যখন আমি শুকনো ছিলাম

কথাটা এভাবেও বলা যেত, যখন আমি শুঁটকা ছিলাম। তা বললাম না, কারণ শুঁটকা কথাটা এলেই মনে পড়ে যায় শুঁটকির কথা। শুঁটকি মাছ। আমি শুঁটকি মাছ একদম পছন্দ করি না। তার গন্ধ আমার পছন্দ নয়। তাই ‘যখন আমি শুঁটকা ছিলাম’ এই কথা না বলে আমি বলছি, যখন আমি শুকনা ছিলাম।

এ প্রসঙ্গে একটা গল্প বলে নিই আগে। একদিন একজন ভদ্রমহিলা আমাদের বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন। আমার বয়স তখন তিন কি চার। ভদ্রমহিলা বললেন, বাবু, তুমি এত শুকনা কেন?

আমি বলেছিলাম, বারে, আমি বুঝি সব সময় ভেজা থাকব?

এখন আমার বয়স সাত বছর। আমার নাম দীপ্র। আমি এখন লম্বা হয়েছি। তবে ভীষণ শুকনো, পাতলা, হালকা আছি।

শুকনো থাকার কতগুলো অসুবিধা আছে।

কতগুলো সুবিধা আছে।

আগে সুবিধাগুলো বলে নিই।

একদিন আমরা কয়েক বন্ধু পাড়ার পার্কের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। পার্কের চারদিকে লোহার বেড়া। একটা জায়গায় একটা লোহার দণ্ড নেই।

এই সময় একটা নাদুস নুদুস কুকুর আমাদের তাড়া করল। আমি ওই ফুটো দিয়ে সহজেই ঢুকে গেলামে পার্কের মধ্যে। আর আমাদের সঙ্গে ছিল আমাদের মোটকু বন্ধু তপু। সে আর কিছুতেই ঢুকতে পারল না। এদিকে কুকুরটা তার দিকেই তেড়ে আসছে। ঘেউ ঘেউ গরগর করে দৌড়াচ্ছে।

তাকে তো বাঁচাতে হবে। আমি পার্কের নিরাপদ চৌহদ্দিতে ঢুকে কুকুরটাকে ডাকতে লাগলাম, আয় আয়, আমার দিকে আয়। কুকুরটার মনোযোগ তখন তপুর দিকে না গিয়ে আমার ওপরে এসে পড়ল। ঘেউ ঘেউ করতে করতে সে আমার দিকে তেড়ে এল। এসে লাভ কী? আমি তো বেড়ার ভেতরে। আর মোটা কুকুরটাও এই চিকন ফাঁক দিয়ে ঢুকতে পারবে না।

কিন্তু বেশি হালকা পাতলা থাকার কতগুলো নেতিবাচক দিকও আছে।

যেমন, বন্ধুরা আমার কতগুলো নাম দিয়েছে।

১. দেশলাইয়ের কাঠি।

২. পাটকাঠি।

৩. রবিউল।

৪. পাতলা খান।

৫. কৌটা।

থাক, নিজের অপমানের কথা নিজের মুখে বেশি বলতে চাই না।

আমি রোগা-পাতলা হওয়ায় আমার কতগুলো বাস্তব অসুবিধা এবং আমার বাবা-মায়ের কতগুলো বাস্তব সুবিধা হয়েছে।

যেমন, তাঁরা যখন রিকশায় যান, তখন একটা মাত্র রিকশা ভাড়া করেন। আর আমাকে তাঁদের কোলে বসিয়ে নেন।

আমার কখনোই সৌভাগ্য হয় না রিকশার সিটে বসে যাত্রা করার।

যদি কখনো-সখনো আমি বাবা-মায়ের সঙ্গে গাড়িতে উঠি, তখন আমাকে সামনের সিটে বসতে দেওয়া হয় না। আমি সব সময়ই বাবা-মায়ের মাঝখানের জায়গাটায় বসি। (আমাদের নিজেদের গাড়ি নেই, কিন্তু মাঝেমধ্যে এর-ওর গাড়িতে চড়ার সুযোগ তো ঘটেই।)

আমি বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। আমার একটা ভাই বা বোন থাকলে সুবিধা হতো। বাবা-মা আর আমাকে কোলে করে রিকশায় করে ঘুরতে পারতেন না। দুটো রিকশা ভাড়া তাঁদের করতেই হতো।

আমরা ছিলাম ছোট শহর নেত্রকোনায়। আমার আব্বা সেখানে সরকারি চাকরি করতেন।

তিনি বদলি হয়ে ঢাকায় এলেন।

নেত্রকোনা শহরে আমাদের বাসার পাশেই ছিল বিশাল মাঠ। আমি সারাক্ষণ মাঠে খেলতাম। ফুটবল আমার প্রিয় খেলা। বিকেল তিনটা বাজতে না বাজতেই একটা ফুটবল নিয়ে আমি মাঠে চলে যেতাম। মাঠের পাশে একটা বিল্ডিং ছিল। সেই দেয়ালে আমি জোরে জোরে বল মারতাম। শব্দ হতো। সেই শব্দ শুনে আমার বন্ধুরা চলে আসত মাঠে।

সারাক্ষণ খেলতাম, দৌড়াতাম। নদীতে সাঁতার কাটা শিখে ফেললাম। সুপারিগাছে উঠতে পারতাম। দুপায়ের গোড়ালির ওপরে একটা গামছা বেঁধে নিয়ে আমি বাঁদরের মতো বেয়ে বেয়ে সুপারিগাছে উঠে পড়তে পারতাম।

এই জন্য আমার আরেকটা নাম হয়ে গেল লেজকাটা বাঁদর।

কিন্তু ঢাকায় এসে আমরা বাসা নিলাম একটা বহুতল ভবনে। ফ্ল্যাটবাড়ি। লিফটে করে উঠতে হয়। খেলার কোনো মাঠ নেই। এমনকি আমি যে স্কুলে ভর্তি হলাম, সেখানেও খেলার কোনো মাঠ নেই।

আমি তখন কম্পিউটারে গেম খেলা শুরু করলাম। বাবা আমাকে প্লেস্টেশন কিনে দিলেন। সেটা নিয়ে সারাক্ষণ খেলি।

মাঝেমধ্যে তো বেড়াতে যেতেও ইচ্ছা করে।

তাই ছুটির দিনে বাবা-মা আমাকে নিয়ে বেড়াতে বের হন। একটা রেস্টুরেন্টে যাই আমরা। আমি বার্গার খাই। কোল্ড ড্রিংকস খাই।

আস্তে আস্তে আমার নেশা হয়ে গেল পিজা বার্গার হটডগ খাওয়া। নানা ধরনের কোমল পানীয় খাওয়া।

শুঁটকো থেকে আমি মোটকু হতে শুরু করলাম।

এবার ভারি মজা হতে লাগল।

বাবা-মা আর আমাকে কোলে নিতে পারেন না। আমি একটা রিকশায় মায়ের সঙ্গে উঠি। বাবা আরেকটা রিকশা নিতে বাধ্য হন।

উত্সাহ পেয়ে আমি আরও খাই। আরও মোটা হই। এবার হলো নতুন বিপদ। আমি আর বাবা-মায়ের সঙ্গে এক বেবিট্যাক্সিতেও উঠতে পারি না। জায়গা হয় না। আর আমার উঠতেও কষ্ট হয়।

বাধ্য হয়ে বাবাকে ট্যাক্সি ডাকতে হয়।

আমি আরও মজা পেয়ে গেলাম। খাওয়া দিলাম আরও বাড়িয়ে। এখন আর কোনো বেবিট্যাক্সি আমাকে যাত্রী হিসেবে গ্রহণ করে না। বাসেও আমি উঠতে পারি না। কারণ, বাসগুলোর সিট ভীষণ চিপা। আমার পা ঢোকে না। কাজেই বাবা একটা গাড়ি কিনতে বাধ্য হলেন।

এখন আর আমাকে কেউ পাতলু খান বলে না।

এখন সবাই আমাকে বলে মোটকু খান।

আমি বলি, খান তো বটেই। যাঁর নাম দীপ্র, তিনি শুধুই খান, বার্গার খান, পিজা খান, আইসক্রিম খান, চকলেট খান। কাজেই আমার নাম আপনারা অবশ্যই খান রাখবেন। খাই খাইও রাখতে পারেন।

মোটা হওয়ার ফলে আমি কতগুলো কাজেও লাগি।

যেমন, যখন কোনো সুটকেস বন্ধ করা যায় না, ভেতরে বড় বেশি কাপড়চোপড় ভরা হয়েছে বলে, তখন আমার ডাক পড়ে।

আমি যাই। সুটকেসের ওপরে বসি। বাকি কাজ বাবা-মা করে ফেলেন। সুটকেসের চেইন লাগিয়ে ফেলেন।

তবে একদিন নিচতলার আন্টি এলেন। বললেন, আপনাদের বাসায় সারাক্ষণ গুড়ুম গুড়ুম শব্দ করে কে। পুরো বিল্ডিং কেঁপে ওঠে। আমরা ভাবি ভূমিকম্প হচ্ছে।

মা বলেন, কক্ষনো না। কেউ শব্দ করে না।

ব্যাপারটা কী বোঝার জন্য আমি বাইরের ঘরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াই। অমনি আন্টি বলে ওঠেন, এই যে আবার শব্দ হচ্ছে। গুড়ুম গুড়ুম। ওরে বাবা। আবারও ভূমিকম্প শুরু হলো নাকি।

মা বলেন, আরে না, আমার ছেলে দীপ্র হেঁটে আসছে। তাই একটু শব্দ হচ্ছে আর কী।

কিন্তু একদিন সত্যি সত্যি ভূমিকম্প শুরু হলো। রাত আটটার দিকে। আমি আমার পড়ার টেবিলে ছিলাম। দেখি, দুনিয়া দুলছে।

আমার বইয়ের সেলফ থেকে বই পড়ে গেল।

সবাই দৌড়াচ্ছে। তারা নামবে।

প্রাণের ভয় তো আমারও আছে। আমিও নামতে লাগলাম সিঁড়ি বেয়ে।

ভূমিকম্প শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যেহেতু আমি প্রাণপণে নামছি সিঁড়ি বেয়ে, পুরো সিঁড়িঘর কাঁপতে লাগল। সমস্ত বিল্ডিংয়ের লোকজন ভয়ে আরও জোরে জোরে নিচে নামতে লাগল।

আটতলা থেকে নামা কি সোজা কথা!

নিচে নামতে গিয়ে আমার জান পয়মাল হয়ে যাওয়ার জোগাড়।

তখন আমার মনে পড়তে লাগল, কী সুন্দর দিন ছিল, যখন আমি শুকনো ছিলাম।

এখন তো আমার সঙ্গে কেউ লিফটেও উঠতে চায় না। সবচেয়ে খারাপ হলো চারতলার পিচ্চি মেয়ে কোকিলা। (ওর নাম আমি দিয়েছি দাঁড়কাক)। আমি যদি লিফটে থাকি, তাহলে চারতলায় গিয়ে লিফটের দরজা খুললেও সে ওঠে না। আমাকে শুনিয়েই বলে, লিফটের তার ছিঁড়ে যাবে।

আর একদিন আমি গাড়িতে উঠেছি। বাবার কেনা নতুন শখের গাড়ি। একটু দূরে গিয়েই গাড়ির টায়ার গেল ফেটে।

ড্রাইভার আংকেল বললেন, দীপ্র ভাইয়া, নাইমা খাড়ান। চাকা পাল্টামু।

আমি বাইরে নেমে হাওয়া খাচ্ছি।

চারদিকে ভিড় জমে গেল।

সবাই হাসছে। বাপরে, কোন দোকানের চাউল খায়। দেখছেন, জলহস্তী উইঠা আইছে ঢাকা শহরে।

আমি ঠিক করলাম, যথেষ্ট হয়েছে। আবার আমি হালকা পাতলা হব। বলুক লোকে আমাকে পাতলা খান।

এর মধ্যে বাবা আবারও বদলি হয়ে গেলেন। এবার বদলি হলেন রাঙামাটিতে।

আমি বললাম, আমিও যাব। রাঙামাটি স্কুলেই আমি পড়ব।

মা বললেন, সেই ভালো। এত সুন্দর শহর রাঙামাটি। আমিও ওখানে যাব।

আমরা তিনজন চলে গেলাম রাঙামাটি।

আমি প্রথম দিনই নেমে পড়লাম রাঙামাটি লেকে। সাঁতার কাটা আমি ভুলিনি। অনেকক্ষণ সাঁতার কাটলাম।

আমার স্কুলে আমি যাই হেঁটে হেঁটে। পাহাড়ি পথ। কোথাও উঁচু, কোথাও নিচু। প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হতো। তারপর আস্তে আস্তে আমার শরীরের মেদও কমতে লাগল। আর আমিও হাঁটতে-চলতে অভ্যস্ত হয়ে পড়লাম।

বার্গার খাই না।

চকলেট খাই না।

আইসক্রিম খাই না।

কোল্ড ড্রিংকস খাই না।

পিজা পাওয়া যায় না।

প্রচুর সবজি খাই। দুধ খাই।

আমার শরীরটা সুন্দর হচ্ছে, আয়নায় দেখে আমি নিজে টের পাই। আবারও ফুটবল মাঠে যেতে শুরু করলাম আমি। আমার ওজন কমছে।

বাহুতে পেশি হচ্ছে।

বাহ্। বাবা আমাকে উত্সাহ দেন।

মা বলেন, আহারে, ছেলে আমার শুকিয়ে যাচ্ছে। শুনে আমি খুশি, আমি তো শুকুতেই চাই।

আমি যখন মোটকু ছিলাম, আমার ঢাকার স্কুলে একদিন আমি ফুটবল খেলতে গিয়েছিলাম ক্লাসের ছেলেদের সঙ্গে, ওরা বলল, তুই গোলকিপার হ। গোলপোস্টের সামনে শুয়ে থাক। তাহলেই আর কেউ গোল দিতে পারবে না।

আর এখন, রাঙামাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ফুটবল টিমের আমি ক্যাপ্টেন। সেন্টার ফরোয়ার্ডে খেলি।

আমার নাম দীপ্র। নামটা খেয়াল রাখবেন। কয়েক বছর পরে ন্যাশনাল টিমে যখন খেলব, তখন আমার সঙ্গে সেলফি তোলার জন্য আপনাদের লাইন দিতে হবে।

অলংকরণ : তুলি