘাস খাচ্ছে সেই কালো ষাঁড়। ছোটখাটো একটা পাহাড় যেন। পিছু হটে পালাতে চাইল ফাহিম। কিন্তু ষাঁড়টা ওকে দেখে ফেলেছে। অজান্তেই প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকে গেল ওর। খামচে ধরল বুড়োর দেওয়া সেই ছোট্ট মোড়কটা।
অলংকরণ: মামুন হোসাইন