লীনা

হেড স্যারের ঘরে ঢুকলেন লাইব্রেরিয়ান বশীর আহমেদ, ‘স্যার, আজও!’

হেড স্যার বললেন, ‘কটা বই?’

লাইব্রেরিয়ান মাথা চুলকে বললেন, ‘তিনটা। নুলিয়াছড়ির সোনার পাহাড়, আমার বন্ধু রাশেদ আর আঙ্কল টমস কেবিন।’

‘ইশ্! নুলিয়াছড়িটা আমি আজ নেব বলে ঠিক করেছিলাম! আবার পড়তে ইচ্ছে করছিল। এইগুলো ছাত্র তো নয়, একেবারে ডাকাত!’

‘ডাকাত না স্যার, চোর! বই চুরি করেছে...।’

‘চোউপ!’ চিত্কার করে উঠলেন হেড স্যার। রেগে গেলে তিনি ‘চুপ’ বলেন না, বলেন ‘চোউপ!’ ‘আমার ছাত্রদের চোর বলবে না। আর শোনো, বই চুরি করা মানে চুরি না। এটা একটা শিল্প। কেউ বই চুরি করেছে মানে সে জ্ঞানের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। বুঝেছ?’

‘খুব বুঝেছি, স্যার!’

‘শোনো, আমিও ছোটবেলায় নিজের মনে করে লাইব্রেরি থেকে কত বই সরিয়েছি!’

উত্তরে কী বলা যায়, তা ভেবে বের করতে না পেরে খুক খুক করে কাশলেন বশীর আহমেদ। হেড স্যারও বুঝতে পারলেন, অতীত টেনে আনা উচিত হয়নি। তাই তিনিও খুক খুক করে কাশলেন।

রুবিনা ম্যাডাম তাঁর চশমাটা নাকের ওপর এক আঙুল দিয়ে ঠেলে ঢুকলেন ঘরে। কম বয়সী শিক্ষক তিনি। এখনো ছাত্রী বলে মনে হয়। পোশাকও পরেন ম্যাচ করে। তিনি যখন বাংলা ক্লাস নেন, তখন একজন ছাত্রও ক্লাস ফাঁকি দেয় না। সবাই হাঁ করে বসে বসে বাংলা ক্লাস করে। তবে মেয়েদের কেউ কেউ এ সময় উধাও হয়ে যায়।

হেড স্যার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন রুবিনা ম্যাডামের দিকে।

রুবিনা ম্যাডাম বললেন, ‘স্যার, আজও!’

‘কজন?’

‘আমার ক্লাসে একটা মেয়েও ছিল না!’

‘গেল কোথায়?’

‘মার্কেটে!’

‘সব কটি?’

‘সব কটি মানে! নিজেরা তো গেছেই, ক্লাস নাইন আর এইট থেকেও মেয়েদের ধরে নিয়ে গেছে!’ তারপর বিড়বিড় করে বললেন, ‘কী আর বলব, স্যার! মেয়েগুলো যাচ্ছেতাই। শুধু উইন্ডো শপিং করে। কিচ্ছু কেনে না!’

হেড স্যার বললেন, ‘আহারে বেচারারা! মার্কেট থেকে কিছু কেনার মতো টাকা কি ওদের আছে! আমার সামর্থ্য থাকলে ওদের সবার হাতে টাকা দিয়ে দিতাম। যা খুশি তা-ই কিনতে পারত ওরা!’ এটুকু বলে তিনি বুঝতে পারলেন, এখানে এ কথা বলা ঠিক হয়নি। তাই আবার একটু খুক খুক করে ম্যাডামের মনোযোগ অন্যদিকে ঘোরাতে চাইলেন।

এ সময় পর্দার পাশ থেকে উঁকি দিলেন ড্রিল স্যার। ছাত্রছাত্রীরা কী এক অজানা কারণে তাঁকে ‘মাক্কু’ বা ‘গ্রেট মাক্কু’ বলে ডাকে।

‘আপনার আবার কী হলো?’

‘স্যার, আজও!’

‘কজন?’

‘চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছে ক্লাস টেনের সাতজন। সিনেমা হলে গেছে আটজন।’

‘গুনল কে?’

‘আমি গুনলাম চায়ের দোকানেরটা। হাফিজ স্যার লুকিয়ে ছিলেন সিনেমা হলে। তিনিই জানালেন, প্রেম পরিণতি দেখতে গেছে আটজন। এর মধ্যে আজ দুইটা মেয়েও ছিল!’

‘কী যা-তা বলছ! মেয়েরা যাবে না কেন? শুধু ছেলেরাই সিনেমা দেখবে?’ এটুকু বলে তিনি বুঝতে পারলেন, এখানে এসব কথা না বলাই ভালো। ‘হুম। স্কুলের আইন আরও কড়া করা দরকার।’ কড়া গলায় বললেন হেড স্যার।

২.

আমাদের এ শহরে এই স্কুলটি খুবই নামকরা। কো-এডুকেশন। স্কুলের খুব কাছে চায়ের দোকান। রূপসী সিনেমা হলটাও খুব দূরে নয়। স্কুলের পাশে হয়েছে একটা দারুণ এসি মার্কেট। হেন কিছু নেই যা এখানে পাওয়া যায় না। ফলে স্কুল ফাঁকি দিয়ে আড্ডা দেওয়া আর সিনেমা দেখা চলছেই। ইচ্ছে হলেই যে কেউ চলে যাচ্ছে মার্কেটে এসির বাতাস খেতে। আরেকটা সমস্যা হলো, লাইব্রেরি থেকে নিয়মিত বই চুরি হচ্ছে। ভালো বইগুলো একেবারেই রাখা যাচ্ছে না। কে যে কখন লুকিয়ে বই নিয়ে যাচ্ছে, বশীর আহমেদ তা ধরতেই পারছেন না।

ক্লাস টেনের ফার্স্ট বয় আরিফ আর সেকেন্ড গার্ল রেহানা কোনোভাবেই ছেলেমেয়েদের ক্লাসে ধরে রাখতে পারছে না। নাম লিখে রেখে স্যারের মার খাওয়াবে বললেও কেউ গা করছে না। যে যার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই সমস্যা থেকে বের হওয়া যাচ্ছেই না।

আরিফ অবশ্য কয়েক দিন চেষ্টা করেছে পালিয়ে যাওয়া ছেলেমেয়েদের নাম লিখে রাখতে। কিন্তু পরদিন ওর টিফিন বক্সে বড় বড় দুটি আরশোলা আর একটি জীবন্ত টিকটিকির সন্ধান পাওয়ায় নাম লেখার দুঃসাহস আর দেখায়নি।

৩.

এ রকম এক মহা বিপদের সময় ক্লাস টেনে ভর্তি হলো এক মেয়ে। হেড স্যার ক্লাসে এসে বললেন, ‘বছরের মাঝামাঝি এই মেয়েটা এসে আমাদের স্কুলে ভর্তি হয়েছে। স্বয়ং ডিসি সাহেব অনুরোধ করেছেন ওকে এখানে নেওয়ার ব্যাপারে। খুব ট্যালেন্টেড মেয়ে। নাম লীনা। আমি ওকে বীজগণিতের তিনটা অঙ্ক দিয়েছিলাম, কয়েক মিনিটের মধ্যে নির্ভুল উত্তর দিয়েছে!’

রেহানার তাতে আঁতে ঘা লাগল। ও বলল, ‘স্যার, এটা কোনো ব্যাপার না। আমাকে দিলেও আমি অঙ্কগুলো করে দিতে পারতাম!’

‘উঁহু, পারতে না।’ ঘোষণা করার মতো করে বললেন হেড স্যার। ‘অঙ্কগুলো আমি নিজে বানিয়েছি। তোমাদের অঙ্ক স্যারকেও দিয়েছিলাম সমাধান করতে। একটারও সমাধান করতে পারেননি তিনি। আর এই মেয়েটা কিনা ফটাফট অঙ্কগুলো কষে দিল!’

এবার আর কথা বাড়াল না রেহানা। সত্যিই যদি অঙ্ক স্যার সমাধান করতে না পারেন, তাহলে তো বিপদই। ৫০ জন ছেলেমেয়ের সামনে যদি অঙ্ক কষতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তো লজ্জায় মুখই দেখানো যাবে না! আরিফও সে ঝুঁকি নিতে চাইল না।

মেয়েটার দিকে যখন সবার চোখ গেল, তখন একটা ব্যাপারে প্রত্যেকেই খুব অবাক হলো। মেয়েটার চোখের মণি কালো নয়। নীল। মনে হয়, এই চোখের দিকে তাকালে গভীর সমুদ্রকে স্পর্শ করা যাবে। মেয়েটার হাসিও নজর কাড়ল সবার। মেয়েটা যখন সেকেন্ড বেঞ্চে বসল, তখন ওর পাশে বসা জয় খুবই গর্বভরে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল, যেন যুদ্ধ শেষে বিজয়ী হয়ে সে ফিরে এসেছে।

আরও অবাক করা ব্যাপার হলো, সেদিনই স্কুলের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো স্কুলপালানো একটি ছেলেমেয়েকেও পাওয়া গেল না।

পরদিনও সবাই স্কুলেই থাকল। বাইরে গেল না। যে শিক্ষকেরা প্রায় ফাঁকা ক্লাসে ক্লাস নিয়ে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন, তাদের অস্বস্তি বাড়ল। ঘরভর্তি শিক্ষার্থীদের নিয়ে ক্লাস করার অভিজ্ঞতা তো ছিল না, তাই নিজেরাই কথা বলতে বলতে খেই হারিয়ে ফেলতে লাগলেন।

ক্লাস টেন, এ সেকশনে এসে স্যাররা অবশ্য একটা ব্যাপারে খুব আনন্দ পেতে থাকলেন। কোনো প্রশ্নের উত্তর যদি কেউ না দেয়, তখন লীনাকে প্রশ্ন করা হয়। ভূগর্ভস্থ জীবন থেকে শুরু করে মহাকাশ পর্যন্ত এমন কোনো বিষয় নেই, যা লীনার জানার বাইরে। সবাই অবাক হয় ওর পড়াশোনার ব্যাপ্তি দেখে।

ছেলেমেয়েরা সুবোধ হয়ে যাচ্ছে দেখে মওকা পেয়ে হেড স্যার খুব কড়া ঘোষণা দিয়ে বসলেন। সকালের অ্যাসেমব্লিতে ঘোষণা করলেন, এখন থেকে স্কুলে ক্লাস চলাকালীন কেউ বাইরে বের হতে পারবে না। চায়ের দোকানে, সিনেমা হলে কিংবা মার্কেটে কাউকে দেখা গেলে কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে। প্রয়োজনে টিসি দিয়ে দেওয়া হবে। আর লাইব্রেরি থেকে বই চুরি হলে এবং চোর ধরা পড়লে তার অভিভাবকদের কাছ থেকে দুটো বইয়ের দাম নেওয়া হবে।

৪.

ঘোষণা দিয়ে দারুণ স্বস্তি পেলেন হেড স্যার। তেল-চকচকে গোঁফে তা দিয়ে ল্যাপটপ খুলে বসলেন। কানে হেডফোন লাগিয়ে লুকিয়ে বিটলসের গান শুনবেন এখন। ঠিক এ সময় লাইব্রেরিয়ান বশীর আহমেদের আগমন। ‘স্যার, আজও!’

‘কী!’ বলে লাফিয়ে উঠলেন হেড স্যার!

‘স্যার, অন্যরা আপনার কাছে আসতে সাহস পাচ্ছে না। তাই সব হিসাব আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে!’

‘বলো।’ গম্ভীর মুখে ল্যাপটপ বন্ধ করতে করতে বললেন হেড স্যার।

‘আজ সিনেমা হলে ১৮ জন, চায়ের দোকানে ১২ জন, মার্কেটে পুরো ক্লাস সেভেন, এইটের ১৪ জন। নাইন আর টেনের হিসাব নিতে পারিনি। লাইব্রেরি থেকে এই থার্ড পিরিয়ডের মধ্যেই দুটো বই নেই।’

‘কোন দুটো?’

‘দুষ্ট ছেলের দশচক্রে আর তিমির পেটে কয়েক ঘণ্টা।’

বেশ একটা আনন্দের হাসি খেলে গেল হেড স্যারের মুখে। ‘ছেলেমেয়েগুলোর তারিফ করতে হয়! বইয়ের ব্যাপারে রুচি আছে বলতে হবে!’ বুঝলেন, ঠিক জায়গায় ঠিক কথাটি বলেননি, তাই বললেন, ‘এ তো দুশ্চিন্তার কথা! শাস্তি কঠিন করলাম, তারপরও কেউ আমাকে পাত্তা দিচ্ছে না! আমি তো এই স্কুলের হেডমাস্টার, নাকি?’

বশীর আহমেদ মাথা ঝাঁকিয়ে স্বীকার করে নেন, ঠিক, তিনিই এ স্কুলের হেড স্যার।

‘চলো। স্কুলটায় একটু রাউন্ড দিয়ে আসি। আমি কিন্তু ভীষণ খেপে গেছি! আমার বেতটা কোথায়?’

বশীর আহমেদ বললেন, ‘স্যার, আপনি তো বেত ফেলে দিয়েছেন সেই কবে! আপনি নাকি কোনো দিন আর বেতের বাড়ি দেবেন না?’

‘ও তাই তো! ও কথা ভুলে গিয়েছিলাম!’

শুরুতেই ক্লাস টেন। একেবারে ফাঁকা নাকি? না। একেবারে নয়। একটা মেয়ে শুধু বসে আছে। লীনা। নতুন মেয়েটা।

স্যারকে দেখে উঠে দাঁড়াল লীনা। হেড স্যার বললেন, ‘তুমি একা বসে আছ কেন? কোথাও যেতে পারলে না?’

লীনা হাসল। কোনো উত্তর দিল না।

হেড স্যার বললেন, ‘আমি আরও কড়া আইন করব। একটা ছেলেমেয়েও যেন ক্লাস থেকে কোত্থাও যেতে না পারে, তার ব্যবস্থা করব।’

এবার লীনা মুখ খুলল, ‘সেটা খুব সম্ভব, স্যার। তবে আইনগুলো হতে হবে অন্য রকম।’

অবাক হয়ে লীনার দিকে তাকালেন হেড স্যার। ‘অন্য রকম মানে?’

‘আমি আপনাকে বলে দেব। দেখবেন, কয়েক দিনের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে।’

‘কী রকম আইন?’

‘বলছি।’

৫.

পরদিন অ্যাসেমব্লিতে হেড স্যার ঘোষণা করলেন, ‘আজ থেকে আমাদের এই স্কুলে নতুন আইন চালু হচ্ছে। সবাই মনোযোগ দিয়ে শোনো। এখন থেকে সেকেন্ড পিরিয়ডের পর কাউকে ক্লাস করার জন্য বাধ্য করা যাবে না। যে কেউ চাইলে চায়ের দোকানে, মার্কেটে বা সিনেমা হলে চলে যেতে পারবে।’

সবাই করতালি দিয়ে উঠল। সবার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। খুশির বন্যায় ভেসে যেতে যেতে কেউ কেউ কুকুর আর বিড়ালের ডাক দিতে লাগল। সে এক কিম্ভূতকিমাকার অবস্থা।

‘ঘোষণা শেষ হয়নি। এখন থেকে কেউ লাইব্রেরিতে বই পড়তে গেলে লুকিয়ে বই সরাতে পারবে। এটা আইন। কেউ যদি বই না সরাও, তাহলে তার ওপর নেমে আসবে চরম শাস্তি। আমাদের শিক্ষকদের বলে দেওয়া হবে, এসব কাজে যেন সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন তাঁরা।’

কানে তালা লেগে যাওয়ার মতো অবস্থা হলো মাঠে। এত করতালি এই স্কুলের ইতিহাসে কখনো কেউ দেয়নি।

৬.

পরের কয়েকটা দিন কী যে ঘটল এই স্কুলে, তার বর্ণনা দেওয়ার সাধ্য আমার নেই। নাম ডাকা হয়ে যাওয়ার পরপরই ছাত্রছাত্রীরা বেরিয়ে পড়তে লাগল। চায়ের দোকানে আড্ডা দেওয়ার সময় স্যারেরা গিয়ে ওদের উত্সাহ দিতে থাকলেন। ‘আড্ডা দাও, আড্ডা দাও, এ বয়সে আড্ডা না দিলে আর কবে দেবে?’

কোনো ছাত্র বা ছাত্রীর যদি আড্ডায় একঘেয়েমি চলে আসত, তখন তারা ফিরতে চাইত স্কুলে। শিক্ষকেরা অনুরোধ-উপরোধ করে বলতেন, ‘মোটেই স্কুলে ফিরে যেয়ো না! এখানেই থাকো। এখানে ভালো না লাগলে সিনেমা হলে চলে যাও! কিংবা মার্কেটে!’

বিরক্ত হয়ে ওরা আবার বসে যেতে লাগল আড্ডায়!

লাইব্রেরিতে যা ঘটছিল, তা পৃথিবীর ইতিহাসে কোথাও কোনো স্কুলে ঘটেনি। বই চুরির উত্সব শুরু হলো যেন! কোনো শিক্ষার্থী যতক্ষণ পর্যন্ত বই চুরি না করছে, ততক্ষণ তক্কেতক্কে থাকতেন বশীর আহমেদ। বলতেন, ‘এই ছেলে, এই মেয়ে, কাণ্ড দ্যাখো! এখনো একটা বই সরাতে পারলে না? আমাকে দেখে লজ্জা পাচ্ছ? ঠিক আছে, আমি অন্যদিকে তাকাচ্ছি, এর মধ্যে চুরি করে নাও। ভাববে, আমি কিছুই জানি না। বেশি বেশি বই হাওয়া হয়ে না গেলে হেড স্যার কিন্তু আমার চাকরি নিয়ে টানাটানি করবেন!’

এই অবস্থা কিন্তু বেশি দিন টিকল না। খুব তাড়াতাড়ি ছাত্রছাত্রীরা আক্রান্ত হলো একঘেয়েমিতে। কেউ আড্ডা দিতে মানা করে না, কেউ সিনেমা দেখতে বাধা দেয় না, কেউ মার্কেটে গেলে শাস্তি দেয় না। এটা একটা জীবন হলো!

আস্তে আস্তে স্কুলের কড়া আইন অমান্য করতে শুরু করল ওরা। বাইরে আড্ডা না মেরে ফিরে আসতে থাকল ক্লাসে। শিক্ষকেরা খুব চেষ্টা করলেন ঠেলেঠুলে বাইরে পাঠাতে, কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা ক্লাসের পড়াশোনায় মন দিল। স্যাররা বললেন, ‘আমি পড়াব না। এখন তোমাদের সিনেমা হলে থাকার কথা। এখন তোমাদের মার্কেটে থাকার কথা।’

শিক্ষার্থীরা বলল, ‘আমরা আইন মানব না। আমরা স্কুলেই থাকব!’

আর কী আশ্চর্য, আগে ক্লাস টেনের অঙ্ক ক্লাসে আরিফ আর রেহানাই শুধু ব্ল্যাকবোর্ডে গিয়ে অঙ্ক কষত। এখন ব্যাকবেঞ্চার ইউসুফও এসে অঙ্কের সমাধান করে যায়!

বশীর আহমেদের মনও খুব খারাপ। একটা বইও চুরি হয় না এখন। হেড স্যার তাঁকে ডেকে বকাবকি করেন, বলেন, ‘আপনাকে দিয়ে তো কাজ হবে না দেখছি! কী করেন! একটা ছেলেও পান না, একটা মেয়েও পান না, যে নিজের বই মনে করে লাইব্রেরির বই গাপ করে দেবে!’

স্কুলে শান্তি ফিরে এল। আইন থাকল আগের মতোই, কিন্তু সবাই মিলে আইন ভঙ্গ করলেও কেউ আর শাস্তি দিল না। ফলে সে বছর থেকে এসএসসিতে এই স্কুলের রেজাল্ট হতে থাকল দারুণ ভালো। ফলাফল দেওয়ার দিন টিভি ক্যামেরা আর পত্রিকার ফটোসাংবাদিকেরা ছুটে আসতে লাগল এই স্কুলের দিকে।

৭.

একদিন হঠাত্ করেই দেখা গেল নীলনয়না লীনা আর স্কুলে আসছে না।

সবাই অবাক হলো। কোথায় গেল মেয়েটা। হেড স্যার প্রশ্ন করলেন, ‘কেউ কি লীনার ঠিকানা জানো?’

‘না।’

‘আচ্ছা, ডিসি সাহেব তো আমাকে ফোন করে লীনাকে এই স্কুলে ভর্তি করতে বলেছিলেন। তাঁকেই জিজ্ঞেস করি।’

ফোন করা হলো জেলা প্রশাসককে। কুশল বিনিময়ের পর হেড স্যার বললেন, ‘আচ্ছা, আপনি আমার স্কুলে লীনা নামের একটা মেয়েকে পাঠিয়েছিলেন। কয়েক দিন হলো ও তো স্কুলে            আসছে না। আমাদের কেউ ওর বাড়ি চেনে না। আপনি কি একটু বলবেন, কীভাবে ওর সঙ্গে যোগাযোগ করব?’

ভীষণ অবাক হয়ে জেলা প্রশাসক বললেন, ‘আমি আপনার কাছে লীনা নামের একটি মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করে নিতে বলেছি! কী বলছেন! আজ তো পয়লা এপ্রিল না!’

অবাক হয়ে ফোন ছেড়ে দিলেন হেড স্যার। সবাইকে বললেন কথাটা।

লীনা আর ফিরে আসেনি। কোত্থেকে ও এসেছিল, সেটাও কেউ জানল না কোনো দিন। শুধু মাঝেমধ্যে কারও কারও মনে ওর নীল চোখ দুটো ভেসে উঠত।

অলংকরণ: মাহফুজ রহমান