আমার নাম মায়ের দোয়া

আমার নাম মায়ের দোয়া। বয়স মাত্র এক সপ্তাহ। আমি দেখতে খুবই সুন্দর। এ জন্য খুব গর্ব হয় আমার। আমার পুরো শরীরে ছবি আঁকা আছে। নানা রঙের পাখির ছবি, বর-বউ ও নায়ক-নায়িকার ছবি, পালকির ছবি। ঝলমলে এসব ছবির দিকে তাকিয়ে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে মুগ্ধ হয়। তখন আমার যে কী ভাব হয়, তা আর কী বলব তোমাদের। ছেলেমেয়েরা স্কুল বা কোচিংয়ে যাওয়ার সময় আমাকে দেখলে আমার সিটে বসেই যেতে চায়। মায়েরাও দেখি সামনে থাকা বুড়ো কোনো রিকশা না ডেকে আমার কাছেই আসে।
মাত্র এক সপ্তাহ বয়স তো আমার, তাই আমার এত কদর। যত দিন এ রকম তরতাজা থাকব, তত দিন আমার কদর থাকবে। তোমাদের দাদি-নানিদের মতো বুড়ো হয়ে যখন আমার চামড়া ঝুলে পড়বে, তখন আমার দিকে কেউ ফিরেও তাকাবে না। তোমাদের মতো আমারও চামড়া আছে কিন্তু। যাকে তোমরা হুড বলো আর সেই হুডটি যে প্লাস্টিকের মতো কাগজ দিয়ে মোড়ানো থাকে, তা হলো আমার চামড়া। আর বুড়ো হলে এই চামড়া এদিক থেকে ছিঁড়ে, ওদিক থেকে ছিঁড়ে খুলে ঝুলে পড়বে। ইশ্! বুড়ো হব আমি! ভাবতেই কান্না পাচ্ছে। এই চকচকে যৌবন আমার থাকবে না, ভাবতেই পারি না! থাক, বুড়ো বয়সের কথা ভেবে খালি খালি মন খারাপ করব না আর। যত দিন যুবক আছি, তত দিন আনন্দ-ফুর্তি করে কাটাই।
আমার যেদিন জন্ম হলো, সেদিন আমাকে নিয়ে বের হলো আমার মনিব। আমরা কিন্তু তোমাদের মতো নই, এ ক্ষেত্রে আমরা হলাম গরু-ছাগলের মতো। জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গে দৌড়াদৌড়ি-লাফালাফি সবই করতে পারি। তোমাদের মতো পুরো এক বছর লাগে না আমাদের হাঁটা শিখতে। জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গে যুবকদের মতো শাঁ শাঁ করে দৌড়াতে পারি আমরা।
আমাকে বানাতে আমার মনিবের প্রায় সাত হাজার টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু তার নিজের বাসায় রাখার জায়গা নেই বলে ভাড়া নিয়েছে একটি গ্যারেজ। রাতের বেলা আমাকে সেখানে রাখে। যাক গে, যা বলছিলাম, গ্যারেজ থেকে আমার মনিব আমাকে নিয়ে উড্ডয়নবাজ ঘোড়ার মতো একনিমেষে বাংলামোটর ওভারব্রিজের কাছে চলে এল। আমার মনিব বেশ শক্ত-সামর্থ্য আর তরতাজা যুবক।
বাংলামোটর ব্রিজের কাছে এসে দেখি এক বাচ্চাকে নিয়ে মা কোচিংয়ে যাওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। গ্রিনরোড যাবে। আমার মনিব ভাড়া চেয়ে বসল ৯০ টাকা। বাচ্চাটার মা মুখ ঝামটানি দিয়ে বলল, ‘থাক, তোমার আর ভাড়া খাটা লাগবে না, সারা দিন বসে বসে হাওয়া খাও।’ কথাটা শুনে আমার মন আর মেজাজ খুবই খারাপ হলো! মন খারাপ হওয়ার কারণ, সত্যি সত্যি মনিব যদি ভাড়া না পায়, তাহলে তো সারা দিন বসে বসে ঝিমাতে হবে। আমার রক্ত তো গরম। আমার কি আর বসে বসে ঝিমাতে মন চায়, বলো! কিছুক্ষণ আগে যখন আমার মনিব আমাকে নিয়ে ইস্কাটনের গ্যারেজ থেকে ক্রিং ক্রিং শব্দে শাঁই শাঁই করে উড়ে আসছিল, তখন আমার যে কী ভালো লাগছিল!
আর মেজাজ খারাপের কারণ মহিলার এমন মুখ ঝামটানি। তুই বাবা মুখ ঝামটানি দেওয়ার কে? স্বীকার করছি আমার মনিব অনেক বেশি ভাড়া চাইছে। তোরাও তো বাবা ১০০ টাকার ভাড়া ৪০ টাকা বলিস। তখন? তখন আমার মনিবদের কেমন লাগে বল দেখি। তোর পোষাবে না, তুই যাবি না, তুই মুখ ঝামটানি দেওয়ার কে?
যা-ই হোক, আমার মনিব গামছা দিয়ে চোখমুখ মুছতে মুছতে পাশের জনের সঙ্গে গল্প করছে। মহিলাটা আমার পাশে অন্য একটা রিকশার ভাড়া ঠিক করল, সে ৪০ টাকায় রাজি হয়েছে। মহিলাটি আমার মনিবের দিকে কটমট করে তাকিয়ে যে–ই রিকশায় উঠতে যাবে, অমনি বিপত্তি। ছেলেটি বেঁকে বসল, ‘না, আমি এই পুরোনো রিকশায় যাব না। ওই ময়ূরের পেখম মেলা সুন্দর চকচকে রিকশায় যাব।’ মা ছেলেটিকে জোরে এক ধমক দিল। হ্যাঁচকা টান দিয়ে জোর করে ওঠানোর চেষ্টা করল রিকশায়। পারল না কোনোভাবেই। ছেলের সেই এক জেদ, ‘আমি ওই চকচকে নতুন রিকশায় যাব।’ এদিকে কোচিংয়ের দেরি হয়ে যাচ্ছে। ছেলেকে কিছুতেই রিকশায় ওঠাতে পারছে না মহিলা। শেষমেশ কী আর করা, ছেলেটিকে নিয়ে আমার কাছে এল তার মা। আমার মনিবও তো কম যায় না, সে মহিলার দিকে তাকিয়ে মুখ ফেটকে এমন একটা হাসি দিল, পিত্তি জ্বলে গেল মহিলার, কিন্তু কিছু বলল না সে। আমার মনিব নেহাত ভালো মানুষ, অন্য কেউ হলে এই সুযোগ কখনো হাতছাড়া করত না। আরও ১০০ টাকা বেশি চেয়ে বসত। হয়তো ছেলেটির প্রতি মায়া হয়েছে আমার মনিবের। আমার মনিব ঘাড় থেকে গামছাটা নিয়ে দু-তিনবার জোরে জোরে ঝাড়া দিয়ে আবার কাঁধে ফেলে আমাকে নিয়ে ছুটে চলল। আমার মন নেচে উঠল খুশিতে।
একদিন কী হয়েছে, জানো? সে এক ভয়ংকর ব্যাপার। এখনো মনে হলে আমি ভয়ে কেঁপে উঠি। সেদিন আমার মনিব আমাকে নিয়ে ধানমন্ডির সাতমসজিদ রাস্তা ধরে যাচ্ছে। রাত খুব বেশি নয়, আনুমানিক নয়টা হবে। বৃষ্টি হচ্ছে। বর্ষাকাল তো। বিকেল থেকেই ঝুমবৃষ্টি হচ্ছে। আমার সিটে বসে আছে ৩০-৩২ বছরের এক যুবক। অফিস থেকে বাসায় ফিরছে সে। রাস্তায় গাড়ি, রিকশা চলাচল করছে, তবে খুব বেশি নয়। ঝুমবৃষ্টির মধ্যে লোকজন ঘর থেকে খুব একটা বের হয় না। শুধু অফিস-ফেরত লোকজন চলাচল করছে। হঠাৎ কোথা থেকে কালো কাপড়ে মুখ ঢাকা চারটা লোক এসে রিকশার গতি রোধ করল। শুধু চোখ দুটি বের করা, পুরো মুখ কালো কাপড়ে ঢাকা। লোকগুলোকে দেখে প্রথমে আমি ভূত ভূত বলে প্রাণপণে চিৎকার দিচ্ছিলাম, যদিও আমার চিৎকার কেউ শুনতে পায়নি। দুজন আমার সিটে বসা লোকটির দুই পাশে বসে লম্বামতো কী জানি একটা ধরল, লাইটের আলো পড়ে চকচক করে উঠল সেই লম্বামতো জিনিসটা। তখন বুঝতে পারলাম ওদের আসল পরিচয়। চকচকে চাকুর ফলা দেখে আমার বুক হিম হয়ে গেল। এই বুঝি দিল এক পোঁচ! কিন্তু না, তারা কিছু করল না। চাকু ধরে থাকল শুধু। বাকি দুজন মিলে লোকটার পকেট থেকে ফোন, ঘড়ি আর মানিব্যাগ নিয়ে চম্পট দিল।
আরেক দিনের কথা বলছি তোমাদের, কথাটি মনে হলে আমার এখনো হাসি পায় খুব। আমার মনিব আমাকে নিয়ে বেইলি রোডের এক গলিতে দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ দেখি কোথা থেকে এক ছেলে আর এক মেয়ে এসে ভাড়া ঠিক করে বসল আমার সিটে। এইট-নাইনে পড়ে মনে হচ্ছে। স্কুলড্রেস পরা। আমার মনিবকে বলল, ‘আঙ্কেল, জোরে চালান।’ কেমন ছটফট করছে ওরা। ওদের হাবভাব দেখে আমার কেমন জানি সন্দেহ হচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর ওদের কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারলাম, ওরা পালিয়ে বিয়ে করতে যাচ্ছে। হায় আল্লাহ! এতটুকুন ছেলেমেয়ে ওরা! এত্ত বড় ভুল করতে যাচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে বদমাশ দুটোর দুই গালে কষে দুটো চড় লাগিয়ে বাড়ি নিয়ে যাই। ওদের বাবা–মায়ের কথা মনে হতেই দুঃখে আমার বুকটা হু হু করে উঠল। আমার তো কিছুই করার সাধ্য নেই। আমি আর কী করতে পারি, বলো? সৃষ্টিকর্তার কাছে করজোড়ে মিনতি করতে লাগলাম, এই ছোট্ট দুটি ছেলেমেয়েকে তুমি রক্ষা করো। আমার মনিবের ওপর খুব রাগ হচ্ছিল। সব বুঝে কেন চুপ করে আছে সে? ওদের কিছু বলছে না কেন? ওদের কেন বোঝাচ্ছে না, এই বয়সে এই ভুল করলে ভয়ংকর বিপদ হবে ওদের। কিছুক্ষণ পর দেখি আমার মনিব একটা থানার একটু দূরে রিকশাটি দাঁড় করাল। ওদের আমতা আমতা করে লাজুক ভঙ্গিতে বলল, ‘আফা, আপনারা একটুখানি বসেন, আমি একটুখানি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়া আসি। যামু আর আমু।’ ও মা! একটু পর দেখি মনিব দুজন পুলিশ নিয়ে এসে আমার সামনে দাঁড়াল। পুলিশ দুজনকে দেখে ওরা পড়ি কি মরি দৌড়াতে লাগল। কিন্তু পুলিশের সঙ্গে কি ওরা পারে!
পুলিশ খপ করে ওদের হাত ধরে ফেলল, ‘বাবাজি, পালানোর পথ নাই। বিয়ের শখ চিরদিনের মতো না মিটিয়ে ছাড়ছি না তোমাদের।’
ওরা পুলিশের হাতে-পায়ে ধরে কান্না শুরু করল, ‘আঙ্কেল, আমাদের ছেড়ে দিন। আমরা আর এমন কাজ কখনো করব না। প্লিজ আঙ্কেল, প্লিজ! আমাদের বাবা–মাকে বলবেন না, তারা আমাদের মেরে ফেলবে। প্লিজ প্লিজ।’
ওদের কাকুতি-মিনতিতে পুলিশ গলল না। বরং জোরে এক ধমক লাগিয়ে ওদের বাবা–মায়ের ফোন নম্বর নিয়ে ফোন করল। কিছুক্ষণ পর ওদের মা-বাবা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল। এসেই কোনো কথা নেই, চড়থাপ্পড় আর কিলঘুষি মারতে শুরু করল। এভাবে মারতে মারতে নিয়ে গেল ওদের।
এভাবে রাস্তায় চলতে চলতে কত যে ঘটনার সাক্ষী আমি! সব তো বলে শেষ করতে পারব না। এখন যে গল্পটি বলব, তা শুনে তোমাদের দুই ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়বে।
নেভি রোডের এক বাসার এক মহিলার সঙ্গে আমার মনিবের চুক্তি হলো। রোজ সকাল সাতটায় আমার মনিব তার ক্লাস ফোরে পড়ুয়া ছেলে রাতুল আর তাকে নিয়ে সিদ্ধেশ্বরীর একটি স্কুলে নামিয়ে দেবে। সকালবেলা রিকশা পাওয়া মুশকিল, তাই মহিলাটি আমার মনিবের সঙ্গে এই চুক্তি করল। আমার মনিবও স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি ভাড়া পাওয়ায় রাজি হয়ে গেল। রোজ আমার মনিব ওদের নিয়ে স্কুলে নামিয়ে দেয়। যেতে যেতে মা-ছেলের কত গল্প আর কত স্বপ্নের কথা শুনি! রোজ রোজ কত স্বপ্ন বোনে তারা। রাতুল ক্লাস ফোর থেকে খুব ভালো রেজাল্ট করে ক্লাস ফাইভে উঠল। মা রাতুলকে বলল, ‘বাবা, ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পেলে তোমাকে অনেক অনেক গিফট দেব।’
রাতুল তো মহা খুশি! মাকে বলল, ‘মা, আমি খুব ভালো করে পড়াশোনা করব। দেখো, সত্যি সত্যি আমি বৃত্তি পাব।’ সকালে স্কুলে যাওয়ার সময় কোনো দিন রাতুল তার মাকে বলে, ‘মা, আমি যদি বৃত্তি পাই, তাহলে আমাকে একটা দামি বেবলেড কিনে দিয়ো।’ মা বলে, ‘আচ্ছা।’ আবার কোনো দিন রাতুল তার মাকে বলে, ‘মা, আমি যদি বৃত্তি পাই, তাহলে আমাকে একটি দামি ঘড়ি কিনে দিয়ো।’ মা বলে, ‘আচ্ছা।’ আবার কোনো দিন রাতুল মাকে বলে, ‘মা, আমাকে একটা রোবট কিনে দিয়ো।’ মা বলে, ‘আচ্ছা।’ এভাবে রাতুল প্রতিদিন তার মাকে কোনো না কোনো গিফটের কথা বলে। উত্তরে মা বলে, ‘আচ্ছা।’
এভাবে সময় গড়িয়ে গেল। রাতুল ক্লাস ফাইভে পিইসি পরীক্ষা দিল। প্রতিটি পরীক্ষাই খুব ভালো দিয়েছে। মা খুব খুশি, ছেলেও খুশি। কিছুদিন ছুটি থাকার পর সিক্সের ক্লাস শুরু হলো। খুব ভালো রেজাল্ট করে রাতুল ক্লাস সিক্সে উঠেছে। বৃত্তির রেজাল্ট এখনো প্রকাশিত হয়নি।
একদিন সকালবেলা রাতুলকে নেওয়ার জন্য আমার মনিব ওদের বাড়ির সামনে প্রতিদিনের মতো দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সাতটা পার হয়ে যাচ্ছে, রাতুল আর তার মা আসছে না। হঠাৎ দেখলাম রাতুলের মাকে কয়েকজন মিলে ধরাধরি করে আমার সিটে বসিয়ে দিল। তিনি খুব অসুস্থ। পাশে রাতুলের বাবা বসল। আমরা ছুটে চললাম বারডেম হাসপাতালে। ওখানেই তাকে ভর্তি করানো হলো। কিন্তু কয়েক দিন পর শুনলাম, রাতুলের মা মারা গেছে। আমার মনিব কথাটা শুনে ডুকরে কেঁদে উঠল। আমিও অনেক কাঁদলাম। আপা, মানে রাতুলের মা খুবই ভালো মানুষ ছিল। আমার মনিবকে খুব সম্মান করত, মানে সব সময় আপনি বলত। কখনো তুই–তোকারি করত না। অন্য আপারা তো সব সময় আমার মনিবকে তুই–তোকারি করে। আমার মনিব বেখেয়ালে কখনো–সখনো অন্য রিকশাকে ধাক্কা মারলে আপা কোনো সময় রাগ করত না, ধমক দিত না। খুব মোলায়েম সুরে বলত, ‘একটু দেখেশুনে, সাবধানে চালান।’ এমন ভালো মানুষ আপা মরে গেল!
এখন রোজ সকালে রাতুল একা একা আমার সিটে বসে বিষণ্ন মনে স্কুলে যায়। আমার মনিব বহুদিন ধরে রাতুলকে স্কুলে নিয়ে যেতে যেতে ওকে খুব ভালোবেসে ফেলেছে। রাতুলকে খুব আদর করে আমার মনিব। আমিও রাতুলকে খুব ভালোবাসি, খুব আদর করি। আমার মনিব রাতুলের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে। কিন্তু আমি তো কোনোভাবে আমার ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারি না।
একদিন সকালে কাঁদতে কাঁদতে রাতুল স্কুলে যাওয়ার জন্য আমার সিটে উঠে বসল। আমার মনিব জিজ্ঞেস করল, ‘রাতুল, কী হয়েছে বাবা, কাঁদছ কেন?’
রাতুল আরও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। আমার মনিব ওর গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে অনেক আদর করল । বলল, ‘কী হয়েছে বাবা, বলো?’
রাতুল কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘জানেন আঙ্কেল, কাল আমার বৃত্তির রেজাল্ট হয়েছে, আমি ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছি।’ রাতুল আবার ডুকরে কেঁদে উঠল।
আমার মনিব রাতুলকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে করতে বলল, ‘কেঁদো না, বাবা, তোমার মা আকাশ থেকে তোমাকে দেখতে পাচ্ছেন। তোমার কান্না দেখলে তিনি কষ্ট পাবেন। তোমার বৃত্তি পাওয়ায় তিনি অনেক খুশি হয়েছেন। তুমি হাসিমুখে থাকলে তিনিও খুশি হবেন।’
রাতুল সঙ্গে সঙ্গে দুই চোখের পানি মুছে আকাশের দিকে তাকিয়ে হেসে চিৎকার করে বলে উঠল, ‘জানো মা, আমি বৃত্তি পেয়েছি!’
পরদিন সকালবেলা রাতুল আর তাদের বাসার কাজের বুয়া মিলে বড় একটা বাক্স ধরাধরি করে আমার সিটের নিচে রাখল।
রাতুল বলল, ‘আঙ্কেল, আজ আমি স্কুলে যাব না।’
আমার মনিব অবাক হয়ে বলল, ‘কেন বাবা?’ বাক্সটির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এই বাক্সের মধ্যে কী আছে?’
রাতুল বলল, ‘জানেন আঙ্কেল, আমি রোজ স্কুলে যাওয়ার সময় মায়ের কাছে যা যা গিফট চেয়েছি, মায়ের হাতে যখনই টাকা হয়েছে, তখনই মা একটা একটা করে গিফট কিনে এই বাক্সে রেখেছে। কারণ, রেজাল্ট হওয়ার পর একসঙ্গে এতগুলো গিফট কেনার টাকা মায়ের হবে না। মা বাক্সটি লুকিয়ে রেখেছিল। মারা যাওয়ার আগের দিন বাবাকে কানে কানে এই বাক্সের কথা বলেছে। আরও বলেছে, রেজাল্ট হওয়ার আগে বাবা যেন আমাকে এটি বের করে না দেয়। মায়ের বিশ্বাস ছিল, আমি বৃত্তি পাব।’
আমার মনিব বলল, ‘এই বাক্সের জিনিসগুলো বের করে তুমি খেলাধুলা করো, বাবা। রিকশায় তুললে কেন?’
‘না আঙ্কেল, এগুলো দিয়ে আমি খেলব না। আমরা এখন কাঁঠালবাগান যাব। ওখানকার একটি এতিমখানার ঠিকানা আছে আমার কাছে। সেই এতিমখানায় গিয়ে এতিম ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে এই খেলনাগুলো গিফট করব।’
গিফটগুলো দেওয়া শেষ করার পর রাতুল হাসতে হাসতে মুখটা উঁচু করে আকাশের দিকে তাকাল। নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা ছোটাছুটি করছে। রাতুল দেখতে পেল, স্পষ্ট দেখতে পেল, সেই ভেলায় চড়ে রাতুলের মা রাতুলের দিকে তাকিয়ে হেসে হেসে হাত নাড়ছে। রাতুলও হাত নাড়ছে। রাতুলের মুখে হাসি, চোখে জলের ধারা।

অলংকরণ: তীর্থ