রক্তাক্ত চিরকুট

অলংকরণ : সব্যসাচী মিস্ত্রী

পারসনস বুলভার্ড থেকেই ঘটনার শুরু। রাত সাড়ে নটা। সাবওয়ের ঠিক উল্টো দিকে মরক্কান ছেলে ফাহাদের যে খাবারের গাড়িটা আছে হাইল্যান্ড অ্যাভিনিউয়ের দিকটায়, ঠিক তার সামনে এসে ধপাস করে পড়ে গিয়েছিল লোকটা। তারপর উপুড় হয়েই হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছিল সামনের দিকে। সে হাতে রক্তের ছোপ আর তাতে ধরা একটি চিরকুট। চিরকুটেও রক্ত লেগে আছে। লালবাতি থাকায় কয়েকটি গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়েছিল জ্যামাইকার এই ব্যস্ত রাস্তায়। কিন্তু ঠিক সে সময় সবুজ বাতি জ্বলে উঠল। তাই গাড়িগুলো থেকে কেউ নেমে এল না। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল না লোকটার দিকে; বরং শাঁ শাঁ করে ছুটে উধাও হয়ে গেল গাড়িগুলো। আবার জনশূন্য রাস্তা!
ফাহাদ ওর গাড়ি থেকে উঁকি দিয়ে লোকটিকে দেখল। এই রং আর চেহারার মানুষ ও চেনে। এরা সাধারণত দক্ষিণ এশিয়ার হয়। এক বাঙালির বাড়ির বেজমেন্ট বা মাটির তলার একটি ঘরে ভাড়া থাকে ফাহাদ। বেজমেন্টের ভাড়া কম হয়। ফাহাদ সে সুযোগটাই নিয়েছে। এখন ওর সামনে পড়ে থাকা লোকটিকে বাঙালি বলে মনে হচ্ছে। ইংরেজিতেই ও জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে তোমার?’
লোকটা উত্তর দিল না; বরং সেভাবেই নিস্তেজ হয়ে পড়ে রইল।
মরে গেল নাকি? সত্যিই ভয় পেল ফাহাদ। এখানে, একেবারে ওর খাবারের গাড়ির সামনে যদি লোকটা মরে যায়, তাহলে নিউইয়র্ক পুলিশ এসে জেরার পর জেরা করে ফাহাদের বারোটা বাজাবে। লোকটা যেন মরে না যায়, সে কামনা করে ঈশ্বরকে ডাকতে লাগল সে।
গ্রীষ্মের রাত। হাওয়া দিচ্ছে, কিন্তু তাতে গরম কমছে না। তাই লোক চলাচল একেবারেই কম। ফাহাদ ডানে–বাঁয়ে দুদিকেই তাকাল। নাহ্‌! কেউ নেই। মান্নান সুপারমার্কেটের দিক থেকেও কেউ আসছে না। হাইল্যান্ডের এ জায়গাটা বুঝি আজ ফন্দি করেই জনশূন্য হয়ে রয়েছে।
‘পানি...’ বিড় বিড় করে বলল লোকটা।
‘হোয়াট?’ না বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করল ফাহাদ।
রক্তাক্ত লোকটা কোনোরকমে চোখ খুলল। আবার বলল, ‘পানি’; তারপর বুঝল এটা বাংলাদেশ নয়, ওর সামনে গাড়ির ভেতর যে লোকটি দাঁড়িয়ে আছে বার্গার বা নুডলস বিক্রি করার জন্য, সে বাংলাদেশি নয়। তাই মৃদু গলায় বলল, ‘ওয়াটার।’
ফাহাদ বুঝতে পারল। যে পানির বোতল ও দুই ডলারে বিক্রি করে, তা বিনে পয়সায় বাড়িয়ে ধরল এই আগন্তুকের দিকে। লোকটা ঢক ঢক করে পানি খেল। কিছুটা গড়িয়ে পড়ল ওর ঠোঁটের কষ বেয়ে।
‘প্লিজ, টেক দিস পেপার। ডোন্ট শো অ্যানিবডি, ইটস সিক্রেট...’ ইংরেজিতে বলার চেষ্টা করল লোকটা।
তার হাতের রক্তমাখা কাগজটা নেবে কি নেবে না, ফাহাদ সে কথা ভাবল কিছুক্ষণ। তারপর রাস্তার এদিক–ওদিক তাকাল। নেই—একজন মানুষও নেই। তার মানে ওকে কেউ দেখছে না। পকেট থেকে রুমাল বের করে সেই রুমালের সাহায্যে লোকটার হাতের চিরকুটটা নিল ফাহাদ। চোখ বন্ধ করেই একটু হাসল লোকটা। তারপর জ্ঞান হারাল। হতবিহ্বল ফাহাদকে অবাক করে দিয়ে খুব শিগগির লোকটার জ্ঞান ফিরে এল এবং সে ফিসফিস করে বলল, ‘আই উইল গেট ইট ফ্রম ইউ।’
তারপর ঘোর মাতালের মতো টলতে টলতে হাইল্যান্ড অ্যাভিনিউয়ের দিকে বাঁক নিয়ে চোখের সামনে থেকে হারিয়ে গেল লোকটা। ফাহাদ নিজের হাতে ধরা চিরকুটটা দেখতে লাগল অবাক হয়ে।
ঠিক সে সময় তিনজন মানুষ, এদের দুজন দক্ষিণ এশীয়, একজন আফ্রিকান, হন্তদন্ত হয়ে এসে দাঁড়াল ফাহাদের গাড়ির কাছে। ফাহাদ দ্রুত চিরকুটটা লুকিয়ে ফেলল খাবারদাবারের মধ্যে।
‘এখানে কি একজন বাঙালিকে দেখেছ?’ ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল দক্ষিণ এশীয় একজন।
‘বাঙালি?’ না বোঝার ভান করে প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্ন ছুড়ে দিল ফাহাদ।
‘বাঙালি মানে আমাদের মতো চেহারা। এই আমার মতো।’
‘না তো!’ অবলীলায় মিথ্যে বলে দিল ফাহাদ।
‘কিন্তু এ পথেই তো ওর আসার কথা!’ সংশয় নিয়ে বলল আফ্রিকান যুবক।
‘সে আমি কী করে বলব? আর এলেও আমার চোখ এড়িয়ে যেতে পারে।’ বলল ফাহাদ।
‘চোখ এড়াবে না!’ ক্রূর হেসে বলল আরেকজন দক্ষিণ এশিয়ান। ‘যে রকম রামধোলাই খেয়েছে, তাতে বাবা রে মা রে বলে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেই দৌড়াতে হবে ওকে!’
‘মানে, তোমরা ওকে মেরেছ?’ যেন কিছুই জানে না, এ রকম নিষ্পাপ শিশুর মতো জিজ্ঞেস করল ফাহাদ।
লোকটা নিজের ভুল বুঝতে পারল। বলল, ‘না। আমরা মারিনি। ওকে মার খেতে দেখেছি। তাই ওকে খুঁজতে এসেছি।’
ওরা বুঝল, ফাহাদের কাছ থেকে কোনো তথ্য পাওয়া যাবে না। তাই এবার দলটি হাইল্যান্ড অ্যাভিনিউয়ের দিকে দৌড় লাগাল। ফাহাদের বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। ভয়ও পেল ও। যদি লোকটাকে ধরে ফেলে ওরা!

হিলসাইড অ্যাভিনিউ
মাত্র এক মাসের জন্য নিউইয়র্কে এসেছে শৌনক। ও এসেছে মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টের পক্ষ থেকে আমন্ত্রিত হয়ে, পরিবারের বাকি তিনজন পারিবারিক আমন্ত্রণে। বাবা, মা আর সনকা আপুকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে সুজন কাকু। সবার জন্যই এত বড় একটা ছুটি ম্যানেজ করা খুব কঠিন। শৌনক ছাড়া বাকি তিনজন অফিস আর বিশ্ববিদ্যালয়কে বুঝিয়েছে, কেন তারা এক মাসের জন্য আমেরিকায় যাচ্ছে।
নিউইয়র্কের মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট থেকে বিশ্বব্যাপী কুইজ প্রতিযোগিতা হয়েছিল। আধুনিক চিত্রকলা নিয়েই ছিল প্রশ্নগুলো। সারা বিশ্বের শিক্ষার্থীরা চাইলে অংশ নিতে পারত এ প্রতিযোগিতায়। দেখা গেল, শৌনকের অবস্থান হয়েছে সেরাদের সেরার মধ্যে। তাই ওকে পনেরো দিনের জন্য নিউইয়র্কে থাকা–খাওয়া এবং হাতখরচ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ও কি একা আসবে? একা এলে ভালো লাগবে? সে কারণেই এসেছে অন্যরা ।
মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টে ভ্যান গঘ, পিকাসো, ক্লদ মনে, পল সেজান, গগ্যার আঁকা ছবি আছে। ছবি আছে আরও অনেক শিল্পীরই। শৌনক সেগুলো নিয়ে পড়াশোনা করে নিল খানিকটা।
শৌনকের আমেরিকা যাওয়া যখন ঠিকঠাক, তখন শৌমিক মাহমুদ আর ইলোরা মাহমুদ ঠিক করলেন, চারজনের জন্যই ভিসার আবেদন করবেন। ভাগ্য ভালো থাকলে ভিসা মিলে যাবে এবং গেলও। শৌনকের সুজন কাকু থাকেন নিউইয়র্কে, সে কথা বলতেই ভিসা অফিসার আর কোনো সমস্যা করেননি। ছয় মাসের ভিসা দিয়ে দিয়েছেন। তবে শৌনকেরা থাকবে এক মাস। এর বেশি নয়। এ সময়ের মধ্যে যা যা দেখার দেখে ফেলবে বলে ঠিক করেছে ওরা। পছন্দের তালিকায় জাদুঘরগুলো তো রয়েইছে, থাকবে নায়াগ্রা জলপ্রপাত।
পারসনস বুলভার্ডের হাইল্যান্ড অ্যাভিনিউতেই ওর সুজন কাকুর বাড়ি। সেখানেই প্রাথমিকভাবে উঠেছে ওরা। কাতার এয়ারওয়েজের প্লেনটা জেএফকে বিমানবন্দরে নেমেছিল সন্ধ্যা সাতটায়। শৌনকের যদিও হোটেলে থাকার কথা, কিন্তু পরিবারের সবার সঙ্গে থাকার মজাই আলাদা। সুজন কাকুকে কত দিন দেখেনি ওরা। বিয়ে করার জন্য যখন চাচা দেশে গিয়েছিলেন, তখন শৌনকের বয়স মাত্র চার। এরপর আর তাঁকে দেখেনি শৌনক। তিনিও আর দেশে যাননি। এবার ওদের পেয়ে খুব খুশি হলেন চাচা। কনা চাচি বললেন, ‘প্লেনে যে হাবিজাবি খেয়েছ, তাতে নিশ্চয়ই ভাত খাওয়ার জন্য মন ব্যাকুল হয়ে আছে। আমি তোমাদের জন্য ভাত রেঁধে রেখেছি। মুখ–হাত ধুয়ে আগে খেয়ে নাও।’
বাড়িগুলোর একটাই অসুবিধা। বাথরুম মাত্র একটা। একেকটা পরিবারের জন্য বাড়িগুলো তৈরি করা হয় বলে একটাই বাথরুমের নিয়ম। দেশের মতো ঘরের লাগোয়া বাথরুম নেই। একটা বাথরুম। যে যে ঘরেই থাকুক না কেন, ওই বাথরুমেই যেতে হবে। নিচতলায় বসার ঘর, খাবার ঘর আর রান্নাঘর। ওপর তলায় বাথরুম আর শোবার তিনটা ঘর। প্রায় সব বাড়িই এই প্যাটার্নে তৈরি।
সত্যিই খাবারটা ছিল দারুণ! বাসমতী চালের ভাত, বেগুন ভাজা, মৃগেল মাছ ভাজি, গরুর কষা মাংস আর ডাল। ছিল বাড়ির বাগান থেকে পেড়ে আনা শসা–টমেটোর সালাদ। মনে হলো বহুদিন পর ভাতের স্বাদ পেল ওরা।
‘চাচি, তোমার রান্নাকে অমৃত বলে মনে হচ্ছে!’ বলল সনকা।
‘দুদিন ভাত না খেলে শুধু ডাল–ভাতকেও অমৃত বলে মনে হয়।’ হেসে বললেন চাচি।
‘সেটা হয়তো হয়, কিন্তু তোমার হাতে জাদু আছে।’ সনকা আবার বলে।
মনে মনে খুশি হন কনা চাচি ।
সুজন কাকু ওদের বলে দেন, ‘নিউইয়র্কে চলাফেরা খুব সোজা। ঠিকানা জানা থাকলে কেউ এখানে হারাবে না। যদি নিজেরা বের হতে চাও, তাহলে মেট্রো কার্ড কিনে দেব। একেক রাইডে ২ দশমিক ৭৫ ডলার খরচ পড়বে। তবে দুই ঘণ্টার মধ্যে যদি একটি বাসে উঠে তারপর মেট্রোতে ওঠা হয়, তাহলে এক পাঞ্চেই হয়ে যাবে। আমি আমার ছুটির দিনে গাড়িতে করে তোমাদের নিয়ে ঘুরতে বের হব। কাল মেট্রোটা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য সবাই মিলে বের হব। রাতে আমরা খাব ম্যাকডোনাল্ডস বা কেএফসিতে। সুশি খেতে চাইলেও বলতে পারো, তাহলে আমরা খুঁজে নেব কোনো জাপানি রেস্তোরাঁ।’
চাচা–চাচির একমাত্র সন্তান রুদ্র বলল, ‘আমিও কিন্তু তোমাদের সঙ্গে বের হব। আমাকে রেখে যেয়ো না।’ ও গ্রেড টেন শেষ করেছে এবার।
শৌনক রুদ্রের কথা শুনে বলল, ‘রুদ্রকে ছাড়া আমি বেরই হব না!’
রুদ্র কোনো দিন বাংলাদেশে যায়নি। কিন্তু এখন দুনিয়াটাই এমন হয়ে গেছে, ঘরে বসেই সব খবর পাওয়া যায়। শৌনকের সঙ্গে ফেসবুকে কথা হয় রুদ্রর। দুই দেশের খবরই পেয়ে যায় ওরা।
রাতের খাবারের পর পালা করে সবাই বাথরুম ঘুরে আসতেই হঠাৎ দোরঘণ্টি বাজাল কেউ।
রাত সাড়ে এগারোটা! এ সময় কোনো আগাম খবর না দিয়ে কে আসতে পারে?
সুজন চাচা দরজা খুললেন। বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘ফাহাদ, এত রাতে!’
ফাহাদের চোখ–মুখ চিন্তামগ্ন। সোফায় বসে ও বলল, ‘আমি বহু ভেবেছি, এত রাতে তোমাদের ডিস্টার্ব করা ঠিক কি না। কিন্তু মনে হলো, ঘটনাটা তোমাকে জানানো দরকার।’
সুজন চাচা সবার সঙ্গে ফাহাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন, ‘ফাহাদ মরক্কোর ছেলে। ও থাকে আমাদের বেজমেন্টে। সামনে একটা গাড়ি–দোকান আছে ওর। সারা দিন বিক্রি–বাট্টা করে।’
ফাহাদ বলল, ‘আপনাদের সবার সঙ্গে পরিচিত হয়ে ভালো লাগছে।’ তারপর যোগ করল, ‘আজ একটা ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছে।’
‘কী?’
‘রাত নটার দিকে সম্ভবত তোমাদের কোনো বাঙালি আমার দোকানের সামনে অজ্ঞান হয়ে যায়। আমার হাতে একটা চিরকুট দিয়ে সে দ্রুত হাইল্যান্ড অ্যাভিনিউ দিয়ে পালিয়ে যায়। ওর সারা শরীরে ছিল রক্ত। ও চলে যাওয়ার পর আরও তিনজন, যাদের দুজন সম্ভবত তোমাদের দেশি আর একজন আফ্রিকান, আমার কাছে এসে লোকটার কথা জানতে চায়। আমি স্রেফ না বলে দিই।’
সুজন কাকু বলেন, সত্যিই তো ভয়ংকর ব্যাপার!’
‘লোকটা যে চিরকুট আমার হাতে দিয়ে গেছে, সেটা আমি তোমার হাতে দিতে চাই। মনে হচ্ছে তোমাদের ভাষাতেই লেখা।’
‘দাও।’
চিরকুটে বাংলায় লেখা, ‘জলপদ্ম’, ‘তারাভরা রাত’, ‘তিন মানবী’। আদ্যাক্ষর। তিন শুক্রবার, তিন। জোসেফ। এক্সট্রা ব্যাংক।
ফাহাদ সুজনের দিকে ঔৎসুক্য হয়ে বলল, ‘কিছু বুঝলে?’ দুদিকে মাথা নেড়ে সুজন চাচা বললেন, ‘কিস্যু না।’

এক্সট্রা ব্যাংক
দুদিন কেটে গেছে। এখনো চিরকুটটার পাঠোদ্ধার করা যায়নি। ওটাকে একটা হেঁয়ালির মতো লাগছে। নিউইয়র্কের লাখ লাখ মানুষের ভিড়ে কাকে ডেকে নিয়ে চিরকুট–রহস্যের জট খোলা যাবে? ফলে চিরকুট নিয়ে প্রথম দিন কিছুটা রোমাঞ্চ থাকলেও পরে ওরা ওটার অস্তিত্ব ভুলে গেছে।
এর মধ্যে সুজন কাকুর কাছে একটা মজার বিষয় জেনে নিয়েছে ওরা। তিনি নিজেই বললেন, ‘আমার হাতের চাবিটা দেখো।’
ওরা দেখল।
‘কিছু বুঝলে?’
‘না।’ সনকা–শৌনক একসঙ্গে বলে উঠল।
‘এভাবে বুঝবে না। চলো, দরজাটা খুলি।’
সুজন কাকু দরজা খোলার সময় চাবির খাঁজগুলো থাকল ওপরের দিকে। বাংলাদেশে থাকে নিচের দিকে। শৌনক সে কথা বলল সুজন কাকুকে। ‘ঠিক বলেছ। এটাই বলতে চেয়েছিলাম। এবার বলো, গাড়ি চালানোর সময় আমি কোন দিকে বসে ছিলাম?’
‘ডান দিকে।’ বলল শৌনক।
‘ইয়েস। তার মানে এটাও বাংলাদেশের মতো না। ঠিক?’
‘ঠিক।’
‘এবার ঘরের বাতিটা জ্বালাও তো! সুইচটা ওপরের দিকে ওঠাচ্ছ, নাকি নিচের দিকে নামাচ্ছ?’
‘ওপরের দিকে ওঠাচ্ছি।’
‘বাংলাদেশে?’
‘বাংলাদেশে নিচের দিকে নামাই।’ বলল শৌনক।
‘হুম। তার মানে কী দাঁড়াচ্ছে? আমেরিকা ব্রিটিশদের কাছ থেকে আলাদা হয়েছে। এমনই আলাদা হয়েছে যে ব্রিটিশরা যেভাবে চলে, সেভাবে কিছুই রাখবে না। পারলে মাথাটাও পেছন দিকে ঘুরিয়ে রাখত। হাহ হাহ হা!’ নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে উঠলেন সুজন কাকু।
এর মধ্যে সাবওয়ের নিয়মকানুন শিখে নিয়েছে ওরা। বাসেরও। বাস আর সাবওয়েতে একই কার্ড কাজ করে। যদি কেউ সাবওয়ে করে এসে বাসে ওঠে দুই ঘণ্টার মধ্যে, তাহলে একবারই ভাড়ার টাকা কাটা হয়। এটা বেশ ভালো ব্যাপার। রাস্তাগুলো অ্যাভিনিউ আর স্ট্রিটে ভাগ করা। অ্যাভিনিউগুলোর আড়াআড়ি গেছে স্ট্রিটগুলো। নম্বর দেখে দেখে ঠিক চিনে নেওয়া যায় রাস্তা। গাড়ি থাকলে এখন তো আর কোনো সমস্যাই হয় না। জিপিএস লাগিয়ে নিলেই জায়গামতো পৌঁছে যাওয়া যায়।
‘আজ কী বার?’ জিজ্ঞেস করলেন সুজন কাকু।
‘শুক্রবার।’
‘তাহলে আমরা একটা কাজ করতে পারি। মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টে যেতে পারি।’
‘কার ছবি আছে ওখানে?’
‘পিকাসোর ছবি আছে। পল সেজানের ছবি আছে। আরও অনেকের ছবি আছে। গেলেই দেখতে পাবে।’
‘তাহলে আর দাঁড়িয়ে আছি কেন? এখনই রওনা দিই। ওখানে তো আমার যেতেই হবে এক সপ্তাহ পরে। ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। ওদের আমন্ত্রণেই তো আমি এখানে এসেছি। ওদের সঙ্গে দেখা করার আগেই একবার মিউজিয়ামটা ঘুরে আসি।’ খুবই রোমাঞ্চিত হয়ে বলল শৌনক।
‘আমরা যাব ফিফথ আর সিক্সথ অ্যাভিনিউয়ের মধ্যে ৫৩ স্ট্রিটে। ওখানেই মোমা।’
‘মোমা মানে?’ ইলোরা মাহমুদ জানতে চাইলেন।
‘মোমা মানে মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট। এম-ও-এম-এ। শৌনক তো ওদের প্রতিযোগিতায়ই পুরস্কার পেয়েছে। আজ যদি আমরা যাই, তাহলে ঢুকতে পয়সা লাগবে না। আজ সবার জন্য ফ্রি।’ সুজন কাকু বুঝিয়ে বললেন।
সনকা জিজ্ঞেস করল, ‘কেন, ফ্রি কেন?’
সুজন কাকু হেসে বললেন, ‘প্রতি শুক্রবার বিকেল চারটা থেকে মোমা সবার জন্য উন্মুক্ত। অন্য দিন টিকিট কেটে ঢুকতে হয়।’
শৌমিক মাহমুদ আর ইলোরা মাহমুদকে কথা বলার সুযোগই দিচ্ছে না ওরা। এক মাস থাকবে, তাই সবকিছুই যেন গোগ্রাসে গিলছে সনকা আর শৌনক।
এফ-ট্রেনে করে কিছুদূর গিয়ে ট্রেন বদলে ই-ট্রেন নেওয়ার পরই ৫৩ স্ট্রিটে পৌঁছে গেল ওরা। কনা চাচি আর সুজন কাকু আছে বলে পথ চিনে নেওয়ার ব্যাপার ছিল না। দড়ি দিয়ে আলাদা লাইন বানিয়ে মোমায় ঢোকার পথ তৈরি করা হয়েছে। সারি বেঁধে মানুষ ঢুকছে, পথের মাঝখানে সবার হাতে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে ফ্রি টিকিট। মোমার ঠিক উল্টো দিকে একটা সাইনবোর্ড দেখে শৌনকের মনে হলো এই কথাগুলো কিছুদিনের মধ্যেই ও কোথাও পড়েছে। লেখা ছিল, ‘এক্সট্রা ব্যাংক।’
‘সনকা আপু, দেখেছ?’
‘কী?’
‘এক্সট্রা ব্যাংক!’
‘তাতে কী হয়েছে?’
‘চিরকুটে এই ব্যাংকের নাম লেখা ছিল!’
‘তাতেই বা কী হয়েছে? তোর মনে হচ্ছে এই ব্যাংকের এই শাখার কথাই চিরকুটে বলা হয়েছে?’
‘যদি হয়?’
সনকা খেপে গিয়ে বলল, ‘যদি হয়, হবে। এখন ও কথা ভেবে পিকাসোর ছবি দেখার আনন্দ মাটি করিস না।’
এরপর অন্যদের সঙ্গে ওরা মিশে গেল।

মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট
রুদ্র বলল, ‘আমরা যদি পুরো মিউজিয়াম ঘুরে দেখি, তাহলে তিন দিনেও দেখা শেষ হবে না। আমি গুগল করে দেখেছি, পাঁচতলায় আছে মডার্ন আর্টের সংগ্রহ। সেখানেই যাই?’
কেউ অমত করল না। কারণ, পাঁচতলার ছবিগুলো দেখতেই অনেক সময় কেটে যাবে। শুক্রবার বিনে পয়সায় মোমায় আসা যায়। কিন্তু অন্য দিনগুলোয় টিকিট করতে হয়। পূর্ণবয়স্ক একজন মানুষের টিকিটের দাম ২৫ ডলার। শিশুদের জন্য ১৬ ডলার। তাই আবার যদি আসতে হয়, সামনের শুক্রবার আসা যাবে।
অন্য অনেক মিউজিয়ামে ডোনেশন দিয়ে ঢোকা যায়, কিন্তু মোমায় কোনো ডোনেশন নেই। ডোনেশন মানে হলো টিকিটের দাম যতই হোক না কেন, যে কেউ সাধ্যমতো টাকা দিয়ে মিউজিয়ামে ঢুকতে পারবে। যেমন টিকিটের দাম ২৫ ডলার হলো, কিন্তু পকেটে আছে ৫ ডলার। সে টাকা দিয়েই ঢোকা যাবে মিউজিয়াম দেখতে।
মোমাতে লিফট নয়, স্বয়ংক্রিয় সিঁড়ি বেয়ে পাঁচতলায় যেতে হয়। একটা করিডরে রাখা আছে ছবি। সে করিডর ঘুরেই যেতে হয় প্রদর্শনী ঘরগুলোর দিকে। শুধু সনকা–শৌনক কেন, ইলোরা মাহমুদ আর শৌমিক মাহমুদের মনেও রোমাঞ্চ। যে বিখ্যাত চিত্রকরদের কথা কেবল বইয়ে পড়া হয়েছে, ওয়েবে দেখা হয়েছে যাদের কাজ, তারা এখন চোখের সামনে!
শৌমিক মাহমুদ বাতাসে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, ‘কাদের ছবি আছে?’
শৌনক বলল, ‘গুগলে দেখলাম পল গগ্যা, ভ্যান গঘের ছবি আছে।’
শৌমিক মাহমুদ এবার যেন কথা বলার সুযোগ পেলেন। বললেন, ‘পল গগ্যা, ভ্যান গঘদের জীবন তো ছিল চরম দারিদ্র্যে ঘেরা। পল গগ্যা চাকরিবাকরি ছেড়ে শিল্পের প্রেমে পড়ে জীবনটা কাটিয়ে দিলেন। আর ভ্যান গঘ? কোনো দিনই ঠিকভাবে চাকরি করলেন না। ছোট ভাই থিও তাঁকে অর্থ সাহায্য করে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। আলোর ব্যবহার নিয়ে ভ্যান গঘের সে কী আকুতি। পৃথিবীর কোন জায়গায় খোলা হাওয়ায় নিজেকে ভাসিয়ে দিয়ে উজ্জ্বল আলো নিয়ে খেলবেন, তা নিয়ে কত ভাবনা! জীবিতকালে খুবই কম মূল্যে একটাই ছবি বিক্রি হয়েছিল ভ্যান গঘের। আর মৃত্যুর পর?’
কথা শোনার চেয়ে চোখে দেখার আনন্দ অন্য রকম। করিডরেই ছিল পিকাসোর আঁকা একটি ছবি। ছিল পল সেজানের আঁকা ছবি। রোমাঞ্চে ঠাসা মন নিয়ে ওরা ছবি দেখতে লাগল। তারপর করিডর থেকে বাঁক নিয়ে প্রদর্শনীর প্রথম কক্ষে ঢুকেই ওদের চোখ ছানাবড়া। এখানে মানুষে মানুষে সয়লাব। একটা ছবির সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে সবাই। সবাই মোবাইল ফোনে ছবি তুলছে, ভিডিও করছে। যারা একবার ছবিটার সামনে দাঁড়াচ্ছে, তাদের আর সরানো যাচ্ছে না। ঠেলেঠুলে জায়গা করে নিতে হচ্ছে ছবির সামনে। ছবিটি ভ্যান গঘের আঁকা। ‘স্টারি নাইট’ নাম। অনেকগুলো তারা। নীল আর হলুদে ভরা এই ছবি। ‘স্টারি নাইট’ খুবই বিখ্যাত ছবি। ছবিটি দেখেই শৌনক চিৎকার করে বলল, ‘এই ছবি নিয়ে একটা কবিতাও আছে। মার্কিন কবি অ্যান সেক্সটনের। আমি পড়েছি! দাঁড়াও, কবিতাটা বের করি।’
গুগল করে কবিতাটা বের করে ও পড়ল খানিকটা:

‘দ্য টাউন ডাজ নট এক্সিস্ট
এক্সেপ্ট হোয়্যার ওয়ান ব্ল্যাক–হেয়ারড ট্রি স্লিপস
আপ লাইক এ ড্রোউনড ওম্যান ইনটু দ্য হট স্কাই
দ্য টাউন ইজ সাইলেন্ট। দ্য নাইট বয়েলস উইথ ইলেভেন স্টারস
ওহ স্টারি নাইট! দিস ইজ হাউ
আই ওয়ান্ট টু ডাই!’

কেন মানুষ এই ছবির কাছে এসে থমকে দাঁড়ায়, তার ব্যাখ্যা কেউ করতে পারবে বলে মনে হয় না। সত্যিই ছবিটি মনকে অবশ করে ফেলে। সকাল, দুপুর, বিকেল, রাতের আকাশ যেন মিলেমিশে আছে এই ছবিতে। এতগুলো তারা! আর ওই কালো গাছটা! শৌনক বলল, ‘অ্যান লিখেছেন ১১টা তারা। আমি তো দেখছি ১২টা!’
অন্যরা কেউ উত্তর দিল না শৌনকের কথার। শুধু ইলোরা মাহমুদ অস্ফুটে বললেন, ‘স্টারি নাইট! তারাভরা রাত!’
চমকে মায়ের দিকে তাকাল শৌনক। বলল, ‘কী বললে! তারাভরা রাত!’
ইলোরা মাহমুদ অবাক হলেন, ‘তাতে কী হয়েছে? হ্যাঁ, তারাভরা রাত!’
শৌনক বলল, ‘সনকা আপু, মা বলছে তারাভরা রাত! তুমি বুঝতে পারছ? তারাভরা রাত!’
সনকাও অবাক হলো। ‘তাতে কী হয়েছে? স্টারি নাইটের বাংলা তো তারাভরা রাতই হয়।’

অলংকরণ : সব্যসাচী মিস্ত্রী


শৌনক বলল, ‘চিরকুটের কথা মনে আছে? ওখানে ছিল “জলপদ্ম”, “তারাভরা রাত”, “তিন মানবী”। যদি “স্টারি নাইট” “তারাভরা রাত” হয়ে থাকে, তাহলে “জলপদ্ম”ও পাব এখানে। “তিন মানবী”ও পাব। একটু সতর্ক হয়ে ছবিগুলোর নাম দেখতে হবে। যদি এখানে নামগুলো পেয়ে যাই, তাহলে কিন্তু চিরকুটের রহস্যের সমাধান হবে।’
সনকা চোখ বড় বড় করে বলল, ‘তুই এখনো ওই চিরকুট নিয়েই আছিস!’
শৌনক বলল, ‘একজন রক্তাক্ত মানুষ একটা চিরকুট রেখে নিরুদ্দেশ হলো, আর তার কথা ভাবব না! কী যে বলো তুমি!’
সনকা বুঝল, রাজ্যের আগাথা ক্রিস্টি পড়ে শৌনকের মাথায় এখন কেবল গোয়েন্দা গল্প। এ ভূত সহজে নামবে না।
কিন্তু কয়েকটা ঘর পার হয়ে যখন পিকাসোর ‘থ্রি উইমেন অ্যাট দ্য স্প্রিং’ ছবিটার সামনে এসে ওরা দাঁড়াল, তখন সনকাও স্বীকার করল, এই ছবিগুলোর সঙ্গে চিরকুটের একটা সম্পর্ক আছে। ‘তিন মানবী’ আসলে পিকাসোর আঁকা এই ‘তিন মানবী’। তার মানে তারাভরা রাত আর তিন মানবীর দেখা পাওয়া গেল। বাকি থাকল শুধু জলপদ্ম। সেটা খুঁজে নিতেও বেশি সময় লাগল না। ক্লদ মনের বিশাল ছবিটা পাওয়া গেল পরের ঘরেই। এবার শৌনক আর সনকার চোখে অন্য রকম আলো। ওরা মোমায় থেকেও মোমা থেকে বেরিয়ে এল যেন। ওদের ভাবনায় জায়গা করে নিল চিরকুট। তিনটি বিখ্যাত ছবি আর তিনজন বিখ্যাত চিত্রকরের সঙ্গে কী সম্পর্ক আছে এই চিরকুটের, সেটাই খুঁজে বের করতে হবে!’

জটিল অঙ্ক
পারসনস বুলভার্ডের হাইল্যান্ড অ্যাভিনিউয়ের চিলেকোঠায় বসেছে তিনজন। সনকা, শৌনক আর রুদ্র। বড়রা নিচের ঘরে বসে চা খাচ্ছে আর আড্ডা দিচ্ছে।
সকালের মিষ্টি রোদ বিছিয়ে আছে চারদিকে। একটু পরই সূর্যটা প্রকট হতে থাকবে।
‘আমার মনে হয়, চিরকুট–রহস্যের একটা সমাধান হওয়া উচিত।’ বলল শৌনক।
সনকাও খুব মনোযোগী হয়ে চিরকুটের কথাই ভাবছে। ‘কী লেখা ছিল চিরকুটে, সেটা দেখি আগে: জলপদ্ম, তারাভরা রাত, তিন মানবী। আদ্যাক্ষর। তিন শুক্রবার, তিন। জোসেফ। এক্সট্রা ব্যাংক।’
রুদ৶ বলল, ‘ছবিগুলোর নাম নাহয় বুঝলাম। কিন্তু আদ্যাক্ষর মানে কী? কোনো এক জোসেফের কথাও বলা হচ্ছে! এখানে আবার এক্সট্রা ব্যাংক এল কেন?’
শৌনক বলল, ‘যিনি এসব লিখেছেন, তিনি বোকা নন। খুব মাথা খাটিয়েই লিখেছেন। এই লেখার কোনো উদ্দেশ্য আছে। আচ্ছা রুদ্র, এক্সট্রা ব্যাংকটা কিরে?’
‘এক্সট্রা ব্যাংকে অনেক লকার আছে। মানুষ বাড়িতে সোনাদানা না রেখে এক্সট্রা ব্যাংকে রাখে। এই ব্যাংকের ফি খুব কম, তাই বেশির ভাগ মানুষ এই ব্যাংকের লকারেই ওসব রাখে।’
‘খুব ভালো একটা তথ্য পাওয়া গেল।’ বলল সনকা। ‘তাহলে মোমার এই তিন শিল্পীর সঙ্গে এক্সট্রা ব্যাংকের একটা সম্পর্ক আছে। কী সে সম্পর্ক?’
‘খুব বুদ্ধিমান এক শয়তান এ কাজগুলো করেছে। কিছু একটা উদ্দেশ্য আছে তার।’ রুদ্র বলল।
এ সময় সুজন কাকু ওদের ঘরে এলেন একজন মানুষকে সঙ্গে নিয়ে। ‘তোমরা কি এই ভদ্রলোককে চেনো?’
‘না তো!’ বলল রুদ্র। সনকা আর শৌনক দুদিকে মাথা নেড়ে বোঝাল ওরাও লোকটাকে চেনে না।
‘এই সেই মানুষ, যিনি রক্তমাখা চিরকুটটা দিয়েছিলেন ফাহাদকে। তাঁর নাম রফিকুল বারী।’
‘বলেন কী!’ লাফিয়ে উঠল শৌনক। ‘আপনিই এই চিরকুট দিয়েছিলেন। এত দিন কোথায় ছিলেন?’
‘আমি তো আহত হয়েছিলাম। ক্ষত একটু শুকানোর পর আমি পারসনস বুলভার্ডে ওই খাবার বিক্রেতার কাছে গিয়ে আমার চিরকুটটার ব্যাপারে জানতে চেয়েছিলাম। ওর নাম ফাহাদ। ও–ই আমাকে এই বাড়িতে নিয়ে এল।’
‘ব্যাপারটা কী বলুন তো!’ শৌনক উৎসুক হয়ে বলে।
‘আমি হিলসাইড অ্যাভিনিউয়ে ১৬৯ স্ট্রিটের একটি রেস্তোরাঁয় বসে খাচ্ছিলাম সেদিন। সেখানে দুজন বাঙালি আর একজন আফ্রিকান যুবকও খাচ্ছিল। তখন রাত সাড়ে আটটার মতো বাজে। ওরা যে বিষয়ে কথা বলছিল, তার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। শুধু বুঝতে পারছিলাম, ওরা যা ভাবছে, তা খারাপ কিছু। ভাসা–ভাসা কয়েকটা শব্দ শুধু শুনতে পাচ্ছিলাম। কোনো এক ব্যাংকের কোনো এক লকার থেকে কিছু চুরি করার ফন্দি অাঁটছিল ওরা। ওদের কথা থেকেই জানলাম, তিনজনই কিছুদিন আগে জেল থেকে বের হয়েছে। ছিঁচকে চোর বলে ওরা জেলে ছিল। এখন বড় ধরনের একটা দাঁও মারার চেষ্টা করছে। এই চুরিটা করতে পারলে ওদের ভাগ্য খুলে যাবে। নিউইয়র্ক থেকে ওরা চলে যাবে অন্য কোনো অঙ্গরাজ্যে। তারপর সুখে–শান্তিতে বসবাস করবে।’
‘কিন্তু আপনাকে মারল কে?’
‘আমি আসলে খুবই শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। আমি কাস্টমসে কাজ করি। এ দেশের আইনকানুনের প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল। কেউ বেআইনি কিছু করলে আমি সহ্য করতে পারি না। ওরা বের হলো। রেস্তোরাঁ থেকে বাইরে এসে দেখি, খুব বাতাস রাস্তায়। রাস্তায় মানুষ খুব কম। আমি ওদের পিছু নিলাম। একটা ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে ওদের একজন বলল, “পুরো নকশা করা আছে। এসো, আমরা এখানে দেখে নিই।”
একটা চিরকুট হাতে নিয়ে ওরা দেখতে থাকল। তখনই আমি ওদের হাত থেকে চিরকুটটা কেড়ে নিয়ে দৌড় দিলাম। ওদের একজন আমাকে ধরে ফেলল। আরেকজন আমার নাকে একটা ঘুষি মারল। অন্যজন পকেট থেকে ছুরি বের করে আমার পেটে চালিয়ে দিল। কিন্তু আমি একটু সরে যাওয়ায় তা আমার কোমর চিরে বেরিয়ে গেল। রক্ত বের হলো শরীর থেকে। এরপর চিরকুটটা নিয়ে আমি দৌড় দিলাম। রাস্তা পার হওয়ার সংকেত ছিল, দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে গেলাম। ওরা পার হওয়ার সময় পথচারী পারাপারের সংকেত বদলে গেল। তাই ওরা দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপরের ঘটনা তো ফাহাদের কাছ থেকে তোমরা শুনেছ।’
‘এক্সট্রা ব্যাংকের লকার থেকে কিছু চুরি করা হবে এই শুক্রবারে। এমনই তো মনে হচ্ছে! ওখানে লেখা তিন শুক্রবার, তিন। মানে মাসের তৃতীয় শুক্রবার তিনটার সময়!’ শৌনক বলল।
‘হ্যাঁ। তেমনই তো মনে হচ্ছে।’ কাস্টমস অফিসার রফিকুল বারী সায় দিলেন শৌনকের কথায়।
‘কিন্তু তাহলে তিন বিখ্যাত শিল্পীর তিনটি বিখ্যাত কাজের নাম কেন এই চিরকুটে?’
‘আমি তো চিরকুটটা দেখিনি। হাতে পেয়েই দিয়ে দিয়েছিলাম ফাহাদের হাতে। তিন শিল্পীর নাম লেখা আছে নাকি সেটায়?’ জানতে চাইলেন রফিকুল বারী।
‘না। তিন শিল্পীর তিনটা বিখ্যাত কাজের নাম লেখা আছে। তিনটা কাজই আছে মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টে। ভ্যান গঘ, পিকাসো আর মনে।’
‘জোসেফটা কে?’ আবারও রফিকুল বারীর প্রশ্ন।
‘সেটা তো আপনার কাছ থেকে জানব বলে ভেবেছিলাম!’ হেসে বলল সনকা।
‘আমি আসলে কিছুই জানি না।’ মন খারাপ করে বললেন রফিকুল।
‘আপনি কি আর কিছু শুনেছিলেন? মনে করতে পারেন?’ শৌনক জিজ্ঞেস করল।
কিছুক্ষণ ভাবলেন তিনি। তারপর বললেন, ‘এদের দলের যে লিডার, সে বুঝি গানের লোক...’
‘কী কে বুঝলেন?’
‘ওরা সিঙ্গার সিঙ্গার বলছিল।’
‘সিঙ্গার? মানে সারেগামাপা?’ সনকা মজা করে বলল।
‘হ্যাঁ, সারেগামাপা।’ হেসে পুনরাবৃত্তি করলেন রফিকুল বারী।
‘এই কথা বলে আপনি খুব উপকার করলেন আমাদের। সারেগামাপা, ভালো বলেছেন।’ বলল শৌনক।
‘কী রকম?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন রফিকুল বারী।
হেসে বলল শৌনক, ‘শুক্রবার আসুক, জানতে পারবেন। আরেকটা কথা, এই চিরকুট হারিয়ে গেলেও তো তারা আবার এটা জোগাড় করতে পারবে, তাই না?’
‘তাই তো মনে হয়। সিঙ্গার নিশ্চয়ই বলে দেবে আবার।’ বললেন রফিকুল বারী।
‘হুম। শুক্রবার কি আপনার অফিস আছে?’ জিজ্ঞেস করল শৌনক।
‘না। আমি সপ্তাহে চার দিন কাজ করি। শুক্রবার অফিস করি না।’
‘তাহলে সেদিন বেলা একটায় আমাদের এখানে চলে আসবেন।’
‘ঠিক আছে।’
রফিকুল বারী চলে গেলেন।
‘আমরা কি আজ মোমাতে যেতে পারব?’ সুজন কাকুকে জিজ্ঞেস করল শৌনক।
‘কেন পারবে না? রুদ্রকে বলো। ও তোমাকে নিয়ে যাবে।’

এক্সট্রা ব্যাংকে ডাকাতি
শুক্রবার পারসনস বুলভার্ডে চলে এলেন রফিকুল বারী। সুজন কাকু তাঁর ভ্যান বের করলেন। ভ্যানে আটজন বসা যায়। তাই প্রত্যেকেই জায়গা করে নিতে পারল গাড়িতে। ড্রাইভিং সিটে সুজন কাকু।
মেট্রোতে গেলে বোঝা যায় না শহরটা। শুধু ট্রেনের শব্দই শোনা যায়। নিউইয়র্কের রাস্তাঘাট সবুজ অনেক। একটু পরপরই এক্সিট রয়েছে। রাস্তার লেখাগুলো পড়লে সংকেতগুলো দেখলে কেউ হারিয়ে যাবে না।
আধঘণ্টার মধ্যে ওরা পৌঁছে গেল মোমার সামনে এক্সট্রা ব্যাংকে। পার্কিং খুঁজে নিয়ে গাড়ি রেখে এগোল ব্যাংকের দিকে। ওরা সরাসরি ব্যাংকের ম্যানেজারের কাছে গেল। মি. ওয়াটসন ওদের নিয়ে বসালেন নিজের ঘরের পাশের মিটিং রুমে। কাউকে কিছু বলতে না দিয়ে বললেন, ‘আপনারা বলছেন, পুলিশকে এখনই জানাতে হবে না?’
শৌনক বলল, ‘আমরা একটা অনুমানের ওপর নির্ভর করে এখানে এসেছি। যদি ঘটনাটা না ঘটে, তাহলে পুলিশ ডাকলে হাসাহাসি হবে। তাই আগে দেখি, ঘটনাটা সত্য কি না। যদি সত্যি হয়, তাহলে আপনার গার্ডরাই সামলে নিতে পারবে। তারপর পুলিশ ডাকা যাবে।’
মি. ওয়াটসন বললেন, ‘ঠিক আছে। দেখি, কী হয়! কিন্তু যাদের এই লকার, তারা যদি জানতে পারে, আমরা তাদের অনুমতি ছাড়া...’
‘আপনি ভাববেন না, তাদের জানানোর দরকার নেই। কাণ্ডটা ঘটে গেলে বরং তাদের সতর্ক করে দিয়ে কোড নম্বরটা বদলে দিয়েন।’
সেদিন ব্যাংকে এসে মি. ওয়াটসনের সঙ্গে কথা বলে গিয়েছিল শৌনক আর রুদ্র। ম্যানেজার প্রথমে কিছুই বিশ্বাস করতে চাননি। তাঁর ব্যাংকে নিরাপত্তাব্যবস্থা এতটাই জোরদার যে কেউ চাইলেই এখানে চুরি করতে পারবে না। শৌনক বুঝিয়েছে, একটা চক্র চুরি করার কথা ভাবছে। যদি কথাটা সত্য হয়, তাহলে সামনে ঘোর বিপদ।
যাঁরা ব্যাংকের লকারে সোনাদানা রেখেছেন, তাঁরা আসছেন, নিজের লকার খুলে পরীক্ষা করছেন, নতুন কিছু রাখছেন। কেউ তাঁদের খেয়াল করছে না। প্রত্যেকেই নিজের লকারের কোড নম্বর জানেন, তাই ব্যাংকের কাউকে জিজ্ঞেস করারও প্রয়োজন পড়ছে না।
বেলা আড়াইটার দিকে ওরা একটু সতর্ক হলো। কিছু ঘটলে একটু পরেই ঘটবে। শৌনক ফিসফিস করে বলল, ‘সিকিউরিটির জোসেফকে এখন কেউ ডাকবেন না। ওকে ওর কাজটা করতে দেবেন।’
মি. ওয়াটসন শঙ্কিত হয়ে বললেন, ‘কী কাজ করবে ও?’
‘আপনাকে বলি তাহলে। জোসেফ কিছুক্ষণের মধ্যেই এখানকার ইলেকট্রিসিটি দুই মিনিটের জন্য বন্ধ করে দেবে।’
‘বলো কী!’
‘দেখুন না কী ঘটে!’
সবাই বসে থাকল। তিনটা বাজার এক মিনিট আগে সত্যিই ব্যাংকের বাতি নিভে গেল। যে যার মতো দাঁড়িয়ে রইল যে যার জায়গায়। শৌনক হাতে টর্চ নিয়ে বেরিয়ে এল। ওর জানা আছে কোথায় যেতে হবে। করিডরের মধ্যে একটি লকারের সামনে দাঁড়িয়ে দেখল, মৃদু টর্চের আলোয় তিনজন মানুষ লকারটা খোলার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।
শৌনক বলল, ‘৪৩৫ কোড নম্বর দিয়ে এই তালা খুলবে না! তোমাদের ভাগ্য খারাপ।’
লোক তিনজন চমকে ওর দিকে তাকাল। ততক্ষণে আবার আলো জ্বলে উঠেছে।
চোরদের পরিকল্পনা ছিল, দুই মিনিটের মধ্যে লকার সাফ করে ফেলতে পারবে। কিন্তু লকারের সাংকেতিক বার্তা পরিবর্তন করা হয়েছে, সেটা তো তাদের জানা ছিল না। তাই বারবার ৪৩৫ দিয়ে খোলার চেষ্টা করছিল লকারটা।
রফিকুল বারী বললেন, ‘তোমরা খারাপ মানুষ। তোমরা চোর।’
ব্যাংকের সিকিউরিটির লোকেরা চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে ওদের। একজন রিভলবার বের করে বলল, ‘হ্যান্ডস আপ!’
তিনজনই হাত তুলল ওপরে।
হতাশ হয়ে বাঙালি একজন বলল, ‘আবার জেল!’
আফ্রিকানটা বলল, ‘ইউ ম্যান! ইউ সেইড দেয়ার ইজ নো রিস্ক! বুলশিট!’
ওদের যখন মিটিং রুমে আনা হলো, তখন ওরা দেখল মাথা নিচু করে বসে আছে জোসেফ। ওকেও একটু আগে ধরে এনে এখানে বসানো হয়েছে।

কী থেকে কী হলো
ম্যানেজারের ঘর থেকে ওরা তিনজন আর ব্যাংকের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা জোসেফ চলে গেছে পুলিশের হেফাজতে। মি. ওয়াটসন সংক্ষেপে পুলিশকে বুঝিয়েছেন, কীভাবে কী ঘটল। তিনি আটকে গেলে শৌনক সাহায্য করেছে। এখন সবাই শুনতে চাইল ঘটনার আদ্যোপান্ত।

অলংকরণ : সব্যসাচী মিস্ত্রী


শৌনকই বলা শুরু করল, ‘আমরা এখন জেনে গেছি, জিম ক্রাউলি নামের একজন গায়ক মাদক বিক্রির জন্য বহু বছর ধরে নিউইয়র্কের একটি জেলে রয়েছেন। ভারতীয় সংগীতের সঙ্গেও তাঁর যোগ ছিল। ভারতীয় সারগামও জানতেন তিনি। তিনিই এই তিন ছিঁচকে চোরের সঙ্গে আলাপ করে ষড়যন্ত্র করেন। জিম ক্রাউলি মি.স্যামসন নামের এক ধনকুবেরের অফিসে কাজ করতেন একসময়। মি. স্যামসন তাঁর যাবতীয় গোপন কাগজপত্র জিম ক্রাউলির মাধ্যমে হ্যান্ডল করতেন। একদিন জরুরি কাজে ব্যস্ত থাকায় তিনি জিম ক্রাউলিকে পাঠিয়েছিলেন লকারে কিছু হীরা রাখার জন্য। স্বভাবতই জিম ক্রাউলিকে লকারের সাংকেতিক নম্বরটাও তিনি জানিয়েছিলেন। তখন ক্রাউলি কাজটা করেছিলেন খুবই বিশ্বস্ততার সঙ্গে। কিন্তু তত দিনে তিনি মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে গেছেন। একদিন পুলিশের হাতে ধরাও পড়লেন।
‘জেলখানায় বসে তিনি তাঁর শাগরেদ বানালেন তিন ছিঁচকে চোরকে। তাদের নাম আর বলছি না। কী লাভ নাম বলে! জিম ক্রাউলি ছাড়া পাবেন আরও দুই বছর পর। তাই তিনি তাঁর শাগরেদদের এক অভিনব চুরির কাজে লাগাতে চাইলেন। ছিঁচকে চোরেরা ভুল করতে পারে কিংবা চাপে পড়ে বেফাঁস কথা বলতে পারে, সে কথা ভেবেই তিনি একটি চিরকুট লেখেন, যা আবার দুই বাঙালিকে দিয়ে বাংলা করান, যেন কোনোভাবেই তা বাইরের কেউ বুঝতে না পারে। তাই ওখানে বাংলায় লেখা ছিল, ‘“জলপদ্ম”, “তারাভরা রাত”, “তিন মানবী”। আদ্যাক্ষর। তিন শুক্রবার, তিন। জোসেফ। এক্সট্রা ব্যাংক।’ তিন ছিঁচকেকে তিনি শিখিয়ে দিয়েছিলেন লকারের সাংকেতিক বার্তা।
‘কিন্তু সাংকেতিক বার্তায় ৪৩৫ কোড নম্বরটি তো নেই! সেটা এল কোত্থেকে?’ রফিকুল বারীর প্রশ্ন।
‘খুব সহজ। দেখুন, প্রথম শব্দটি জলপদ্ম, মানে ক্লদ মনের ওয়াটার লিলি, তারাভরা রাত হলো ভ্যান গঘের স্টারি নাইট আর তিন মানবী হলো পিকাসোর থ্রি উইমেন অ্যাট দ্য স্প্রিং।’
‘এখনো বুঝলাম না!’ হতাশ হয়ে বললেন রফিকুল বারী।
‘মনে, গঘ, পিকাসো। আদ্যাক্ষর ধরে এগোলে সারেগামাপার—তিনটি সংখ্যা পেয়ে যাবেন। মা গা পা...। বুঝেছেন? অর্থাৎ সারগমের ৪ ৩ ৫।’
এতক্ষণে রফিকুল বারীর চোখ–মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
‘কিন্তু এত কঠিন করে সংকেত শেখানো কেন?’
শৌনক বলল, ‘সেটা আমিও বলতে পারব না। হয়তো জিম ক্রাউলি তাঁর প্রতিভাটা মাদকের পেছনে ব্যয় না করলে একজন অসাধারণ শিল্পী হয়ে উঠতে পারতেন। গোয়েন্দাও হয়ে উঠতে পারতেন। চিরকুটে যে ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, তা তাঁর সৃজনশীলতারই প্রমাণ। তিনি ভেবেছিলেন, দুই বছর পর যখন জেল থেকে বের হবেন, তখন শাগরেদদের খুঁজে নিয়ে নিজের টাকার অংশ পাওয়ার পর সুখী জীবনযাপন করবেন! সেটা হলো না। আমি কিন্তু ক্রাউলি ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বললে সুখী হতাম। আসলেই খুব সৃজনশীল ভদ্রলোক। শিল্পীদের নাম যেভাবে যুক্ত করেছেন, তা থেকে যেভাবে নকশাটা বানিয়েছেন, তাতে আমি মুগ্ধ! আফসোস শুধু, নিজের এই সৃজনশীলতা ভালো কোনো কাজে ব্যবহার করলেন না!’
এবার সুজন কাকু জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিন্তু এই ক্রাউলি–স্যামসন উপাখ্যান তুমি জানলে কী করে?’
‘খুব সোজা। ম্যানেজার মি. ওয়াটসনকে জিজ্ঞেস করলাম, ৪৩৫ কোডের লকারটি কার। খুব অবাক হয়েছিলেন তিনি। তবে ঘটনার তাৎপর্য বুঝে তিনি বিশ্বাস করে বলে দিলেন নামটা। মি. স্যামসনকে ফোন করে বললাম, তাঁর সঙ্গে কি এমন কারও পরিচয় আছে, যিনি গানের সঙ্গে যুক্ত। তিনি আমাকে জিম ক্রাউলির ইতিহাস জানালেন। আমার চোখে তখন সবকিছুই পরিষ্কার হয়ে গেল। তবে মি. স্যামসনকে ফোনে পেতে আমার খুব কষ্ট হয়েছে। মি. ওয়াটসন সাহায্য করেছেন বটে, কিন্তু সেক্রেটারির মাধ্যমে সময় নিয়ে কথা বলতে হয়েছে। দুই মিনিটের বেশি কথা বলবেন না, সে কথা আগেই জানিয়ে দিয়েছেন মি. স্যামসন...। ভদ্রলোকের ধনভান্ডার যে লোপাট হয়ে যাচ্ছে, সে কথা তাঁকে কে বোঝাবে!’
‘আর এই জোসেফ কী করে মিশে গেল এই দলে?’ ইলোরা মাহমুদের প্রশ্ন।
‘এটাও আরেক মজার কাহিনি। জোসেফও একসময় মি. স্যামসনের অফিসে কাজ করতেন। সে চাকরি টেকেনি। পরে তিনি কাজ নেন এই ব্যাংকের সিকিউরিটি বিভাগে। মি. ক্রাউলির সঙ্গে জোসেফের একটা যোগাযোগ ছিল। মি. ক্রাউলি যখন চুরির পরিকল্পনা করেন, তখন জোসেফকে একবার জেলখানায় ডেকে নিয়ে পুরো পরিকল্পনাটা শুনিয়েছেন। জোসেফ রাজি হয়েছেন। তারপর তো কী হয়েছে, নতুন করে বলার দরকার নেই।’
শৌনক এবার ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মি. ওয়াটসন! এবার আপনি আবার লকারের নম্বর পরিবর্তন করতে পারেন। মি. স্যামসনকে ডেকে নতুন কোড দিয়ে দেবেন।’
‘সে আর বলতে!’ খুশিতে গদগদ হয়ে বললেন মি. ওয়াটসন। ‘তোমরা আমাকে যে বিশাল বিপদ থেকে রক্ষা করলে, সে জন্য কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। আমি তোমাদের এই তিন ডেভিলের জন্য একটা পানিশমেন্টের ব্যবস্থা করতে চাই! আশা করি, এই সাজা খাটতে তোমাদের ভালো লাগবে।’
সনকা, শৌনক আর রুদ্র এ ওর দিকে তাকাল। তারপর তিনজনই তাকাল মি. ওয়াটসনের দিকে।
‘তোমাদের জন্য একটা ব্রডওয়ে শো দেখার ব্যবস্থা করছি! লায়ন কিং না প্রিটি ওম্যান দেখবে?’
রুদ্র লাফিয়ে উঠে বলতে গেল লায়ন কিং, কিন্তু সনকার দিকে তাকিয়ে কী যেন কী হয়ে গেল ওর। ও যা উচ্চারণ করল, তা হলো, ‘লায়... নো নো প্রিটি ওম্যান’।
ওর কথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে উঠল।

পারসনস বুলভার্ড থেকেই ঘটনার শুরু। রাত সাড়ে নটা। সাবওয়ের ঠিক উল্টো দিকে মরক্কান ছেলে ফাহাদের যে খাবারের গাড়িটা আছে হাইল্যান্ড অ্যাভিনিউয়ের দিকটায়, ঠিক তার সামনে এসে ধপাস করে পড়ে গিয়েছিল লোকটা। তারপর উপুড় হয়েই হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছিল সামনের দিকে। সে হাতে রক্তের ছোপ আর তাতে ধরা একটি চিরকুট। চিরকুটেও রক্ত লেগে আছে। লালবাতি থাকায় কয়েকটি গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়েছিল জ্যামাইকার এই ব্যস্ত রাস্তায়। কিন্তু ঠিক সে সময় সবুজ বাতি জ্বলে উঠল। তাই গাড়িগুলো থেকে কেউ নেমে এল না। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল না লোকটার দিকে; বরং শাঁ শাঁ করে ছুটে উধাও হয়ে গেল গাড়িগুলো। আবার জনশূন্য রাস্তা!ফাহাদ ওর গাড়ি থেকে উঁকি দিয়ে লোকটিকে দেখল। এই রং আর চেহারার মানুষ ও চেনে। এরা সাধারণত দক্ষিণ এশিয়ার হয়। এক বাঙালির বাড়ির বেজমেন্ট বা মাটির তলার একটি ঘরে ভাড়া থাকে ফাহাদ। বেজমেন্টের ভাড়া কম হয়। ফাহাদ সে সুযোগটাই নিয়েছে। এখন ওর সামনে পড়ে থাকা লোকটিকে বাঙালি বলে মনে হচ্ছে। ইংরেজিতেই ও জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে তোমার?’লোকটা উত্তর দিল না; বরং সেভাবেই নিস্তেজ হয়ে পড়ে রইল।মরে গেল নাকি? সত্যিই ভয় পেল ফাহাদ। এখানে, একেবারে ওর খাবারের গাড়ির সামনে যদি লোকটা মরে যায়, তাহলে নিউইয়র্ক পুলিশ এসে জেরার পর জেরা করে ফাহাদের বারোটা বাজাবে। লোকটা যেন মরে না যায়, সে কামনা করে ঈশ্বরকে ডাকতে লাগল সে। গ্রীষ্মের রাত। হাওয়া দিচ্ছে, কিন্তু তাতে গরম কমছে না। তাই লোক চলাচল একেবারেই কম। ফাহাদ ডানে–বাঁয়ে দুদিকেই তাকাল। নাহ্‌! কেউ নেই। মান্নান সুপারমার্কেটের দিক থেকেও কেউ আসছে না। হাইল্যান্ডের এ জায়গাটা বুঝি আজ ফন্দি করেই জনশূন্য হয়ে রয়েছে।‘পানি...’ বিড় বিড় করে বলল লোকটা।‘হোয়াট?’ না বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করল ফাহাদ।রক্তাক্ত লোকটা কোনোরকমে চোখ খুলল। আবার বলল, ‘পানি’; তারপর বুঝল এটা বাংলাদেশ নয়, ওর সামনে গাড়ির ভেতর যে লোকটি দাঁড়িয়ে আছে বার্গার বা নুডলস বিক্রি করার জন্য, সে বাংলাদেশি নয়। তাই মৃদু গলায় বলল, ‘ওয়াটার।’ফাহাদ বুঝতে পারল। যে পানির বোতল ও দুই ডলারে বিক্রি করে, তা বিনে পয়সায় বাড়িয়ে ধরল এই আগন্তুকের দিকে। লোকটা ঢক ঢক করে পানি খেল। কিছুটা গড়িয়ে পড়ল ওর ঠোঁটের কষ বেয়ে। ‘প্লিজ, টেক দিস পেপার। ডোন্ট শো অ্যানিবডি, ইটস সিক্রেট...’ ইংরেজিতে বলার চেষ্টা করল লোকটা।তার হাতের রক্তমাখা কাগজটা নেবে কি নেবে না, ফাহাদ সে কথা ভাবল কিছুক্ষণ। তারপর রাস্তার এদিক–ওদিক তাকাল। নেই—একজন মানুষও নেই। তার মানে ওকে কেউ দেখছে না। পকেট থেকে রুমাল বের করে সেই রুমালের সাহায্যে লোকটার হাতের চিরকুটটা নিল ফাহাদ। চোখ বন্ধ করেই একটু হাসল লোকটা। তারপর জ্ঞান হারাল। হতবিহ্বল ফাহাদকে অবাক করে দিয়ে খুব শিগগির লোকটার জ্ঞান ফিরে এল এবং সে ফিসফিস করে বলল, ‘আই উইল গেট ইট ফ্রম ইউ।’তারপর ঘোর মাতালের মতো টলতে টলতে হাইল্যান্ড অ্যাভিনিউয়ের দিকে বাঁক নিয়ে চোখের সামনে থেকে হারিয়ে গেল লোকটা। ফাহাদ নিজের হাতে ধরা চিরকুটটা দেখতে লাগল অবাক হয়ে।ঠিক সে সময় তিনজন মানুষ, এদের দুজন দক্ষিণ এশীয়, একজন আফ্রিকান, হন্তদন্ত হয়ে এসে দাঁড়াল ফাহাদের গাড়ির কাছে। ফাহাদ দ্রুত চিরকুটটা লুকিয়ে ফেলল খাবারদাবারের মধ্যে।‘এখানে কি একজন বাঙালিকে দেখেছ?’ ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল দক্ষিণ এশীয় একজন।‘বাঙালি?’ না বোঝার ভান করে প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্ন ছুড়ে দিল ফাহাদ।‘বাঙালি মানে আমাদের মতো চেহারা। এই আমার মতো।’‘না তো!’ অবলীলায় মিথ্যে বলে দিল ফাহাদ।‘কিন্তু এ পথেই তো ওর আসার কথা!’ সংশয় নিয়ে বলল আফ্রিকান যুবক।‘সে আমি কী করে বলব? আর এলেও আমার চোখ এড়িয়ে যেতে পারে।’ বলল ফাহাদ।‘চোখ এড়াবে না!’ ক্রূর হেসে বলল আরেকজন দক্ষিণ এশিয়ান। ‘যে রকম রামধোলাই খেয়েছে, তাতে বাবা রে মা রে বলে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেই দৌড়াতে হবে ওকে!’‘মানে, তোমরা ওকে মেরেছ?’ যেন কিছুই জানে না, এ রকম নিষ্পাপ শিশুর মতো জিজ্ঞেস করল ফাহাদ।লোকটা নিজের ভুল বুঝতে পারল। বলল, ‘না। আমরা মারিনি। ওকে মার খেতে দেখেছি। তাই ওকে খুঁজতে এসেছি।’ওরা বুঝল, ফাহাদের কাছ থেকে কোনো তথ্য পাওয়া যাবে না। তাই এবার দলটি হাইল্যান্ড অ্যাভিনিউয়ের দিকে দৌড় লাগাল। ফাহাদের বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। ভয়ও পেল ও। যদি লোকটাকে ধরে ফেলে ওরা!    হিলসাইড অ্যাভিনিউমাত্র এক মাসের জন্য নিউইয়র্কে এসেছে শৌনক। ও এসেছে মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টের পক্ষ থেকে আমন্ত্রিত হয়ে, পরিবারের বাকি তিনজন পারিবারিক আমন্ত্রণে। বাবা, মা আর সনকা আপুকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে সুজন কাকু। সবার জন্যই এত বড় একটা ছুটি ম্যানেজ করা খুব কঠিন। শৌনক ছাড়া বাকি তিনজন অফিস আর বিশ্ববিদ্যালয়কে বুঝিয়েছে, কেন তারা এক মাসের জন্য আমেরিকায় যাচ্ছে। নিউইয়র্কের মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট থেকে বিশ্বব্যাপী কুইজ প্রতিযোগিতা হয়েছিল। আধুনিক চিত্রকলা নিয়েই ছিল প্রশ্নগুলো। সারা বিশ্বের শিক্ষার্থীরা চাইলে অংশ নিতে পারত এ প্রতিযোগিতায়। দেখা গেল, শৌনকের অবস্থান হয়েছে সেরাদের সেরার মধ্যে। তাই ওকে পনেরো দিনের জন্য নিউইয়র্কে থাকা–খাওয়া এবং হাতখরচ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ও কি একা আসবে? একা এলে ভালো লাগবে? সে কারণেই এসেছে অন্যরা ।মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টে ভ্যান গঘ, পিকাসো, ক্লদ মনে, পল সেজান, গগ্যার আঁকা ছবি আছে। ছবি আছে আরও অনেক শিল্পীরই। শৌনক সেগুলো নিয়ে পড়াশোনা করে নিল খানিকটা। শৌনকের আমেরিকা যাওয়া যখন ঠিকঠাক, তখন শৌমিক মাহমুদ আর ইলোরা মাহমুদ ঠিক করলেন, চারজনের জন্যই ভিসার আবেদন করবেন। ভাগ্য ভালো থাকলে ভিসা মিলে যাবে এবং গেলও। শৌনকের সুজন কাকু থাকেন নিউইয়র্কে, সে কথা বলতেই ভিসা অফিসার আর কোনো সমস্যা করেননি। ছয় মাসের ভিসা দিয়ে দিয়েছেন। তবে শৌনকেরা থাকবে এক মাস। এর বেশি নয়। এ সময়ের মধ্যে যা যা দেখার দেখে ফেলবে বলে ঠিক করেছে ওরা। পছন্দের তালিকায় জাদুঘরগুলো তো রয়েইছে, থাকবে নায়াগ্রা জলপ্রপাত।পারসনস বুলভার্ডের হাইল্যান্ড অ্যাভিনিউতেই ওর সুজন কাকুর বাড়ি। সেখানেই প্রাথমিকভাবে উঠেছে ওরা। কাতার এয়ারওয়েজের প্লেনটা জেএফকে বিমানবন্দরে নেমেছিল সন্ধ্যা সাতটায়। শৌনকের যদিও হোটেলে থাকার কথা, কিন্তু পরিবারের সবার সঙ্গে থাকার মজাই আলাদা। সুজন কাকুকে কত দিন দেখেনি ওরা। বিয়ে করার জন্য যখন চাচা দেশে গিয়েছিলেন, তখন শৌনকের বয়স মাত্র চার। এরপর আর তাঁকে দেখেনি শৌনক। তিনিও আর দেশে যাননি। এবার ওদের পেয়ে খুব খুশি হলেন চাচা। কনা চাচি বললেন, ‘প্লেনে যে হাবিজাবি খেয়েছ, তাতে নিশ্চয়ই ভাত খাওয়ার জন্য মন ব্যাকুল হয়ে আছে। আমি তোমাদের জন্য ভাত রেঁধে রেখেছি। মুখ–হাত ধুয়ে আগে খেয়ে নাও।’বাড়িগুলোর একটাই অসুবিধা। বাথরুম মাত্র একটা। একেকটা পরিবারের জন্য বাড়িগুলো তৈরি করা হয় বলে একটাই বাথরুমের নিয়ম। দেশের মতো ঘরের লাগোয়া বাথরুম নেই। একটা বাথরুম। যে যে ঘরেই থাকুক না কেন, ওই বাথরুমেই যেতে হবে। নিচতলায় বসার ঘর, খাবার ঘর আর রান্নাঘর। ওপর তলায় বাথরুম আর শোবার তিনটা ঘর। প্রায় সব বাড়িই এই প্যাটার্নে তৈরি।সত্যিই খাবারটা ছিল দারুণ! বাসমতী চালের ভাত, বেগুন ভাজা, মৃগেল মাছ ভাজি, গরুর কষা মাংস আর ডাল। ছিল বাড়ির বাগান থেকে পেড়ে আনা শসা–টমেটোর সালাদ। মনে হলো বহুদিন পর ভাতের স্বাদ পেল ওরা।‘চাচি, তোমার রান্নাকে অমৃত বলে মনে হচ্ছে!’ বলল সনকা।‘দুদিন ভাত না খেলে শুধু ডাল–ভাতকেও অমৃত বলে মনে হয়।’ হেসে বললেন চাচি।‘সেটা হয়তো হয়, কিন্তু তোমার হাতে জাদু আছে।’ সনকা আবার বলে।মনে মনে খুশি হন কনা চাচি ।সুজন কাকু ওদের বলে দেন, ‘নিউইয়র্কে চলাফেরা খুব সোজা। ঠিকানা জানা থাকলে কেউ এখানে হারাবে না। যদি নিজেরা বের হতে চাও, তাহলে মেট্রো কার্ড কিনে দেব। একেক রাইডে ২ দশমিক ৭৫ ডলার খরচ পড়বে। তবে দুই ঘণ্টার মধ্যে যদি একটি বাসে উঠে তারপর মেট্রোতে ওঠা হয়, তাহলে এক পাঞ্চেই হয়ে যাবে। আমি আমার ছুটির দিনে গাড়িতে করে তোমাদের নিয়ে ঘুরতে বের হব। কাল মেট্রোটা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য সবাই মিলে বের হব। রাতে আমরা খাব ম্যাকডোনাল্ডস বা কেএফসিতে। সুশি খেতে চাইলেও বলতে পারো, তাহলে আমরা খুঁজে নেব কোনো জাপানি রেস্তোরাঁ।’চাচা–চাচির একমাত্র সন্তান রুদ্র বলল, ‘আমিও কিন্তু তোমাদের সঙ্গে বের হব। আমাকে রেখে যেয়ো না।’ ও গ্রেড টেন শেষ করেছে এবার। শৌনক রুদ্রের কথা শুনে বলল, ‘রুদ্রকে ছাড়া আমি বেরই হব না!’রুদ্র কোনো দিন বাংলাদেশে যায়নি। কিন্তু এখন দুনিয়াটাই এমন হয়ে গেছে, ঘরে বসেই সব খবর পাওয়া যায়। শৌনকের সঙ্গে ফেসবুকে কথা হয় রুদ্রর। দুই দেশের খবরই পেয়ে যায় ওরা।রাতের খাবারের পর পালা করে সবাই বাথরুম ঘুরে আসতেই হঠাৎ দোরঘণ্টি বাজাল কেউ।রাত সাড়ে এগারোটা! এ সময় কোনো আগাম খবর না দিয়ে কে আসতে পারে?সুজন চাচা দরজা খুললেন। বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘ফাহাদ, এত রাতে!’ফাহাদের চোখ–মুখ চিন্তামগ্ন। সোফায় বসে ও বলল, ‘আমি বহু ভেবেছি, এত রাতে তোমাদের ডিস্টার্ব করা ঠিক কি না। কিন্তু মনে হলো, ঘটনাটা তোমাকে জানানো দরকার।’সুজন চাচা সবার সঙ্গে ফাহাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন, ‘ফাহাদ মরক্কোর ছেলে। ও থাকে আমাদের বেজমেন্টে। সামনে একটা গাড়ি–দোকান আছে ওর। সারা দিন বিক্রি–বাট্টা করে।’ফাহাদ বলল, ‘আপনাদের সবার সঙ্গে পরিচিত হয়ে ভালো লাগছে।’ তারপর যোগ করল, ‘আজ একটা ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছে।’‘কী?’‘রাত নটার দিকে সম্ভবত তোমাদের কোনো বাঙালি আমার দোকানের সামনে অজ্ঞান হয়ে যায়। আমার হাতে একটা চিরকুট দিয়ে সে দ্রুত হাইল্যান্ড অ্যাভিনিউ দিয়ে পালিয়ে যায়। ওর সারা শরীরে ছিল রক্ত। ও চলে যাওয়ার পর আরও তিনজন, যাদের দুজন সম্ভবত তোমাদের দেশি আর একজন আফ্রিকান, আমার কাছে এসে লোকটার কথা জানতে চায়। আমি স্রেফ না বলে দিই।’সুজন কাকু বলেন, সত্যিই তো ভয়ংকর ব্যাপার!’‘লোকটা যে চিরকুট আমার হাতে দিয়ে গেছে, সেটা আমি তোমার হাতে দিতে চাই। মনে হচ্ছে তোমাদের ভাষাতেই লেখা।’‘দাও।’চিরকুটে বাংলায় লেখা, ‘জলপদ্ম’, ‘তারাভরা রাত’, ‘তিন মানবী’। আদ্যাক্ষর। তিন শুক্রবার, তিন। জোসেফ। এক্সট্রা ব্যাংক।       ফাহাদ সুজনের দিকে ঔৎসুক্য হয়ে বলল, ‘কিছু বুঝলে?’ দুদিকে মাথা নেড়ে সুজন চাচা বললেন, ‘কিস্যু না।’
এক্সট্রা ব্যাংকদুদিন কেটে গেছে। এখনো চিরকুটটার পাঠোদ্ধার করা যায়নি। ওটাকে একটা হেঁয়ালির মতো লাগছে। নিউইয়র্কের লাখ লাখ মানুষের ভিড়ে কাকে ডেকে নিয়ে চিরকুট–রহস্যের জট খোলা যাবে? ফলে চিরকুট নিয়ে প্রথম দিন কিছুটা রোমাঞ্চ থাকলেও পরে ওরা ওটার অস্তিত্ব ভুলে গেছে।এর মধ্যে সুজন কাকুর কাছে একটা মজার বিষয় জেনে নিয়েছে ওরা। তিনি নিজেই বললেন, ‘আমার হাতের চাবিটা দেখো।’ওরা দেখল।‘কিছু বুঝলে?’‘না।’ সনকা–শৌনক একসঙ্গে বলে উঠল। ‘এভাবে বুঝবে না। চলো, দরজাটা খুলি।’সুজন কাকু দরজা খোলার সময় চাবির খাঁজগুলো থাকল ওপরের দিকে। বাংলাদেশে থাকে নিচের দিকে। শৌনক সে কথা বলল সুজন কাকুকে। ‘ঠিক বলেছ। এটাই বলতে চেয়েছিলাম। এবার বলো, গাড়ি চালানোর সময় আমি কোন দিকে বসে ছিলাম?’‘ডান দিকে।’ বলল শৌনক।‘ইয়েস। তার মানে এটাও বাংলাদেশের মতো না। ঠিক?’‘ঠিক।’‘এবার ঘরের বাতিটা জ্বালাও তো! সুইচটা ওপরের দিকে ওঠাচ্ছ, নাকি নিচের দিকে নামাচ্ছ?’‘ওপরের দিকে ওঠাচ্ছি।’‘বাংলাদেশে?’‘বাংলাদেশে নিচের দিকে নামাই।’ বলল শৌনক।‘হুম। তার মানে কী দাঁড়াচ্ছে? আমেরিকা ব্রিটিশদের কাছ থেকে আলাদা হয়েছে। এমনই আলাদা হয়েছে যে ব্রিটিশরা যেভাবে চলে, সেভাবে কিছুই রাখবে না। পারলে মাথাটাও পেছন দিকে ঘুরিয়ে রাখত। হাহ হাহ হা!’ নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে উঠলেন সুজন কাকু।এর মধ্যে সাবওয়ের নিয়মকানুন শিখে নিয়েছে ওরা। বাসেরও। বাস আর সাবওয়েতে একই কার্ড কাজ করে। যদি কেউ সাবওয়ে করে এসে বাসে ওঠে দুই ঘণ্টার মধ্যে, তাহলে একবারই ভাড়ার টাকা কাটা হয়। এটা বেশ ভালো ব্যাপার। রাস্তাগুলো অ্যাভিনিউ আর স্ট্রিটে ভাগ করা। অ্যাভিনিউগুলোর আড়াআড়ি গেছে স্ট্রিটগুলো। নম্বর দেখে দেখে ঠিক চিনে নেওয়া যায় রাস্তা। গাড়ি থাকলে এখন তো আর কোনো সমস্যাই হয় না। জিপিএস লাগিয়ে নিলেই জায়গামতো পৌঁছে যাওয়া যায়। ‘আজ কী বার?’ জিজ্ঞেস করলেন সুজন কাকু।‘শুক্রবার।’‘তাহলে আমরা একটা কাজ করতে পারি। মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টে যেতে পারি।’‘কার ছবি আছে ওখানে?’‘পিকাসোর ছবি আছে। পল সেজানের ছবি আছে। আরও অনেকের ছবি আছে। গেলেই দেখতে পাবে।’‘তাহলে আর দাঁড়িয়ে আছি কেন? এখনই রওনা দিই। ওখানে তো আমার যেতেই হবে এক সপ্তাহ পরে। ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। ওদের আমন্ত্রণেই তো আমি এখানে এসেছি। ওদের সঙ্গে দেখা করার আগেই একবার মিউজিয়ামটা ঘুরে আসি।’ খুবই রোমাঞ্চিত হয়ে বলল শৌনক।‘আমরা যাব ফিফথ আর সিক্সথ অ্যাভিনিউয়ের মধ্যে ৫৩ স্ট্রিটে। ওখানেই মোমা।’‘মোমা মানে?’ ইলোরা মাহমুদ জানতে চাইলেন।‘মোমা মানে মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট। এম-ও-এম-এ। শৌনক তো ওদের প্রতিযোগিতায়ই পুরস্কার পেয়েছে। আজ যদি আমরা যাই, তাহলে ঢুকতে পয়সা লাগবে না। আজ সবার জন্য ফ্রি।’ সুজন কাকু বুঝিয়ে বললেন।সনকা জিজ্ঞেস করল, ‘কেন, ফ্রি কেন?’সুজন কাকু হেসে বললেন, ‘প্রতি শুক্রবার বিকেল চারটা থেকে মোমা সবার জন্য উন্মুক্ত। অন্য দিন টিকিট কেটে ঢুকতে হয়।’শৌমিক মাহমুদ আর ইলোরা মাহমুদকে কথা বলার সুযোগই দিচ্ছে না ওরা। এক মাস থাকবে, তাই সবকিছুই যেন গোগ্রাসে গিলছে সনকা আর শৌনক।এফ-ট্রেনে করে কিছুদূর গিয়ে ট্রেন বদলে ই-ট্রেন নেওয়ার পরই ৫৩ স্ট্রিটে পৌঁছে গেল ওরা। কনা চাচি আর সুজন কাকু আছে বলে পথ চিনে নেওয়ার ব্যাপার ছিল না। দড়ি দিয়ে আলাদা লাইন বানিয়ে মোমায় ঢোকার পথ তৈরি করা হয়েছে। সারি বেঁধে মানুষ ঢুকছে, পথের মাঝখানে সবার হাতে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে ফ্রি টিকিট। মোমার ঠিক উল্টো দিকে একটা সাইনবোর্ড দেখে শৌনকের মনে হলো এই কথাগুলো কিছুদিনের মধ্যেই ও কোথাও পড়েছে। লেখা ছিল, ‘এক্সট্রা ব্যাংক।’ ‘সনকা আপু, দেখেছ?’‘কী?’‘এক্সট্রা ব্যাংক!’‘তাতে কী হয়েছে?’‘চিরকুটে এই ব্যাংকের নাম লেখা ছিল!’‘তাতেই বা কী হয়েছে? তোর মনে হচ্ছে এই ব্যাংকের এই শাখার কথাই চিরকুটে বলা হয়েছে?’‘যদি হয়?’সনকা খেপে গিয়ে বলল, ‘যদি হয়, হবে। এখন ও কথা ভেবে পিকাসোর ছবি দেখার আনন্দ মাটি করিস না।’এরপর অন্যদের সঙ্গে ওরা মিশে গেল।
মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টরুদ্র বলল, ‘আমরা যদি পুরো মিউজিয়াম ঘুরে দেখি, তাহলে তিন দিনেও দেখা শেষ হবে না। আমি গুগল করে দেখেছি, পাঁচতলায় আছে মডার্ন আর্টের সংগ্রহ। সেখানেই যাই?’কেউ অমত করল না। কারণ, পাঁচতলার ছবিগুলো দেখতেই অনেক সময় কেটে যাবে। শুক্রবার বিনে পয়সায় মোমায় আসা যায়। কিন্তু অন্য দিনগুলোয় টিকিট করতে হয়। পূর্ণবয়স্ক একজন মানুষের টিকিটের দাম ২৫ ডলার। শিশুদের জন্য ১৬ ডলার। তাই আবার যদি আসতে হয়, সামনের শুক্রবার আসা যাবে। অন্য অনেক মিউজিয়ামে ডোনেশন দিয়ে ঢোকা যায়, কিন্তু মোমায় কোনো ডোনেশন নেই। ডোনেশন মানে হলো টিকিটের দাম যতই হোক না কেন, যে কেউ সাধ্যমতো টাকা দিয়ে মিউজিয়ামে ঢুকতে পারবে। যেমন টিকিটের দাম ২৫ ডলার হলো, কিন্তু পকেটে আছে ৫ ডলার। সে টাকা দিয়েই ঢোকা যাবে মিউজিয়াম দেখতে।মোমাতে লিফট নয়, স্বয়ংক্রিয় সিঁড়ি বেয়ে পাঁচতলায় যেতে হয়। একটা করিডরে রাখা আছে ছবি। সে করিডর ঘুরেই যেতে হয় প্রদর্শনী ঘরগুলোর দিকে। শুধু সনকা–শৌনক কেন, ইলোরা মাহমুদ আর শৌমিক মাহমুদের মনেও রোমাঞ্চ। যে বিখ্যাত চিত্রকরদের কথা কেবল বইয়ে পড়া হয়েছে, ওয়েবে দেখা হয়েছে যাদের কাজ, তারা এখন চোখের সামনে! শৌমিক মাহমুদ বাতাসে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, ‘কাদের ছবি আছে?’শৌনক বলল, ‘গুগলে দেখলাম পল গগ্যা, ভ্যান গঘের ছবি আছে।’শৌমিক মাহমুদ এবার যেন কথা বলার সুযোগ পেলেন। বললেন, ‘পল গগ্যা, ভ্যান গঘদের জীবন তো ছিল চরম দারিদ্র্যে ঘেরা। পল গগ্যা চাকরিবাকরি ছেড়ে শিল্পের প্রেমে পড়ে জীবনটা কাটিয়ে দিলেন। আর ভ্যান গঘ? কোনো দিনই ঠিকভাবে চাকরি করলেন না। ছোট ভাই থিও তাঁকে অর্থ সাহায্য করে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। আলোর ব্যবহার নিয়ে ভ্যান গঘের সে কী আকুতি। পৃথিবীর কোন জায়গায় খোলা হাওয়ায় নিজেকে ভাসিয়ে দিয়ে উজ্জ্বল আলো নিয়ে খেলবেন, তা নিয়ে কত ভাবনা! জীবিতকালে খুবই কম মূল্যে একটাই ছবি বিক্রি হয়েছিল ভ্যান গঘের। আর মৃত্যুর পর?’কথা শোনার চেয়ে চোখে দেখার আনন্দ অন্য রকম। করিডরেই ছিল পিকাসোর আঁকা একটি ছবি। ছিল পল সেজানের আঁকা ছবি। রোমাঞ্চে ঠাসা মন নিয়ে ওরা ছবি দেখতে লাগল। তারপর করিডর থেকে বাঁক নিয়ে প্রদর্শনীর প্রথম কক্ষে ঢুকেই ওদের চোখ ছানাবড়া। এখানে মানুষে মানুষে সয়লাব। একটা ছবির সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে সবাই। সবাই মোবাইল ফোনে ছবি তুলছে, ভিডিও করছে। যারা একবার ছবিটার সামনে দাঁড়াচ্ছে, তাদের আর সরানো যাচ্ছে না। ঠেলেঠুলে জায়গা করে নিতে হচ্ছে ছবির সামনে। ছবিটি ভ্যান গঘের আঁকা। ‘স্টারি নাইট’ নাম। অনেকগুলো তারা। নীল আর হলুদে ভরা এই ছবি। ‘স্টারি নাইট’ খুবই বিখ্যাত ছবি। ছবিটি দেখেই শৌনক চিৎকার করে বলল, ‘এই ছবি নিয়ে একটা কবিতাও আছে। মার্কিন কবি অ্যান সেক্সটনের। আমি পড়েছি! দাঁড়াও, কবিতাটা বের করি।’গুগল করে কবিতাটা বের করে ও পড়ল খানিকটা: 
‘দ্য টাউন ডাজ নট এক্সিস্টএক্সেপ্ট হোয়্যার ওয়ান ব্ল্যাক–হেয়ারড ট্রি স্লিপসআপ লাইক এ ড্রোউনড ওম্যান ইনটু দ্য হট স্কাইদ্য টাউন ইজ সাইলেন্ট। দ্য নাইট বয়েলস উইথ ইলেভেন স্টারসওহ স্টারি নাইট! দিস ইজ হাউআই ওয়ান্ট টু ডাই!’
কেন মানুষ এই ছবির কাছে এসে থমকে দাঁড়ায়, তার ব্যাখ্যা কেউ করতে পারবে বলে মনে হয় না। সত্যিই ছবিটি মনকে অবশ করে ফেলে। সকাল, দুপুর, বিকেল, রাতের আকাশ যেন মিলেমিশে আছে এই ছবিতে। এতগুলো তারা! আর ওই কালো গাছটা! শৌনক বলল, ‘অ্যান লিখেছেন ১১টা তারা। আমি তো দেখছি ১২টা!’অন্যরা কেউ উত্তর দিল না শৌনকের কথার। শুধু ইলোরা মাহমুদ অস্ফুটে বললেন, ‘স্টারি নাইট! তারাভরা রাত!’ চমকে মায়ের দিকে তাকাল শৌনক। বলল, ‘কী বললে! তারাভরা রাত!’ইলোরা মাহমুদ অবাক হলেন, ‘তাতে কী হয়েছে? হ্যাঁ, তারাভরা রাত!’ শৌনক বলল, ‘সনকা আপু, মা বলছে তারাভরা রাত! তুমি বুঝতে পারছ? তারাভরা রাত!’সনকাও অবাক হলো। ‘তাতে কী হয়েছে? স্টারি নাইটের বাংলা তো তারাভরা রাতই হয়।’শৌনক বলল, ‘চিরকুটের কথা মনে আছে? ওখানে ছিল “জলপদ্ম”, “তারাভরা রাত”, “তিন মানবী”। যদি “স্টারি নাইট” “তারাভরা রাত” হয়ে থাকে, তাহলে “জলপদ্ম”ও পাব এখানে। “তিন মানবী”ও পাব। একটু সতর্ক হয়ে ছবিগুলোর নাম দেখতে হবে। যদি এখানে নামগুলো পেয়ে যাই, তাহলে কিন্তু চিরকুটের রহস্যের সমাধান হবে।’সনকা চোখ বড় বড় করে বলল, ‘তুই এখনো ওই চিরকুট নিয়েই আছিস!’শৌনক বলল, ‘একজন রক্তাক্ত মানুষ একটা চিরকুট রেখে নিরুদ্দেশ হলো, আর তার কথা ভাবব না! কী যে বলো তুমি!’সনকা বুঝল, রাজ্যের আগাথা ক্রিস্টি পড়ে শৌনকের মাথায় এখন কেবল গোয়েন্দা গল্প। এ ভূত সহজে নামবে না।কিন্তু কয়েকটা ঘর পার হয়ে যখন পিকাসোর ‘থ্রি উইমেন অ্যাট দ্য স্প্রিং’ ছবিটার সামনে এসে ওরা দাঁড়াল, তখন সনকাও স্বীকার করল, এই ছবিগুলোর সঙ্গে চিরকুটের একটা সম্পর্ক আছে। ‘তিন মানবী’ আসলে পিকাসোর আঁকা এই ‘তিন মানবী’। তার মানে তারাভরা রাত আর তিন মানবীর দেখা পাওয়া গেল। বাকি থাকল শুধু জলপদ্ম। সেটা খুঁজে নিতেও বেশি সময় লাগল না। ক্লদ মনের বিশাল ছবিটা পাওয়া গেল পরের ঘরেই। এবার শৌনক আর সনকার চোখে অন্য রকম আলো। ওরা মোমায় থেকেও মোমা থেকে বেরিয়ে এল যেন। ওদের ভাবনায় জায়গা করে নিল চিরকুট। তিনটি বিখ্যাত ছবি আর তিনজন বিখ্যাত চিত্রকরের সঙ্গে কী সম্পর্ক আছে এই চিরকুটের, সেটাই খুঁজে বের করতে হবে!’
জটিল অঙ্কপারসনস বুলভার্ডের হাইল্যান্ড অ্যাভিনিউয়ের চিলেকোঠায় বসেছে তিনজন। সনকা, শৌনক আর রুদ্র। বড়রা নিচের ঘরে বসে চা খাচ্ছে আর আড্ডা দিচ্ছে।সকালের মিষ্টি রোদ বিছিয়ে আছে চারদিকে। একটু পরই সূর্যটা প্রকট হতে থাকবে। ‘আমার মনে হয়, চিরকুট–রহস্যের একটা সমাধান হওয়া উচিত।’ বলল শৌনক।সনকাও খুব মনোযোগী হয়ে চিরকুটের কথাই ভাবছে। ‘কী লেখা ছিল চিরকুটে, সেটা দেখি আগে: জলপদ্ম, তারাভরা রাত, তিন মানবী। আদ্যাক্ষর। তিন শুক্রবার, তিন। জোসেফ। এক্সট্রা ব্যাংক।’রুদ৶ বলল, ‘ছবিগুলোর নাম নাহয় বুঝলাম। কিন্তু আদ্যাক্ষর মানে কী? কোনো এক জোসেফের কথাও বলা হচ্ছে! এখানে আবার এক্সট্রা ব্যাংক এল কেন?’শৌনক বলল, ‘যিনি এসব লিখেছেন, তিনি বোকা নন। খুব মাথা খাটিয়েই লিখেছেন। এই লেখার কোনো উদ্দেশ্য আছে। আচ্ছা রুদ্র, এক্সট্রা ব্যাংকটা কিরে?’‘এক্সট্রা ব্যাংকে অনেক লকার আছে। মানুষ বাড়িতে সোনাদানা না রেখে এক্সট্রা ব্যাংকে রাখে। এই ব্যাংকের ফি খুব কম, তাই বেশির ভাগ মানুষ এই ব্যাংকের লকারেই ওসব রাখে।’‘খুব ভালো একটা তথ্য পাওয়া গেল।’ বলল সনকা। ‘তাহলে মোমার এই তিন শিল্পীর সঙ্গে এক্সট্রা ব্যাংকের একটা সম্পর্ক আছে। কী সে সম্পর্ক?’‘খুব বুদ্ধিমান এক শয়তান এ কাজগুলো করেছে। কিছু একটা উদ্দেশ্য আছে তার।’ রুদ্র বলল।এ সময় সুজন কাকু ওদের ঘরে এলেন একজন মানুষকে সঙ্গে নিয়ে। ‘তোমরা কি এই ভদ্রলোককে চেনো?’‘না তো!’ বলল রুদ্র। সনকা আর শৌনক দুদিকে মাথা নেড়ে বোঝাল ওরাও লোকটাকে চেনে না।‘এই সেই মানুষ, যিনি রক্তমাখা চিরকুটটা দিয়েছিলেন ফাহাদকে। তাঁর নাম রফিকুল বারী।’‘বলেন কী!’ লাফিয়ে উঠল শৌনক। ‘আপনিই এই চিরকুট দিয়েছিলেন। এত দিন কোথায় ছিলেন?’‘আমি তো আহত হয়েছিলাম। ক্ষত একটু শুকানোর পর আমি পারসনস বুলভার্ডে ওই খাবার বিক্রেতার কাছে গিয়ে আমার চিরকুটটার ব্যাপারে জানতে চেয়েছিলাম। ওর নাম ফাহাদ। ও–ই আমাকে এই বাড়িতে নিয়ে এল।’‘ব্যাপারটা কী বলুন তো!’ শৌনক উৎসুক হয়ে বলে।‘আমি হিলসাইড অ্যাভিনিউয়ে ১৬৯ স্ট্রিটের একটি রেস্তোরাঁয় বসে খাচ্ছিলাম সেদিন। সেখানে দুজন বাঙালি আর একজন আফ্রিকান যুবকও খাচ্ছিল। তখন রাত সাড়ে আটটার মতো বাজে। ওরা যে বিষয়ে কথা বলছিল, তার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। শুধু বুঝতে পারছিলাম, ওরা যা ভাবছে, তা খারাপ কিছু। ভাসা–ভাসা কয়েকটা শব্দ শুধু শুনতে পাচ্ছিলাম। কোনো এক ব্যাংকের কোনো এক লকার থেকে কিছু চুরি করার ফন্দি অাঁটছিল ওরা। ওদের কথা থেকেই জানলাম, তিনজনই কিছুদিন আগে জেল থেকে বের হয়েছে। ছিঁচকে চোর বলে ওরা জেলে ছিল। এখন বড় ধরনের একটা দাঁও মারার চেষ্টা করছে। এই চুরিটা করতে পারলে ওদের ভাগ্য খুলে যাবে। নিউইয়র্ক থেকে ওরা চলে যাবে অন্য কোনো অঙ্গরাজ্যে। তারপর সুখে–শান্তিতে বসবাস করবে।’‘কিন্তু আপনাকে মারল কে?’‘আমি আসলে খুবই শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। আমি কাস্টমসে কাজ করি। এ দেশের আইনকানুনের প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল। কেউ বেআইনি কিছু করলে আমি সহ্য করতে পারি না। ওরা বের হলো। রেস্তোরাঁ থেকে বাইরে এসে দেখি, খুব বাতাস রাস্তায়। রাস্তায় মানুষ খুব কম। আমি ওদের পিছু নিলাম। একটা ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে ওদের একজন বলল, “পুরো নকশা করা আছে। এসো, আমরা এখানে দেখে নিই।”একটা চিরকুট হাতে নিয়ে ওরা দেখতে থাকল। তখনই আমি ওদের হাত থেকে চিরকুটটা কেড়ে নিয়ে দৌড় দিলাম। ওদের একজন আমাকে ধরে ফেলল। আরেকজন আমার নাকে একটা ঘুষি মারল। অন্যজন পকেট থেকে ছুরি বের করে আমার পেটে চালিয়ে দিল। কিন্তু আমি একটু সরে যাওয়ায় তা আমার কোমর চিরে বেরিয়ে গেল। রক্ত বের হলো শরীর থেকে। এরপর চিরকুটটা নিয়ে আমি দৌড় দিলাম। রাস্তা পার হওয়ার সংকেত ছিল, দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে গেলাম। ওরা পার হওয়ার সময় পথচারী পারাপারের সংকেত বদলে গেল। তাই ওরা দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপরের ঘটনা তো ফাহাদের কাছ থেকে তোমরা শুনেছ।’‘এক্সট্রা ব্যাংকের লকার থেকে কিছু চুরি করা হবে এই শুক্রবারে। এমনই তো মনে হচ্ছে! ওখানে লেখা তিন শুক্রবার, তিন। মানে মাসের তৃতীয় শুক্রবার তিনটার সময়!’ শৌনক বলল।‘হ্যাঁ। তেমনই তো মনে হচ্ছে।’ কাস্টমস অফিসার রফিকুল বারী সায় দিলেন শৌনকের কথায়।‘কিন্তু তাহলে তিন বিখ্যাত শিল্পীর তিনটি বিখ্যাত কাজের নাম কেন এই চিরকুটে?’‘আমি তো চিরকুটটা দেখিনি। হাতে পেয়েই দিয়ে দিয়েছিলাম ফাহাদের হাতে। তিন শিল্পীর নাম লেখা আছে নাকি সেটায়?’ জানতে চাইলেন রফিকুল বারী।‘না। তিন শিল্পীর তিনটা বিখ্যাত কাজের নাম লেখা আছে। তিনটা কাজই আছে মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টে। ভ্যান গঘ, পিকাসো আর মনে।’‘জোসেফটা কে?’ আবারও রফিকুল বারীর প্রশ্ন।‘সেটা তো আপনার কাছ থেকে জানব বলে ভেবেছিলাম!’ হেসে বলল সনকা।‘আমি আসলে কিছুই জানি না।’ মন খারাপ করে বললেন রফিকুল।‘আপনি কি আর কিছু শুনেছিলেন? মনে করতে পারেন?’ শৌনক জিজ্ঞেস করল।কিছুক্ষণ ভাবলেন তিনি। তারপর বললেন, ‘এদের দলের যে লিডার, সে বুঝি গানের লোক...’‘কী কে বুঝলেন?’‘ওরা সিঙ্গার সিঙ্গার বলছিল।’‘সিঙ্গার? মানে সারেগামাপা?’ সনকা মজা করে বলল।‘হ্যাঁ, সারেগামাপা।’ হেসে পুনরাবৃত্তি করলেন রফিকুল বারী।‘এই কথা বলে আপনি খুব উপকার করলেন আমাদের। সারেগামাপা, ভালো বলেছেন।’ বলল শৌনক।‘কী রকম?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন রফিকুল বারী।হেসে বলল শৌনক, ‘শুক্রবার আসুক, জানতে পারবেন। আরেকটা কথা, এই চিরকুট হারিয়ে গেলেও তো তারা আবার এটা জোগাড় করতে পারবে, তাই না?’‘তাই তো মনে হয়। সিঙ্গার নিশ্চয়ই বলে দেবে আবার।’ বললেন রফিকুল বারী।‘হুম। শুক্রবার কি আপনার অফিস আছে?’ জিজ্ঞেস করল শৌনক।‘না। আমি সপ্তাহে চার দিন কাজ করি। শুক্রবার অফিস করি না।’‘তাহলে সেদিন বেলা একটায় আমাদের এখানে চলে আসবেন।’‘ঠিক আছে।’রফিকুল বারী চলে গেলেন।‘আমরা কি আজ মোমাতে যেতে পারব?’ সুজন কাকুকে জিজ্ঞেস করল শৌনক।‘কেন পারবে না? রুদ্রকে বলো। ও তোমাকে নিয়ে যাবে।’        এক্সট্রা ব্যাংকে ডাকাতিশুক্রবার পারসনস বুলভার্ডে চলে এলেন রফিকুল বারী। সুজন কাকু তাঁর ভ্যান বের করলেন। ভ্যানে আটজন বসা যায়। তাই প্রত্যেকেই জায়গা করে নিতে পারল গাড়িতে। ড্রাইভিং সিটে সুজন কাকু। মেট্রোতে গেলে বোঝা যায় না শহরটা। শুধু ট্রেনের শব্দই শোনা যায়। নিউইয়র্কের রাস্তাঘাট সবুজ অনেক। একটু পরপরই এক্সিট রয়েছে। রাস্তার লেখাগুলো পড়লে সংকেতগুলো দেখলে কেউ হারিয়ে যাবে না।আধঘণ্টার মধ্যে ওরা পৌঁছে গেল মোমার সামনে এক্সট্রা ব্যাংকে। পার্কিং খুঁজে নিয়ে গাড়ি রেখে এগোল ব্যাংকের দিকে। ওরা সরাসরি ব্যাংকের ম্যানেজারের কাছে গেল। মি. ওয়াটসন ওদের নিয়ে বসালেন নিজের ঘরের পাশের মিটিং রুমে। কাউকে কিছু বলতে না দিয়ে বললেন, ‘আপনারা বলছেন, পুলিশকে এখনই জানাতে হবে না?’শৌনক বলল, ‘আমরা একটা অনুমানের ওপর নির্ভর করে এখানে এসেছি। যদি ঘটনাটা না ঘটে, তাহলে পুলিশ ডাকলে হাসাহাসি হবে। তাই আগে দেখি, ঘটনাটা সত্য কি না। যদি সত্যি হয়, তাহলে আপনার গার্ডরাই সামলে নিতে পারবে। তারপর পুলিশ ডাকা যাবে।’মি. ওয়াটসন বললেন, ‘ঠিক আছে। দেখি, কী হয়! কিন্তু যাদের এই লকার, তারা যদি জানতে পারে, আমরা তাদের অনুমতি ছাড়া...’‘আপনি ভাববেন না, তাদের জানানোর দরকার নেই। কাণ্ডটা ঘটে গেলে বরং তাদের সতর্ক করে দিয়ে কোড নম্বরটা বদলে দিয়েন।’সেদিন ব্যাংকে এসে মি. ওয়াটসনের সঙ্গে কথা বলে গিয়েছিল শৌনক আর রুদ্র। ম্যানেজার প্রথমে কিছুই বিশ্বাস করতে চাননি। তাঁর ব্যাংকে নিরাপত্তাব্যবস্থা এতটাই জোরদার যে কেউ চাইলেই এখানে চুরি করতে পারবে না। শৌনক বুঝিয়েছে, একটা চক্র চুরি করার কথা ভাবছে। যদি কথাটা সত্য হয়, তাহলে সামনে ঘোর বিপদ।যাঁরা ব্যাংকের লকারে সোনাদানা রেখেছেন, তাঁরা আসছেন, নিজের লকার খুলে পরীক্ষা করছেন, নতুন কিছু রাখছেন। কেউ তাঁদের খেয়াল করছে না। প্রত্যেকেই নিজের লকারের কোড নম্বর জানেন, তাই ব্যাংকের কাউকে জিজ্ঞেস করারও প্রয়োজন পড়ছে না।বেলা আড়াইটার দিকে ওরা একটু সতর্ক হলো। কিছু ঘটলে একটু পরেই ঘটবে। শৌনক ফিসফিস করে বলল, ‘সিকিউরিটির জোসেফকে এখন কেউ ডাকবেন না। ওকে ওর কাজটা করতে দেবেন।’মি. ওয়াটসন শঙ্কিত হয়ে বললেন, ‘কী কাজ করবে ও?’‘আপনাকে বলি তাহলে। জোসেফ কিছুক্ষণের মধ্যেই এখানকার ইলেকট্রিসিটি দুই মিনিটের জন্য বন্ধ করে দেবে।’‘বলো কী!’ ‘দেখুন না কী ঘটে!’সবাই বসে থাকল। তিনটা বাজার এক মিনিট আগে সত্যিই ব্যাংকের বাতি নিভে গেল। যে যার মতো দাঁড়িয়ে রইল যে যার জায়গায়। শৌনক হাতে টর্চ নিয়ে বেরিয়ে এল। ওর জানা আছে কোথায় যেতে হবে। করিডরের মধ্যে একটি লকারের সামনে দাঁড়িয়ে দেখল, মৃদু টর্চের আলোয় তিনজন মানুষ লকারটা খোলার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।শৌনক বলল, ‘৪৩৫ কোড নম্বর দিয়ে এই তালা খুলবে না! তোমাদের ভাগ্য খারাপ।’লোক তিনজন চমকে ওর দিকে তাকাল। ততক্ষণে আবার আলো জ্বলে উঠেছে। চোরদের পরিকল্পনা ছিল, দুই মিনিটের মধ্যে লকার সাফ করে ফেলতে পারবে। কিন্তু লকারের সাংকেতিক বার্তা পরিবর্তন করা হয়েছে, সেটা তো তাদের জানা ছিল না। তাই বারবার ৪৩৫ দিয়ে খোলার চেষ্টা করছিল লকারটা।রফিকুল বারী বললেন, ‘তোমরা খারাপ মানুষ। তোমরা চোর।’ব্যাংকের সিকিউরিটির লোকেরা চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে ওদের। একজন রিভলবার বের করে বলল, ‘হ্যান্ডস আপ!’তিনজনই হাত তুলল ওপরে।হতাশ হয়ে বাঙালি একজন বলল, ‘আবার জেল!’আফ্রিকানটা বলল, ‘ইউ ম্যান! ইউ সেইড দেয়ার ইজ নো রিস্ক! বুলশিট!’ওদের যখন মিটিং রুমে আনা হলো, তখন ওরা দেখল মাথা নিচু করে বসে আছে জোসেফ। ওকেও একটু আগে ধরে এনে এখানে বসানো হয়েছে।
কী থেকে কী হলোম্যানেজারের ঘর থেকে ওরা তিনজন আর ব্যাংকের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা জোসেফ চলে গেছে পুলিশের হেফাজতে। মি. ওয়াটসন সংক্ষেপে পুলিশকে বুঝিয়েছেন, কীভাবে কী ঘটল। তিনি আটকে গেলে শৌনক সাহায্য করেছে। এখন সবাই শুনতে চাইল ঘটনার আদ্যোপান্ত।শৌনকই বলা শুরু করল, ‘আমরা এখন জেনে গেছি, জিম ক্রাউলি নামের একজন গায়ক মাদক বিক্রির জন্য বহু বছর ধরে নিউইয়র্কের একটি জেলে রয়েছেন। ভারতীয় সংগীতের সঙ্গেও তাঁর যোগ ছিল। ভারতীয় সারগামও জানতেন তিনি। তিনিই এই তিন ছিঁচকে চোরের সঙ্গে আলাপ করে ষড়যন্ত্র করেন। জিম ক্রাউলি মি.স্যামসন নামের এক ধনকুবেরের অফিসে কাজ করতেন একসময়। মি. স্যামসন তাঁর যাবতীয় গোপন কাগজপত্র জিম ক্রাউলির মাধ্যমে হ্যান্ডল করতেন। একদিন জরুরি কাজে ব্যস্ত থাকায় তিনি জিম ক্রাউলিকে পাঠিয়েছিলেন লকারে কিছু হীরা রাখার জন্য। স্বভাবতই জিম ক্রাউলিকে লকারের সাংকেতিক নম্বরটাও তিনি জানিয়েছিলেন। তখন ক্রাউলি কাজটা করেছিলেন খুবই বিশ্বস্ততার সঙ্গে। কিন্তু তত দিনে তিনি মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে গেছেন। একদিন পুলিশের হাতে ধরাও পড়লেন।‘জেলখানায় বসে তিনি তাঁর শাগরেদ বানালেন তিন ছিঁচকে চোরকে। তাদের নাম আর বলছি না। কী লাভ নাম বলে! জিম ক্রাউলি ছাড়া পাবেন আরও দুই বছর পর। তাই তিনি তাঁর শাগরেদদের এক অভিনব চুরির কাজে লাগাতে চাইলেন। ছিঁচকে চোরেরা ভুল করতে পারে কিংবা চাপে পড়ে বেফাঁস কথা বলতে পারে, সে কথা ভেবেই তিনি একটি চিরকুট লেখেন, যা আবার দুই বাঙালিকে দিয়ে বাংলা করান, যেন কোনোভাবেই তা বাইরের কেউ বুঝতে না পারে। তাই ওখানে বাংলায় লেখা ছিল, ‘“জলপদ্ম”, “তারাভরা রাত”, “তিন মানবী”। আদ্যাক্ষর। তিন শুক্রবার, তিন। জোসেফ। এক্সট্রা ব্যাংক।’ তিন ছিঁচকেকে তিনি শিখিয়ে দিয়েছিলেন লকারের সাংকেতিক বার্তা।‘কিন্তু সাংকেতিক বার্তায় ৪৩৫ কোড নম্বরটি তো নেই! সেটা এল কোত্থেকে?’ রফিকুল বারীর প্রশ্ন।‘খুব সহজ। দেখুন, প্রথম শব্দটি জলপদ্ম, মানে ক্লদ মনের ওয়াটার লিলি, তারাভরা রাত হলো ভ্যান গঘের স্টারি নাইট আর তিন মানবী হলো পিকাসোর থ্রি উইমেন অ্যাট দ্য স্প্রিং।’‘এখনো বুঝলাম না!’ হতাশ হয়ে বললেন রফিকুল বারী।‘মনে, গঘ, পিকাসো। আদ্যাক্ষর ধরে এগোলে সারেগামাপার—তিনটি সংখ্যা পেয়ে যাবেন। মা গা পা...। বুঝেছেন? অর্থাৎ সারগমের ৪ ৩ ৫।’এতক্ষণে রফিকুল বারীর চোখ–মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।‘কিন্তু এত কঠিন করে সংকেত শেখানো কেন?’শৌনক বলল, ‘সেটা আমিও বলতে পারব না। হয়তো জিম ক্রাউলি তাঁর প্রতিভাটা মাদকের পেছনে ব্যয় না করলে একজন অসাধারণ শিল্পী হয়ে উঠতে পারতেন। গোয়েন্দাও হয়ে উঠতে পারতেন। চিরকুটে যে ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, তা তাঁর সৃজনশীলতারই প্রমাণ। তিনি ভেবেছিলেন, দুই বছর পর যখন জেল থেকে বের হবেন, তখন শাগরেদদের খুঁজে নিয়ে নিজের টাকার অংশ পাওয়ার পর সুখী জীবনযাপন করবেন! সেটা হলো না। আমি কিন্তু ক্রাউলি ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বললে সুখী হতাম। আসলেই খুব সৃজনশীল ভদ্রলোক। শিল্পীদের নাম যেভাবে যুক্ত করেছেন, তা থেকে যেভাবে নকশাটা বানিয়েছেন, তাতে আমি মুগ্ধ! আফসোস শুধু, নিজের এই সৃজনশীলতা ভালো কোনো কাজে ব্যবহার করলেন না!’এবার সুজন কাকু জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিন্তু এই ক্রাউলি–স্যামসন উপাখ্যান তুমি জানলে কী করে?’‘খুব সোজা। ম্যানেজার মি. ওয়াটসনকে জিজ্ঞেস করলাম, ৪৩৫ কোডের লকারটি কার। খুব অবাক হয়েছিলেন তিনি। তবে ঘটনার তাৎপর্য বুঝে তিনি বিশ্বাস করে বলে দিলেন নামটা। মি. স্যামসনকে ফোন করে বললাম, তাঁর সঙ্গে কি এমন কারও পরিচয় আছে, যিনি গানের সঙ্গে যুক্ত। তিনি আমাকে জিম ক্রাউলির ইতিহাস জানালেন। আমার চোখে তখন সবকিছুই পরিষ্কার হয়ে গেল। তবে মি. স্যামসনকে ফোনে পেতে আমার খুব কষ্ট হয়েছে। মি. ওয়াটসন সাহায্য করেছেন বটে, কিন্তু সেক্রেটারির মাধ্যমে সময় নিয়ে কথা বলতে হয়েছে। দুই মিনিটের বেশি কথা বলবেন না, সে কথা আগেই জানিয়ে দিয়েছেন মি. স্যামসন...। ভদ্রলোকের ধনভান্ডার যে লোপাট হয়ে যাচ্ছে, সে কথা তাঁকে কে বোঝাবে!’‘আর এই জোসেফ কী করে মিশে গেল এই দলে?’ ইলোরা মাহমুদের প্রশ্ন।‘এটাও আরেক মজার কাহিনি। জোসেফও একসময় মি. স্যামসনের অফিসে কাজ করতেন। সে চাকরি টেকেনি। পরে তিনি কাজ নেন এই ব্যাংকের সিকিউরিটি বিভাগে। মি. ক্রাউলির সঙ্গে জোসেফের একটা যোগাযোগ ছিল। মি. ক্রাউলি যখন চুরির পরিকল্পনা করেন, তখন জোসেফকে একবার জেলখানায় ডেকে নিয়ে পুরো পরিকল্পনাটা শুনিয়েছেন। জোসেফ রাজি হয়েছেন। তারপর তো কী হয়েছে, নতুন করে বলার দরকার নেই।’শৌনক এবার ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মি. ওয়াটসন! এবার আপনি আবার লকারের নম্বর পরিবর্তন করতে পারেন। মি.  স্যামসনকে ডেকে নতুন কোড দিয়ে দেবেন।’‘সে আর বলতে!’ খুশিতে গদগদ হয়ে বললেন মি. ওয়াটসন। ‘তোমরা আমাকে যে বিশাল বিপদ থেকে রক্ষা করলে, সে জন্য কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। আমি তোমাদের এই তিন ডেভিলের জন্য একটা পানিশমেন্টের ব্যবস্থা করতে চাই! আশা করি, এই সাজা খাটতে তোমাদের ভালো লাগবে।’সনকা, শৌনক আর রুদ্র এ ওর দিকে তাকাল। তারপর তিনজনই তাকাল মি. ওয়াটসনের দিকে।‘তোমাদের জন্য একটা ব্রডওয়ে শো দেখার ব্যবস্থা করছি! লায়ন কিং না প্রিটি ওম্যান দেখবে?’রুদ্র লাফিয়ে উঠে বলতে গেল লায়ন কিং, কিন্তু সনকার দিকে তাকিয়ে কী যেন কী হয়ে গেল ওর। ও যা উচ্চারণ করল, তা হলো, ‘লায়... নো নো প্রিটি ওম্যান’।ওর কথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে উঠল।