লজ্জা

.
.

তখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি। প্রতি মাসের শেষ বৃহস্পতিবার আমাদের স্কুলে গানের আসর বসত। সে আসরে প্রতিটি শ্রেণি থেকে দুজন করে ছাত্রছাত্রীকে গান গাইতে হতো। যারা গান গাইতে পারত না, তাদেরও নিস্তার মিলত না। তাদের বলা হতো, ‘আমি গান জানি না’—কথাটি সুর করে বলো।
তত দিনে আমার এক বছর পার হয়ে গেল। কোনো গান গাইতে হয়নি। হবে কীভাবে, যেদিন গানের আসর বসত, সেদিন তো স্কুলেই যেতাম না! সপ্তম শ্রেণিতে উঠে আর রক্ষা হলো না। বন্ধুরা একদিন পাকড়াও করল, যে করেই হোক, গান গাওয়াবেই।
সেদিন অনুষ্ঠান পরিচালনার ভার ছিল আমাদের ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের শিক্ষক গোলাম রব্বানী স্যারের। ক্লাস ধরে ধরে গান গাওয়ানো হচ্ছিল। ষষ্ঠ শ্রেণির দুই শিক্ষার্থীর গান গাওয়া শেষ হলো। এবার আমার পালা। রব্বানী স্যার মাইকে ঘোষণা করলেন, ‘এবার আপনাদের সম্মুখে গান পরিবেশন করবেন সপ্তম শ্রেণির কৃতী ছাত্র রাকিবুল প্রিয়।’
গেলাম গান গাইতে। গান আমি আগেও গেয়েছি। তবে সেটা ছিল বাথরুম থেকে বড়জোর ক্লাসরুমে। কিন্তু মঞ্চে!
দুরুদুরু বুকে, ভীরু পায়ে এগিয়ে গেলাম। মঞ্চে উঠে সামনে তাকাতেই কাঁপুনি যেন আরও বেড়ে গেল! ঠোঁটস্থ করা গান মুহূর্তেই গেলাম ভুলে। চোখ বুজে অনেক চেষ্টার পর মনে পড়ল। শুরু করলাম—
‘ও আমার বন্ধু গো/ চির সািথ পথ চলা...’
যেই না ‘মঞ্জিল ভালোবাসার’—লাইনটায় এলাম, অমনি গলা গেল বসে। চোখ খুলে সামনে তাকিয়ে দেখি, দর্শকসারির সবাই হাসিতে গড়াগড়ি করছে। আমি কালবিলম্ব না করে দিলাম দৌড়! এক দৌড়ে আমাদের ক্লাসে। ভেতরে ঢুকেই দিলাম দরজা বন্ধ করে।
সময় গড়িয়ে এদিকে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। অনুষ্ঠানও প্রায় শেষ। দর্শনার্থীও হয়তো সবাই চলে যেতে শুরু করেছে। তবু আমি ক্লাসরুম থেকে বের হচ্ছি না। যখন পুরোপুরি সন্ধ্যা হয়ে এল, মাইকের শব্দ আর কানে আসছে না, তখন দরজা খুলে দেখি ঘোর অন্ধকার। কেউ নেই। আর এই সুযোগে কক্ষ থেকে বের হয়ে বাড়ি চলে আসি।
এরপর লজ্জায় প্রায় এক সপ্তাহ স্কুলেই যাইনি।