‘আমাকে কেউ বুঝতে পারে না, আমাকে কেউ ভালোবাসে না!’

তোমারও কি এই রকম মনে হয় যে তোমাকে কেউ বুঝতে পারে না?

তোমারও কি এই রকম মনে হয় যে তোমাকে কেউ বুঝতে পারে না? ছোটবেলায় আমারও নানা কিছু মনে হতো। ঠিক আমাকে কেউ বুঝতে পারে না বা আমাকে কেউ ভালোবাসে না টাইপ নয়, তবে একধরনের ‘আমার কথা কেউ ভাবে না’ ধরনের কথা আমারও খুব মনে পড়ত।

কী রকম? সেটা আগে বলি। আমরা ছিলাম পাঁচ ভাইবোন। আমাদের সময়ে প্রতি ঈদে নতুন জামা জুটত না সবার। হয়তো এই ঈদে শার্ট পেলাম, তো পরের ঈদে স্যান্ডেল। আমার হয়তো স্যান্ডেল ছিঁড়ে গেছে। আমি ঈদের আগে চাইতাম না। ঈদের দিন কাঁদতে বসতাম। আমার স্যান্ডেল লাগবে, কেউ কেন দেখল না। বাসার সবাই বলতেন, এটা ঈদের দিন কেন বলছ, ঈদের আগে বললেই তো হতো। ঈদের আগে বলিনি, অভিমানবশত, কেন বলব? ঈদের দিন কাঁদছি, সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে।

আমি তো আর মনোবিজ্ঞানী নই, সবার মনে কী আছে, সেটা তো বলতে পারব না। তবে আমার নিজের মনে যেহেতু এই রকমটা হতো, তাতে আমার ধারণা, অন্য সবার মনেই এই রকমটা হয়। সবাই একটুখানি মনোযোগ চায়, আদর চায়। শিশু যে কাঁদে, তাও তো তার প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যই।

আর কিশোর বয়সেই মনে হয়, আমাকে কেউ গুরুত্ব দিচ্ছে না।

কিন্তু এটা সত্য নয়। সবাই তোমাকে ঠিকই গুরুত্ব দেয়। ছোটবেলায় গল্প পড়েছিলাম—এক ছেলের মনে হয়, তাকে কেউ ভালোবাসে না। একদিন সে লুকোচুরি খেলতে গিয়ে ঘরের এক কোণে আলনার কাপড়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকে। তারপর ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম ভাঙে অনেক পরে। তত দিনে বাসায় খোঁজ খোঁজ রব পড়ে গেছে। ছেলে কই? মা কাঁদেন, বাবা হন্যে হয়ে যান, ভাইবোনেরা সবাই তাকে খুঁজতে থাকে। তখন ছেলেটি বুঝতে পারে, সবাই তাকে কত ভালোবাসে।

আসলেই তোমাকে সবাই খুব ভালোবাসে। বাংলাদেশের আচার-আচরণের একটা সীমাবদ্ধতা আছে, আমরা কেউ ভালোবাসার কথা মুখে বলি না। বাবাকে বলি না, বাবা, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি; মাকে বলি না, মা, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি, ভাইবোনেরাও কেউ কাউকে বলে না, তোমাকে আমি ভালোবাসি। মায়েরাও ছেলেমেয়েদের মুখ ফুটে ভালোবাসা জানান না। কিন্তু মনে মনে তাঁরা সবাই ভীষণ ভালোবাসেন সন্তানকে, ভাইবোনকে। আমরাও আমাদের মা-বাবাকে ভালোবাসি। বলা হয় না, এই আরকি!

আমাকে কি কেউ ভালোবাসে? আমাকে কি কেউ বুঝতে পারে?
আমাকে কি কেউ ভালোবাসে? আমাকে কি কেউ বুঝতে পারে?

তাহলে আমরা কী করব? আমাকে কি কেউ ভালোবাসে? আমাকে কি কেউ বুঝতে পারে? আমি একটা ছোট্ট কিন্তু দারুণ বুদ্ধি দিতে পারি তোমাদের। দেওয়ার বেলায় এগিয়ে থাকবে। এই খেলার নিয়ম হলো, তুমি যদি বেশি দাও তাহলে তুমি জয়লাভ করবে। তোমাকে কেউ ভালোবাসে কি না, সেটা বড় কথা নয়; তুমি তোমার মা-বাবা, ভাইবোন, বন্ধু, শিক্ষককে বেশি ভালোবাসছ কি না। যদি বাসো, তাহলে তোমার জয়।

আরেকটা সমস্যা আমার হয়। এক. মনে হয় সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। দুই. মনে হয় কেউ আমার দিকে তাকাচ্ছে না। কোথায় যাব, কী পরব, কী বলব—এই নিয়ে দুশ্চিন্তা হয়। কিন্তু সেখানে গেলে পরে ভুলে যাই, কী পরেছি। আসলে এটা কোনো ব্যাপারই না। আবার কোথাও গেলাম, কেউ হয়তো আমার সঙ্গে কথাই বলছে না। এই সমস্যার সমাধান হলো, আমি যেমন ভাবছি, কেউ আমাকে পাত্তা দিচ্ছে না, অন্যরাও তাই ভাবছে। কাজেই আমার উচিত হবে, নিজেই এগিয়ে যাওয়া। নেতৃত্ব গ্রহণ করা। নিজেই সবার সঙ্গে কথা বলা। যাতে আমি কার সঙ্গে কথা বলছি, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

নিজেকে গুটিয়ে না রেখে বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলো নিজে থেকেই, মেতে ওঠো হৈ-হুল্লোড়ে
নিজেকে গুটিয়ে না রেখে বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলো নিজে থেকেই, মেতে ওঠো হৈ-হুল্লোড়ে

আরও ভালো, এসব নিয়ে না ভাবা। নিজের মতো করে নিজের কাজ করে যাওয়া। তবে নিশ্চয়ই সামাজিকতা বজায় রাখতে হবে। সবার সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলতে হবে। একটা গেমবয় বা মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকলে চলবে না। আর নিজেকে নিয়ে সারাক্ষণ দুর্ভাবনা না করে কোনো একটা ভালো কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকো। খেলাধুলা করো, গান করো, বিতর্ক করো, সামাজিক সেবামূলক কাজ করো, ছবি আঁঁকো, চলচ্চিত্র দেখো, বই পড়ো, ক্রিকেট খেলা নিয়ে মেতে ওঠো, ফুটবল ক্লাব সমর্থন করো, খেলা দেখো। তাহলে দেখবে, তোমার মতের সঙ্গে মেলে, এমন অনেকের দেখা পাবে, কথা বলার অভিন্ন বিষয় খুঁজে পাবে।

সমাজসেবামূলক কাজের মাঝেও আছে অনাবিল আনন্দ
সমাজসেবামূলক কাজের মাঝেও আছে অনাবিল আনন্দ

আমার আরেকটা প্রিয় অবলম্বন আছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বোঝাপড়া’ কবিতাটা—

মনেরে আজ কহ যে,

ভালো মন্দ যাহাই আসুক

সত্যেরে লও সহজে।

                কেউ বা তোমায় ভালোবাসে

                                কেউ বা বাসতে পারে না যে,

                কেউ বিকিয়ে আছে, কেউ বা

                                সিকি পয়সা ধারে না যে,

                কতকটা যে স্বভাব তাদের

                                কতকটা বা তোমারো ভাই,

                কতকটা এ ভবের গতিক—

                                সবার তরে নহে সবাই।

                তোমায় কতক ফাঁকি দেবে

                                তুমিও কতক দেবে ফাঁকি ,

                তোমার ভোগে কতক পড়বে

                                পরের ভোগে থাকবে বাকি,

                মান্ধাতারই আমল থেকে

                                চলে আসছে এমনি রকম—

                তোমারি কি এমন ভাগ্য

                বাঁচিয়ে যাবে সকল জখম!

                                মনেরে আজ কহ যে,

                ভালো মন্দ যাহাই আসুক

                                সত্যেরে লও সহজে ।

এটা মনে রাখলে জীবনের যেকোনো পর্যায়ের যেকোনো অবস্থা হাসিমুখে নেওয়া যায়। আমি তা-ই করি।

মডেল: বিভা, তনিকা, পিউ, সৌরভ, আবৃত্তি ও হুমাম

ছবি: কবির হোসেন ও সুমন ইউসুফ