বনে গিয়ে ভোজন

অলংকরণ : রাকিব রাজ্জাক
অলংকরণ : রাকিব রাজ্জাক

বিল্টুর মধ্যে নেতাভাব প্রবল। সে সবার সামনে হাঁটতে হাঁটতে পেছন ফিরে বলল, ‘স্যার, হাতি এলে লুঙ্গি মালকোচা মেরে যেদিকে দুচোখ যায় দৌড় মারবেন। জান বাঁচানো ফরজ।’

হেডস্যার বিল্টুকে ধমকে ওঠেন, ‘ব্যাটা বদের ডিপো। চোখের মাথা খেয়েছিস নাকি! আমি কি লুঙ্গি পরে এসেছি?’

বিল্টু জিবে কামড় দেয়, ‘ভুল হয়ে গেছে স্যার। আসলে এত বড় একটি দলের দায়িত্ব নিলে মাথা কি ঠিক থাকে! আপনিই বলুন স্যার। পেছনের গাধাগুলো শুধু বসে বসে খায়। কোনো কাজে হাত দেয় না। এখন হাতি দেখার জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওদিকে রান্নাবান্না সব বাকি।’

বিল্টুকে কষে একটা চড় মারতে পারলে আমাদের মনের ঝাল একটু কমত। হেডস্যার থাকায় আমরা কিছু বলতে পারছি না। বিল্টু আমাদের দিকে তাকিয়ে চোখ মটকায়। আমরাও ইশারায় বুঝিয়ে দিই, তোমাকে একবার হাতের কাছে পাই। হেভিওয়েট পাঞ্চ মেরে চেহারার নকশা পাল্টে দেব!

আমরা এসেছি বনভোজনে। নবম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলে আমাদের সবারই মনে হলো কিছু একটা করা উচিত। পরীক্ষা দিতে দিতে মাথার ঘিলু সব শরবত হয়ে গেছে। যেকোনো সময় কান দিয়ে বের হয়ে আসতে পারে।

পটলার মাথায় সব সময় আইডিয়া ঘোরে। সে উত্সাহিত হয়ে বলল, ‘চল আমরা একটা নাটক করি। পুরোনো দিনের নাটক, নবাব সিরাজউদ্দৌলা। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার মহান অধিপতি...।’

বিল্টু তাকে থামায়, ‘ব্যাটা বুরবক! ওই ডায়ালগ এখন সবাই জানে। নাটক করলে আমরা নিজেরা ছাড়া আর কেউ দেখতে আসবে না। তুইও আসতে পারিস কি না সন্দেহ আছে। তোর তো সারা বছর পেটব্যথা থাকে।’

বিল্টুর কথায় পটলা খেপে গিয়ে বিল্টুকে মারতে যায়। আমরা তাকে থামালাম, ‘মারামারি পরে করিস। আমরা এখন কী করতে পারি সেটা নিয়ে চিন্তা কর আগে।’

হঠাত্ সন্তু এক পাশ থেকে বলে ওঠে, ‘চল, আমরা বনভোজনে যাই। একদম সত্যিকারের বনে গিয়ে ভোজন। আমাদের পাশের উপজেলাতে তো পাবলাখালী রেঞ্জ। অথচ আমাদের কখনো যাওয়া হয়নি। শুনেছি সেখানে একটা অভয়ারণ্য হয়েছে। এই সুযোগে সেটাও দেখা হয়ে যাবে।’

 সন্তুর কথা আমাদের মনে ধরে। সন্তু এমনিতে চুপচাপ থাকে। কিন্তু যখন কোনো আইডিয়া দেয়, আমরা সেটা ফেলতে পারি না।

বিল্টু হঠাত্ বলে ওঠে, ‘আমি শুনেছি পাবলাখালী রেঞ্জে হাতি আছে। মাঝেমধ্যেই গভীর জঙ্গল থেকে হাতি নেমে এসে মানুষের ঘরবাড়ি নষ্ট করে দেয়। হাতি আমাদের ধাওয়া করলে তখন কী হবে!’

আমি বিল্টুকে খোঁচা দিই, ‘তুই হাতির পিঠে করে ওদের সঙ্গে চলে যাবি। গিয়ে কলাগাছ খাবি। একটা হনুমান চলে এসেছে ভেবে হাতিরা অবশ্য চিন্তায় পড়ে যেতে পারে!’

বিল্টু আমার দিকে কটমট করে তাকায়। কিন্তু সবার সামনে কিছু করার সাহস পায় না।

আমাদের ক্লাসের ক্যাপ্টেন তৌফিক দাঁড়িয়ে বলল, ‘বনভোজন করার জন্য তো হেডস্যারের অনুমতি লাগবে। চল, স্যারের কাছে যাই।’

বনভোজনের কথা বলতেই স্যার খেঁকিয়ে উঠলেন, ‘আর কিছুদিন পরেই তোদের এসএসসি পরীক্ষা। এখন এসব করা যাবে না।’

তৌফিক কাচুমাচু করে বলে, ‘স্যার, পরীক্ষা তো এক বছর পরে। আমরা সবে ক্লাস টেনে উঠলাম।’

 ‘তাতে কী!’ স্যারের ধমকে আমরা চুপসে যাই, ‘এক বছর পরে হোক আর দুই মাস পরে হোক, পরীক্ষা তো পরীক্ষাই। যা এখন গিয়ে পড়তে বস।’

মাত্র কয়েক দিন আগে আমাদের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলো। আবার পড়তে বসার কথা শুনে আমার কান দিয়ে রীতিমতো গরম ধোঁয়া বের হতে লাগল।

বিল্টু ফস করে বলে বসল, ‘স্যার, আমরা পাবলাখালী রেঞ্জে বনভোজনে যেতে চাই। ওখানে হাতি দেখা যায়। হাতি কী সুন্দর চরে বেড়ায়, দেখলে মন ভালো হয়ে যায় স্যার।’

 ‘হাতি কি গরু নাকি, যে চরে বেড়াবে! ব্যাটা রামছাগল। আদব করে কথা বল। মামা বলে ডাকবি। ওদের একটা ইজ্জত আছে না!’ হেডস্যারের চোখ দেখে মনে হলো আগুন বেরোচ্ছে। বিল্টু পুরোপুরি চুপসে গেল।

পটলা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘স্যার, বিল্টুটা সব সময় এ রকম উল্টাপাল্টা কথা বলে। বনভোজনটা হলে কিন্তু আমরা অনেক কিছু শিখতে পারতাম স্যার। আমরা কেউ এখনো সত্যিকারের বনে যাইনি।’

হেডস্যার একটু নরম হলেন, ‘আগে দেখি তোদের সাধারণ জ্ঞানের পরিধি কতটুকু! দেখি, বলতা হাতি নামটা কোত্থেকে এল?’

বিল্টু আবারও ফোড়ন কাটে, ‘স্যার, হাতি অনেক বড়। কিন্তু তার চোখগুলো হলো ছোট ছোট। এত উঁচু থেকে ছোট ছোট চোখে নিচের কিছু দেখতে পারে না বলে সে হাতড়ে হাতড়ে চলে। এ জন্য নাম হাতি!’

হেডস্যার বিল্টুকে ধমক দিতে গিয়ে কী মনে করে থেমে গেলেন। হেসে বললেন, ‘হাতির সামনে যে শুঁড়টা আছে, আসলে ওটা হলো তার হাত। হস্ত বা হাত থেকেই তার নাম হয়েছে হস্তী বা হাতি। সে তার এই হাত দিয়েই পানি খায়।’ হেডস্যার একটু থেমে আমতা আমতা করে বললেন, ‘ইয়ে মানে, তোদের সঙ্গে আমাকে নিয়ে যাবি? অনেক ছোটবেলায় হাতি দেখেছিলাম চিড়িয়াখানায়।’

আমরা সবাই হুল্লোড় করে উঠি।

২.

বনভোজনের আয়োজন করা আমাদের কাছে ছোটখাটো একটা যুদ্ধের মতো মনে হলো। হেডস্যার রেঞ্জ কর্মকর্তাকে ফোন করেছিলেন। রেঞ্জ কর্মকর্তা সিরাজ চাচা বলেছেন তাঁর বাংলোর সামনে অনেক খালি জায়গা আছে, সেখানে রান্নাবান্না করা যাবে।

রান্নার আয়োজন করে আমরা সবাই ঘুরতে বের হলাম। বিল্টু আমাদের সামনে হাঁটতে হাঁটতে হঠাত্ নেতৃত্ব নিয়ে নিল।

চারদিকে সুনসান নীরবতা। জঙ্গলের একটা আলাদা সৌন্দর্য আছে। আওয়াজ করলেই মনে হয় সে সৌন্দর্য ভেঙে গুঁড়িয়ে যাবে। আমরা নিঃশব্দে হাঁটতে থাকি। মাঝেমধ্যে নাম না জানা কোনো পাখি ডেকে উঠলে আমরা চমকে উঠি।

পটলা ফিসফিস করে বলল, ‘আচ্ছা, হাতি কামড়ালে কি ব্যথা পাওয়া যায়?’

আমার ইচ্ছে করে পটলাকে ধরে কানটা মুচড়ে দিই। চাপা স্বরে বলি, ‘তুই একটা আস্ত উল্লুক। কখনো শুনেছিস, হাতি কাউকে কামড় দিয়েছে!’

হেডস্যার হেলেদুলে হাঁটতে লাগলেন। ফুরফুরে মেজাজে বললেন, ‘তোদের আরও একটা মজার তথ্য জানিয়ে রাখি। হাতি দেখতে যে রকম, খায়ও সে রকম, ত্যাগও করে সে রকম। হাতি দিনে প্রায় ১০০ কেজি মলত্যাগ করে।’

বিল্টু আমাদের দিকে তাকিয়ে দাঁত চেপে বলল, ‘তোদের দিনে তিন বেলা হাতির গোবর খাওয়ানো উচিত।’

অলংকরণ : রাকিব রাজ্জাক
অলংকরণ : রাকিব রাজ্জাক

বিনা উসকানিতে বিল্টু আমাদের সঙ্গে ঝগড়া লাগানোর চেষ্টা করছে দেখে আমার মেজাজ গরম হয়ে গেল। কান চিড়বিড় করতে লাগল। বিল্টুকে ধরতে যাব এমন সময় সরসর আওয়াজ শুনে চমকে উঠি আমরা সবাই। কে যেন বললো, ‘নিশ্চয় হাতি আসছে।’ শুনে হেডস্যার কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, ‘ইয়ে আমাকে ফেলে তোরা চলে যাস না।’ ব্যস, কে শোনে কার কথা! যে যেদিকে পারলাম দৌড় লাগালাম আমরা। একটু পর জঙ্গল ভেদ করে সিরাজ চাচা আর কয়েকজন বনরক্ষী নিয়ে এসে উপস্থিত হলেন। আমাদের ছোটাছুটি দেখে অবাক হয়ে বললেন, ‘তোমরা এ রকম ছোটাছুটি করছ কেন? এখানে তো কোনো জন্তু-জানোয়ার নেই। ভয়ের কিছু নেই।’

এমন সময় হেডস্যার একটা গাছের মগডাল থেকে চিত্কার করে বললেন, ‘বদের দল, আমাকে আগে এখান থেকে নামা!’

সিরাজ চাচা হেডস্যারের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলেন, ‘আপনি গাছে উঠলেন কীভাবে?’

হেডস্যার আমতা আমতা করে বললেন, ‘কী করবো? পাজি বিল্টুটা বলল হাতি আসছে স্যার, গাছে  উঠে যান। ভয়-টয় না, ছেলেটার কথা রাখতেই...’

সিরাজ চাচা হেসে ফেললেন, ‘এখানে হাতি আসবে কোত্থেকে! হাতি তো গভীর জঙ্গলে। এটা আমার বাংলোর পেছনের অংশটা। অবশ্য অনেক আগে হাতি আসত এদিকে। কিন্তু মানুষ এখন বনজঙ্গল কেটে সাফ করে ফেলছে। এদিকে এলে তো হাতি না খেয়ে মরবে।’

হেডস্যার দাঁত কিড়মিড় করে বললেন, ‘বিল্টুটাকে একবার হাতের কাছে পাই। পিটিয়ে পিঠের চামড়া তুলে ফেলব। আমাকে হাতির ভয় দেখায়!’

বিল্টু স্রেফ গায়েব হয়ে গেছে। আমরা আশপাশে কোথাও তাকে দেখতে পেলাম না।