পালকি চলে গগন তলে

জনৈক আলোকচিত্রীর ১৯৭০ সালে তোলা বরযাত্রার একটা ছবি
জনৈক আলোকচিত্রীর ১৯৭০ সালে তোলা বরযাত্রার একটা ছবি

নির্জন মাঠ। কেবল সূর্য উঠেছে। একপাশে ধু ধু প্রান্তর। এক পাশে ঘন বাঁশবাগান। মাঝখানে ছোট্ট নদী। ভূতের খাবার আধখাওয়া করে কেবল উঠছে গুপি আর বাঘা। তখনই দিগন্তে ধুলো উড়িয়ে হাজির একদল বেহারা। কাঁধে ছাদখোলা পালকি। পালকিতে বসেই আয়েশে গলা সাধছেন ওস্তাদ গানওয়ালা। উচ্চাঙ্গসংগীতের মূর্ছনা ছড়িয়ে পড়ছে প্রান্তরজুড়ে। ভয়ে ভয়ে সেদিকে এগিয়ে যায় বাঘা। ওস্তাদের পাইককে জিজ্ঞেস করে, এই পালকি কোথায় যাবে? পাইক অবহেলাভরে জবাব দেয়, সুন্ডিতে তাদের গন্তব্য। সেখানে গানের বাজি হবে। যিনি জিতবেন তাঁকেই রাজা সভাগায়কের চাকরি দেবেন।

গুপি-বাঘার আরও কিছু জানার ছিল—গানবাজনার অপরাধেই তাদের গ্রামছাড়া করেছে রাজার লোকেরা। কিন্তু ওস্তাদের লোকেদের সময় নেই রাস্তার ছেলেদের কথা শোনার। দ্রুতপায়ে দিগন্তের দিকে ছুটে চলে ছয় বেহারার পালকি। বাঘা বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে বলে, ‘বাপরে বাপরে বাপ, কী দাপট!’

শুধু সত্যজিতের সিনেমাতেই নয়, সত্যি সত্যিই দাপুটে লোকেরা পালকিতে চড়ত। বড্ড গরিব ছিল সেকালের সাধারণ মানুষ। পায়ে হেঁটেই চলত দূরের যাত্রা। কিন্তু যারা দাপুটে জমিদার, কিংবা রাজা-মহারাজা, পালকি ছিল তাঁদের অন্যতম বাহন। ঘোড়া ছিল, ঘোড়ার গাড়িও ছিল, কিন্তু ধনীদের আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে ছিল পালকি। এক শ বছর আগেও এ দেশে মোটরগাড়ি ছিল না, রেলগাড়ির প্রচলন হয়েছে কেবল, তার আগে ছিল না রেলগাড়িও। তখন গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি আর পালকিই ভরসা। পরিবারের লোকেরা ছোটখাটো দূরত্বে চলাচলের জন্য ব্যবহার করত পালকি।

পালকির ব্যবহার ঠিক কত আগে শুরু হয়, বছরের মাপকাঠিতে তা বলা মুশকিল। মিসরীয় ও মায়া সভ্যতার চিত্রলিপিতে পালকির ছবি পাওয়া গেছে। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে লেখা বাল্মিকীর রামায়ণেও পালকির কথা এসেছে বহুবার। পুরাণকাহিনিতে পালকির ব্যবহার শুধু ঠাকুর-দেবতাদের জন্য। আদিম যুগের মানুষ পশু শিকার করে খাদ্যের চাহিদা মেটাত। তারা শিকার করা মৃত পশু বড় একটা লাঠির মঝখানে ঝুলিয়ে বয়ে নিয়ে আসত বাড়িতে। এ দেশের সাঁওতালরা এখনো শিকার করা পশু এভাবেই বহন করে। শিকার বহনের এই পদ্ধতিই পরে পালকির ধারণা তৈরি করে বলে মনে করেন অনেক ঐতিহাসিক।

মোগল আমলে রাজপরিবারের নারীদের মধ্যে পালকি বেশ জনপ্রিয় ছিল। বিশেষ করে যুদ্ধের সময়। মোগল রাজবংশের একটা রীতি ছিল। যুদ্ধের সময় মোগল রমণীরাও সম্রাটের সঙ্গে যুদ্ধের ময়দানে যেতেন পালকি চড়ে। সম্রাট হুমায়ুন সিংহাসনে বসার কিছুদিন পরেই ক্ষমতাচ্যুত হন বাংলার শাসক শের শাহের কাছে পরাজিত হয়ে। তারপর বহুদিন তিনি ফেরারি ছিলেন। অল্প কিছু সৈন্যসামন্ত নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন গুজরাট-মহারাষ্ট্রের পথে-প্রান্তরে। হুমায়ুনের স্ত্রী তাঁর সঙ্গে সঙ্গে চলতেন পালকিতে চড়ে। তিনি তখন সন্তানসম্ভবা। পালকিতে ঘুরতে ঘুরতে গুজরাটের মরুপ্রান্তরে জন্ম বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম প্রভাবশালী সম্রাট আকবরের।

এ দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতিতেও পালকি আছে বিশেষ মর্যাদা নিয়ে। ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর বিখ্যাত ‘পালকির গান’ নামের ছড়ায় তুলে ধরেছেন এ দেশের গাঁয়ের পথে চলা পালকির এক অবিস্মরণীয় চিত্র—

‘পালকি চলে!/ পালকি চলে!/ গগন তলে/আগুন জ্বলে!/ স্তব্ধ গাঁয়ে/ আদুল গায়ে/ যাচ্ছে কারা/ রোদ্র সারা...’

পরে এই ছড়াটাই কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে গান হিসেবেও খ্যাতি লাভ করে। পালকি নিয়ে গান গেয়েছেন ভূপেন হাজারিকাও। তাঁর ‘দোলা হে দোলা’ গানটিতে তিনি পালকির বেহারাদের দুঃখভরা জীবনসংগ্রামের করুণ চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন।

যাঁরা পালকি বহন করেন তাঁদের বলে বেহারা। কোথাও কোথাও আবার বলে কাহার। বিখ্যাত ঔপন্যাসিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাঁসুলি বাঁকের উপকথা উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যে নতুন ধারার জন্ম দেয়। উপন্যাসটিতে হতদরিদ্র কাহার সমাজের এক করুণ চিত্র তুলে ধরেছেন তারাশঙ্কর। রবীন্দ্রনাথের ‘বীরপুরুষ’ কবিতার সেই ছোট্ট ছেলেটির মা-ও চলছিল পালকিতে চড়ে, ‘তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চড়ে, দরজাটুকু একটুকু ফাঁক করে...’

রবীন্দ্রনাথ নিজেও পালকিতে চড়ে ঘোরাঘুরি করতেন। তিনি যখন শিলাইদহের জমিদার, তখন প্রজাদের খোঁজখবর নেওয়ার জন্য ব্যবহার করতেন পালকি। কুষ্টিয়ার শিলাইদহের রবীন্দ্রকুঠিতে আজও রাখা আছে রবীন্দ্রনাথের ব্যবহার করা বেশ কিছু পালকি। কুষ্টিয়ারই আরেক বিখ্যাত সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেনও চড়তেন পালকিতে। বিষাদ-সিন্ধু উপন্যাসের জন্য খ্যাত এই লেখকের ব্যবহূত একটা ভাঙাচোরা পালকি রাখা আছে তাঁর লাহিনীপাড়ার বাড়িতে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ষোলো বেহারার এই পালকিতে চড়ে শিলাইদহে ঘুরতেন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ষোলো বেহারার এই পালকিতে চড়ে শিলাইদহে ঘুরতেন

পালকি আসলে কাঠ দিয়ে তৈরি ছোট্ট বাহন। সাধারণত পালকিতে একজনই চড়তে পারতেন। অবশ্য বড় পালকিতে একাধিক মানুষের বসার ব্যবস্থাও ছিল। পালকির আকার-আকৃতি ছিল নানা রকম। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই পালকির চল ছিল। দেশের সামাজিক রীতিনীতির ওপরই নির্ভর করত পালকি দেখতে কেমন হবে। কোথাও একেবারে বদ্ধ-গুমোট পালকির চল ছিল, কোথাওবা ছাদখোলা পালকি। আমাদের উপমহাদেশের পালকির চেহারা ছিল চারকোনা সিন্দুকের মতো। দুপাশে দুটো দরজা—কাপড়ের পর্দা দিয়ে দরজা ঢাকা। কিছু পালকির চেহারা সিংহাসনের মতো। ওপরের দিক খোলা আরামদায়ক এক চেয়ার যেন। গুপি গাইন বাঘা বাইন সিনেমার ওই পালকিটা সিংহাসনের মতো ছিল দেখতে। ব্রিটেনের অভিজাত লোকেরা যেসব পালকিতে চড়তেন, সেগুলোতে আবার ছিল শোবার ব্যবস্থাও।

পালকির সামনে ও পেছনে এক বা একাধিক লম্বা হাতল থাকে। সেই হাতল কাঁধে রেখে বেহারা বয়ে নিয়ে চলেন পালকি। পালকির আকারের ওপর নির্ভর করে পালকির ভার বইবেন কজন বেহারা। দুই, চার, ছয়, আট এমনকি ষোলো বেহারার পালকির চল ছিল এ দেশে। রোদ-ঝড়-বৃষ্টি মাথায় করে, ভীষণ কষ্ট সয়ে বেহারার দল পালকি বয়ে নিয়ে যেত মাইলের পর মাইল। কষ্ট ভুলতেই তাঁরা একটা ছন্দ আওড়াতেন—হুনহুনা, হুনহুনা।

পৃথিবী বদলে গেছে, রাজাদের রাজত্ব গেছে, গেছে জমিদারের জমিদারিও। রেলগাড়ি, মোটরগাড়ি, রিকশা ইত্যাদি কত রকমের যানবাহন এসেছে। এসব যানবাহনে ধনী-গরিব সবাই চলাচল করতে পারে। বিয়েতেও আজকাল কত রকম বাহারি গাড়ি ব্যবহূত হয়। ইতিহাসের দায় মিটিয়ে তাই হারিয়ে গেছে পালকি। শেষ হয়েছে কাহারদের রোদে পোড়া, বৃষ্টিতে ভেজা কষ্টের জীবন। পালকির স্থান এখন ইতিহাসের পাতায়, সিনেমার পর্দায় আর জাদুঘরের শোকেসে।

তথ্যসূত্র: দ্য ট্রাভেলস অব পিয়েত্রো ডেলা ভ্যালি ইন ইন্ডিয়া