শক্তিমান লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস

লেখালেখি তো অনেকেই করেন, কিন্তু সবাইকে কি মনে রাখে মানুষ? আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে কিন্তু মনে রাখবে। অল্প কয়েকটি বই লিখেছেন তিনি, কিন্তু তাতেই এমন কিছু আছে যে বারবার ফিরতে হয় তাঁর কাছে।

কী এমন ছিল তাঁর রচনায় যে বারবার ফিরতে হবে তাঁর কাছে?

এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে একটু বলে নিই, সমাজতন্ত্রের দিকেই ছিল তাঁর ঝোঁক। সাম্যবাদী দুনিয়ার জন্যই ছিল তাঁর আর্তি। একটা সময় ছিল, যখন পুঁজিবাদ আর সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের মধ্যে ভাগ হয়ে গিয়েছিল পৃথিবী। উজ্জ্বল সাহিত্যিকদের অনেকেই সমাজতন্ত্রের প্রতি ছিলেন বিশ্বস্ত। সমাজের সূক্ষ্ম পরিবর্তনগুলো তাঁরা ধরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন পাঠকের চোখে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের লেখায়ও সেটা ফুটে উঠেছে।

দুটি উপন্যাস আছে তাঁর। চিলেকোঠার সেপাই আর খোয়াবনামা নামে। অনেকেই মনে করেন, বাংলা সাহিত্যের সেরা উপন্যাসের তালিকায় এ দুটি উপন্যাসই থাকবে। কী নিয়ে উপন্যাস দুটি, একটু জেনে নিই। চিলেকোঠার সেপাই উপন্যাসটি লেখা হয়েছে উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে। তোমরা নিশ্চয়ই জানো, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের আগে ১৯৬৯ সালে এই বাংলায় গণ-অভ্যুত্থান হয়েছিল। সে সময় আন্দোলনে অংশ নেওয়া আসাদ ও মতিউরকে হত্যা করেছিল পাকিস্তানের বাহিনী। সেই গণ-অভ্যুত্থানে আইয়ুব খানের ক্ষমতা নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল। ইয়াহিয়া খানের হাতে ক্ষমতা দিয়ে তিনি দৃশ্যপট থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। সামন্তবাদ, পুঁজিবাদ, উপনিবেশবাদের ছায়া, আমলাতন্ত্র ইত্যাদির যে জগাখিচুড়ি ছিল পাকিস্তান, তাতে সাধারণ মানুষ যে ক্ষোভে জ্বলে উঠবে, তা ছিল অবধারিত। অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য গণমানুষের এত বড় আন্দোলন এ দেশের ইতিহাসে ঘটেনি আগে। কিন্তু সেই ক্ষোভকে বিপ্লবে পরিণত করার জন্য যে বিপ্লবী সংগঠনের দরকার, তা ছিল না।

খোয়াবনামা বড় উপন্যাস। মুসলিম লীগের পাকিস্তান আন্দোলনের পথ ধরে ২০০ বছর পিছিয়ে গিয়ে অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন ইলিয়াস। ইংরেজবিরোধী সংগ্রাম, ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, ভারতবিভক্তি উঠে এসেছে সে উপন্যাসে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, শত শত বছর ধরে মুসলমান ও হিন্দু সম্প্রদায় যেভাবে তাদের ধর্মীয় পরিচয় অক্ষুণ্ন রেখেই সম্প্রীতি বজায় রেখেছিল, সে কথা উপন্যাসের নানা চরিত্রের পথ ধরে উঠে এসেছে।

পাঁচটি গল্পের বই আছে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের। অন্য ঘরে অন্য স্বর, খোঁয়ারি, দুধভাতে উত্পাত, দোজখের ওম, জাল স্বপ্ন স্বপ্নের জাল নামে। সংস্কৃতির ভাঙা সেতু নামে তাঁর প্রবন্ধের বইটিও খুব উঁচুমানের।

আখতারুজ্জামান মোহাম্মদ ইলিয়াস তাঁর পুরো নাম। তিনি জন্মেছিলেন ১৯৪৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি গাইবান্ধা জেলার গোটিয়া গ্রামে। সেটা ছিল তাঁর মামার বাড়ি। তাঁর ডাক নাম মঞ্জু। পৈতৃক বাড়ি বগুড়া জেলায়। ১৯৯৭ সালের ৪ জানুয়ারি তিনি মারা যান।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বেশ কয়েকটি পুরস্কার পেয়েছেন। সেগুলো হলো হুমায়ুুন কবির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭৭), বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮৩), আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৭), আনন্দ পুরস্কার (১৯৯৬), সাদাত আলী আখন্দ পুরস্কার (১৯৯৬), কাজী মাহবুবুল্লাহ স্বর্ণপদক (১৯৯৬) ও একুশে পদক (মরণোত্তর) (১৯৯৯)।

সৌজন্যে: গুণীজন ট্রাস্ট

প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল