কিংবদন্তি থেকেও বেশি কিছু

টেনিস আর ফেদেরার শব্দ দুটো কি সমার্থক? কে জানে! তবে চ্যাম্পিয়ন আর ফেদেরার শব্দ দুটি সমার্থক হতেই পারে। ১৯তম গ্র্যান্ড স্লাম জিততে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি কদিন আগে। রাফায়েল নাদাল, নোভাক জোকোভিচ কিংবা অ্যান্ডি মারের মতো খেলোয়াড়দের ছাড়িয়ে জিতেছেন উইম্বলডন। টেনিসের সবচেয়ে পুরোনো এবং মর্যাদাপূর্ণ এই টুর্নামেন্টে ফেদেরারই সেরা, যাঁর নামের পাশে ৮টি উইম্বলডন ট্রফি। অস্ট্রেলিয়ান ওপেন ২০১৭ জয়ের পর উইম্বলডন জয়—ফেদেরার নিজেও কি ভেবেছিলেন? ২০১৭-র আগে গ্র্যান্ড স্লাম জিতেছিলেন সেই ২০১২ সালে, উইম্বলডন। তারপর দীর্ঘ পাঁচ বছরের খরা। ফাইনাল-সেমিফাইনালেই আটকে যাচ্ছিলেন এই সুইস তারকা। নিন্দুকেরা বলতে শুরু করলেন, বুড়ো হয়ে গেছেন ফেদেরার। সময় ফুরিয়ে এসেছে তাঁর।

তাই ৩৫ ছুঁইছুঁই বয়সে ফেদেরার যখন অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের ফাইনালে উঠলেন, অনেকেই ভাবছিলেন, আবারও বোধ হয় তীরে এসে ডুববে তরি। প্রতিপক্ষ ছিলেন এমন একজন,  যাঁর বিপক্ষে ফেদেরারের অস্বস্তি ছিল ক্যারিয়ারজুড়েই। রাফায়েল নাদাল। ২০০৫-২০০৯ সময়টায় টেনিস মানেই যেন ফেদেরার বনাম নাদালের ক্ল্যাসিক লড়াই। মুখোমুখি লড়াইয়ে নাদালের ২৩ জয়ের বিপরীতে ফেদেরারের জয় ১১টিতে। বোঝাই যাচ্ছে, ইতিহাস ফেদেরারের বিপক্ষে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফেদেরারের মুখেই হাসি।

তারপরই উইম্বলডন জয়। নাদাল, মারের মতো তারকারা যখন একে একে বিদায় নিচ্ছিলেন, তখন গুঞ্জন উঠেছিল, ফেদেরার পারবেন তো? কিন্তু কঠিন সার্ভে  সেগুলোকে উড়িয়ে দিয়ে নতুন ইতিহাস গড়লেন ফেড-এক্সপ্রেস। যাঁকে বুড়ো ভেবেছিলেন সমালোচকেরা, তরুণ মারিন চিলিচকে হারিয়ে সেই ফেদেরারই জিতলেন উইম্বলডন। 

ছোটবেলায় ফেদেরার
ছোটবেলায় ফেদেরার

সুইজারল্যান্ডের বাসেলে জন্ম ফেদেরারের। বাবা সুইস, মা দক্ষিণ আফ্রিকান। টেনিসে ফেদেরারের যাত্রা কিন্তু বলবয় হিসেবে। তারপর জুনিয়র লেভেলে থেকেই সফলতা পেতে শুরু করলেন। ১৯৯৮ সালে জুনিয়র লেভেলে জেতেন উইম্বলডন সিঙ্গেলস আর ডাবলস দুটোতেই। তিন বছর পর ২০০১ সালে চমকে দেন পুরো টেনিস বিশ্বকে। তখনকার নাম্বার ওয়ান এবং টেনিস গ্রেট পিট সাম্প্রাসকে হারিয়ে দেন উইম্বলডনে। পরের বছর বাদ পড়েন প্রথম রাউন্ড থেকেই। ২০০৩ সালে তো জিতেই গেলেন উইম্বলডন।

২০০৪ সালে র্যাঙ্কিংয়ের ১ নম্বরে ওঠেন রজার ফেদেরার। এরপর উন্মুক্ত যুগে রেকর্ড ৩০২ সপ্তাহ র্যাঙ্কিংয়ের ১ নম্বরে থাকার কৃতিত্বও তাঁর। সঙ্গে ২৪টি এটিপি ১০০০ মাস্টার্স, অলিম্পিকে স্বর্ণ জয় তো আছেই। ক্যারিয়ারে ইনজুরি, উত্থান-পতন তো ছিলই। কিন্তু ফেদেরার হার মানেননি কখনো। ক্যারিয়ার গ্র্যান্ড স্লাম অর্থাত্ চারটি গ্র্যান্ড স্লাম পাওয়া আটকে ছিল ২০০৯ পর্যন্ত। সবই পেয়েছেন, শুধু বাকি ছিল ‘কিং অব ক্লে’ রাফায়েল নাদালের মাটির দুর্গ ফ্রেঞ্চ ওপেন জয়। অবশেষে অনেক ধৈর্য আর কষ্টের পর ফ্রেঞ্চ ওপেন যখন জিতলেন, আনন্দে কেঁদে ফেললেন ফেদেরার। সেই সুখের কান্নাটা টেনিসপ্রেমীদের আজীবন মনে থাকবে।

পরিবারের সঙ্গে রজার ফেদেরার
পরিবারের সঙ্গে রজার ফেদেরার

টেনিসকে ভালোবাসার আরেকটি বড় জায়গা রয়েছে ফেদেরারের। তাঁর স্ত্রী মিরকা ফেদেরারও ছিলেন টেনিস খেলোয়াড়। ২০০০ সালে টেনিস কোর্টেই দেখা হয় দুজনের। দুজন মিলে দেশের হয়ে ডাবলসে অংশ নেন। একসঙ্গে খেলতে খেলতেই দারুণ বোঝাপড়া হয়ে যায় দুজনের মধ্যে। কিন্তু ২০০২ সালে ইনজুরিতে পড়ে টেনিস ছাড়তে বাধ্য হন মিরকা। কিন্তু পরস্পরকে ছাড়েননি কেউই। ২০০৯ সালে যমজ মেয়ের বাবা-মা হন ফেদেরার-মিরকা।  ২০১৪ সালে আবার যমজ ছেলেও আসে তাঁদের কোলে। পরিবার নিয়ে সুখেই আছেন ফেদেরার-মিরকা। ফেদেরার দেখিয়েছেন তিনি খেলোয়াড়, তিনি স্বামী, তিনি বাবা এবং সবচেয়ে বড় কথা তিনি অত্যন্ত অমায়িক এবং ভালো মানুষ। আদর্শ অ্যাথলেটের প্যারাগ্রাফ তাঁকে নিয়ে লিখলে, শিক্ষকেরা দশে দশ না দিয়ে কোথায় যাবেন!

প্রচণ্ড পরিশ্রমের খেলা টেনিসে অনেক কিংবদন্তি খেলোয়াড়ও মাঝেমধ্যে উদ্ধত হয়ে যান। কিন্তু ফেদেরার সব সময়ই বিনয়ী, শান্ত। তা যেমন কোর্টে, তেমনি সংবাদ সম্মেলনেও। বেশ কয়েকটি ভাষা জানেন ফেদেরার। সুইস, জার্মান, স্ট্যান্ডার্ড জার্মান, ইংরেজি ও ফ্রেঞ্চ ভাষায় তিনি ভালোই দক্ষ। সংবাদ সম্মেলনে কোনো সাংবাদিক নিজের ভাষায় প্রশ্ন করলে ফেদেরারও চেষ্টা করেন সে ভাষাতেই উত্তর দিতে।

ধীরস্থির ফেদেরারের গুণের শেষ নেই। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে প্রতিষ্ঠা করেছেন রজার ফেদেরার ফাউন্ডেশন। ২০১৮ সালের মধ্যে ১০ লাখ শিশুকে এর আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্য এই ফাউন্ডেশনের।

ফেদেরারের আইডল কে? এখানে বেশ কৌশলী ফেড-এক্সপ্রেস। সাম্প্রাসের সার্ভ, স্টিভেন এডবার্গের ভলির ভক্ত তিনি। তবে ফেদেরারের ভক্ত পৃথিবীজুড়েই। শচীন টেন্ডুলকার, টাইগার উডস, মাইকেল জর্ডান কিংবা উইল স্মিথদের মতো তারকারাও ফেদেরারের ভক্ত। ফেদেরারের খেলা হলে ডেভিড বেকহাম, ব্র্যাডলি কুপার কিংবা বেয়ার গ্রিলসদেরও দেখা যায় দর্শকসারিতে। খেলা দেখলে মনে হবে ফেদেরারই টেনিস, টেনিসই ফেদেরার। গত ১৫-১৬ বছর টেনিসে যে সাবলীলভাবে খেলেছেন, শতবর্ষ পরেও হয়তো টেনিস বিশ্ব ফেদেরারেই আটকে থাকবে। আসলে রজার ফেদেরার শুধু কিংবদন্তি নন, তার থেকেও বেশি কিছু।