নিদ্রাকুসুম

স্কুলের সীমানায় সবে এক পা দিয়েছি, শরীরের বেশির ভাগ তখনো গেটের বাইরে, এমন সময় ভেতর থেকে দৌড়ে এল সিপু। সিপু মানে সিপার, আমার ক্লাসমেট। আমরা ডাকি কাউয়া সিপু। অপরের পেছনে লেগে থেকে জ্বালাতন করার ব্যাপারে কাকের মতোই নিষ্ঠা ওর। আমার সামনে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে সিপু বলল, ‘দোস্ত, ঘটনা তো ঘইটা গেছে!’

: কী হয়েছে? স্কুল ছুটির ঘোষণা দিয়েছে? আনন্দমাখা গলায় জানতে চাই আমি।

: আরে না, সুখবর আমাগো কপালে নাই। ঘটনা খারাপ। চিন্তিত হওয়ার মতো খারাপ। মেজাজ বিগড়ায়া যাওয়ার মতো খারাপ।

: খুলে বল দেখি। এবার আমিও চিন্তায় পড়ে যাই।

: ঘটনা হইল—কুসুইম্যা ব্রিলিয়ান্ট হয়া গেছে!

কুসুইম্যা মানে আমাদের আরেক ক্লাসমেট কুসুম। ওর ব্রিলিয়ান্ট হয়ে যাওয়া মানে আমাদের কাছে মোটামুটি কেয়ামতের আলামত। প্রতিটি পরীক্ষায় যে কিনা টেনেটুনে পাস করে, কখনোবা শিক্ষকদের খয়রাতি নম্বরও দিতে হয়, সে কীভাবে ব্রিলিয়ান্ট হবে! এটা কি ক্রিকেট খেলা নাকি যে চরম অনিশ্চয়তা আর অঘটনের সম্ভাবনা থাকে!

আমাদের এই কুসুম বড্ড ঘুমকাতুরে। ও ক্লাসে বসে ঘুমায়, পিটি করার লাইনে দাঁড়িয়ে ঘুমায়, এমনকি পরীক্ষার হলেও খাতার ওপর মাথা রেখে নাক ডাকে। শুনেছি, বাসায়ও নাকি অর্ধেক ভাত খেয়ে প্লেটের পাশেই মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে! ওর ছোট দুই ভাইবোনও আমাদের স্কুলে পড়ে, ক্লাস সিক্সে। ভাই কানন আর বোন কলি প্রতিদিন কুসুমকে স্কুলে নিয়ে আসে, ছুটির পরও সঙ্গে নিয়ে যায়। নতুবা রাস্তায় যদি কোথাও ঘুমিয়ে থাকে? তিন ভাইবোন স্কুলে একসঙ্গে ঢোকামাত্রই আমরা বলে উঠি, ‘কাননে কুসুম কলি সকলি জুটিল।’

মোদ্দাকথা, ঘুমানোর মিশন নিয়েই যেন কুসুম দুনিয়ায় এসেছে। তাই আমরা ওর নাম দিয়েছি ‘নিদ্রাকুসুম’। এই নামে একটি ঘুমপাড়ানি তেল আছে। তো যে ছেলে সারা দিন ঘুমিয়েই কাটায়, সেই ছেলের ব্রিলিয়ান্ট হওয়ার চান্সটা কোথায়?

কাউয়া সিপু ব্যাখ্যা করে, ‘আগে থাকতে বলা নেই কওয়া নেই, আজ দেখি কুসুইম্যা চোখে চশমা পরে স্কুলে এসেছে। ক্লাস এইটের ছাত্র কেন চশমা লাগাবে? হালায় ব্রিলিয়ান্ট ভাব ধরছে।’

: অল্পতেই অস্থির হবি না। ওর চোখে হয়তো জ্বালাপোড়াজাতীয় কোনো সমস্যা আছে। আমি সিপুকে বোঝাতে চেষ্টা করি।

: কী কস! চোখে জ্বলুনি থাকলে সারা দিন ঘুমায় ক্যামনে?

: তাই তো! এভাবে তো ভেবে দেখিনি!

: ও নিজে আমার কাছে কইছে, চোখে চশমা পরলে সবাই ভালো ছাত্র মনে করে, তাই...

: হুম, লক্ষণ খারাপ। গামছার কেন সাধ হবে ধোপাবাড়ি যেতে? চল তো, গিয়ে দেখি। —বলে সিপুকে নিয়ে ক্লাসের দিকে রওনা দিলাম।

ঢুকতে না-ঢুকতেই ঘণ্টা পড়ে গেল। আশরাফ স্যার ক্লাসে ঢুকলেন। তিনি আমাদের ইংরেজি পড়ান, তবে মাঝেমধ্যে নানা রকম বিদেশি গল্প বলেন। বাচনভঙ্গিও অতি চমত্কার। পড়া ফেলে এ রকম গল্পের আসর আমাদের বেশ ভালোই লাগে। একফাঁকে দেখে নিলাম শেষ বেঞ্চের ঠিক আগের বেঞ্চটার মাঝখানে ভাব ধরে বসে আছে আমাদের নিদ্রাকুসুম। ঘুমানোর সুবিধার্থে ওই জায়গাটাকেই ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ হিসেবে বেছে নিয়েছে ও।

আজ বিশেষ পড়া ছিল না। তাই রোল কলের পর স্যার গল্প শুরু করলেন। রিপ ভ্যান উইংকেলের গল্প। বুড়ো উইংকেল ২০ বছরের ঘুম শুরু করেছেন। আমরা শুনছি, আর পেছনে কুসুম ঘুমাচ্ছে। ২০ বছর পর সেই বুড়োর ঘুম ভাঙল, কুসুমেরটা ভাঙল না। প্রায় প্রতিটি ক্লাসের শেষেই স্যাররা খোঁজ নেন কুসুমের কী অবস্থা। আজ আশরাফ স্যারও নিলেন—

: সিঁ..পু, কুসুঁ..ম কোথাঁ..য় রে? স্যার অনেকটা যাত্রার সংলাপের মতো টেনে টেনে হালকা চন্দ্রবিন্দু লাগিয়ে কথা বলেন। বড় ফাইন লাগে! কুসুমের সামনের বেঞ্চেই সিপু বসা। ওর মৃদু ধাক্কায় বেঞ্চের ছাত্ররা দুদিকে হেলে গেল। মাঝখানের ফাঁক দিয়ে দেখা গেল, আমাদের কুসুম যেন ফুলের কলিটির মতো গুটিয়ে ঘুমিয়ে আছে। সবাই হেসে উঠল, ও টেরও পেল না। স্যার কৃত্রিম ধমকের সুরে জোরে ডাক দিলেন কুসুঁ..ম! এত জোরে ‘কুসুম’ শব্দটা ডেলিভারি হলো যে ‘ঢিসুম’ হয়ে ওর কানে ধাক্কা দিল। ঘুম টুটে গিয়ে ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল ও।

: ঘুমাচ্ছিলি বুঝি? স্যার জিজ্ঞেস করেন।

: ক..ক..কই, না তো!

: তাহলে বল দেখি, কাকে নিয়ে গল্প বলছিলাম?

কুসুমের পাশ থেকে আলমগীর ফিসফিসিয়ে বলে দিল, রিপ ভ্যান উইংকেল। বেচারা ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে কী শুনল, কে জানে! হয়তো প্রথম দুইটা শব্দ ওর কানেই ঢোকেনি, আর শেষ শব্দটাও ঢুকেছে অস্পষ্টভাবে। স্যারের দিকে তাকিয়ে কুসুম ঠাস করে বলে দিল, ‘আংকেলকে নিয়ে গল্প করছিলেন।’ উইংকেল হয়ে গেল আংকেল! পুরো ক্লাসে যেন হাসির প্রতিযোগিতা শুরু হলো। স্যারও হেসে দিলেন। তারপর বললেন, ‘তুই দেখি আজ চশমা পরেছিস রে!’ এতক্ষণে সুযোগ পেয়ে সিপু বলে উঠল, ‘স্যার, ও ঘুমের মাঝে স্বপ্নটা পরিষ্কার দেখার জন্য চশমা পরেছে।’ আবারও হাসি।

পরের ক্লাসে প্রদীপ স্যার আসবেন গণিত পড়াতে। স্যার আসার আগেই আমি, সিপু, বনি আমিন আর নাসির খান গিয়ে ঘিরে ধরলাম কুসুমকে—কী রে, তোর চোখে কী হইছে? ও আমাদের দিকে একবার তাকিয়েই চোখ দুটো আধ বোজা করে টেবিলে মাথা রাখল। এটা কি আসলেই ঘুম, নাকি ভণিতা? বুঝতে পারি না আমরা। সিপু খেঁকিয়ে ওঠে, ‘সারা দিন ঘুমায় দুই কিসিমের লোক, নাইটগার্ড আর চোর। তুই এর কোনটা?’ জবাব নেই। নিদ্রাকুসুম ততক্ষণে নাক ডাকা শুরু করেছে।

ক্লাসে এসে প্রদীপ স্যার রোল কল শেষ করে বললেন, ‘আজ কিছু সরল অঙ্ক শেখাব। নামে সরল, আসলে গরল। বড়ই জটিল! তোরা কুসুমকে ডেকে তোল। ওর জেগে থাকা দরকার।’ এই হচ্ছে নিদ্রাকুসুমের প্রতি স্যারদের ভালোবাসা। এটা নাকি একধরনের অসুখ। তাই স্পেশাল কেয়ার নিতে হয়! আমরা এসব দেখে হিংসায় মরি—কেন যে ঘুমকাতুরে হলাম না!

আমরা করছি সরল, ওদিকে কুসুম ঘুমে তরল! বেচারা অঙ্কের অর্ধেকটা পর্যন্ত চোখ খোলা রাখতে পেরেছিল। তিনটা অঙ্ক শিখিয়ে স্যার বললেন, আজ এ পর্যন্তই। পরের তিনটা অঙ্ক বাড়ির কাজ হিসেবে রইল। কুসুম কী করছে রে?’ এবারও কাউয়া সিপু জবাব দিল, ‘স্যার, ও চশমা চোখে দিয়ে স্বপ্ন দেখছে।’ ব্ল্যাকবোর্ড মুছতে মুছতে স্যার বলতে থাকেন, ‘শোন, ঘুমেরও একটা নিয়ম আছে। যখন-তখন ঘুমানো ভালো না। আচ্ছা, তোরা রাতে খাওয়ার পর পর কী করিস রে?’ বোর্ড মোছা শেষ করে স্যার আমাদের দিকে ফেরেন। আমরা কেউ বললাম—শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ি (যেন কত লক্ষ্মী ছেলে!), কেউ বললাম—দাঁত ব্রাশ করি (কত স্বাস্থ্যসচেতন!), কেউ বললাম—আবার অঙ্ক নিয়ে বসি (স্যারকে খুশি করতে)। কিন্তু স্যার সবাইকে হতাশ করে বললেন, ‘ভুল, সবই ভুল। রাতে খাওয়ার পর একটু হাঁটাহাঁটি করবি। এটা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। ইংরেজিতে একটা উপদেশবাক্য আছে, ‘আফটার লাঞ্চ টেক রেস্ট আ হোয়াইল, আফটার ডিনার ওয়াক আ মাইল। বুঝলি কিছু?’

: জি স্যার, একদম পরিষ্কার। পণ্ডিতের ভাব ধরে আলিনূর বলে ওঠে।

: বল দেখি কতটা পরিষ্কার বুঝলি।

: আফটার লঞ্চ টেক রোস্ট আ হোয়েইল, মানে হচ্ছে...উমমম...মানে হচ্ছে—লঞ্চের ওপরে বসে তিমি মাছের রোস্ট খেতে মজা।

প্রদীপ স্যার কিছুক্ষণ চোখ দুটো মার্বেলের মতো করে আলিনূরকে দেখেন। তারপর একটা ধমক লাগিয়ে বসিয়ে দেন। এ সুযোগে আবারও ফোড়ন কেটে ওঠে একজন। কে? কে আবার, কাউয়া সিপু। ও স্যারকে শুনিয়ে আলিনূরকে বলল, ‘পারস না, খালি খালি মাতব্বরি করতে যাস ক্যান?’ ‘মন দিয়ে শোন সবাই,’ স্যার বলতে লাগলেন, ‘লঞ্চ না, লাঞ্চ। এর মানে দুপুরের খাওয়া। আর রোস্ট না, রেস্ট, মানে হচ্ছে বিশ্রাম। দুপুরে খাওয়ার পর একটু বিশ্রাম নিতে হয়। বাসায় থাকলে একটু ঘুমাবি। একে বলে ভাতঘুম। আবার ডিনার মানে রাতে খাওয়ার পর মাইলখানেক হাঁটা ভালো।’

এটুকু শোনার পর আমি স্যারকে বলতে চেয়েছিলাম, রাতে যদি ছিনতাইকারী ধরে, তখন কী হবে? কিন্তু শেষ পর্যন্ত সাহসে কুলায়নি। হঠাত্ মনে পড়ল, বাবার মুখে তো কিছুদিন আগে এ কথাই শুনেছি! তিনি ভাতঘুম প্রসঙ্গেই বলেছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়লাম। স্যার বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, আবার দাঁড়ালেন—

: কী, বলবি কিছু?

: স্যার, আপনার দুটো লাইনের ভালো বাংলা আমি জানি।

: ভালো বাংলা? শোনা তো, দেখি তোর বাংলার দৌড়!

: দিনে খেয়ে বালিশ, রাতে খেয়ে চলিস।

: বাহ্! দারুণ বলেছিস তো! স্যার মুগ্ধ হয়ে আমার মাথায় হাত বোলান। তারপর ঘণ্টা বেজে ওঠে। ক্লাস থেকে বেরিয়ে যান তিনি।

চারটা ক্লাসের পর টিফিন। সিপু বলল, নিদ্রাকুসুমকে ওই সময়েই জেরা করতে হবে। ওর চোখে চশমা মানে আমাদেরই অপমান। কিন্তু আমাদের বোর্ড মিটিংয়ে এটা পাস হলো না। স্যারদের কেউ টের পেলে রায় যাবে কুসুমের পক্ষেই। শেষে চারজন সিদ্ধান্ত নিলাম, ছুটির পর ক্লাসরুমেই চেপে ধরব কুসুমকে। ওকে নিরিবিলি ঝাড়তে হবে।

টিফিনের পর সবাই ক্লাসে ফিরে আসি। আবদুল্লাহ স্যার বিজ্ঞান পড়াতে এলেন। রোল কলের পর টের পেলাম কুসুম নেই! এ কেমন ব্যাপার! স্যার তো বটেই, আমরাও দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। ক্লাসে ঘুমাক আর যা-ই করুক, কুসুম ক্লাস ফাঁকি দিয়েছে—এই অপবাদ কেউ দিতে পারবে না। আমাদের সবাই ক্ষেত্রবিশেষে মাঝেমধ্যে ক্লাস ফাঁকি দিই, কিন্তু কুসুম একেবারেই আলাদা। এবার আমরা বুঝি—ও কতটা ভালো ছেলে। কারও সাতেপাঁচে নেই। কোনো দিন কারও সঙ্গে ঝগড়া করা দূরের কথা, কটু কথাটা পর্যন্ত বলেনি। আমরা যে সব সময় ওকে ভেংচাই, ও হাসিমুখে ওসব শুনতে শুনতেই ঘুমিয়ে পড়ে। আহা রে! গেল কোথায় ছেলেটা?

সবার আগে উঠে দাঁড়াল সিপুই। আবদুল্লাহ স্যারকে কাঁদো কাঁদো গলায় ও বলল, ‘স্যার, আমি কুসুমের বাসা চিনি। এক দৌড়ে গিয়ে খবর নিয়ে আসি, ও বাসায় গেল কি না?’

: উহুঁ, সেটা ঠিক হবে না—স্যার বললেন। ‘বাসায় যদি না গিয়ে থাকে, ওর মা চিন্তায় পড়ে যাবেন। মাথা ঠান্ডা করে ভাবো, আর কোথায় ওকে পাওয়া যেতে পারে। নিজেরা আশপাশে খুঁজে দেখো। না পেলে পরে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা।

: স্কুলের পাশেই আসাদুল্লার হোটেলে গিয়ে দেখা যাক। ওখানে টিফিনে শিঙাড়া খেতে গেছে নাকি। ভালো একটা পরামর্শ দিল হানিফ। স্যার হানিফ আর জাহাঙ্গীরকে পাঠিয়ে দিলেন আসাদুল্লার হোটেলে।

: আনারকলি হলে সিনেমা দেখতে গেছে মনে হয়। বসির বলল।

: তুই চুপ থাক। বসিরকে ধমকে ওঠে পাপ্পু। ‘তুই ক্লাস ফাঁকি দিলে সিনেমা হলে খুঁজে পাওয়া যাবে। কুসুমকে পাব না।’

: না, মানে...যাইতে পারে না? আমতা আমতা করে বসির।

: না, মোটেও যাইতে পারে না। পাপ্পু বলে, ‘কুসুম টিকেট কাইটা ঘুমাইতে যাইব না। হুদাই প্যাঁচাল পাড়িস না।’

বিজ্ঞান ক্লাস শিকেয় উঠল। দুজন, তিনজনের কয়েকটা গ্রুপ তৈরি করে আশপাশের সম্ভাব্য জায়গাগুলোয় খোঁজ নিতে পাঠালেন স্যার। একটা করে গ্রুপ ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে, আর ক্লাসের পরিবেশ আরও গুমোট, আরও ভারী হয়ে ওঠে। টেনশনে স্যারও গম্ভীর হয়ে উঠছেন।

হঠাত্ একটা চিত্কার, তারপর শোরগোল শোনা যায়। ক্লাসরুমের পেছনের জানালা দিয়ে আমরা দেখি—৩০ গজ দূরে স্কুলের পুকুরের কোনায় পিয়ন, দপ্তরিসহ চার-পাঁচজন ছুটে যাচ্ছে। বিপরীত দিক থেকে, যেদিকে স্কুলের টয়লেট, সেখান থেকে বদনা হাতে ছুটে আসছে স্কুলের মালি আইয়ুব আলী। আমাদেরই সমবয়সী। দু-তিন কদম এগিয়েই বেচারা চালের বস্তার মতো ধপ করে পড়ে গেল। তবে জ্ঞান হারায়নি, বসেই আছে। এ পাশ থেকে যারা তাকে সাহায্য করতে দৌড়ে যাচ্ছিল, তাদের আইয়ুব আলী আঙুল দিয়ে টয়লেটের দিকে দেখাচ্ছে, আর কী যেন বলছে। চোখে-মুখে আতঙ্কমাখা। দুজন সাহায্যকারী আইয়ুব আলীকে জড়িয়ে ধরে সাহস দিচ্ছে, বাকি তিনজন গেল ওর নির্দেশিত পথে। আমরা ভয়ে ভয়ে ভাবছি, আবার কোন অঘটন ঘটল? ওই তিনজন গিয়ে আস্তে আস্তে, সাবধানে টয়লেটের দরজা খুলল। তারপর আবার তারস্বরে চিত্কার। তারস্বরে এবং সমস্বরে। আমরা ভয়ই পেয়ে গেলাম। হঠাত্ দেখি টয়লেটের ভেতর থেকেও আরেকজন বেরিয়ে আসছে।

এ যে আমাদের কুসুম! চোখ কচলাতে কচলাতে বেরিয়ে আসছে কুসুম। আমরা সবাই হুড়মুড় করে ক্লাস থেকে বেরিয়ে দৌড়ালাম ওদিকে। চিত্কার-চেঁচামেচি শুনে অন্যান্য ক্লাসের ছাত্র-শিক্ষকেরাও পুকুরপাড়ে রওনা দিয়েছেন। অকুস্থলে পৌঁছে যা শুনলাম, তা হচ্ছে—মালি আইয়ুব আলী পুকুর থেকে বদনা ভরে টয়লেটের দরজা খুলেই ভূত দেখে চিত্কার করতে করতে উল্টো দৌড় লাগায়। টয়লেটে নাকি দিগম্বর হয়ে ভূত বসে আছে! আসলে টিফিনের পর আমাদের ‘নিদ্রাকুসুম’ টয়লেটে গিয়ে ভুলে ছিটকিনিটা লাগায়নি। কিংবা লাগালেও তা জায়গামতো সেট হয়নি। বেশির ভাগ স্কুল-কলেজ, অফিসের ছিটকিনি তো ত্যাড়া-ই থাকে। তারপর ‘নিদ্রাকুসুম’ ওখানে বসেই যথারীতি ঘুমিয়ে পড়ে।

খুব একচোট হাসাহাসি হলো। প্রদীপ স্যার কেবল মুচকি হেসে কুসুমকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী রে, বাথরুমেই ভাতঘুম দিয়ে দিলি?’

অলংকরণ: বিপ্লব চক্রবর্তী