তুমি বড় নাকি ছোট?

‘তেরো-চৌদ্দ বছরের ছেলের মতো পৃথিবীতে এমন বালাই আর নাই। শোভাও নাই, কোনো কাজেও লাগে না। স্নেহও উদ্রেক করে না, তাহার সঙ্গসুখও বিশেষ প্রার্থনীয় নহে। তাহার মুখে আধো-আধো কথাও ন্যাকামি, পাকা কথাও জ্যাঠামি এবং কথামাত্রই প্রগলভতা।’ ‘ছুটি’ গল্পে এভাবেই কৈশোর আর বয়ঃসন্ধিকে বর্ণনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ। আসলেই কি কৈশোর এতটা সংকটপূর্ণ? কেন এ বয়সটাকে বলা হয় ‘ক্রাইসিস’-এর বয়স? এ সময়টায় একটি শিশুর কিছু শারীরিক পরিবর্তন ঘটে। পরিবর্তন ঘটে তার মনে। মা-বাবাসহ আশপাশে যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা সহজে তাঁর মনটাকে পড়তে পারেন না—তখন খানিকটা সংকট তৈরি হয় বটে, তবে তা কৈশোরের সংকট নয়, তারুণ্যের সংকট নয়, বরং তাঁদের মনকে বুঝতে না পারার কারণে অভিভাবকদেরই সংকট। কৈশোর বা বয়ঃসন্ধিতে কোমলমতি কিশোরটির আচরণ তাই বদলে যেতে থাকে। বড়দের আসরে সমাদৃত হয় না, আবার ছোটদের আসরেও অনাকাঙ্ক্ষিত—সে পড়ে যায় অস্তিত্বের সংকটে। কখনো চুপচাপ হয়ে যায়, কখনো মা-বাবার অবাধ্য হয়ে ওঠে। পারিবারিক অনুষ্ঠানগুলো হয়তো তার ভালো লাগে না—তাকে কেন কেউ বুঝতে পারছে না এই যাতনায় সে কাতর হয়ে যায়—তখন সে নিজেকে ব্যস্ত রাখে ইন্টারনেটে, জড়িয়ে যেতে পারে মাদকে, অন্যের সঙ্গে তুলনা করে নিজেকে ছোট মনে করে—সেখান থেকে তার আচরণ কখনো হয়ে ওঠে উদ্ধত। ‘আমাকে কেউ বুঝল না, আমাকে কেউ ভালোবাসল না’—এই ভেবে ভেবে কখনো তার জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা চলে আসতে পারে। ‘থ্রিল’ খুঁজতে গিয়ে জড়িয়ে পড়ে অপরাধে। কেউবা সামাজিক রীতিনীতি ভাঙার মধ্যেই একটা আনন্দ খুঁজে পায়। নানা রকম আবেগের সম্পর্ক তৈরি হতে পারে এই বয়সে।

সমস্যা লুকিয়ে না রেখে আলোচনা করো আস্থাভাজন কারো সঙ্গে
সমস্যা লুকিয়ে না রেখে আলোচনা করো আস্থাভাজন কারো সঙ্গে

প্রকৃতপক্ষে ‘তেরো-চৌদ্দ’ বছর বয়স মোটেই বালাই নয়, বরং নিজেকে তৈরি করার বয়স, যোগ্য করে তোলার বয়স। এই বয়সের শোভা বুঝতে হলে অভিভাবকদের তৈরি হতে হবে। কিন্তু বেশির ভাগ অভিভাবকই সে জন্য তৈরি নন। তাঁরা সন্তানের স্কুলের রিপোর্ট কার্ডের মাহাত্ম্য বাড়াতে যতটা উদ্গ্রীব—সামাজিক দক্ষতা বাড়ানোর চেষ্টায় ততটাই নির্লিপ্ত। ফলে মা-বাবার কাঙ্ক্ষিত রোবোটিক কৈশোর সত্যিই ‘কোনো কাজে লাগে না’।

মা-বাবারা অনেক সময় নিজের যুক্তিতে কখনো তাদের ছোট বানিয়ে রাখেন—‘না, তোমার বয়স মাত্র তেরো, বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে যেতে পারবে না।’ আবার কখনো নিজের যুক্তিতে তাদের বড় বানিয়ে দেন—‘কী বলো, তোমার বয়স এখন তেরো। এত বড় হয়ে গেছ এই সামান্য কাজটি পারো না।’ কিশোর-কিশোরী তখন পড়ে যায় সত্যিকারের সংকটে—সে কি বড় না ছোট?

মানুষের নৈতিকতার বিকাশের পর্যায় ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মার্কিন বিজ্ঞানী লরেন্স কোহলবার্গ তিনটি স্তরের বর্ণনা দেন। জন্ম থেকে প্রথম কয়েক বছর শাস্তি এড়াতে শিশুরা নিয়মকানুন মেনে চলে, এরপর বয়ঃসন্ধিতে সে নিজের কাজের স্বীকৃতির জন্য সামাজিক রীতিনীতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে ‘ভালো ছেলে’ বা ‘ভালো মেয়ে’ অভিধায় ভূষিত হতে চায়। আর নৈতিকতা বিকাশের তৃতীয় স্তর শুরু হয় ১৬-১৭ বছর বয়সের দিকে। তখন সে নৈতিকতাকে নিজস্ব ধারণার জগতের সঙ্গে মিলিয়ে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা দিতে থাকে। তার ধারণার জগত্ বা জ্ঞানীয় বিকাশ যদি হয় প্রচলিত সমাজ-সংস্কৃতিপন্থী, তবে তার নৈতিকতার চর্চা হয় সমাজ অনুগামী। আর তার ধারণার জগতে যদি সে বিশ্বাস করে এই সমাজ, এই প্রচলিত রীতিনীতি ‘সঠিক নয়’, তখন সে তার চারপাশকে পরিবর্তন করতে চায়। তখন  আশপাশের বড়দের কাছে তাদের ‘পাকা কথাও জ্যাঠামি এবং কথামাত্রই প্রগলভতা’ হয়ে যায়। 

সুইস মনোবিজ্ঞানী জ্যঁ পিয়াজে শিশুদের ধারণার জগত্ বা জ্ঞানীয় বিকাশের বিখ্যাত তত্ত্বটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, ৭ থেকে ১১ বছর বয়সের একটি শিশু আশপাশ সম্পর্কে অনেক যুক্তি দিয়ে ভাবতে শেখে। কোনো বস্তুর ধারণায় সে গুণগত মানকে প্রাধান্য দেয়। আর ১১ বছরের পর থেকে পরিণত বয়স পর্যন্ত তার ধারণার জগিট অনেক বিস্তৃত হতে থাকে, বিমূর্ত হতে থাকে এবং কার্যকারণ বিবেচনা করে সে তার ধারণা প্রস্তুত করে। এই পর্যায়টি এ কারণে গুরুত্বপূর্ণ যে এই সময়টিতেই একজন কিশোরের মধ্যে তার অভিভাবক আর পরিবেশে অনুযায়ী আত্মকেন্দ্রিক ক্যারিয়ার নির্ভর অথবা ভোগবাদে পরিপূর্ণ কিংবা পুরোপুরি পরার্থবাদী ধারণা তৈরি হতে থাকে। এই ১১-১২ বছর বয়সটিতে অভিভাবক আর পরিবেশের প্রভাব এই কারণেই খুব গুরুত্বপূর্ণ।

এত তত্ত্বকথার ভিড়ে আসল কথাটি হচ্ছে, কৈশোর বা বয়ঃসন্ধিকালকে সংকটাপন্ন বা সম্ভাবনাময় যেটাই বলা হোক না কেন, তা নির্ভর করে অভিভাবক আর পরিবেশের ওপর। তাই বড়রা যদি কিশোরদের বুঝতে পারে, তাদের সামাজিক দক্ষতা বাড়াতে উত্সাহিত করে ‘জিপিএ ফাইভ’ আর ‘হতেই হবে’র দেয়াল থেকে মুক্ত রাখে, তবে মনে রাখতে হবে যে ‘তেরো-চৌদ্দ বছরের ছেলেমেয়ের মতো পৃথিবীতে এমন সম্ভাবনা আর নেই।’

পড়াশোনা হোক আনন্দের, তা যেন কখনোই তোমার ওপর চাপ হয়ে না দাঁড়ায়
পড়াশোনা হোক আনন্দের, তা যেন কখনোই তোমার ওপর চাপ হয়ে না দাঁড়ায়

বড়রা তোমাদের সব সময় বুঝতে পারবে না, তখন তুমি কী করবে? 

  • লজ্জা বা ভয় থেকে দূরে থাকতে হবে—তুমি যা জানতে চাও তা গোপন করবে না। বাবা-মা বা শিক্ষকের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করতে পারো।
  • নিজের কোনো সমস্যা হলে তা লুকিয়ে রাখবে না। খুব কাছের বড় কারও সঙ্গে আলোচনা করবে।
  • নিজেকে ছোট ভাববে না—তবে মনে রাখবে, তুমি কিন্তু তৈরি হচ্ছো। তাই অনেক কিছুই তোমার পক্ষে এই বয়সে করা সম্ভব নাও হতে পারে।
  • উদ্ধত আচরণ কখনোই করবে না। মা-বাবার তোমাকে বুঝতে ভুল হতে পারে। কিন্তু তর্ক করে তাঁদের শোধরানোর চেষ্টা করবে না। তুমি কাজের মধ্য দিয়ে তাদের ভুল ভাঙাবে।
  • ছোট ছোট সমস্যা নিজে নিজে ভেবে সমাধান খুঁজবে। সব সময় অপরের ওপর নির্ভর করবে না।
  • নিজের পছন্দের বিষয়ে (ক্যারিয়ার ও অন্যান্য) পরিষ্কার করে জানাবে। কেন বিষয়টি পছন্দের তার পক্ষে যুক্তি তৈরি করবে।
  • ‘না’ বলা শিখতে হবে। বন্ধুদের চাপে পড়ে, নিজেকে স্মার্ট দেখানোর জন্য যেন মাদক বা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে না পড়ো, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।
  • জীবনে সফলতার পাশাপাশি ব্যর্থতাও একটি অনুষঙ্গ। ব্যর্থতা মানেই কিন্তু ফুরিয়ে যাওয়া নয়। ব্যর্থতাকে মেনে নিয়ে নতুনভাবে শুরু করতে থাকো। 
  • আবেগের সম্পর্ক তৈরি হওয়া, কাউকে ভালো লাগা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক বিষয়। আগে নিশ্চিত হও তোমার ভালো লাগার মাত্রা কতটুকু, সেটি কি কেবলই মোহ না তার চেয়েও বেশি কিছু।
  • খেলাধুলা, বই পড়া, বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যাওয়া, পরিমিত ইন্টারনেট ব্যবহার করা—সবই তোমার জীবনে থাকবে। এগুলো তোমাকে সামাজিকভাবে দক্ষ করে তুলবে।
  • কখনো অযৌক্তিক রাগ করবে না। রাগ তোমাকে আনস্মার্ট করে তুলবে।
  • অবশ্যই রাতে ঘুমাবে, দিনে পড়ালেখা-কাজ করবে। রাতে জেগে থাকলে মস্তিষ্কের ‘বায়োলজিক্যাল ক্লক’টি বিগড়ে যেতে থাকে। তখন চিন্তা ও আচরণের সমস্যা হয়।
  • শরীরেরও যত্ন নেবে। সুষম খাবার খাবে আর প্রতিদিন হালকা ব্যায়াম করবে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, শিশু-কিশোর ও পারিবারিক মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা

মডেল : কারিন, তনিকা, বিভা ও সৈকত

ছবি : সুমন ইউসুফ