ড্যানিয়েল থেকে হ্যারি

‘হ্যারি পটার’, ‘দ্য বয় হু লিভড’ বলামাত্র পটারভক্তদের চোখের সামনে এক নিমেষে ভেসে ওঠে ড্যানিয়েল রেডক্লিফ। গোল চশমার আড়ালে বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, কপালের ‘স্কার’ ঢেকে রাখা চুল আর চমত্কার অভিনয়ে বিশ্বজোড়া ভক্তদের মুগ্ধ করল যে ড্যানিয়েল, তাকে খুঁজতে কিন্তু বেশ বেগ পেতে হয়েছিল কাস্টিং ডিরেক্টরদের। কাস্টিং ডিরেক্টরের কাজই হলো ছবির জন্য মনের মতো অভিনেতা খুঁজে বের করা। 

হ্যারি পটার সিরিজের চলচ্চিত্রগুলোর কাস্টিং ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করেছেন জ্যানেট হিরশেনশন। তবে তিনি কাজ শুরু করার এক বছর আগে থেকেই কাস্টিংয়ের দায়িত্বে ছিলেন অন্য একজন। তাই হারমায়োনি বা রনের চরিত্রে কে অভিনয় করবে তা ঠিক করাটা তুলনামূলক সহজই ছিল। নির্বাচিত কিছু মুখ থেকে শুধু এমা আর রুপার্টকে খুঁজে নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তখনো পাওয়া যাচ্ছিল না কাঙ্ক্ষিত ‘হ্যারি’কে। হাফিংটন পোস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাত্কারে জ্যানেট বলেন, ‘হ্যারিকে খুঁজে পাওয়াই ছিল সবচেয়ে কঠিন।’

রন, হারমায়োনি ও হ্যারি বড় হয়েও বাস্তব জীবনে বেশ ভালো বন্ধু

হ্যারি পটার সিরিজের বইগুলোতে বারবার উঠে এসেছে কিংস ক্রস স্টেশনসহ ইংল্যান্ডের বিভিন্ন স্থানের কথা। এমনকি হগওয়ার্টসকেও বলা হয়েছে ব্রিটেনের সবচেয়ে বিখ্যাত জাদুবিদ্যার স্কুল। ব্রিটিশ আবহে লেখা এই সিরিজকে নিয়ে যখন চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়, তখন স্বভাবতই ব্রিটিশ অভিনেতাদের নিয়েই কাজ করতে চেয়েছিলেন কাস্টিং ডিরেক্টর। হ্যারি পটারের চরিত্রে অডিশন দেওয়া একমাত্র আমেরিকান অভিনেতা ছিলেন লিয়াম আইকেন, যাঁকে পরে দেখা গেছে ‘হ্যারি পটার অ্যান্ড ফিলোসফারস স্টোন’-এর পরিচালক ক্রিস কলম্বাস নির্মিত স্টেপ মম চলচ্চিত্রে। ‘শুধু ব্রিটিশ অভিনেতা’ নীতিতে পরিচালক এমনই অটল ছিলেন যে অডিশনে হ্যাগ্রিডের চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করে মন জিতে নেওয়া অভিনেতা রবিন উইলিয়ামসকেও তিনি নিতে চাননি। কারণ, রবিন আমেরিকান।

জে কে রাউলিংয়ের লেখনীতে হ্যারির বয়স আর চেহারার খুঁটিনাটি বর্ণনা কাস্টিংয়ের কাজকে আরও কঠিন করে দিয়েছিল। ‘শুধু একটি সিনেমাই নয়, সিরিজের বাকি সিনেমাগুলোতেও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হ্যারির চেহারা কেমন হবে, এমন খুঁটিনাটি বিষয় মাথায় রাখা আবশ্যক ছিল। তাই ১৩-এর কাছাকাছি বয়সী যেকোনো অভিনেতাকেই নিয়ে নেওয়া ছিল অসম্ভব।’ বয়স কীভাবে হ্যারি চরিত্রের অভিনেতা নির্বাচনকে কঠিন করে তুলেছিল, তা-ই বললেন জ্যানেট। এমনকি বিলি এলিয়ট খ্যাত অভিনেতা জিমি বেলকেও নিতে না পারার কারণ ছিল তার বয়স। জ্যানেটের ভাষায়, ‘বিলি চমত্কার অভিনেতা কিন্তু ওর বয়স ১৪। ব্যাপারটা এমন ছিল যে যেহেতু তার বয়স ১৪, সে হ্যারি হতেই পারে না!’

‘অনেক ভালো অভিনেতাকেই বাদ দিতে হয়েছিল। কারণ, তাদের চোখের রং নীল বা সবুজ কিংবা নীলাভ সবুজ বা সবুজাভ নীল ছিল না।’ কাস্টিংয়ের কর্মযজ্ঞে হ্যারির চোখের রংও যে জটিলতা যোগ করেছিল তা বেশ বোঝা যায় জ্যানেটের এই কথায়।

এসব খুঁটিনাটির কারণেই বেশ দীর্ঘ সময় ধরে চলেছিল হ্যারির সন্ধান। কিন্তু পরিচালক কলম্বাসের চোখ প্রথম থেকেই পড়েছিল ড্যানিয়েল রেডক্লিফের ওপর। এমনকি তিনি ড্যানিয়েল অভিনীত ডেভিড কপারফিল্ড নাটকের রেকর্ডও এনে দিয়েছিলেন জ্যানেটকে।

রেডক্লিফকে রাজি করাতেও কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। প্রথম যখন হ্যারি চরিত্রে অভিনয়ের কথা রেডক্লিফকে বলা হয়, তত দিনে তার অভিনয়ের প্রতি আগ্রহ চলে গেছে। কিন্তু প্রফেসর ডাম্বলডোর বলেছেন, ‘ঘোর অন্ধকারতম সময়েও সুখ খুঁজে পাওয়া সম্ভব যদি তুমি জানো কী করে আলো জ্বালাতে হয়’, তাই হ্যারি পটারের কাস্টিং দলও সহজে হাল ছাড়েনি। প্রযোজক ডেভিড হেয়ম্যান চিনতেন ড্যানিয়েলের বাবা অ্যালান জর্জ রেডক্লিফকে। থিয়েটার এজেন্ট ছিলেন অ্যালান। অ্যালানের সঙ্গে কথা বলেই ড্যানিয়েলকে অডিশনে আসতে রাজি করান হেয়ম্যান।

এরপর আসে স্ক্রিন টেস্টের পালা। তিন প্রধান চরিত্রের স্ক্রিন টেস্ট নেওয়া হয় একই দিনে। সেই স্মৃতিও মনে আছে জ্যানেটের। ‘তখন আমাদের হাতে প্রায় ছয়জন হ্যারি, দুই-তিনজন হারমায়োনি আর প্রায় পাঁচজনের মতো রন ছিল।’

পরিচালক কলম্বাসের প্রথম পছন্দ ড্যানিয়েল হলেও, স্ক্রিন টেস্টে আরও দু-একজনের মনে হলো অন্য ছেলেটিই বেশি ভালো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ড্যানিয়েলই কেন হলো ‘হ্যারি পটার’? উত্তরে জ্যানেট বলেন, ‘অন্য ছেলেটি অনেকটাই হ্যারির মতো ছিল, অনিশ্চিত ভাবভঙ্গিসহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে তাকে একদম ঠিক মনে হয়েছিল। কিছু অনিশ্চয়তা, ভয় থাকলেও হ্যারি শেষ পর্যন্ত একটি শক্তিশালী চরিত্র। ড্যানিয়েলের মধ্যে আমরা দুটো দিকই খুঁজে পেয়েছিলাম। কিশোর হিসেবে কিছু অনিশ্চয়তা, সংশয় যেমন তার ছিল, তেমনি সাহস ও শক্তির দুর্দান্ত সমন্বয়ের উপস্থিতিও ছিল তার অভিনয়ে।’

কিন্তু শুধুই তো অভিনেতা নির্বাচন করলেই হয় না, তিন শিশু অভিনেতার রসায়ন কেমন হবে তাও তো মহাচিন্তার বিষয়। ড্যানিয়েল, এমা ও রুপার্ট— একসঙ্গে স্ক্রিন টেস্ট নেওয়ার সময় তিনজনের কেউই জানত না যে তারাই নির্বাচিত প্রধান চরিত্র। স্ক্রিন টেস্টের এক ফাঁকে এমা ড্যানিয়েলকে জিজ্ঞেস করল হ্যারি পটারের বইগুলো তার পছন্দ কি না। ড্যানিয়েলের উত্তর, ‘হ্যাঁ! কিন্তু আমার ডব্লিউডব্লিউএফ বেশি পছন্দ।’ ড্যানিয়েলের উত্তর আর এমার প্রায় হারমায়োনিসুলভ অভিব্যক্তি দেখে কাস্টিং দল নিমেষেই বুঝে গেল ‘ত্রিরত্ন’ বেছে নিতে কোনো ভুল করেনি তারা।

তবে যাঁর কল্পনায় হ্যারি, রন ও হারমায়োনির সৃষ্টি, সেই জে কে রাউলিংয়ের কাছে বাস্তবের ড্যানিয়েল, এমা ও রুপার্ট কতটা গ্রহণযোগ্য ছিল সে প্রশ্নের উত্তরে জ্যানেট বলেন, ‘শুটিং শুরুর আগে প্রথম রিডিং সেশনেই তিনজনকে দেখে রাউলিংয়ের মুখে ছিল তৃপ্তির হাসি। হয়তো রাউলিং এক ঝলকেই বুঝে নিয়েছিলেন এরা রুপালি পর্দায় কী চমত্কার জাদুর ছটা ছড়াবেন!’