ঘোড়ার ডিমের ছাই

অলংকরণ: সারা তৌফিকা
অলংকরণ: সারা তৌফিকা

‘দেশটার নাম বলামাত্রপুর।’

‘কী বললে? এ কেমন নাম!’

‘হুঁ, আজবই বটে।’

‘কোথায় সেই দেশ?’

‘সাত নদী, তেরো সমুদ্র, বিরাশি পাহাড় আর শখানেক জঙ্গল পার হয়ে যেতে হয় সেই দেশে।’

‘তুমি গিয়েছিলে?’

সেতুর প্রশ্ন শুনে ছোট মামা বিষম খান, ‘ধুর! আমার এত সময় কই সে দেশে যাওয়ার? তা ছাড়া আমি তো সাঁতার জানি না।’

‘মামা, আমি কিন্তু সাঁতার জানি।’ লাফিয়ে ওঠে সিঁথি।

‘আমিও।’ সেতুর চোখ চকচক করে, ‘সাঁতার শিখতে তো মাত্র এক সপ্তাহ লাগে। মামা, তুমিও শিখে ফেলো।’

মামার হাত ধরে সিঁথি, ‘তুমি তো বড়, দুই-তিন দিনেই শিখে ফেলতে পারবে। প্লিজ ছোট মামা..., আমরা একসঙ্গে সেই দেশে যাব।’

গল্প শোনাতে গিয়ে এ কোন মুসিবতে পড়া গেল! মনে মনে ভাবে সজল। গতকাল রাতে বেড়াতে এসেছে বোনের বাসায়। তখন সেতু-সিঁথি ঘুমে। সকালে সজলের ঘুম ভাঙল ‘ছোট মামা ছোট মামা, গুড মর্নিং...’ ডাকে। ঘুম ভাঙতেই দুই বোনের বায়না—নতুন গল্প শোনাতে হবে।

এখন তো দেখা যাচ্ছে দুই ভাগনি তাকে সাঁতার শিখিয়ে, পাহাড়ে উঠিয়ে, জঙ্গল পাড়ি দিয়ে কাল্পনিক দেশে নিয়েই ছাড়বে!

‘ইয়ে মানে...’ কথা গুছিয়ে নেয় সজল, ‘সাঁতার নাহয় শিখলাম, কিন্তু সেই দেশে তো যাওয়া যাবে না।’

‘কেন?’ প্রায় একসঙ্গে চিত্কার করে ওঠে সেতু আর সিঁথি।

‘শোন বোকারা, সাত নদী, তেরো সমুদ্র, বিরাশি পাহাড় আর শখানেক জঙ্গল পার হয়ে সেই দেশে যেতে তো কমপক্ষে তিন মাস লাগবে। এদিকে সাঁতার শেখা, পাহাড়ে ওঠার ট্রেনিং ইত্যাদি করতে ধর আরও এক মাস...। ওকে, আমার সমস্যা নেই...’ এই পর্যন্ত বলে মুচকি হাসেন ছোট মামা, ‘তোদের স্কুল ছুটি কত দিন?’

এবার সেতু-সিঁথি একসঙ্গে চুপসে যায়। তাই তো! মাত্র ১০ দিনের ছুটিতে তো কিছুতেই সেখানে যাওয়া যাবে না।

সেতু মন খারাপ করে বলে, ‘তাহলে উপায়?’

ভাগনিদের মন খারাপ দেখে ছোট মামা বলেন, ‘উপায় একটাই, বলামাত্রপুরের গল্প শোনা।’

‘বলামাত্রপুরের গল্প আবার কী মামা?’ সিঁথি কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে জানতে চায়।

‘আরে, এরই মধ্যে ভুলে গেলি? এতক্ষণ যে দেশে তোরা যাওয়ার জন্য হাউকাউ করলি, সেই দেশের নামই তো বলামাত্রপুর। আমি তোদের সেই দেশের গল্প বলতে পারি।’

‘আচ্ছা, তা-ই বলো।’ সেতু সায় দেয়। 

ছোট মামা একটি বালিশ টেনে নিয়ে কোলের মধ্যে রেখে আরাম করে বিছানায় বসেন। তাঁর ডান পাশে বড় ভাগনি সেতু। বাঁয়ে ছোট সিঁথি।

‘শোন তবে। নামটা যেমন আজব, বলামাত্রপুর দেশের মানুষগুলোও অদ্ভুত। আর তাদের সব কর্মকাণ্ডই অদ্ভুতুড়ে।’

‘কী রকম?’ খুব মনোযোগী শ্রোতার মতো জানতে চায় সিঁথি।

‘সেই দেশের মানুষগুলো যা চায় তা-ই পায়। মুখে যা বলে সঙ্গে সঙ্গে তা-ই হয়ে পূরণ হয়ে যায়।’

‘ধুর! এটা কীভাবে সম্ভব?’ সেতুর কণ্ঠে অবিশ্বাস।

‘তাহলে একদিনের ঘটনা বলি, শোন।’

সেতু-সিঁথি সোজা হয়ে বসে। কান খাড়া করে।

‘বলামাত্রপুর দেশটা খুব ছোট। সেই দেশে মানুষজনও খুব অল্প। তারা সবাই মিলে মাসের শেষ দিন আসরে বসে।’

‘আসরে কী হয় মামা?’ সিঁথি জানতে চায়।

‘আড্ডা হয়। গান হয়। গল্প হয়। ইচ্ছেপূরণ হয়। মানে যা-ইচ্ছা তা-ই হয়।’ ছোট মামা মাথাটা একটু চুলকে নিয়ে বলেন, ‘তো একদিন এ রকম জমজমাট আসর বসেছে। নানা রঙের-ঢঙের বয়সী মানুষ সেখানে। আসরে ছিল ইয়া মোটা এক লোক। সারাক্ষণ খাই খাই করে। হঠাত্ সে বলে উঠল, শালগম খাব। অমনি আসরে বসা একজনের শরীর থেকে উড়ে এল একটি শাল। আর পাশের দোকান থেকে উড়ে এল ঝুড়িভর্তি গম। দুয়ে মিলে হয়ে গেল শালগম। লোকটি গপাগপ খেয়ে ফেলল।’ 

অলংকরণ: সারা তৌফিকা
অলংকরণ: সারা তৌফিকা

‘বলো কী মামা? এ তো অবিশ্বাস্য। অসম্ভব!’ সিঁথি বলল।

মামা হাসেন, ‘আগেই বলেছি, অসম্ভবকে সম্ভব করাই বলামাত্রপুর দেশের মানুষের কাজ!’

সেতু চোখ বড় বড় করে বলল, ‘তারপর কী হলো মামা?’

‘তারপর...? আসরে সেই রকম শুকনা এক লোক ছিল। পাটকাঠির চেয়েও চিকন। হঠাত্ সে বলে বসল, কানামাছি খেলব। অমনি টুপ করে শব্দ হলো।’

‘কিসের শব্দ মামা?’ সিঁথি অবাক।

‘একটি বড়সড় মাছি টুপ করে শুকনা লোকটির পায়ের কাছে পড়ল। লোকটি হাতের তালুতে নিয়ে দেখে—মাছিটির চোখে কালো চশমা।’

‘মাছির চোখে চশমা? কেন?’ সেতু জানতে চায়।

‘কারণ, মাছিটি ছিল কানা। তারপর চিকন লোকটি কানামাছি নিয়ে খেলতে শুরু করল।’

‘মামা, আর কী কী হলো সেই আসরে?’ সিঁথির আগ্রহ যেন বাড়তেই থাকে।

‘সেই দেশের সবচেয়ে বাঁটকু লোকটা, যার উচ্চতা মাত্র সোয়া দুই ফুট, তার কোথায় যেন যাওয়ার কথা। তাই পাশের জনের কাছে জানতে চাইল, আচ্ছা, কয়টা বাজে? সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠল দোকানের সব হাঁড়ি-পাতিল-চামচ। বাজতে শুরু করল সেগুলো। ঝনঝন...ঝুনঝুন...।’

সেতু বলল, ‘কয়টা বাজছিল মামা?’

‘কে গুনবে? শত শত হাঁড়ি-পাতিল একসঙ্গে বাজতে শুরু করতেই সবাই দুই কানে আঙুল ঢুকিয়ে দিল। আর বলামাত্রপুরের সবচেয়ে লম্বা এবং রাগী লোকটা চিত্কার করে বলল, এসব কী হচ্ছে? যত সব ঘোড়ার ডিম। ব্যস! পাশেই ছিল একটি ঘোড়া। অমনি সেটি ডিম পেড়ে দিল।’

‘তারপর?’ উত্তেজনায় একসঙ্গে বলে ওঠে সেতু-সিঁথি।

‘ঠিক তখনই আসরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল এক মা। কোলে তার ছোট্ট শিশু। শিশুটি হাত উঁচিয়ে বলল, মা মা, ওই দ্যাখো ঘোড়ার ডিম। মা বলল, ধুর! ওটা ঘোড়ার ডিম না ছাই। অমনি ডিমটি ছাই হয়ে গেল।’

‘সবার সামনে?’ সেতুর মনটা খারাপ হলো।

‘হ্যাঁ।’ ছোট মামা ছোট্ট একটা হাই তুলে সেতুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ঘোড়াটিরও মন খুব খারাপ হয়ে গেল। ঘোড়াটি মনে মনে চাইল ছাইগুলো উড়ে যাক। তাই বলল, হাওয়া...’

‘এক মিনিট।’ সিঁথি হাত তুলে ছোট মামাকে থামায়, ‘ঘোড়া কীভাবে কথা বলল মামা’

‘আরে বোকা, বলামাত্রপুরের পশুপাখিও কথা বলতে পারে। প্রথমেই তো বলেছি ওটা আজব দেশ।’

সেতু বলল, ‘আচ্ছা, তারপর কী হলো?’

‘ঘোড়াটি হাওয়া বলার সঙ্গে সঙ্গে আসরের সব লোক হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। এক সেকেন্ড পর ঘোড়াটিও। শুধু পড়ে রইল ঘোড়ার ডিমের ছাই।’

‘গুল মারছ মামা? ঘোড়ার ডিমের আবার ছাইও হয় নাকি?’ সেতু আপত্তি জানায়।

‘হ্যাঁ, হয় তো। আমার এক বন্ধু কিন্তু বলামাত্রপুর দেশে গিয়েছিল। সে আমার জন্য বোতলে করে সেই ছাই নিয়ে এসেছে। এই দ্যাখ...।’ বলতে বলতে পাশের টেবিলে রাখা ব্যাগ থেকে একটি বোতল বের করেন ছোট মামা।

‘এখন তোরা যা তো। সকাল সকাল গল্প বলতে গিয়ে তো দাঁতই মাজা হলো না।’ এই বলে ছোট মামা ঘোড়ার ডিমের ছাইয়ের বোতলটা হাতে নিয়ে বাথরুমে ঢোকেন।

সেতু আর সিঁথি বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাঝামাঝি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে পরস্পরের দিকে।