ফুটবলের মানিক-রতনেরা

’৮৬ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার কাছে কোয়ার্টার ফাইনালে বাড়ির পথ ধরার পর সক্রেটিস আক্ষেপ করে বলেছিলেন, “ফুটবল মাঠে এমন একজন দরকার, যার সঙ্গে গাইতে পারা যায়, চাইলেই আকাশে ওড়া যায়, ওড়ানো যায়’ বিখ্যাত একটা জুটি শুধু অন দ্য পিচের রেকর্ড ভাঙার গল্পই বলে না, বলে বন্ধুত্বের গল্প। অসাধারণ বন্ধুত্বের গল্প লুকিয়ে থাকে একটা দুর্ধর্ষ জুটির পেছনে। টেলিপ্যাথিক যোগাযোগ ছাড়া কোনো ভয়ানক জুটি কখনো সম্ভব? শার্লক-ওয়াটসন, ব্যাটম্যান-গর্ডন; একজন ব্রেইন হলে অন্যজন তার মাসল। কেউ কারও চেয়ে কম নন, বরং একে অপরের পরিপূরক। ডক্টর জন ওয়াটসন ছাড়া যেমন শার্লক হোমসকে চিন্তা করা যায় না, তেমনি নন্টেকে ছাড়া ফন্টেকে। একটা জুটি এমন করেই মানুষের মনে বিঁধে থাকে, ইতিহাসে লেখা হয়ে থাকে, যেখানে একজনের নাম বললে অন্যজনের নাম উঠে আসতে বাধ্য। ফুটবলের এমন কিছু বিখ্যাত জুটির গল্প বলব আজ।


ফ্রাঙ্কো বারেসি-পাওলো মালদিনি:

মালদিনি-বারেসি
মালদিনি-বারেসি

ফুটবল এমন একটা খেলা, যেখানে গোল করা যেমন শিল্প, তেমনই গোল আটকানোও একটা শিল্প। বলা হয়, ‘ডিফেন্স ইজ দ্য পিউরেস্ট ফর্ম অব আর্ট’। ডিফেন্স শক্ত থাকলে তা দিয়ে যেকোনো অবস্থাতেই জিতে আসা সম্ভব। 
বারেসি-মালদিনি ছিলেন আরিগো সাচ্চির সোনার ডিম পাড়া হাঁস। ফুটবলের বহু বিখ্যাত দলের মধ্যে আরিগো সাচ্চির ‘দ্য ইমরটালস’ একটু অন্যভাবে গেঁথে আছে মানুষের মনে। যেখানে বেশির ভাগ ইতিহাস সৃষ্টিকারী দলের আক্রমণভাগের নামডাক বেশি, সেখানে মিলানের এই দলের নামডাক ডিফেন্সের হবেই–বা না কেন? এসি মিলানের ‘ইয়ুথ সিস্টেম’ থেকে উঠে আসা দুই তারকার বন্ধন এমনই অটুট ছিল যে গোলরক্ষক চাইলে মাঠের মধ্যে ঘুমিয়েও নিতে পারতেন। 
এই দুজনে জুটি গড়ে ৬ বছরে জিতেছেন মোট ১৬ ট্রফি, আর সে জন্য মিলানের জালে কয়বার বল জড়িয়েছে? মাত্র ২৩ বার। ১৯৯০ থেকে ’৯৪, চার বছরে ১৩৬ ম্যাচ খেলে হেরেছেন মাত্র ১১ ম্যাচে। এমনকি ৩০ ম্যাচে মাত্র ৪৩ গোল করে লিগ শিরোপা জেতার স্বাদ পেয়েছিল এসি মিলান। মিলান নামের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে পাওলো মালদিনি আর ফ্রাঙ্কো বারেসি নাম দুটো। যে কারণে অবসর নেওয়ার পর তাঁদের ‘৩’ ও ‘৬’ নম্বর জার্সি দুটো আজীবনের মতো তুলে রেখেছে এসি মিলান। 

ডেনিস বার্গক্যাম্প-থিয়েরি অঁরি

বার্গক্যাম্প-অঁরি
বার্গক্যাম্প-অঁরি


আর্সেনাল বললেই রাশভারী ক্যারেক্টার আর্সেন ওয়েঙ্গারের কথা মনে পড়তে বাধ্য। ২২ বছর আর্সেনালের কোচের পদে আসীন হয়ে আর্সেন আর আর্সেনালকে এক করে ফেলেছিলেন। আর্সেনালের কোট পরে দ্য ইনভেন্সিবলসের অসামান্য এক রেকর্ড করেছিলেন ওয়েঙ্গার, ২০০৩-০৪ মৌসুমে কোনো ম্যাচ না হেরেই ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন ওয়েঙ্গার। সেবার শুধু ইতিহাস সৃষ্টিকারী দল নয় বরং ইতিহাসে লিখে রাখার মতো এক জুটি গড়েছিলেন তিনি; দ্য বার্গক্যাম্প-অঁরি জুটি!

আর্সেন ওয়েঙ্গার আর্সেনালে এসেই পেয়েছিলেন বার্গক্যাম্পকে। ভঙ্গুর আর্সেনাল রাজ্যের বারুদহীন কামান ছিলেন বার্গক্যাম্প। আয়াক্স-ইন্টার ঘুরে এলেও কাজে এসেছিল শূন্য। পুরো দলের ভার যখন কাঁধে চাপিয়েছেন, ইতালি-হল্যান্ড কাঁপানো স্ট্রাইকারকেও তখন তালে ফেরালেন আর্সেন। ১৯৯৯ সালে ইতালি থেকে নিয়ে এলেন তরুণ থিয়েরি অঁরিকে। মার্সেলো লিপ্পির অধীনে হিমশিম খাওয়া তরুণ আর পোড়–খাওয়া স্ট্রাইকার নিয়ে গড়ে তুললেন প্রিমিয়ার লিগের ভীতিজাগানিয়া এক স্ট্রাইক ফোর্স। 

আর্সেনালের সামনে বড় প্রতিপক্ষ ছিল স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। ‘ক্লাস অব নাইন্টি টু’ নিয়ে স্যার অ্যালেক্স তখন বহাল তবিয়তে। কিন্তু সে রাজ্যে ওয়েঙ্গার হানা দিয়েছিলেন এদের নিয়ে। অন্য জুটি থেকে এ জুটির পার্থক্য হলো গোল করা আর বানানোয়। এ জুটিতে একজন আরেকজনের ওপর নির্ভরশীল নয় বরং দুজনেই সমান পারদর্শী ছিলেন বল বানানো আর জাল জড়ানোতে। যে কারণে সমসাময়িক যেকোনো জুটির থেকে ভয়ংকর ছিলেন দুজনে। ৭ বছরে এ জুটি প্রতিপক্ষের জালে বল জড়িয়েছে ২০০ বার, আর অ্যাসিস্ট ১১৯টি। প্রিমিয়ার লিগ রাজত্ব করা জুটির শিরোপাসংখ্যা মাত্র ৮, চ্যাম্পিয়নস লিগ ছুঁই–ছুঁই করেও ফেরত আসতে হয়েছে তাঁদের। কিন্তু ইংলিশ ফুটবলে তাঁদের মতো প্রভাব বিস্তার করা জুটি খুব কমই আছে।

আলফ্রেডো ডি স্টেফানো-ফেরেঙ্ক পুসকাস

ডি স্টেফানো-পুসকাস
ডি স্টেফানো-পুসকাস

কথায় আছে ইতিহাস, রেকর্ডের জন্ম হয় ভাঙার জন্য। নতুন করে লেখার জন্য। কিন্তু যাঁরা প্রথমবার ইতিহাস লেখেন, তাঁদের গল্পটা কেমন? স্টেফানো-পুসকাস জুটির গল্পটা ইতিহাসে প্রথমবার লেখার মতোই একটা জুটি। রিয়াল মাদ্রিদের রয়্যাল মাদ্রিদ হয়ে ওঠার সূচনা হয়েছিল এ দুজনের হাত ধরে। 
অথচ কম জল ঘোলা হয়নি দুজনের রিয়াল মাদ্রিদে আসা নিয়ে। আলফ্রেডো ডি স্টেফানোকে আনতে যেতে হয়েছিল আদালত পর্যন্ত, আর ফেরেঙ্ক পুসকাসকে আনার কথাবার্তা চলাকালেই দুই বছরের জন্য তাঁকে ব্যান করেছিল উয়েফা। দুই বছর পর যখন পুসকাস ফিরলেন, তখন কেউই আর তাঁর জন্য অপেক্ষা করেনি। সে সুযোগে রিয়ালে যোগ দেন পুসকাস, আর সূচনা হয় বিশ্বকাঁপানো এ জুটির। 
পুসকাস আসার আগে থেকেই চ্যাম্পিয়নস লিগে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার শুরু করেছিল রিয়াল, দুই বছরের জন্য ফুটবল থেকে দূরে না থাকতে হলে হয়তো সে পথের সাথি হতে পারতেন পুসকাসও। কিন্তু ৩১ বছর বয়সে রিয়ালে যোগ দিয়ে জুটি গড়েন ৩২ বছর বয়সী স্টেফানোর সঙ্গে। পুসকাস সব আলো কেড়ে নেন চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে, স্টেফানোর হ্যাটট্রিক চাপা পড়ে যায় তাঁর ৪ গোলের নিচে। ফাইনালে ৭ গোল দেওয়া রিয়ালের দল সম্পর্কে আর বেশি কিছু বলার প্রয়োজন পড়ে না। পুসকাস আর স্টেফানো মিলে জিতেছেন দুই চ্যাম্পিয়নস লিগ, টানা চার বছর লা লিগা। সেই সময়ে মাত্র ৬ বছরে জুটি গড়ে করেছেন ৩৬৩ গোল। 


ইয়ান রাশকেনি ডালগিশ

রাশ-ডালগিশ
রাশ-ডালগিশ


ইয়ান রাশ একের পর এক গোল করতেন, আর তাঁর পেছনের কারিগর থাকতেন কেনি ডালগিশ। ইংলিশ ফুটবলের আশির দশকের শেষটা এভাবেই লেখা হয়েছিল, ইয়ান-কেনি জুটি দিয়ে। তাঁদের জুটির গল্পটা শুধু দুজন খেলোয়াড়ের গল্প নয়, বরং খেলোয়াড় কোচ জুটির গল্পও।
ইয়ান রাশ ক্যারিয়ার শুরু করার আগে থেকেই লিভারপুলের স্ট্রাইকিং পজিশনে রাজত্ব করেছেন কেনি ডালগিশ। ১৯ বছর বয়সী ইয়ান রাশের জন্য তাই পথটা সোজা ছিল না, বরং বন্ধুর পথে বন্ধু পেয়েছিলেন ডালগিশকে। বলা বাহুল্য, ইয়ান রাশ লিভারপুলে এসেছিল ডালগিশের ইনজুরির সুবাদে। ইনজুরি থেকে ফিরলেই বেঞ্চ গরম করতে হবে, এই শর্তে রাজিও হয়েছিলেন। কিন্তু ডালগিশ ফেরার পর দেখা গেল উল্টো গল্প। দুজনে আলাদা খেলার চেয়ে দুজনের জুটিটা বেশি কার্যকর। প্রথম ৭ বছরে দুজনে মিলে করেছিলেন মোট ২৭৮ গোল। এরপর জুভেন্টাসের জন্য দল ছাড়েন ইয়ান রাশ আর ডালগিশ হন লিভারপুলের প্লেয়ার-ম্যানেজার। যদিও এক মৌসুম পরে লিভারপুলে ফিরেছিলেন রাশ, কিন্তু দুজনের আর একত্রে খেলা হয়নি তেমন। শেষ ১৯৯০ সালে লিগ উইনিং ম্যাচে একত্রে দেখা গিয়েছিল রাশ-ডালগিশ জুটিকে। সেদিনে এই বিখ্যাত জুটির সঙ্গে সঙ্গে লিভারপুলকেও আর লিগ শিরোপা উঁচিয়ে ধরতেও দেখা যায়নি। 

রবার্তো কার্লোসকাফু:

কার্লোস-কাফু
কার্লোস-কাফু



অন্য সব জুটি থেকে এই জুটির গল্পটা একটু আলাদা, ফুটবলে খুব একটা মানুষকে কথা বলতে দেখা যায় না এই জুটি নিয়ে। কেনইবা বলবে, অন্য সব জুটির মতো একসঙ্গে এক জায়গায় খেলার সৌভাগ্য তাঁদের কখনোই হয়নি, তাঁদের পরিধিটা ছিল মাঠের দুই প্রান্তে, তবু দুই প্রান্তে থেকেই বিশ্বজয় করা জুটির কাফু–কার্লোস। 

কাফু কার্লোস কখনোই ক্লাবের জার্সিতে একসঙ্গে খেলেননি, তাঁদের পুরো জুটিটাই ছিল হলুদ জার্সিতে। দুজনের ফুটবলজগতে আগমন ঘটেছিল প্রায় একসঙ্গেই। ’৯৪ বিশ্বকাপজয়ী ব্রাজিল দলে কাফু জায়গা পেলেও শেষমুহূর্তে ছিটকে যান কার্লোস। কিন্তু বিশ্বকাপের পরেই রক্ষণের দুই পাশের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন দুজনে। তখনকার টেক্সটবুক ডিফেন্সে ডিফেন্ডার মানেই ছিল জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা। ডিফেন্ডারের সর্বোচ্চ দৌড় মাঝমাঠ পর্যন্ত। কিন্তু কাফু কার্লোস ছিলেন তার বিরোধী। ডিফেন্সই যে হতে পারে আক্রমণের প্রথম সূতিকাগার; তা দেখিয়েছিলেন কার্লোস আর কাফু। রক্ষণের পাশাপাশি আক্রমণেও তাই সমান অবদান রাখতেন তাঁরা দুজনে। 

সক্রেটিস-জিকো চলে যাওয়ার পর অনেক দিন ব্রাজিলে সেই মানের মিডফিল্ডার চোখে পড়েনি। সামনে থাকা ‘ট্রিপলডোি আর’//////-এর বল বানানোর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন কাফু-কার্লোস। দুজনের রেকর্ডবুকটাও তাই বেশ হিংসাজাগানিয়া। দুজনে মিলে বিশ্বকাপে পদক ছাড়া ফেরেননি। একবার জিতেছেন, একবার রানার্সআপ আরেকবার তৃতীয়। জিতেছেন কোপা আমেরিকা, কনফেডারেশনস কাপও। ২০০৬ বিশ্বকাপই ছিল তাঁদের শেষ একত্রে খেলা। তাঁদের হয়তো আর একত্রে দেখা যায়নি, কিন্তু তাঁদের পথ ধরে উঠে এসেছে হাজারো ওভারল্যাপিং ফুলব্যাক। এখনকার মার্সেলো, রবার্টসন, দানি আলভেস, ট্রেন্ট আলেকজান্ডার-আর্নল্ডদের আইডল যে তাঁরাই। 


ইয়োহান ক্রুইফ-ইয়োহান নেসকেন্স

ক্রুইফ-নেসকেন্স
ক্রুইফ-নেসকেন্স


নাটক সিনেমার মূল আকর্ষণ থাকে নায়ক-নায়িকারা। দর্শকদের চোখের পুরো আলো কেড়ে নেয় স্ক্রিনে জেঁকে বসে থাকা নায়ক–নায়িকা দুজনে। কিন্তু তাঁদের নাকের নিচ দিয়ে গল্পের প্রয়োজনে চলতে থাকে অন্য কারও গল্প। পাদপ্রদীপের আলোয় যার মুখ দেখানোর সুযোগ হয় না। সিনেমার জগতে সাইড নায়ক নামেই পরিচিত তারা। ব্যাটম্যানের পাশে থাকলে রবিনকে একটু নিষ্প্রভই লাগে, অথচ সপ্রতিভ রবিনের মূল্য কি কোনো অংশে কম? “টোটাল ফুটবল”-এর জনক বললে যেভাবে ইয়োহান ক্রুইফের নাম আসে, সেভাবেই আড়ালে থেকে যায় আরেক ইয়োহানের নাম। 

কোচ রিনাস মাইকেল যখন ফুটবলে নতুনত্ব আনতে ‘টোটাল ফুটবল’ শুরু করতে চাইলেন, তার ধারক–বাহক ছিলেন ক্রুইফ আর নেসকেন্স। ১৯৭০ সালে আয়াক্সে যোগ দেন নেসকেন্স, সেখান থেকেই শুরু হয় এই জুটির যাত্রা। নেসকেন্স ছিলেন ক্রুইফের প্রটেক্টর। নেসকেন্স যেখানে শেষ করতেন, সেখান থেকে শুরু করতেন ক্রুইফ। ক্রুইফ যেখানে মাঝমাঠের রাজা ছিলেন, সেখানে মাঝমাঠের সৈনিক ছিলেন নেসকেন্স। দুই ইয়োহানের পার্থক্য ছিল মূলত শক্তিমত্তায়। ক্রুইফ যেখানে ‘লেগ গেমে’ পারদর্শী সেখানে নেসকেন্স ছিলেন ‘থ্রিডি’ ডিফেন্ড, ড্রিবল আর ডিস্ট্রিবিউশন মাস্টার। ক্রুইফ বল হারানোমাত্র শুরু হতো নেসকেন্সের কাজ, আর ক্রুইফের কাছে বল পৌঁছালেই সমাপ্ত।

দুজনে মিলে যেখানে গেছেন, রাজত্ব করেছেন। নেদারল্যান্ডে জিতেছেন দুই লিগ, লিগ কাপ আর হ্যাটট্রিক ইউরোপিয়ান কাপ। জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন টানা দুই বিশ্বকাপ ফাইনাল। বার্সার হয়েও কোপা দেল রে আর ইউরোপার শিরোপা জিতেছেন দুজনে। প্রায় ১০ বছর খেলার পর একত্রে চলার পাট চুকে যায় দুজনের। সেখান থেকে আর কখনো দেখা যায়নি টোটাল ফুটবলের এই দুই মহারথীকে।