অন্তু আর কদমগাছ

‘অন্তু, অন্তু, অন্তু...’

ঘুম ঘুম চোখে অন্তু বোঝার চেষ্টা করে এত রাতে কে ওকে ডাকছে।

চোখ না খুলেই আবার শোনার চেষ্টা করে অন্তু, ‘কই, কোনো শব্দ তো নেই! আর এত রাতে কেই-বা ডাকবে ওকে?’

ঘুমে চোখ বুজে আসার মুহূর্তে আবার শোনা গেল, ‘অন্তু, অন্তু, অন্তু...’

হুম এবার পরিষ্কার শোনা গেছে। নিচু গলায় খানিকটা সময় নিয়ে কেউ একজন ডাকছে ওকে। না, বিষয়টা তো দেখতেই হচ্ছে।

অন্তুর বয়স আট। ওর আম্মু তো প্রায়ই বলেন, ‘আমার অন্তু বাবা তো অনেক বড় হয়ে গেছে। এখন একা একাই ঘুমাতে পারে।’

একা ঘুমাতে যে অন্তুর একদমই ভয় করে না তা কিন্তু নয়। তবে বড় হওয়ার নানা সুবিধাও আছে। এই যেমন ধরো চাইলেই ইচ্ছেমতো আইসক্রিম, পিত্জা, বার্গার খাওয়া যায়। এসবের জন্য বড় হওয়ার খানিকটা অভিনয় করা যেতেই পারে।

খাটের মশারিটা উঠিয়ে বাইরে বের হয় অন্তু। নিচু গলায় সেই কণ্ঠস্বরটা ডেকে চলেছে, ‘অন্তু, অন্তু, অন্তু...’

কণ্ঠস্বরটা অনুসরণ করতে করতে অন্তু হাজির হয় ওদের পেছনের বারান্দায়। চাঁদের আলোয় চারপাশটা আবছা-আবছা দেখা যাচ্ছে। ‘নাহ্, কাউকে তো দেখা যাচ্ছে না!’ চোখের সামনে শুধু বিশাল এক কদমগাছ। অনেক বছরের পুরোনো। বাবা বলেছেন, গাছটার চারা নাকি ওর দাদাই লাগিয়েছিলেন। অন্তুর দাদা মারা গেছেন গত বছর। দাদা-নাতির সম্পর্কটা ছিল বেশ মধুর। অন্তু তো দাদাকে ছাড়া কিছুই বুঝত না। আর দাদাও ছিলেন নাতির জন্য পাগল। সেই দাদা মারা যাওয়ার পর বেশ কষ্ট পেয়েছিল অন্তু। কয়েক দিন তো ঠিকমতো খাওয়াদাওয়াই করল না ও। দাদার অনেক প্রিয় ছিল এই কদমগাছ। প্রতি বর্ষায় কদম ফুলে ভরে যেত গাছটা। কিন্তু এবারের বর্ষা থেকে কেন জানি গাছটা শুকিয়ে যাচ্ছে। বাগানে গিয়ে গাছকে ধরে কয়েকবার জিজ্ঞেসও করেছে ও, ‘কদমগাছ, ও কদমগাছ, তুমি কেন শুকিয়ে যাচ্ছো? পেট ভালো তো তোমার? স্যালাইন খাবে?’

গাছেরা তো আর কথা বলতে পারে না। তাই কদমগাছটাও কোনো উত্তর দেয় না। শুধু চুপ করে থাকে। অন্তু নিজেই টুকটাক কথা বলে চলে আসে। নিয়ম করে কয়েক দিন ধরেই এই একতরফা কথোপকথন চলছে। এরই মধ্যে একদিন ওর বাবাও এসেছিলেন বাগানে।

‘কিরে অন্তু, কার সঙ্গে এভাবে কথা বলছিস?’

‘কেন, এই কদমগাছের সঙ্গে।’

‘কী বলছিস এসব? গাছের সঙ্গে কি কথা বলা যায়? গাছেরা তো কথা বলতে পারে না।’

বাবার এসব কথায় তেমন একটা কাজ হলো না। কদমগাছের সঙ্গে অন্তুর কথাবার্তা চলতেই লাগল। এসব দেখে চিন্তিত বাবা একদিন আম্মুকে বলেই বসলেন, ‘নাহ্, এই গাছ গাছ করে তোমার ছেলে তো পাগলই হয়ে যাচ্ছে। মরা গাছ ফেলে রেখে লাভ নেই। কেটে ফেলা দরকার।’

আম্মুও একমত, ‘দেখো যা ভালো মনে হয় তোমার। গাছটা কেটে ফেললে ও না আবার কষ্ট পায়!’

আব্বু-আম্মুর এই কথাবার্তা শুনেছে অন্তু। আর তাই তো বেশ চেষ্টাচরিত্র করছে গাছটাকে ভালো করে তোলার জন্য।

‘অন্তু, অন্তু, অন্তু...?’

এবার বেশ কাছ থেকে শোনা গেল কণ্ঠস্বরটা। খানিকটা ভয়ও পেল অন্তু। কাঁপা-কাঁপা গলায় বলল, ‘কে? কে ওখানে?’

‘আমি।’

‘আমিটা কে? সামনে আসো। তোমাকে তো দেখতে পাচ্ছি না।’

‘সামনে কী আসব, আমি তো তোমার সামনেই আছি।’

‘সামনে মানে? আমার সামনে তো একটা কদমগাছ।’

‘হ্যাঁ, ঠিকই তো আছে। এই কদমগাছই তো আমি।’

অন্তু এবার দারুণ অবাক হলো। চোখ দুটো বড় বড় করে বলল, ‘বলো কী, তুমি একটা গাছ? কিন্তু গাছেরা তো কথা বলতে পারে না। তুমি কথা বলছ কীভাবে?’

‘গাছেরা যে কথা বলতে পারে এটা মানুষেরা জানে না। কেননা আমরা তো সেভাবে তোমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করিনি। অবশ্য কখনো কখনো কিছু কিছু মানুষের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করেছি। তবে সেটা মানুষের মতো শব্দ করে নয়। শব্দ তৈরি করে কথা বলতে আমাদের ভালো লাগে না। তবে একসময় গাছেরা মানুষের মতো শব্দ করেই কথা বলত। সেটা লাখ লাখ বছর আগের কথা। মানুষ কথা বলতে শেখার পর থেকে আমরা শব্দ করে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছি। কিছু কিছু মানুষ আমাদের নিচে বসে এত কথা বলে যে কী আর বলব।’

‘তাহলে তোমরা এখন কথা বলো কীভাবে?’

‘গাছেরা এখন কথা বলে টেলিপ্যাথির মাধ্যমে। মানে পরস্পরের সঙ্গে মনে মনে কথা বলতে পারি। যেসব মানুষের এই বিশেষ ক্ষমতা থাকে, শুধু তারাই শুনতে পারে আমাদের কথা। তোমারও সেই ক্ষমতা আছে। আচ্ছা, জগদীশচন্দ্র বসুর নাম শুনেছ? মস্ত বড় বিজ্ঞানী। তিনি এমন এক যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন, যা দিয়ে তিনি আমাদের সঙ্গে কথা বলতে পারতেন।’

জগদীশচন্দ্র বসুর কথা অন্তু জানে। ওর দাদার কাছ থেকেই জেনেছে। গাছের যে প্রাণ আছে সে কথা তো তিনিই প্রথম জানিয়েছিলেন বিশ্ববাসীকে।

‘উনি না মাইক্রোওয়েভ আবিষ্কার করেছিলেন?’

‘সেই প্রযুক্তিকে আরও উন্নত করেই তো তিনি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। তবে সেটা তিনি গোপন রেখেছেন আমাদের অনুরোধেই। ভেবে দেখো তো এই যন্ত্র আবিষ্কার হলে কী যা তা অবস্থা হতো আমাদের। মানুষেরা আমাদের ফল-ফসলের পরিমাণ জানার জন্য পাগল করে ফেলত। বসুবাবু বড় ভালো মানুষ ছিলেন। তাঁর কল্যাণে অনেক মানুষই এখন আমাদের নিয়ে ভাবে। তারপরও দেখোই না কীভাবে আমাদের কেটে কেটে শেষ করে ফেলছে। তোমার বাবাও তো আমাকে কেটে ফেলতে চাইছেন।’

‘আব্বু তো মনে করেছেন তুমি বোধ হয় মরেই গেছো। তোমার হয়েছে কী বলো তো? কেন তুমি এভাবে শুকিয়ে যাচ্ছো?’

‘আসলে হয়েছে কি বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার শিকড়গুলো বাড়তে বাড়তে তোমাদের বাড়ির বাইরে চলে গেছে। রাস্তায় চলা খোঁড়াখুঁড়িতে সেসব শিকড়ের বেশ কিছু পড়েছে কাটা। ফলে আগের মতো খাবার জোগাড় করতে পারছি না। আর এ জন্যই তো অমন করে শুকিয়ে যাচ্ছি। তবে নতুন করে শিকড় ছাড়া শুরু করেছি। কিছুদিনের মধ্যে আবার আগের মতো সুস্থ হয়ে যাব। দেখো না তোমার বাবাকে বলে আমাকে কাটাকাটির হাত থেকে কোনোভাবে রক্ষা করতে পারো কি না?’

অন্তুর মন খুশিতে নেচে ওঠে, ‘সত্যিই তো? কথা দিচ্ছো তো?’

পরের দিন সকালে স্কুলে যাওয়ার পথে বাবাকে অন্তু বলল, ‘আব্বু, কদমগাছটাকে না কাটলেই কি নয়?’

‘কেন রে, গাছটা তো এমনিতেই মরে যাচ্ছে। মরা গাছের ডালপালা ভেঙে কারও মাথায় পড়তে পারে।’

এবার অন্তু জোর দিয়ে বলল, ‘না, আব্বু এ রকম কিছুই হবে না। গাছটা ভালো হয়ে যাবে।’

‘ঠিক আছে। তোর কথামতো করলামই না হয় কিছুদিন অপেক্ষা। তবে ওটার কোনো উন্নতি না হলে কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেটেই ফেলব।’

‘ইয়াহু!’ আনন্দে একপ্রকার চিত্কার করেই উঠল অন্তু।

সত্যি সত্যিই কয়েক মাসের মধ্যে কদমগাছে আবার নতুন করে পাতা আর শাখা-প্রশাখা গজাতে লাগল। আস্তে আস্তে সবুজ হয়ে উঠতে লাগল ওটা। এটা দেখে খুুুশিই হলেন বাবা। মনে মনে ভাবলেন, ‘যাক, গাছটা সুস্থ হওয়ায় ভালোই হয়েছে। অন্তুকে এখন আর কদমগাছটার সঙ্গে আগের মতো কথা বলতে দেখা যায় না। ছেলের পাগলামি বোধ হয় সেরেই গেল।’

বাবা তো জানেন না অন্তুকে এখন আর আগের মতো শব্দ করে কদমগাছের সঙ্গে কথা বলতে হয় না। টেলিপ্যাথি আছে না, ওটার সাহায্যে তো অন্তু এখন শুধু কদমগাছই না, আশপাশের সব গাছের সঙ্গেই কথা বলতে পারে। এই যেমন বারান্দার টবে থাকা পাতাবাহার গাছটা এখন ওকে বলছে, ‘অন্তু, নতুন ওঠা অ্যাপার্টমেন্টের জন্য গায়ে রোদ লাগছে না। একটু রোদের দিকে ঘুরিয়ে দেবে?’

‘আসছি দাঁড়াও।’ বলে নিজের ঘর থেকে বের হয়ে বারান্দার দিকে হাঁটা দেয় অন্তু।

অলংকরণ: জুনায়েদ আজীম চৌধুরী