একরত্তি মুনাই

মুনাইকে এ বাড়ির দারোয়ান সোবহান চেনেন। কাজেই আটকালেন না। এর আগে বজলু নামের যে দারোয়ান ছিল, সেও মুনাইকে ভালো করেই চিনত, কিন্তু প্রতিবারই আটকাত সে। তেরচা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলত, ‘তুই য্যান কে?’

মুনাই বিরক্তি চেপে বলত, ‘আমি জুলেখা বুয়ার পুত।’

এরপরও কি সে ছাড়ে? পুলিশের মতো এক শ একটা প্রশ্ন! শেষে মা এসে উদ্ধার করে নিয়ে যেত। তাই বলে বজলু দারোয়ানকে একহাত নিতে ছাড়ত না মুনাইয়ের মা। তার পলিশ করা মুখ। বকা খেয়ে হে হে করে হাসত বজলু। যেন বকা খাওয়ার জন্যই সে এ কাজ করত। স্বভাব খারাপ বলেই তো চাকরিটা গেল। কী যেন চুরি করেছিল। মাস দুয়েক আগে গলাধাক্কা খেয়েছে।

সোবহান চাচা সে রকম নন। নরম-সরম মানুষ। বয়স হয়েছে বলে নড়াচড়া কম। ফাঁক পেলেই ঝিমান। মুনাইয়ের হাতের পেপার ব্যাগটা নিয়ে মোটেও আগ্রহ দেখালেন না তিনি। বজলু হলে খপ করে ধরত। পেপার ব্যাগে একটা বাঘের মুখোশ আছে। দুদিন আগে এক ফেরিওয়ালার কাছ থেকে মা কিনে দিয়েছে। মুনাইয়ের প্যান্টের ডান পকেটেও একটা জিনিস আছে। ছোট একটা চাকু। ভাঁজ করা যায়। মায়ের দেওয়া টাকা জমিয়ে কিনেছে মুনাই। ফাল্গুন-চৈত্র মাসে ওর বয়সী গাঁয়ের ছেলেদের কাছে এই চাকুর বিশেষ কদর রয়েছে। গুটি আম পাড়ো, আর চাকু দিয়ে ছিলে লবণ-মরিচ লাগিয়ে খাও। গাঁয়ে আমগাছের অভাব নেই। পথের ধারেই কত! ঢাকায় সে সুযোগ নেই। তবু চাকু কিনেছে মুনাই। অভ্যাস।

এই ছয়তলা ফ্ল্যাটবাড়িতে লিফট আছে। কিন্তু মুনাই লিফটে চড়তে ভয় পায়। ওঠানামা করা ছোট ঘরটায় ওই একবারই উঠেছিল। দরজাটা বন্ধ হতেই মনে হলো দম আটকে যাচ্ছে। নামার পর সেই যে হাঁফ ছেড়েছে, দ্বিতীয়বার আর ওতে পা দেয়নি।

সিঁড়ি বেয়ে চারতলায় উঠে আসে মুনাই। জানে, এখন মা ছাড়া ভেতরে আর কেউ নেই। বাসার কর্তা আর কর্ত্রী অফিসে। তাঁদের একমাত্র ছেলে পরাগ স্কুলে। অবশ্য তার ফেরার সময় হয়ে গেছে। একটার সময় ফেরে সে। এখন ১২টার মতো বাজে। আসার সময় এক পথচারীর কাছ থেকে সময় জেনেছে মুনাই। কাজেই বেশি দেরি করা যাবে না।

এখানে অসময়ে মুনাইয়ের এভাবে চুপি চুপি আসাটা মোটেও পছন্দ করে না মা। এখানে সিসি ক্যামেরা আছে। সবই দেখা যায়। কাজেই মুনাই এলে মা তটস্থ থাকে। ওকে খাড়ার ওপর ভাগিয়ে দিতে মরিয়া হয়ে যায়। মুনাই তো এটাই চায়। এ সময় মা ওকে ২০ টাকা পর্যন্ত দিয়ে দেয়। অন্য সময় তো পাঁচ টাকা বাগাতেই ঘ্যান ঘ্যান করে মুখে ফেনা উঠে যায়!

পরাগদের ফ্ল্যাটের সামনে এসে বাঘের মুখোশটা মুখে এঁটে নেয় মুনাই। এবার ডোরবেলের সুইচ টেপে। মা এসে দরজা খুলে দেয়। অমনি নাক দিয়ে বিদঘুটে একটা শব্দ করে মুনাই। মা আঁতকে উঠে পিছিয়ে যায়। এরপরই একেবারে অগ্নিমূর্তি।

হাত তুলে মার দেওয়ার ভঙ্গিতে মা বলে, ‘চড় দিয়া গালডা এক্করে ফাডাইয়া দিমু! এমুন কইরা ডর দেহাইতে তোরে না মানা করছি।’

মুনাই হাসে কিটকিট। ঘাড় বাঁকিয়ে বলে, ‘ডরাও ক্যান? তোমার না এত সাহস!’

‘তোর কাছে আমার সাহসের পরীক্কা দিতে অইব না। তোরে না এই বাড়িত আইতে মানা করছি?’

মাকে এক রকম ঠেলেঠুলে ভেতরে ঢুকে পড়ে মুনাই। বলে, ‘বস্তির আন্ধার ঘরে থাকতে আমার একটুও ভালো লাগে না। গরমে শইলডা সিদ্ধ হইয়া যায়। আর এইহানে কত ঠান্ডা! কী আরাম!’

‘এই আরামের কাম নাই। তুই ঘরে ফিরা যা।’

‘যাইতাছি, ২০টা টেকা দেও। খুব খিদা লাগছে।’

‘মায়ের কাছে আইলেই খালি টেকা। এই টেকা নিয়া নিয়া পোলাডা নষ্ট হইয়া যাইব!’

জুলেখা বুয়া এ কথা বলে ঠিকই, কিন্তু আঁচলের গিঁট খুলে ছেলের হাতে ২০ টাকার একটা নোট দেয়। টাকা পেয়ে মুনাই মুখ ভরে হাসে। এক্ষুনি দোকানে গিয়ে পুরি আর চা খাবে। ঘুরতে যাবে, এমন সময় মা পেছন থেকে ডাকে, ‘একটু খাড়া।’

দাঁড়িয়ে যায় মুনাই। মা ভেতর থেকে চট করে একটা টি-শার্ট আর জিনসের প্যান্ট নিয়ে আসে। মুনাইয়ের দিকে বাড়িয়ে ধরে বলে, ‘এইগুলা পরাগ বাবুর পোশাক। বিবি সাবে তোরে দিছে। পইরা ল।’

মুনাইয়ের মুখে খুশির ঝিলিক। পোশাক দুটো হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখে ও। মাকে বলে, ‘এরা কত বড়লোক দেখছ, মা! দুই-তিন মাস পোশাক পইরাই ফালাইয়া দেয়। আর আমরা...’

‘এত কথা কইতে অইব না তোর। পেন-জামা পাইছস, পইরা ফালা। খাড়া, একটু সেমাই দেই তোরে। সকালের নাশতা খাই নাই এহনো।’

এই বলে মুনাইয়ের মা রান্নাঘরের দিকে যায়। মুনাই থাকে ভাবালু একটা ঘোরের ভেতর। গ্রামের কথা, বাবার কথা মনে পড়ে যায়। বাবা ওকে বছরে বার দুয়েক জামাকাপড় কিনে দিত। নতুন ক্লাসে উঠলে আর রোজার ঈদে। ভালোই ছিল সে জীবন।

ছোট এক নদীর ধারে ছিল ওদের বাড়ি। সেই নদীতে খলবলিয়ে সাঁতার কাটত মুনাই। এক ডুবে অনেক দূর চলে যেত। পানির নিচে অনেকক্ষণ থাকতে পারে বলে খেলার সাথিরা ওর নাম দিয়েছিল ‘ডুবাইল’। আর ঢাকায় এসে যেন একটা খাঁচার মধ্যে ঢুকেছে।

গ্রামের পাঠশালায় পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে মুনাই। বাবার খুব আগ্রহ ছিল ওর পড়া নিয়ে। স্যাররা প্রায়ই বাবাকে বলতেন, ‘তোমার ছেলেকে ভালো করে পড়তে বলো। ওর মাথা ভালো। শুধু একটু অলস!’

স্কুল আসলে ভালো লাগত না মুনাইয়ের। যা পড়াশোনা করত, তা ওই বাবার চাপে। এখন মনে হয়, স্কুলের ওই দিনগুলোই ভালো ছিল। সহপাঠীদের সঙ্গে দৌড়ঝাঁপের দৃশ্যগুলো এখনো চোখে ভাসে। আর তখন আউলা বাতাসের মতো হু হু করে বুক।

বাবা মহাজনি আড়তে কাজ করত। খাটনির চেয়ে মজুরি কম। সংসার চলে না। শেষে নিজেই একটা দোকান দেবে ঠিক করল। সদু মেম্বারের কাছ থেকে সুদে টাকা ধার নিল। সেটাই হলো কাল। দোকান তো লাটে উঠলই, দেনা গিয়ে ঠেকল চাঁদিতে।

একদিন এই দেনা নিয়ে সদু মেম্বারের সঙ্গে বাবার খুব কথা-কাটাকাটি হলো। এর দুদিন পর বাবা হাওয়া। নেই যে নেই-ই। কেউ বলে গা-ঢাকা দিয়েছে, কেউ বলে মেম্বার গুম করেছে। আসলে কী, তা কে জানে।

এর দুই মাস পর লেঠেল বাহিনী নিয়ে এসে সদু মেম্বার ওদের ঘাড় ধরে বের করে দিল। মা আর মুনাই কাঁদতে কাঁদতে তার পায়ে পড়েছিল। মেম্বার টলেনি। সে পাথরের চেয়েও কঠিন। ভিটেবাড়ি হারিয়ে মা ওকে নিয়ে চলে এসেছে ঢাকায়। বুয়ার কাজ করে পেট চালাচ্ছে।

এসব ভাবতে ভাবতে মুনাইয়ের চোখে জল এসে যায়। চোখ মুছে পরাগের টি-শার্ট আর প্যান্ট পরে নেয় সে। পায়ে পায়ে পরাগের ঘরটায় এসে দাঁড়ায়।

এই ঘরটা মুনাইয়ের কাছে স্বপ্নের মতো লাগে। ওর বয়সী কারও ঘর এত সুন্দর হতে পারে, দেখেও বিশ্বাস হতে চায় না। পরাগের ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নিজেকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে মুনাই। নিজেকে ওর এখন হিরো হিরো লাগছে। নায়ক শাকিব খানের মতো একটা ভাব এসে যায়। খায়ের চাচার চায়ের দোকানে হরদম টিভি চলে। সেখানে শাকিব খানের ছবি দেখেছে ও। যা ঢিসুম-ঢুসুম করে! মুনাইয়ের সামনে খলচরিত্র একটাই—সদু মেম্বার। আয়নার ভেতর সদুর কায়াটা যে দেখতে পায় মুনাই। শাকিব খানের ঢঙে বলে, ‘আরেকটু বড় হইয়া লই, মেম্বার। তোমার আর রেহাই নাই। আমাগোর যেমুন বাইর কইরা দিছ, তোমারেও ওই রকম তুলার মতো উড়াইয়া দিমু! ইয়া—ঢিসুম!’

‘ও মা গো, এই পোলা তো আমার চাকরিডা খাইব!’

মায়ের এই মাতমে চমকে ওঠে মুনাই। নিমেষে ওর ঘোর কেটে যায়। মায়ের এক হাতে সেমাইয়ের পিরিচ, আরেক হাতে পানির গ্লাস।

‘তুই এই ঘরে হান্দাইছস কী কামে? জলদি সেমাই খাইয়া ভাগ!’

মুনাই টের পায়, মায়ের মেজাজ সত্যিই বেশ চড়ে গেছে। হাপুসহুপুস করে সেমাই খেয়ে বেরিয়ে আসে সে। পেছন থেকে মা পই পই করে বলে, ‘চা-পুরি খাইয়া সিধা ডেরায় যাইবি। বদমাইশ পোলাগো লগে মিশবি না।’

মুনাই হুঁ-হুঁ করতে করতে বেরিয়ে আসে। ওর গায়ে এখন পরাগের পোশাক। নিজের পুরোনো শার্ট-প্যান্ট পেপার ব্যাগে। মুখোশটাও মুখে এঁটে নিয়েছে। ভাবখানা এই—ও এখন আর মুনাই নয়, পরাগ। মুখোশ পরা পরাগ যাচ্ছে।

বাড়ির ফটক পেরিয়ে মুনাই কেবল রাস্তায় এসে পৌঁছেছে, এমন সময় একটা মাইক্রোবাস এসে দাঁড়ায় ওর সামনে। ভেতর থেকে ফিটফাট এক যুবক নেমে আসে। মুনাইকে বলে, ‘তোমার নাম কী খোকন?’

মুনাই গলে যায়। ‘তুমি’ করে বলছে, আবার ‘খোকন’! আহ্, একেই বলে পোশাকের গুণ! মুনাই বেশ ভাব নিয়ে বলে, ‘জি, আমি পরাগ!’

তরুণ খপ করে ধরে ফেলল মুনাইকে। মুখ চেপে ধরে পাঁজাকোলা করে ওকে ঢুকিয়ে দিল মাইক্রোবাসের ভেতর। ঘটনাটা এত দ্রুত ঘটল যে মুনাই কিছুই ঠাওরাতে পারল না। কেবল টের পেল, মাইক্রোবাসের ভেতর তিন গাট্টাগোট্টা যুবক খুব কষে ঠেসে ধরেছে ওকে। যখন মনে হলো—এখন গলা ফাটিয়ে একটা চিত্কার দেওয়া দরকার, ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। ওর হাত-পা বাঁধা হয়েছে, মুখে গুঁজে দেওয়া হয়েছে এক টুকরো কাপড়। চোখ বাঁধা হয়েছে। নাক-মুখ প্যাঁচানো হয়েছে চওড়া একফালি কাপড় দিয়ে। মুনাইয়ের দম বন্ধ হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে, মারা যাবে। চোখ ফেটে পানি গড়াচ্ছে ওর। শাঁ শাঁ করে মাইক্রোবাস কোন দিকে ছুটে চলেছে, কে জানে?

মুনাই একেবারে জ্ঞান হারাল না। আবার পুরোপুরি যে জেগে আছে, তা-ও নয়। অদ্ভুত এক ঘোরের ভেতর রইল। ঘণ্টা দেড়েক পর মাইক্রোবাস নির্জন এক পুরোনো বাড়ির ভেতর ঢুকল। সেখানে একটা ঘরে ষন্ডা মার্কা কয়েকজন লোক অপেক্ষায় ছিল। তাদের সামনে নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হলো মুনাইকে।

মুনাইকে দেখে আঁতকে উঠল অপেক্ষায় থাকা একজন। হতাশা নিয়ে বলল, ‘আরে, তোমরা কারে উঠাইয়া আনছ! হে তো পরাগ না। পরাগগো বাড়ির জুলেখা বুয়ার পোলা। এইডা কী করছ তোমরা!’

মুনাই এর মধ্যে কিছুটা ধাতস্থ হয়ে উঠেছে। হতাশ লোকটাকে দেখেই চিনে ফেলল ও। সেই বজলু দারোয়ান। এই খাটাশ বেটা এখানে কেন?

ওদের কথাবার্তা শুনে শিগগিরই মুনাই টের পেয়ে যায়—আসলে কী ঘটেছে। বজলু একটা অপহরণকারী দলে ভিড়েছে। তাদের নিয়ে পরাগকে অপহরণ করার মতলব করেছিল। ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ চাইত তারা। যারা অপহরণ করতে গিয়েছিল, তাদের কাছে পরাগের একটা ছবি ছিল। ছবিতে পরাগের যে পোশাক, সেটা এখন মুনাইয়ের গায়ে। মুখে মুখোশ থাকায় ওর চেহারাটা দেখতে পায়নি অপহরণকারীরা। এদিকে পরাগ আর মুনাই মাথায় একই সমান। তার ওপর নাম জিজ্ঞেস করায় পরাগের নামই বলেছে মুনাই। সব মিলিয়ে বেধে গেছে ভজকট।

ভারিক্কি চেহারার বয়স্ক লোকটা অপহরণকারী দলের সরদার। সে খুব কষে মুনাইয়ের গাল টিপে দিয়ে বলল, ‘এখন এই পোলারে দিয়া কী হইব?’

মুনাইকে তুলে আনা এক যুবক বলল, ‘ওরে চোখ বাইন্ধা দূরে নিয়া ছাইড়া দিয়া আসি। ঝামেলা খালাস!’

হাত তুলে বাধা দিল বজলু। বলল, ‘না, এইডা হইব না। এই পোলা খুব সেয়ানা। গিয়া সব কইয়া দিব। পুলিশ আইসা ধরব আমাগো। ওরে মারন ছাড়া গতি নাই।’

এ কথায় ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল মুনাই। ছুটে গিয়ে পায়ে পড়ল বজলুর। কাতর হয়ে বলল, ‘আমারে মাইরো না, চাচা। সারা জীবন তোমার গোলাম হইয়া থাকুম। কাউরে কমু না এ কথা।’

বজলু ওর টুঁটি চেপে ধরে বলল, ‘চুপ, একদম চুপ!’

চুপ হয়ে গেল মুনাই। জানে, কান্নাকাটি করে লাভ নেই। মুখে কাপড় গুঁজে ওকে একটা মোটা থামের সঙ্গে পিঠমোড়া করে বেঁধে রাখা হলো।

সরদারকে এক সাঙাত বলল, ‘ওস্তাদ, ওর ভুঁড়ি কি নামাইয়া দিমু?’

সরদার বলল, ‘আরে—না, না! চিকা মাইরা হাত গন্ধ করার দরকার নাই। ওরে বস্তায় ভইরা পানিতে ফালাইয়া দিলেই হইব।’

সন্ধ্যার দিকে বস্তিতে ফিরল মুনাইয়ের মা। কিন্তু দরজায় তালা ঝুলছে। এই তালার এক চাবি তার কাছে, আরেকটা মুনাইয়ের কাছে। এ সময় তো ঘরেই থাকে ছেলেটা। মায়ের মুখ দেখতে ব্যাকুল হয়ে ওঠে। কিন্তু আজ গেছে কোথায়?

মায়ের মন দুরুদুরু করে। ঘরে না ঢুকে মুনাইকে খুঁজতে বেরোয় সে। একে-ওকে জিজ্ঞেস করে মুনাইয়ের কথা। কেউ কোনো খোঁজ দিতে পারে না। মোড়ের পরিচিত দোকানিদের কাছে জানতে চায়—তার বুকের ধনকে তারা দেখেছে কি না। না, কেউ দেখেনি। কেউ জানে না, কোথায় গেছে মুনাই। তবে কি সে গ্রামে চলে গেল?

মুনাই প্রায়ই বলত এখানে ওর ভালো লাগে না। গ্রামে ফিরে যাবে। কিন্তু তা তো হওয়ার কথা নয়। মাকে ছাড়া একটা দিনও কোথাও থাকতে পারবে না ও।

অজানা একটা ভয় ঝাপটা মারে মায়ের মনের কোণে। এই রাজধানীতে চলতে-ফিরতে রোজ কত অঘটন ঘটে। সে রকম কিছু ঘটেনি তো? গাড়িচাপায়...না, এটা হতে পারে না।

ঘরে ফিরে হাত তুলে মোনাজাতে বসে যায় মুনাইয়ের মা। কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে, ‘হে আল্লাহ, আমার মুনাইরে তুমি ফিরাইয়া দাও!’

রাত বাড়ে। মুনাই ফেরে না। পড়শিরা এসে খোঁজখবর নেয়। নানা কথা বলে ওর মাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে। দুয়েকজন মুনাইয়ের খোঁজে বের হয়। মুনাইয়ের মা না খেয়ে, না দেয়ে ওভাবেই পড়ে থাকে।

এদিকে মুনাইয়ের অবস্থা বড় কাহিল। সারা দিন পেটে কিছু পড়েনি। তার ওপর একঠায় দাঁড়িয়ে। নড়াচড়া বন্ধ। দুর্বল শরীর নিয়ে ঝিমোচ্ছে ও।

গভীর রাতে একটা বস্তায় ভরে মুনাইকে কাছের একটা পচা পুকুরে ফেলে দিল ওরা। মুনাই পানির নিচে এক-দেড় মিনিট থাকতে পারে। কিন্তু দুর্গন্ধে ওর দম বন্ধ হয়ে আসছে। বস্তাটা শিগগিরই অগভীর পানির তলায় গিয়ে ঠেকল। মায়ের মায়াভরা মুখটা এখন দেখতে পাচ্ছে মুনাই। আহ্, অভাগী মা জানেও না কী নির্মম আর করুণভাবে মারা যাচ্ছে তার ছেলে!

আচমকা মাথার ভেতর একটা বাতি জ্বলে উঠল। হ্যাঁ, বাঁচার উপায় আছে তো। ডান পকেটে আছে সেই চাকুটা। ভাগ্যিস, বস্তায় ভরার সময় ওরা হাত-পা বাঁধেনি! কেবল মুখটা বেঁধেছে।

পকেট থেকে চাকুটা বের করে ভাঁজ খুলে নেয়। একেবারে নতুন চাকু। ফলাটা বেশ ধারালো। বস্তাটা চিরে ফেলতে মাত্র কয়েক সেকেন্ড লাগে। তারপর ভুশ করে ভেসে ওঠে মুনাই। অনেক কষ্টে সাঁতরে উল্টো দিকের তীরে এসে পৌঁছে।

ক্লান্ত পা দুটো টেনে টেনে রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। কাছেই দুজন টহল পুলিশ। তাদের দিকে এগিয়ে যায় ও।

অনেক রাতে মুনাইয়ের মায়ের সস্তা মোবাইল ফোনটা বেজে ওঠে। কলটা ধরতেই ওপাশ থেকে ভরাট কণ্ঠ বলে, ‘আপনি মুনাইয়ের মা?’

ঘপাত্ করে একটা ঢোঁক গিলে জুলেখা বলে, ‘জে হ।’

‘আপনি একটু থানায় আসতে পারবেন?’

‘কিসের লাইগা?’

‘আপনার ছেলে মুনাই আছে এখানে।’

আর কোনো কথা না বলে পড়শি দুজনকে নিয়ে থানার দিকে রওনা হয় জুলেখা। সেখানে গিয়ে দেখে, এলাহি কাণ্ড! তার একরত্তি ছেলে গোটা অপহরণকারী দলকে ধরিয়ে দিয়েছে। সেখানে বজলু বদমাশটাও আছে। শুধু তা-ই নয়, মুনাইয়ের কল্যাণে ফাঁস হয়েছে অপহরণকারীদের এক গভীর ষড়যন্ত্র।

পরদিন মুনাইয়ের ছবিসহ খবরটা ছাপা হলো সব পত্রিকায়। পরাগের মা-বাবা তো পারলে মুনাইকে মাথায় নিয়ে নাচেন। ভাগ্যিস, মুনাই এসেছিল! নইলে তো কোনো এক ফাঁকে তাঁদের ছেলেকে অপহরণ করত ওরা।

পরাগের বাবা মুনাইকে আদর করে বললেন, ‘বলো, বাবা, কী চাও? কী পেলে তুমি খুশি?’

মুনাই বলল, ‘আমারে খালি একটা স্কুলে ভর্তি কইরা দ্যান। এই রকম হুদা থাকতে আর ভালো লাগে না!’

অলংকরণ: শিখা