জেমস বন্ড ও আমার স্কি ট্রেনিংয়ের গল্প

জেমস বন্ড মুভি ওয়ার্ল্ড ইজ নট এনাফ-এ একটা দুর্দান্ত অ্যাকশন দৃশ্য আছে। বন্ডরূপী পিয়ার্স ব্রসনান ও সোফি মাহসু ফ্রান্সের তুষারে মোড়া শামানি পর্বতের ঢালে হেলিকপ্টার থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়ে। দুজনের হাতে দুটো করে স্টিক। আর পায়ে স্কি। এরপর তুষারের বুক চিরে পাল্লা দিয়ে শুরু হয় তাদের কসরত দেখানোর পালা। বরফের রাজ্যে কী অসম্ভব গতি আর কী নিয়ন্ত্রণ দুজনের! দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন দুধের সাগরে লাফিয়ে লাফিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে দুজন মানুষ। এর একটু পরেই ভাসমান একধরনের যানে উদয় হলো ভিলেনের দল। তারা আকাশ থেকে গুলি আর গ্রেনেড ছুড়তে শুরু করলে জেমস বন্ড নানান ক্যারিশমা করে গাছের ফাঁকফোকর দিয়ে দুরন্তগতিতে বেরিয়ে যায় স্কি করে। এই দৃশ্য দেখার পর কার না এমন রোমাঞ্চকর স্কি করতে ইচ্ছে করে! আমারও করছিল। শুধু সময় আর সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম।

প্রথম সুযোগটা এসেছিল গত বছর। ক্যালিফোর্নিয়ার সান ফ্রান্সিসকোর অদূরে লেক টাহো স্কিয়িংয়ের জন্য বেশ বিখ্যাত। একদিন সময়-সুযোগমতো সেখানকার ‘হ্যাভেনলি স্কি রিসোর্ট’-এর উদ্দেশে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম স্কিয়িংয়ের প্রথম পাঠ নিতে। কিন্তু ভাগ্য খারাপ। যাত্রাপথে অ্যাভালাঞ্জের (তুষারধস) শিকার হয়ে সেবার আর স্কি করা হলো না। কিন্তু এবার বেশ আটঘাট বেঁধে নামলাম। ইন্টারনেটে আবহাওয়ার সংবাদ দেখে প্রফেশনালি স্কি করে এমন একদল বন্ধুর সঙ্গে রওনা হলাম লেক টাহোর ‘নর্থস্টার স্কি রিসোর্ট’-এর উদ্দেশে। গাড়িতে করে যেতে যেতেই কথা হলো স্কি বিশেষজ্ঞ বন্ধুদের সঙ্গে। তারা জানাল, তুষারের মধ্যে স্কিয়িংয়ের পাশাপাশি স্নোবোর্ডিংও খুব জনপ্রিয়। স্কি শুরুতে বেশ সহজ হলেও দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রচুর অধ্যবসায় প্রয়োজন। আর স্নোবোর্ডিং শুরুতে আয়ত্তে আনা বেশ কষ্টকর হলেও একবার ব্যাপারটা ধরতে পারলে পরে সমস্যা হয় না। এখন আমি কোনটা দিয়ে শুরু করতে চাই? আমার মাথায় তো আছে জেমস বন্ড। তাই কোনো ভাবনাচিন্তা না করেই বলে দিলাম, অবশ্যই স্কি। আগে ওই রকম স্কি করে তুষারের সমুদ্রে চলতে শিখি এরপর স্নোবোর্ডিং দেখা যাবে। ‘আচ্ছা, তাহলে তোমাকে আগে কালকে সকালবেলা স্কির বেসিক নিয়মকানুনের ওপর দুই ঘণ্টার একটা ক্লাস করতে হবে। এরপর নিজে নিজে প্র্যাকটিস করার পালা। এক্ষুনি ওদের ওয়েবসাইটে ঢুকে ক্লাস আর স্কির সরঞ্জামাদির বুকিং দিয়ে ফেলো।’

আমার স্ত্রী দিয়া এসব ব্যাপারে খুবই পাকা মেয়ে। তখনই ওয়েবে ঢুকে ক্রেডিট কার্ড দিয়ে সে সব ব্যবস্থা করে ফেলল।

সে রাতটা লেক টাহোতেই আমাদের এক বন্ধুর বাসায় কাটিয়ে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠলাম। স্বচ্ছ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি একি কাণ্ড। আশপাশের বাড়িঘর সব একদম তুষারের মাঝে ডুবে আছে। চারদিকে সব সাদা। এমন সাদা আগে কখনো দেখিনি। তার মাঝে আকাশ থেকে মুষলধারায় নেমে আসছে তুলার মতো তুষার। গুগল করে জানা গেল, বাইরে তাপমাত্রা আজ মাইনাস ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাই দ্রুত নাশতা করে বেশ কয়েক প্রস্থ কাপড়ের ওপর স্কি উপযোগী জ্যাকেট আর প্যান্ট পরে গিয়ে দাঁড়ালাম বাড়ির সামনে। সেখান থেকে ‘নর্থস্টার স্কি’র নিজস্ব বাসে পৌঁছে গেলাম রিসোর্টে।

রিসোর্টে পৌঁছে দেখি এলাহি কাণ্ড। চারদিকে শত শত মানুষ বিশাল বিশাল স্নোবোর্ড আর স্কি নিয়ে এদিক-ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। এসব দেখতে দেখতে আমিও খুঁজে বের করে ফেললাম আমার স্কি সরঞ্জাম ভাড়া নেওয়ার জায়গাটা। সেখানে শুরুতেই আমার হাতে ধরিয়ে দিল প্রায় হাঁটু পর্যন্ত উঁচু এক বিশেষ ধরনের জুতা। এই জুতা স্কিতে আটকিয়ে তুষারের ওপর চলতে হবে। একটা হাতে নিয়ে আমি বললাম—খাইছে। ওজন কম করে হলেও ছয় কেজি। দুটো মিলিয়ে প্রায় ১২ কেজির এই ভারী জুতা পরে আমি হাঁটব কীভাবে? ওখানকার লোকটা উত্তর দিল, হাঁটবে কে বলল, তুমি তো এখানে স্কি করতে এসেছ। কিন্তু তার কথা সত্যি হলো না। ওই জুতা পরে আমাকে বেশ হাঁটতে হলো। একজোড়া স্কি আর স্টিক নিয়ে পেঙ্গুইনের মতো অনেক কষ্ট করে হাঁটতে হাঁটতে আমাকে উঠতে হলো একটা কেব্ল কারে। যেটা পাহাড়ের নিচ থেকে আমাকে পৌঁছে দিল পাহাড়ের মাঝামাঝি ‘স্কি অ্যান্ড স্নোবোর্ডিং স্কুলে’।

স্কুলের ওই জায়গাটাও যেন একটা বিশাল বাজার। রংবেরঙের স্কি জ্যাকেট পরা শত শত মানুষ। তাদের বয়স ৫ থেকে শুরু করে ৭০। কেউ স্কি শিখছে, কেউ সাঁই সাঁইবেগে ওপরের পাহাড় থেকে স্কি আর স্নোবোর্ডিং করে নেমে আসছে, কেউ শুধুই তাকিয়ে দেখছে। তাদের ফাঁকফোকর গলিয়ে আমি পৌঁছে গেলাম স্কুলে। আমার মাস্টারমশাইয়ের বয়স প্রায় ৬০। স্কিয়িংয়ে তাঁর ক্যারিয়ার ৫০ বছরের। আজকের এই সেশনে তিনি আমাকেসহ আরও তিনজনকে স্কি শেখাবেন। আমার সহপাঠী দুই ক্যালিফোর্নিয়ান তরুণী আর এক সুইডিশ তরুণ। সবার সঙ্গে পরিচিত হয়ে শুরু হলো আমাদের স্কি শেখা।

এর পরের দুই ঘণ্টা আমাদের ওপর দিয়ে কী গেল সেটা আর বলার মতো না। সামান্য দুটো স্কি নিয়ন্ত্রণ করা যে এত পরিশ্রমের কাজ হতে পারে আর তাতে এত নিয়মকানুন থাকতে পারে, তা বুঝলে নিশ্চয়ই এই পথ আমি মাড়াতে আসতাম না। পরিশ্রমের ঠেলায় মাইনাস ১০ ডিগ্রির সেই তাপমাত্রায় আমরা একেবারে ঘেমেনেয়ে উঠলাম। তৃষ্ণায় বুক ফেটে যেতে থাকল। ইনস্ট্রাক্টরকে বললাম, একটু পানি পানের বিরতি দেন জনাব। পাশের রেস্টুরেন্ট থেকে পানি খেয়ে আসি। তিনি বললেন, এতদূর যেতে হবে কেন, পাশ থেকে এক খাবলা তুষার মুখে পুরে খেয়ে ফেলো। ওটা তো পানিই। আরে তাই তো!

আমাদের পাশে চার থেকে পাঁচ বছর বয়সী বাচ্চাদের একটা গ্রুপের স্কি ট্রেনিং হচ্ছিল। তারা হঠাত্ অবাক হয়ে দেখল, তাদের পাশের রিংয়ের এই বড় বড় মানুষগুলো হঠাত্ কপ কপ করে তুষার খাওয়া শুরু করেছে। আমার সবচেয়ে কাছের পিচ্চিটাকে আরও অবাক করে দিয়ে আমি বললাম, তোমার কাছে সুগার হবে? তাহলে আইসক্রিম বানিয়ে খেতাম। পিচ্চিটার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল তার মা। সত্যি সত্যি সে তার মায়ের কাছ থেকে গিয়ে ছোট্ট স্যাশে প্যাকেটে এক প্যাকেট চিনি এনে দিল (কফিতে দেওয়ার জন্য স্যাশেতে এমন চিনি পাওয়া যায়)। আমি স্কি ট্রেনিংয়ের কথা ভুলে গিয়ে আইসক্রিম বানানোয় পূর্ণ মনোযোগ দিলাম। আহা, ছোটবেলায় কত না আইসক্রিমওয়ালা হতে চেয়েছি। আজ আশা পূরণ হচ্ছে।

বি.দ্র.: দুই ঘণ্টার সেই ট্রেনিং শেষে আমি ভাবলাম, স্কি তো শিখেই গেছি। এবার একটু সাঁই সাঁই করে বন্ডের মতো নামি দেখি পাহাড় থেকে। ফলাফল, ব্রেক কষার কৌশল ঠিকমতো আয়ত্তে না আসায় তুষারের একটা বড় স্তূপের নিচে পাঁচ মিনিট আটকা পড়ে ছিলাম। স্কি পেট্রোল এসে উদ্ধার করেছে। এখন ঠিকমতো হাঁটতেও পারছি না। পা ভেঙেছে কি না বুঝতে পারছি না। এক্স-রে করাতে যাব। প্রে ফর মি!