জাদুর আঙ্গুল

আমাদের খামারবাড়ির ঠিক পাশেরটার মালিক মিস্টার আর মিসেস গ্রেগ। তাঁদের দুটি সন্তান। দুটিই ছেলে। একজনের নাম ফিলিপ, আরেকজন উইলিয়াম। মাঝেমধ্যেই তাদের খামারে গিয়ে ওদের সঙ্গে খেলি আমি।

ভালো কথা, আমি কিন্তু মেয়ে। আর আমার বয়স মোটে আট বছর।

ফিলিপের বয়সও আট বছর।

উইলিয়াম আমাদের চেয়ে তিন বছরের বড়। ওর বয়স এগার।

কী বললে? ওহ, আচ্ছা ঠিক আছে। বুঝেছি, ওর বয়স এগারো বছর।

এই তো গত সপ্তাহে গ্রেগ পরিবারে খুবই মজার একটা ঘটনা ঘটল। সেই ঘটনাটাই যত দূর পারি তোমাদের বলব এখন।

অন্য যেকোনো কাজের চেয়ে শিকার করতেই বেশি পছন্দ করেন মিস্টার গ্রেগ আর তাঁর দুই ছেলে। প্রতি শনিবার সকাল হতে না-হতেই তারা বনের দিকে ছুটে যায়। তাদের হাতে থাকে বন্দুক। সেখানে কোন জন্তু বা পাখি পেলেই তাদের দিকে দুম দুম করে গুলি ছোড়ে। ফিলিপের বয়স মাত্র আট হলে কী হবে, ওরও নিজেরও একটা বন্দুক আছে।

পশুপাখি শিকার করা একেবারেই সহ্য করতে পারি না আমি। বিষয়টি কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। মানুষ শুধু মজা করার জন্য জন্তু-জানোয়ার মেরে ফেলছে—এটা কোনোভাবেই ভালো কাজ হতে পারে না বলেই আমার ধারণা। তাই আমি সব সময়ই ফিলিপ আর উইলিয়ামকে এ ধরনের কাজে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু তারা কেউই আমার কথায় কান দেয় না। উল্টো আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে।

একবার তো মিস্টার গ্রেগকেও এ বিষয়ে বলেছিলাম। কিন্তু আমার কথা শুনে তিনি এমন ভাব করে পাশ কাটিয়ে গেলেন, যেন সেখানে আমার কোনো অস্তিত্বই নেই।

তারপর এক শনিবার সকালের ঘটনা। সেদিনও ফিলিপ আর উইলিয়ামকে তাদের বাবার সঙ্গে বন থেকে বেরিয়ে আসতে দেখলাম। খুবই সুন্দর দেখতে একটা হরিণের বাচ্চা ধরাধরি করে আনছিল তারা তিনজন।

দৃশ্যটা দেখে খুব রাগ হলো আমার। তাদের উদ্দেশে চিত্কার করতে লাগলাম আমি।

কিন্তু পাজি ছেলে দুটি উল্টো আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসতে লাগল। ভেংচিও কাটল দুজন মিলে। আর মিস্টার গ্রেগ রাগী গলায় আমাকে বাড়ি গিয়ে নিজের চরকায় তেল দিতে বললেন।

এই ছিল সেদিনের ঘটনা। এরপরই হঠাত্ চোখের সামনে কেমন অদ্ভুত লাল রং দেখতে পেলাম আমি। নিজেকে থামানোর আগেই আমি এমন কিছু করলাম, যা আসলে মোটেও করা উচিত ছিল না। তাদের দিকে  তাক করে বসলাম জাদুর আঙুল।

হায়! হায়! মিসেস গ্রেগ সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। কিন্তু তাঁর দিকেও মনে মনে জাদুর আঙুল তাক করলাম। মানে হলো, গ্রেগ পরিবারের কেউই বাদ গেল না।

কয়েক মাস ধরেই নিজেকে বোঝাচ্ছিলাম, আর কারও দিকেই কখনো আমার জাদুর আঙুল তুলব না। আমার ক্লাস টিচার বুড়ি মিসেস উইন্টারের সঙ্গে ঘটা সেই বিচ্ছিরি ঘটনার পর থেকেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমি। আহারে! এখনো মিসেস উইন্টারের কথা ভাবলে দুঃখ হয়।

ঘটনাটা খুলেই বলি। হয়েছে কী, একদিন আমরা ক্লাসে বসে আছি। সেদিন আমাদের বানান শেখাচ্ছিলেন মিসেস উইন্টার। আমাকে বললেন, ‘অ্যাই মেয়ে, উঠে দাঁড়াও। ক্যাট বানান করো।’

‘এটা তো সোজা বানান। কে-এ-টি।’, আমি দ্রুত জবাব দিলাম।

‘গাধা মেয়ে কোথাকার!’, মিসেস উইন্টার বলে বসলেন।

‘আমি মোটেও গাধা মেয়ে নই!’, চিত্কার করে জবাব দিলাম আমি। ‘আমি খুবই লক্ষ্মী মেয়ে!’

‘এদিকে এসো। যাও, ওই কোনায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকো’—আদেশ করলেন মিসেস উইন্টার।

আর সহ্য হলো না, ভীষণ রাগ হলো আমার। আর সঙ্গে সঙ্গেই চোখের সামনে কেমন অদ্ভুত লাল রং দেখতে পেলাম। পলকেই মিসেস উইন্টারের দিকে উঠে গেল আমার জাদুর আঙুল। তারপর সঙ্গে সঙ্গেই...

আন্দাজ করো তো, কী হয়েছিল?

তার মুখ থেকে জুলফি বের হতে লাগল। সেই জুলফিগুলো ছিল লম্বা আর কালো কালো। একেবারে বিড়ালের মতো। তবে বিড়ালের চেয়ে একটু বড় সাইজের এই যা! জুলফিগুলো বড় হচ্ছিল খুবই তাড়াতাড়ি। কী হচ্ছে, সেটি নিয়ে আমরা একটু চিন্তাভাবনা করার আগেই সেগুলো তার কান ছাড়িয়ে গেল!

বলার অপেক্ষা রাখে না, এতে হো হো করে হাসতে শুরু করেছিল ক্লাসের সবাই। ঠিক তখন মিসেস উইন্টার অবাক হয়ে বললেন, ‘তোমরা কি দয়া করে একবার বলবে, এভাবে পাগলের মতো হাসার কী আছে?’

কথাটা বলেই পেছনের ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে ফিরলেন তিনি। তখন আমরা দেখলাম, তাঁর পেছনে একটা আস্ত লেজও গজিয়েছে! লেজটাও ছিল বিশাল আর ঝোপঝাড়ের মতো ঘন!

সেদিন এসবের পর কী হয়েছিল, সেটা আমি তোমাকে বলতে পারব না। কিন্তু তোমরা যদি জানতে চাও, মিসেস উইন্টার আগের মতো ভালো হয়ে গেছেন কি না, তাহলে তার উত্তর হচ্ছে, না। আসলে তিনি কখনোই আর আগের মতো হতে পারবেন না।

আরেকটি কথা হচ্ছে, ওই কাজটি কীভাবে করেছিলাম তা-ও বলতে পারব না আমি। কারণ, বিষয়টি আমি নিজেই জানি না ভালোমতো।

তবে আমি যখনই রেগে যাই আর চোখে লাল রং দেখি, তখনই এ ধরনের ঘটনা ঘটে...

সে সময় নিজের ভেতর বেশ তাপ অনুভব করি...

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমার ডান হাতের তর্জনীর মাথা খুব টন টন করে ওঠে...

তারপর হঠাত্ সেখান থেকে দুম করে একটা আলোর ঝলক বেরিয়ে যায়। খুবই দ্রুতগতিতে। অনেকটা বিদ্যুতের মতো।

যে মানুষটি আমাকে রাগিয়েছে, তার দিকেই লাফ দিয়ে ছুটে যায় সেটি...

ওই মানুষটির ওপর জাদুর আঙুলের ঝলক পড়ার পর ঘটতে শুরু করে এমন অদ্ভুত ঘটনা...

যা-ই হোক, এখন আমার জাদুর আঙুল পুরো গ্রেগ পরিবারের ওপর পড়েছে। এখন আর এটি ফিরিয়ে নেওয়ার কোনো উপায় নেই।

আমি এক দৌড়ে বাড়ি ফিরে এলাম। এবার কী অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে তার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।

বেশি অপেক্ষা করতে হলো না। বেশ দ্রুতই ঘটে গেল ঘটনাটা।

এখন তোমাদের বলতে পারি, কী ঘটেছে। কারণ পরদিন সকালে পুরো ঘটনা শুনলাম ফিলিপ আর উইলিয়ামের কাছে।

যেদিন আমি গ্রেগ পরিবারের ওপর জাদুর আঙুল তাক করেছিলাম, সেদিন বিকেলেও মিস্টার গ্রেগ, ফিলিপ আর উইলিয়াম আবারও শিকারে বেরিয়েছিল। এবার বুনো হাঁস শিকার করতে চাইছিল তারা। তাই হ্রদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল তিনজন।

প্রথম ঘণ্টাতেই দশটা পাখি শিকার করতে পেরেছিল তারা।

পরের ঘণ্টায় তারা শিকার করেছিল আরও ছয়টা পাখি।

‘আজকের দিনটা বেশ ভালো। এর মতো ভালো আর হয় না’—ভীষণ আনন্দে কেঁদে ফেলার মতো অবস্থা মিস্টার গ্রেগের।

কিছুক্ষণ পর আরও চারটি বুনো হাঁস উড়ে গেল তাদের মাথার ওপর দিয়ে। পাখিগুলো বেশ নিচু দিয়েই উড়ে যাচ্ছিল। গুলি ছুড়ে সহজেই তাদের মারা যাবে।

মুহূর্তেই তিনজনের বন্দুক থেকে ঠাস! ঠাস! ঠাস! শব্দে গুলি বের হলো।

তবে আশ্চর্য, গুলিগুলোর একটাও হাঁসগুলোর গায়ে লাগল না। তারা দিব্যি উড়ে চলে গেল।

‘কী ব্যাপার! একটা গুলিও লাগল না। ভারি মজার তো!’—মিস্টার গ্রেগ বলে উঠলেন।

সবাইকে অবাক করে দিয়ে এরপর চারটি হাঁস তাদের দিকে ঘুরে আসতে লাগল। একেবারে তাদের বন্দুকের দিকেই।

‘আরে! হাঁসগুলোর হলোটা কী’—বলেই আবারও গুলি ছুড়লেন মিস্টার গ্রেগ। তাঁর ছেলেরাও বাদ গেল না। কিন্তু এবারও হাঁসগুলোর গায়ে লাগাতে পারল না কেউই।

পরপর দুবার লক্ষ্যভেদ করতে না পেরে বেশ রেগেই গেলেন মিস্টার গ্রেগ। মুখ-চোখ লাল করে তিনি বললেন, ‘আলোর কারণে এমন হচ্ছে। চারদিকে বেশ অন্ধকার হয়ে গেছে। সে জন্যই ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না। চলো, বাড়ি ফেরা যাক।’

সুতরাং আগে শিকার করা ১৬টি পাখি হাতে নিয়ে তারা বাড়ির পথ ধরল।

তবে ওই চারটি হাঁস কিন্তু তাদের পিছু ছাড়ল না। তাদের কেন্দ্র করে মাথার ওপর দিয়ে উড়তে শুরু করল হাঁসগুলো। তিন শিকারি যে দিকে যায়, পাখিগুলোও সেদিকে যেতে লাগল। অবাক কাণ্ড!

বিষয়টি সহ্য করতে পারছিলেন না মিস্টার গ্রেগ। ‘এই, দূরে সরে যা!’, তিনি চিত্কার করে বললেন। সেই সঙ্গে কয়েকবার পাখিগুলোর দিকে গুলিও ছুড়লেন। কিন্তু এবারও ভাগ্য সহায় হলো না তাঁর। পাখির গায়ে একটা গুলিও লাগাতে পারলেন না তিনি।

তারা বাড়ি ফেরা পর্যন্ত পাখিগুলো তাদের মাথার ওপর চক্কর দিতে লাগল। কোনোভাবেই তাদের দূরে সরানো গেল না।

সেদিন রাতে ফিলিপ আর উইলিয়াম বিছানায় ঘুমাতে গেল। এরপর আগুন জ্বালানোর জন্য কিছু কাঠ আনতে ঘরের বাইরে গেলেন মিস্টার গ্রেগ। উঠান পেরোতেই মাথার ওপর বুনো হাঁসের ডাক শুনতে পেলেন তিনি।

খানিক দাঁড়িয়ে ওপরের দিকে তাকালেন তিনি। কিন্তু চারদিকে স্থির নিশ্চুপ রাত। গাছপালা আর পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে পাতলা ফিনফিনে চাঁদ উঁকি দিয়েছে। আকাশ ভরা অগুনতি জ্বলজ্বলে তারা। এর মধ্যেই হঠাত্ মাথার ওপর দিয়ে ডানা ঝাপটে কিছু উড়ে যাওয়ার শব্দ শুনলেন মিস্টার গ্রেগ। রাতের অন্ধকার ভেদ করেই চারটি হাঁসকে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে উড়ে যেতে দেখতে পেলেন তিনি। পাখিগুলো বারবার তাঁদের বাড়ির চারদিকে উড়ে বেড়াচ্ছিল।

আগুন জ্বালানোর কাঠের কথা ভুলে গেলেন মিস্টার গ্রেগ। দেরি না করে দ্রুতবেগে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেলেন তিনি। এবার একটু ভয়ও পেলেন। বিষয়টি মোটেই ভালো লাগল না তাঁর। তবে এ ব্যাপারে মিসেস গ্রেগকে কিছুই বললেন না। শুধু বললেন, ‘চলো, ঘুমাতে যাই। খুব ক্লান্ত লাগছে।’

এরপর আর কী, বিছানায় গিয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমাতে লাগলেন তাঁরা।

সকাল হতেই সবার আগে ঘুম ভেঙে গেল মিস্টার গ্রেগেরই। তিনি চোখ খুললেন। অভ্যাসমতো কয়টা বাজে তা দেখতে ঘড়ি নিতে হাত বাড়ালেন। কিন্তু হাত বের করতে পারলেন না। ‘ধুত্তোরি, হাত কোথায় গেল’—বলে উঠলেন মিস্টার গ্রেগ।

শুয়ে থেকেই বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত হলেন তিনি। একবার ভাবলেন, হাতটা কোনো কারণে আঘাত পেয়ে অবশ হয়ে গেছে নাকি?

তাই এবার আরেক হাত বের করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ওই হাতও বের করতে পারলেন না তিনি।

এবার ধড়মড় করে উঠে বসলেন মিস্টার গ্রেগ। ঠিক সে সময় প্রথমবারের মতো নিজের চেহারাটা দেখতে পেলেন তিনি!

কান ফাটানো এক চিত্কার দিয়ে তিনি বিছানা থেকে লাফিয়ে নামলেন।

তাঁর চিত্কারে ঘুম ভেঙে গেল মিসেস গ্রেগের। মেঝেতে মিস্টার গ্রেগকে দেখতে পেয়ে তিনিও কান ফাটানো চিত্কার জুড়ে দিলেন। কারণ, তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মিস্টার গ্রেগ তখন একটা বামন মানুষ। তাঁর উচ্চতা খুব বেশি হলে চেয়ারের সিটের সমান, এর চেয়ে বেশি নয়। আর তাঁর হাত দুটো, ওমা হাতের বদলে হাঁসের মতো দুটি পাখা!

‘কিন্তু...কিন্তু...কিন্তু...তোমার কী হয়েছে?’—ফুঁপিয়ে উঠলেন মিসেস গ্রেগ।

‘তুমি কি বলতে চাচ্ছ, আমাদের দুজনের কী হয়েছে!’ চেঁচিয়ে বললেন মিস্টার গ্রেগ।

এবার নিজের দিকে তাকালেন মিসেস গ্রেগ। তারপর তিনিও বিছানা থেকে লাফ দিলেন। চেহারা দেখার জন্য পড়িমরি করে আয়নার দিকে দৌড়ে গেলেন তিনি। কিন্তু আয়না দেখার মতো যথেষ্ট লম্বা ছিলেন না তিনি। মিস্টার গ্রেগের চেয়েও ছোট দেখাচ্ছিল তাঁকে। মিস্টার গ্রেগের মতো তাঁরও হাতের বদলে একজোড়া পাখা দেখা গেল।

‘ওহ! ওহ! ওহ! ওহ!’, ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন মিসেস গ্রেগ।

‘এটা নিশ্চয়ই কোনো ডাইনির কাজ!’—কেঁদে উঠলেন মিস্টার গ্রেগও। তারপর দুজনই নিজেদের ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে ঘরের চারদিকে দৌড়াতে লাগলেন।

এ ঘটনার এক মিনিট পরেই ফিলিপ আর উইলিয়ামের চিত্কার শোনা গেল। তাদের ক্ষেত্রেও দেখা গেল একই ঘটনা। হাতের জায়গা তাদেরও দুটি পাখা। তারাও খুদে মানুষ হয়ে গেছে। তাদের পাখাগুলোর আকার ছিল রবিন পাখির মতো।

‘মা! মা! মা!’, পাখির মতোই কিচিরমিচির করে উঠল ফিলিপ। ‘দেখো, মা, আমরা উড়তে পারছি!’, এ কথা বলেই বাতাসে উড়ে দেখাল দুই ভাই।

‘তাড়াতাড়ি নিচে নেমে এসো!’, উত্তেজিত হয়ে বললেন মিসেস গ্রেগ। ‘অনেক উঁচুতে উঠেছ তোমরা!...’, কিন্তু আর কিছু বলার আগেই জানালা দিয়ে বাইরে উড়ে গেল ফিলিপ আর উইলিয়াম।

মিস্টার আর মিসেস গ্রেগ দৌড়ে জানালার কাছে গিয়ে দুই ভাইকে খুঁজতে লাগলেন। খুদে দুই ভাই ততক্ষণে আকাশের বেশ উঁচুতে পাখা মেলে উড়ছে।

মিস্টার গ্রেগের দিকে ঘুরে মিসেস গ্রেগ বললেন, ‘তোমার কি মনে হয়, আমরাও ওদের মতো উড়তে পারব?’

‘কেন নয়’, মিস্টার গ্রেগ বললেন, ‘চলো, চেষ্টা করে দেখি।’

মিস্টার গ্রেগ ডানা ঝাপটাতে শুরু করলেন এবং তারপরই তিনি ওপরে উঠে গেলেন। মিসেস গ্রেগও একইভাবে স্বামীকে অনুসরণ করলেন।

‘হেল্প!’, কিন্তু ওপরে উঠতে গিয়ে ভয় পেয়ে চিত্কার জুড়ে দিলেন মিসেস গ্রেগ। ‘আমাকে বাঁচাও!’

‘ধুত্তোরি, ভয় পেয়ো না তো’—অভয় দিলেন মিস্টার গ্রেগ।

তাঁরাও জানালা দিয়ে ঘরের বাইরে উড়ে গেলেন। একসময় আকাশে উড়তে লাগলেন গ্রেগ দম্পতি। শিগগিরই তাঁরা ফিলিপ আর উইলিয়ামকে ধরে ফেললেন। একসঙ্গে আকাশে উড়ে বেড়াতে লাগল পুরো গ্রেগ পরিবার।

‘খুব মজার তাই না!’—আনন্দে উইলিয়াম বলল। ‘আকাশে ওড়ার সময় পাখিরা কী অনুভব করে সব সময় সেটি জানতে ইচ্ছে করত আমার।’

‘তোমার পাখা দুটি নিশ্চয় ক্লান্ত হয়ে যায়নি, গিয়েছে কি?’—মিসেস গ্রেগকে জিজ্ঞেস করলেন মিস্টার গ্রেগ।

‘মোটেও না। এভাবে আমি সারা জীবন উড়তে পারব!’—জবাব দিলেন মিসেস গ্রেগ।

‘সবাই নিচে ওইখানে তাকিয়ে দেখো!’—ফিলিপ বলল। ‘আমাদের বাগানে দেখো কে যেন হাঁটছে!’

তারা নিচে তাকিয়ে দেখে, নিচে তাদের বাগানে চারটি বিশাল আকৃতির বুনো হাঁস! মানুষের মতোই বড় দেখাচ্ছিল হাঁসগুলোকে। তাদের হাতগুলোও বিশাল আর লম্বা বলেই মনে হলো। পাখার বদলে ঠিক যেন মানুষের হাত।

হাঁসগুলো এক সারিতে হেঁটে গ্রেগদের বাড়ির দরজার দিকে যাচ্ছিল। হাতগুলো দুলিয়ে দুলিয়ে হাঁটছিল তারা। তাদের মুখ তোলা ছিল ওপরের দিকে।

‘এই থামো! এখান থেকে চলে যাও। এটা আমার বাড়ি!’—হাঁসগুলোর ওপর উড়তে উড়তে বললেন খুদে আকৃতির মিস্টার গ্রেগ।

হাঁসগুলো ওপরে তাকিয়ে প্যাকপ্যাক করে উঠল। প্রথম হাঁসটা এক হাত বাড়িয়ে বাড়ির দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। তাকে অনুসরণ করল বাকি হাঁসেরা। তারপর দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

গ্রেগ পরিবার উড়ে এসে একে একে নিচে নামল। দরজার পাশেই একটা দেয়ালে বসল তারা।

কাঁদতে শুরু করলেন মিসেস গ্রেগ। ‘হায়! হায় রে! ওরা আমাদের বাড়িঘর দখল করে ফেলল। এখন আমরা কী করব? কোথায় যাব!’, ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললেন মিসেস গ্রেগ।

কিছুক্ষণ পর ছেলে দুটোও কাঁদতে শুরু করল।

‘রাতের বেলা বিড়াল আর শিয়াল আমাদের খেয়ে ফেলবে!’—কাঁদতে কাঁদতে বলল ফিলিপ।

‘আমি নিজের বিছানায় ঘুমাতে চাই!’—কাঁদতে কাঁদতে বলল উইলিয়াম।

‘চুপ করো সবাই। এখন কান্নাকাটি করে কোনো লাভ নেই’—বললেন মিস্টার গ্রেগ। ‘এখন আমরা কী করব, সেটি কি তোমাদের বলেছি?’

‘কী?’, সবাই একসঙ্গে বলে উঠল।

মিস্টার গ্রেগ সবার দিকে একে একে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন, ‘এখন আমরা পাখির বাসা বানাব।’

‘পাখির বাসা!’—অবাক হয়ে বলল সবাই। ‘আমরা কি বানাতে পারব?’

‘পারতেই হবে। ঘুমানোর জন্য আমাদের একটা জায়গা তো লাগবে, নাকি! আমার সঙ্গে এসো সবাই’—মিস্টার গ্রেগ বললেন।

একটা লম্বা গাছের দিকে উড়ে যেতে লাগল তারা। গাছটির একেবারে মাথায় বাসা বানানোর জন্য জায়গা ঠিক করলেন মিস্টার গ্রেগ।

‘এখন আমাদের ডালপালা দরকার’—তিনি বললেন, ‘অনেক ছোট ছোট ডালপালা লাগবে। তোমরা নিচে গিয়ে ডালপালা খুঁজে নিয়ে এসো।’

‘কিন্তু আমাদের তো হাত নেই!’—ফিলিপ বলল।

‘তাহলে মুখে করে আনো।’—সমাধান দিলেন মিস্টার গ্রেগ।

মিসেস গ্রেগ আর ছেলেরা উড়ে নিচে নেমে গেল। কিছু পরে তারা ফিরে এল। তাদের মুখে অনেকগুলো ডালপালা ধরা।

ডালপালাগুলো নিয়ে বাসা তৈরি করতে শুরু করলেন মিস্টার গ্রেগ।

‘আরও ডালপালা লাগবে। আরও নিয়ে এসো’—কিছুক্ষণ পরই মিস্টার গ্রেগ বললেন।

আস্তে আস্তে বাসা তৈরি হতে লাগল। ডালপালাগুলো একের পর এক সাজানোর ব্যাপারে মিস্টার গ্রেগ বেশ দক্ষ বলেই মনে হলো।

অনেকক্ষণ ধরে বাসা বানানোর কাজ চলতেই লাগল। একসময় শেষ হলো কাজটা।

‘এবার দেখো’—পেছনে ঘুরে পরিবারের সদস্যদের বললেন মিস্টার গ্রেগ। নিজের কাজে নিজেই মুগ্ধ তিনি।

‘ওহ, কী সুন্দর!’, খুশি হয়ে উঠলেন মিসেস গ্রেগ। একটু এগিয়ে বাসায় গিয়ে বসে পড়লেন তিনি। ‘আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, যেকোনো সময় আমি একটা ডিম পাড়ব!’

পরিবারের অন্যরাও তাঁর পাশে এসে বসল।

‘জায়গাটা কত সুন্দর আর গরম!’—বলল উইলিয়াম।

‘এত ওপরে থাকাও বেশ মজার’—ফিলিপ বলল। ‘আমরা ছোট হতে পারি, কিন্তু এখানে কেউ আমাদের ক্ষতি করতে পারবে না।’

‘কিন্তু আমরা খাব কী?’, মিসেস গ্রেগ বললেন। ‘সারা দিন কিছুই খাইনি আমরা।’

‘ঠিক বলেছ’—মিস্টার গ্রেগ বললেন। ‘চলো, এখন আমাদের বাড়ির দিকে উড়ে যাই। কোনো খোলা জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পাজি হাঁসদের চোখ এড়িয়ে বিস্কিটের টিন নিয়ে আসি।’

‘ওহ্, না, ওই পাজি হতচ্ছাড়া হাঁসগুলো আমাদের ঠোকর মারবে!’, মিসেস গ্রেগ ভয়ার্ত গলায় বললেন।

‘আমরা সতর্ক থাকব’—অভয় দিলেন মিস্টার গ্রেগ। তারপর তারা একযোগে উড়তে শুরু করল।

কিন্তু নিজেদের বাড়িতে পৌঁছে সব জানালা আর দরজা বন্ধ দেখল তারা। ভেতরে ঢোকার কোনো উপায় নেই।

‘তাকিয়ে দেখো, বদমাশ হাঁসটা আমার স্টোভে রান্না করছে!’—রান্নাঘরের পাশ দিয়ে ওড়ার সময় আর্তনাদ করে উঠলেন মিসেস গ্রেগ। ‘সে এত সাহস পেল কোথায়!’

‘দেখো, আরেকজন আমার বিছানায় শুয়ে আছে!’—ওপরের একটা জানালার দিকে তাকিয়ে বলল উইলিয়াম।

‘আর ওখানে দেখো, আরেকজন আমার প্রিয় বন্দুকটা ধরে আছে!’—উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন মিস্টার গ্রেগ।

‘আরেকজন আমার ইলেকট্রিক ট্রেন নিয়ে খেলছে দেখো!’—কেঁদেই ফেলল ফিলিপ।

‘আমি পোকামাকড় খেতে পারব না। তার চেয়ে মরে যাব’—জানাল ফিলিপ।

‘কেঁচোও খেতে পারব না’—উইলিয়াম বলল।

মিসেস গ্রেগ দুই ছেলেকে নিজের পাখার নিচে টেনে এনে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, ‘চিন্তা করো না। আমি মাংসের কিমার মতো খুব সুন্দর করে কুচি কুচি করে কেটে দেব। তোমরা বুঝতেও পারবে না। মজাদার কেঁচো বার্গার আর সুস্বাদু পোকার বার্গার।’

‘না, কিছুতেই না!’, কেঁদে ফেলল উইলিয়াম।

‘কখনোই না!’—কাঁদল ফিলিপও।

‘ওহ্, সোনা! কাঁদে না, সোনা! দেখছই তো, ওরা আমাদের বাড়ি দখল করে নিয়েছে! ওটা ফিরে পাওয়ার কোনো উপায় নেই। তাহলে এখন আমরা কী খাব?’—বোঝানোর চেষ্টা করলেন মিসেস গ্রেগ।

‘বিরক্তিকর!’—বললেন মিস্টার গ্রেগ। ‘শুধু পাখা আছে বলেই আমাদের পাখির খাবার খেতে হবে, এর কোনো মানে নেই। তার বদলে আমরা আপেল খেতে পারি। আমাদের গাছে আপেলভর্তি। চলো, সেখানেই যাই!’

তারা আপেলগাছের দিকে উড়ে গেল।

কিন্তু তোমার যদি হাত না থাকে তাহলে একটা আপেল খাওয়া সোজা কম্ম নয়। যতবারই তুমি আপেলে দাঁত বসাতে যাবে, ততই দূরে সরে যাবে আপেল। তাই অনেক চেষ্টায় আপেলে খুব সামান্যই কামড় বসাতে পারলেন গ্রেগরা। এর মধ্যেই চারদিকে আঁধার নেমে এল। সবাই তাড়াহুড়ো করে নিজেদের নতুন বাসার দিকে উড়ে গেল। ঘুমানোর জন্য শুয়ে পড়ল তারা।

ঠিক সে সময় আমি বাড়িতে ফিরে হাতে টেলিফোন তুলে নিলাম। ফিলিপকে ফোন করার চেষ্টা করলাম। আসলে দেখতে চাচ্ছিলাম, ওদের পরিবার ঠিকঠাক আছে কি না।

‘হ্যালো’—এপাশ থেকে আমি বললাম।

‘প্যাক, প্যাক, প্যাক!’—টেলিফোনের ওপাশ থেকে একটা কণ্ঠ শোনা গেল।

‘কে বলছেন?’—আমি জিজ্ঞেস করলাম।

‘প্যাক, প্যাক, প্যাক!’

‘ফিলিপ, নাকি?’

‘প্যাক, প্যাক, প্যাক, প্যাক, প্যাক, প্যাক!’

‘ওহ, থামো!’—আমি বললাম।

এরপর হাস্যকর একটা গোলমাল শোনা গেল। মনে হলো যেন, একটা পাখি হাসছে।

আমি তাড়াতাড়ি টেলিফোন নামিয়ে রাখলাম।

‘ওহ্, আবারও জাদুর আঙুলের কাণ্ড!’, আমি চিত্কার করে উঠলাম। ‘আমার বন্ধুদের কী ক্ষতি করেছে জাদুর আঙুল?’

অবশেষে সকাল হলো। এর সঙ্গে উষ্ণ সূর্যটাকেও দেখা গেল।

‘সৌভাগ্য যে অবশেষে সবকিছু শেষ হলো! আর কখনো পাখির বাসায় ঘুমাতে চাই না আমি!’—মিসেস গ্রেগ এ কথা বলে একপাশে তাকালেন...

তারপরই ভয়ার্ত গলায় চিত্কার করে বললেন, ‘বাঁচাও! দেখো! ওই যে নিচে তাকাও!’

‘কী হয়েছে?’—মিস্টার গ্রেগ বললেন। ততক্ষণে তিনি উঠে দাঁড়িয়ে উঁকি দিলেন।

জীবনেও এতটা আশ্চর্য কখনো হননি তিনি।

আসলে ওই রাতে যখন মিস্টার আর মিসেস গ্রেগ, ফিলিপ আর উইলিয়াম গাছের উঁচু মগডালে ঘুমানোর চেষ্টা করছিল, তখন বিপুল বেগে এক ঝড় শুরু হয়েছিল। তাতে গাছটি এপাশ-ওপাশ প্রবলভাবে দুলতে শুরু করে। মিস্টার গ্রেগসহ সবাই ভয় পাচ্ছিল যে যেকোনো সময় তাদের বাসাটা নিচে পড়ে যাবে। এর মধ্যেই শুরু হলো বৃষ্টি। একটানা বৃষ্টি হতেই লাগল। বৃষ্টির পানি তাদের বাসার ভেতরেও ঢুকে পড়ল। ভিজেও গেল সবাই। সত্যিই রাতটা খুবই খুব বাজে ছিল তাদের জন্য!

ওদিকে গাছের ঠিক নিচেই চারটি বিশাল আকৃতির হাঁস লম্বা মানুষের মতো ভঙ্গি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের তিনজনের হাতে বন্দুক ধরা। এর একটি মিস্টার গ্রেগের বন্দুক। একটি ফিলিপের আর আরেকটি উইলিয়ামের বন্দুক। বন্দুকগুলো গ্রেগদের নতুন বাসার দিকেই তাক করা।

‘না! না! না!’—একসঙ্গে চিত্কার করে উঠলেন মিস্টার আর মিসেস গ্রেগ। ‘গুলি করো না! দয়া করে, আমাদের গুলি করো না!’

‘কেন নয়?’—একটা হাঁস জিজ্ঞেস করল। যে হাঁসটির হাতে কোনো বন্দুক ছিল না সেই হাঁসটিই বলল এ কথা। ‘তোমরা তো আমাদের সব সময়ই গুলি করতে!’

‘কিন্তু দুটো বিষয় তো আর এক নয়!’—মিস্টার গ্রেগ বললেন। ‘হাঁসদের গুলি করার অনুমতি তো আমাদের আছে!’

‘কে তোমাদের এই অনুমতি দিয়েছে?’—হাঁসটি এবার জিজ্ঞেস করল।

‘আমরা নিজেরাই নিজেদের এই অনুমতি দিয়েছি’—মিস্টার গ্রেগ বললেন।

‘চমত্কার। তাহলে এবার আমরা নিজেরা নিজেদের গুলি করার অনুমতি দিচ্ছি’—ব্যঙ্গ করে বলল হাঁসটি।

(সেই সময় মিস্টার গ্রেগের মুখটা একবার খুবই দেখতে ইচ্ছে করছিল।)

‘ওহ্, দয়া করো!’, কাকুতি-মিনতি করলেন মিসেস গ্রেগ। ‘আমার দুটি ছোট্ট শিশু আমাদের সঙ্গে এখানে আছে! আমার শিশুদের গুলি করো না!’

‘গতকাল তুমি আমার শিশুদের গুলি করেছিলে। তুমি আমার ছয়টি শিশুকে গুলি করেছ’—হাঁসটি জবাব দিল।

‘আমি আর কখনো করব না! কখনো না, কখনো না!’—কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন মিস্টার গ্রেগ।

‘সত্যি বলছ তো!’—হাঁসটি জিজ্ঞেস করল।

‘সত্যি বলছি!’—মিস্টার গ্রেগ বললেন। ‘যত দিন বেঁচে থাকব, আমি আর কখনো কোনো হাঁসকে গুলি করব না!’

‘এটুকু যথেষ্ট নয়! হরিণদের তাহলে কী হবে?’—হাঁসটি বলল।

‘তুমি যা বলবে আমি তাই করব। শুধু যদি তোমরা বন্দুকগুলো নামাও!’—আমি আর কখনো কোনো হাঁস বা কোনো হরিণ কিংবা অন্য কিছুকে গুলি করব না!’—কাঁদতে কাঁদতে বললেন মিস্টার গ্রেগ।

‘এ ব্যাপারে তুমি কথা দিচ্ছ?’—হাঁসটি যেন একটু নরম হলো।

‘অবশ্যই! আমি কথা দিচ্ছি!’—বললেন মিস্টার গ্রেগ।

‘তুমি কি তোমার বন্দুকগুলো ফেলে দেবে?’—জিজ্ঞেস করল হাঁসটি।

‘আমি বন্দুকগুলো ভেঙে কুটি কুটি করব! আমাকে আর আমার পরিবারের কাউকে আর তোমাদের ভয় পেতে হবে না’—মিস্টার গ্রেগ বললেন।

‘ঠিক আছে। এবার তোমরা নিচে নেমে আসতে পারো’—হাঁসটি বলল।

‘আর শোনো, বাসাটার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। প্রথমবার চেষ্টায় বেশ ভালো একটা বাসা বানিয়েছ তুমি।’

মিস্টার ও মিসেস গ্রেগ, ফিলিপ আর উইলিয়াম এবার তাদের বাসা থেকে লাফ দিয়ে বেরিয়ে এল। উড়তে উড়তে নিচে নামতে লাগল তারা।

ঠিক সেই মুহূর্তে হঠাত্ তাদের চোখে সবকিছু কেমন যেন কালো হয়ে গেল। চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না তারা। একই সঙ্গে একটা মজার অনুভূতিও হচ্ছিল তাদের। পাশাপাশি একটা ঝোড়ো হাওয়ার গর্জন শুনতে পাচ্ছিল গ্রেগ পরিবার। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের চোখের সামনে থেকে কালো উধাও হয়ে নীল রঙে পরিণত হলো। এরপর আস্তে আস্তে সবুজ, লাল, সোনালি রং দেখতে লাগল তারা। হঠাত্ তারা দেখতে পেল, চমত্কার উজ্জ্বল রোদে তারা নিজেদের বাড়ির পাশেই নিজেদের বাগানে দাঁড়িয়ে আছে। আর সবকিছু ঠিক আগের মতোই স্বাভাবিক হয়ে গেছে।

‘আরে! আমাদের পাখাগুলো অদৃশ্য হয়ে গেছে! আর আবারও আমাদের হাত ফিরে এসেছে!’—চিত্কার করে বলে উঠলেন মিস্টার গ্রেগ।

‘আর দেখো, এখন আমরা আর আগের মতো ছোট নই!’—হাসতে হাসতে বললেন মিসেস গ্রেগ। ‘ওহ্, কী যে খুশি লাগছে!’

ওদিকে ফিলিপ আর উইলিয়াম আনন্দে নাচতে শুরু করল।

ঠিক সে সময় তাদের মাথার ওপরে বুনো হাঁসের ডাক শোনা গেল। তারা মাথা তুলে ওপরে তাকিয়ে নীল আকাশে চারটি হাঁস দেখতে পেল। হাঁসগুলো ঘনিষ্ঠ হয়ে উড়ে বনের ভেতর হ্রদের দিকে উড়ে যাচ্ছিল।

এ ঘটনার প্রায় আধা ঘণ্টা পর গ্রেগদের বাগানের দিকে হাঁটতে লাগলাম আমি। দেখতে চাইছিলাম, ঘটনা কত দূর। আসলে সবচেয়ে খারাপটাই ঘটার আশঙ্কা করছিলাম আমি। ওদের বাড়ির গেটে থেমে আশ্চর্য হয়ে গেলাম। যা দেখলাম, তা এককথায় অবিশ্বাস্য।

উঠানের এক কোনায় মিস্টার গ্রেগ তাঁর তিনটি বন্দুকই বিশাল এক হাতুড়ি দিয়ে পেটাচ্ছেন।

আরেক কোনায় মিসেস গ্রেগ ছোট ছোট মাটির ঢিবির ওপর সুন্দর সব ফুল রাখছেন। পরে জেনেছি, আগের দিন মিস্টার গ্রেগদের বন্দুকের গুলিতে মারা যাওয়া হাঁসদের কবর ছিল ওই মাটির ঢিবিগুলো।

আর মাঝখানে দাঁড়িয়েছিল ফিলিপ আর উইলিয়াম। তাদের পাশেই তাদের বাবার জন্মানো সবচেয়ে ভালো মানের বার্লির বস্তা। দুই ভাইয়ের চারপাশে হাঁস, কবুতর, ঘুঘু, চড়ুই, রবিন, লার্কসহ আর আমার অজানা বিভিন্ন জাতের পাখি ঘিরে কিচিরমিচির করছিল। দুই ভাই চারদিকে মুঠোমুঠো বার্লি ছিটাচ্ছিল আর পাখিগুলো তাই খুঁটে খুঁটে খাচ্ছিল।

‘শুভ সকাল, মিস্টার গ্রেগ’—আমি বললাম।

মিস্টার গ্রেগ তাঁর হাতের হাতুড়িটি নামিয়ে রেখে আমার দিকে তাকালেন। ‘আমার নাম আর গ্রেগ নেই।’ তিনি বললেন। ‘আমার পাখি বন্ধুদের সম্মানে এখন আমার নাম গ্রেগ থেকে পরিবর্তন করে এগ রেখেছি।’

‘আর আমি মিসেস এগ’—বললেন মিসেস গ্রেগ।

‘কী হয়েছে আপনাদের?’—আমি জিজ্ঞেস করলাম। তাদের দেখে মনে হচ্ছিল, সবাই পাগল হয়ে গেছে। চারজনই।

এরপর ফিলিপ আর উইলিয়াম পুরো ঘটনাটাই খুলে বলল আমাকে। তাদের বলা শেষ হলে, উইলিয়াম বলল, ‘দেখো! ওখানে ছিল আমাদের বাসা! দেখতে পাচ্ছ? ওই যে ওই গাছের মগডালে! গতকাল রাতে ওখানেই ঘুমিয়েছিলাম আমরা!’

‘আমি নিজে হাতে বাসাটি বানিয়েছিলাম’—বেশ গর্বের সঙ্গে বললেন মিস্টার এগ।

‘তোমার বিশ্বাস না হলে আমাদের বাড়িতে গিয়ে বাথরুমে একবার উঁকি দিয়ে দেখো। সব কেমন নোংরা হয়ে আছে।’—বললেন মিসেস এগ।

‘ওরা বাথটাব পানি দিয়ে ভরে ফেলেছিল। নিশ্চয়ই সেখানে তারা সারারাত সাঁতার কেটেছে! ওদের গায়ের পালক সব জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে’—ফিলিপ বলল।

‘হাঁসেরা তো পানি পছন্দ করে। ওরা সুন্দর একটা সময় কাটাতে পেরেছে জেনে বেশ ভালো লাগছে’—মিস্টার এগ বললেন।

এ কথা বলতে না-বলতেই বনের ভেতরের হ্রদের দিক থেকে একটা জোরে শব্দ ভেসে এল।

‘কেউ মনে হয় গুলি করছে!’—আমি চিত্কার করে উঠলাম।

‘মনে হয় ওটা জিম কুপার’—মিস্টার এগ বললেন। ‘তিনি আর তাঁর তিন ছেলে। ওরা তো পাগলের মতো গুলি করে। পুরো কুপার পরিবারই তা-ই।’

হঠাত্ আমি চোখের সামনে লাল রং দেখতে পেলাম...

এরপরই আমার ভীষণ গরম লাগতে শুরু করল...

আর তারপরই আমার হাতের তর্জনীর মাথায় ভয়ংকরভাবে টনটন করে উঠল। নিজের ভেতরে একটা অদ্ভুত শক্তি অনুভব করতে লাগলাম আমি।

আমি পাই করে ঘুরে যতটা দ্রুত সম্ভব হ্রদের দিকে দৌড়াতে লাগলাম।

‘এই শুনছ!’—চিত্কার করে উঠলেন মিস্টার এগ। ‘কী হলো তোমার? কোথায় যাচ্ছ এভাবে?’

‘যাই, কুপারদের খুঁজে বের করি’—জবাব দিলাম আমি।

‘কিন্তু কেন?’

‘একটু অপেক্ষা করুন, দেখতে পাবেন!’—আমি বললাম। ‘কুপারদের আজ রাতে গাছের মগডালে পাখির বাসায় কাটাতে হবে। সব্বাইকে!’

(মূল গল্প: দ্য ম্যাজিক ফিঙ্গার - রোয়াল্ড ডাল)

অলংকরণ: মাহাতাব রশীদ