কাইয়ুম চৌধুরী

ছবি আঁকতেন কাইয়ুম চৌধুরী। তাঁর হাতে ছবিগুলো হয়ে উঠত অন্য রকম। মুক্তিযোদ্ধাদের যে ছবিগুলো এঁকেছেন, তাতে লুঙ্গি-গামছায় মুক্তিযোদ্ধারা হয়ে উঠেছেন উজ্জ্বল। মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের বিষয়টি এভাবেই তিনি ঢুকিয়ে দিয়েছেন ছবিপ্রেমীদের মনে।

গত বছরের মার্চ মাসে এক স্মৃতিচারণা অনুষ্ঠানে সৈয়দ শামসুল হক জানালেন, কাইয়ুম চৌধুরী একবার তাঁকে বলেছিলেন, ‘হক, যেদিন আমরা আমাদের জীবনযাপনের প্রতিটি ক্ষেত্রে জানালার পর্দায়, দরজার পর্দায়, শার্টের কাপড়ে ছবি দেখতে পাব, সেদিনই বুঝব জাতি সত্যিই এগিয়ে গেছে।’

শিল্পের নানা দিক নিয়ে আগ্রহ ছিল তাঁর। বইয়ের প্রচ্ছদ, পত্রিকার ইলাস্ট্রেশনেও তিনি ছিলেন সমান পারদর্শী। আমাদের দেশের প্রধান একজন নকশাবিদ ছিলেন তিনি। তাঁর ছবিতে জ্যামিতিক নকশা ও বর্ণবাহুল্য সহজেই চোখে পড়ে। বাংলা হরফ নিয়ে কত যে কাজ আছে তাঁর, তা বলে শেষ করা যাবে না।

১৯৩২ সালের ৯ মার্চ তিনি জন্মেছিলেন ফেনীতে। মক্তবে হয়েছিল তাঁর শিক্ষার হাতেখড়ি। বাবার ছিল বদলির চাকরি। তাই তিনি এরপর ভর্তি হয়েছেন চট্টগ্রামের নর্মাল স্কুলে। এরপর কুমিল্লা হয়ে যান নড়াইলে। সেখান থেকে সন্দ্বীপ, আবার ফেনী। এরপর ফরিদপুর, ময়মনসিংহ। এখানেই সিটি কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। স্কুলজীবন থেকেই আঁকাআঁকির প্রতি ছিল তাঁর টান। ১৯৪৯ সালে তিনি ভর্তি হন আর্ট ইনস্টিটিউটে, পাস করেন ১৯৫৪ সালে। 

তোমরা তো জানোই, বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে পাকিস্তানের শোষণের প্রতিবাদ করতে করতে। সেই যে ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা বিতর্ক উঠল, ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে প্রাণ দিল বাংলার ছেলেরা, তারই পথ ধরে ১৯৬৯ সালে এ দেশে হলো গণ-অভ্যুত্থান, তারপর ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পেল সরকার গঠন করার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা। আন্দোলনের প্রতিটি পর্যায়েই কাইয়ুম চৌধুরী সক্রিয় ছিলেন। শিল্পী হিসেবে যেমন থেকেছেন আন্দোলনের সঙ্গে, তেমনি অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নেমেছেন রাজপথে।

বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকায় তিনি পালাবদল ঘটান জহুরুল হকের সাতুসাঁতার বইয়ের প্রচ্ছদে। ১৯৫৭ সালে তিনি আর্ট কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। শামসুর রাহমানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে। এ বইয়ের প্রচ্ছদ করেছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী। ১৯৬১ সালে তিনি যোগ দেন অবজারভার পত্রিকার চিফ আর্টিস্ট হিসেবে।

প্রথম আলো পত্রিকার সঙ্গে ছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী। পত্রিকাটির অঙ্গসৌষ্ঠব গড়ে উঠেছে তাঁরই নির্দেশনায়।

বর্ণোজ্জ্বল ছিল কাইয়ুম চৌধুরীর ছবি। লাল, নীল আর সবুজ রং প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার করেছেন তিনি। পুতুল, পাখা, হাঁড়ি. শীতলপাটি, কাঁথার মতো লোকশিল্পকে তিনি নিয়ে এসেছিলেন তাঁর ছবিতে।

আঁকাআঁকির বাইরে শিল্পের অনেক শাখায় ছিল তাঁর বিচরণ। চলচ্চিত্রের প্রতি ছিল তাঁর টান। তাঁর খুব প্রিয় ছিলেন হলিউডের নায়িকা অড্রে হেপবার্ন। পুরোনো কালের হলিউডের ছবির খুব বড় ভক্ত ছিলেন তিনি। পুরোনো অসংখ্য রেকর্ডের সংগ্রহ ছিল তাঁর। কবিতা লিখতেন, ছড়া লিখতেন। জীবনটাকে আনন্দময় করে তোলার চেষ্টা করে গেছেন সারা জীবন।

২০১৪ সালের ৩০ নভেম্বর রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়ামে উচ্চাঙ্গ সংগীতের আসরে বক্তব্য দেওয়ার সময় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। শিল্পীকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিত্সক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।

সৌজন্য: গুণীজন ট্রাস্ট