আয়নাকথন

অলংকরণ: মামুন হোসাইন
অলংকরণ: মামুন হোসাইন

একটা ইলেকট্রিকের তারের ওপর কতগুলো শালিক পাখি বসে ছিল। কয়টা শালিক পাখি? তারান্নুম গুনতে শুরু করে, ‘এক, দুই, চার, ছয়, আট, নয়!’ তার মনটা অসম্ভব খারাপ। পাখি হয়ে জন্মালেই হয়তো ভালো হতো! উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়ানো যেত। পাখিদেরও কি তার মতো মন খারাপ হয়?

স্কুলবাসে করে ফিরতে ফিরতে প্রায়ই ভাবে তারান্নুম, তার সঙ্গেই কেন এমন হয়? অঙ্ক পরীক্ষার দিনের কথাই ধরা যাক। রুম্পা কী একটা বীজগণিতের অঙ্কে গোল পাকিয়ে বসেছিল। না পেরে তারান্নুমকে ডাক দিল, ‘আমাকে একটু দেখাবি?’ তারান্নুম নিজেও সেই অঙ্ক করেনি, তাই ও পেছন ফিরে বলল, ‘আমি তো করিনি এখনো। করার সময় দেখাব।’ কথা শেষ হওয়ার আগেই মিজান স্যার ধমকে উঠলেন, ‘সারা বছর অঙ্ক না করে এখন এসেছ অন্যের থেকে দেখে অঙ্ক করতে? দাঁড়াও, ভালো করে দেখাচ্ছি!’ বলেই খাতাটা ঝট করে নিয়ে নিলেন। বিশ মিনিট পার না হলে খাতা দেবেন না। তারান্নুম চোখের পানি আটকে শক্ত হয়ে বসে ছিল। খাতা নিয়ে যাওয়ায় ক্লাস ফাইভপড়ুয়া কেউ কাঁদছে ব্যাপারটা খুবই হাস্যকর! ও পেছন ফিরে দেখে রুম্পা তখন অন্য একটা অঙ্ক একমনে করছে।

তার ভাগ্যটাই হয়তো এমন খারাপ। ক্লাসে একদল দুষ্টু মেয়ে আছে, এরা সারা দিন ওর পেছনে লেগে থাকে। এদের বিশ্বাস করা বেশ মুশকিল। একদিন ফারিহা খুব সহজ-সরল মুখ করে এসে বলল, ‘তোর ইংলিশ হোমওয়ার্কের খাতাটা দিবি? আমার করা শেষে জমা দিয়ে দেব।’ তারান্নুম কথা না বাড়িয়ে দিয়ে দিল। একটু পর হোমওয়ার্ক খাতা দেখতে গিয়ে স্যার ডাক দিলেন, ‘তারান্নুম?’ ও জড়সড় হয়ে দাঁড়াল। স্যার মুখটা খিঁচড়ে বললেন, ‘এত বানান ভুল। ক্লাস টুয়ের ছেলেমেয়েরাও এর চেয়ে কম ভুল করে!’ খাতাটা ফেরত পেতেই তারান্নুম চোখ বুলিয়ে দেখে ব্যাপারটা কী। সবগুলো ‘ড়’-কে কেউ একজন দাগ দিয়ে ‘ধ’- বানিয়ে দিয়েছে। কে করেছে বুঝতে দেরি হলো না ওর। চোখ পড়তেই দেখল ফারিহা মিটমিটিয়ে হাসছে। আরেক দিনের কথা না বললেই নয়। গানের ক্লাস থেকে ফিরছিল তারান্নুম। রাস্তায় একটা মধ্যবয়স্ক লোক এসে কান্নাকাটি করে টাকা চাইতে শুরু করল। দেখে খুব মায়া হলো। ব্যাগ থেকে পার্সটা বের করল টাকা দেওয়ার জন্য। কিছু বুঝে ওঠার আগেই পার্সটা নিয়ে লোকটা দিল দৌড়! এ রকম একটা ব্যাপারও যে ঘটতে পারে এটাই জানা ছিল না ওর। হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ও।

আচমকা ব্রেক কষল বাসটা। বাসার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। এখান থেকে রিকশা নিয়ে ফিরতে হবে। চিন্তাভাবনা ফেলে বাস থেকে নামল তারান্নুম।

‘এই রিকশা, যাবেন?’ তারান্নুম জানতে চাইল।

‘যামু,’ রিকশাওয়ালা যেন জানে সে কোথায় যাবে, এমনভাবে উত্তর দিল।

‘সুরুজ মিয়ার মোড়, কত?’ ভাড়া সব সময় ঠিক করে উঠতে হয়, এমনটাই শিখিয়েছেন বাবা। সেই অনুযায়ী ভাড়া জানতে চাইল।

‘দিয়েন যত ভাড়া ততই’, উদাস ভঙ্গিতে জবাব দেয় লোকটা।

‘আমি কিন্তু বিশ টাকা দিয়ে রেগুলার যাওয়া-আসা করি’, বুঝিয়ে বলে তারান্নুম। থামিয়ে দেয় রিকশাওয়ালা, ‘এত কথা কন ক্যা? উইঠা বসেন। পোলাপান লইয়া এই এক ভেজাল। কথা শুরু করলে থামায় না’, বিরক্ত হয়ে রাস্তায় থুতু ফেলে সে।

রিকশা চলতে শুরু করলে আবার ভাবতে শুরু করে তারান্নুম। মানুষকে আসলে বিশ্বাস করাই ঠিক না। যতই মানুষকে বিশ্বাস করে, প্রতিবারই সে ধরা খায়। আর করবে না কাউকে বিশ্বাস। আর ভাগ্যটাকে তো না-ই!

একটা গলির দিকে ঢুকতে খেয়াল হয় ওর, রিকশাটা কোন গলিতে এসেছে? এ গলি দিয়ে তো সে আসা-যাওয়া করে না। বাসার রাস্তাটা যে তার মুখস্থ। এ গলিটা একদম ফাঁকা। একটু সাহস নিয়ে গলায় জোর এনে জিজ্ঞেস করে, ‘এই যে, এই গলিটা দিয়ে আনলেন কেন? আপনি আগের মোড়ে নেন। এই গলি দিয়ে আমি যাব না।’ রিকশাওয়ালা কোনো কিছু যেন শুনতেই পায়নি। নিজ মনে চালাতে লাগল।

‘এই মামা, আপনি রিকশা থামান। আমি আপনার রিকশায় যাব না।’ ব্যাগের ভেতর পেনসিল কাটার একটা ছোট ছুরি আছে, সেটা হাতড়ে খুঁজতে থাকে তারান্নুম।

রিকশাওয়ালা রিকশার গতি বাড়িয়ে দিয়ে বলে উঠলেন, ‘কথা না কইয়া বইসা থাকেন। সুজা রাস্তায় কম সময়ে নিয়া যামু।’ তারান্নুম মনের ভয়টা দূর করে ধমকে ওঠে, ‘আমি তো বললাম আমি যাব না। আপনি থামান। আমি ভাড়া দিয়ে দিচ্ছি।’ রিকশাওয়ালা পেছন ফিরে প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে বলল, ‘কথা কইয়া মাথাডা ধরায় দিতাসেন। উফফ, পোলাপান মানুষ মানেই ভেজাল।’ এক লোক রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল তাকে ডাক দিল রিকশাওয়ালাটা, ‘এ ভাই, এই দিক দিয়া সুরুজ মিয়ার মোড় যাওন যায় তো?’ লোকটা হ্যা-সুচক মাথা নাড়তেই খেঁকিয়ে উঠল সে, ‘এই মাইয়া বিশ্বাসই করে না। পোলাপান মানেই ভেজাল, কী কন?’ লোকটা দাঁত বের করে হেসে বলল, ‘শুধু ভেজাল না ভাই, আজকালকার পোলাপান বড়ই সেয়ানা!’ তারান্নুম এত কথা শুনতে চায় না। এসব ছেলেধরাদের লোকই হতে পারে, সব হয়তো প্ল্যান করা। পত্রিকায় এমনটাই দেখা যায়। রিকশাওয়ালাটাকে দেখেই ওর সন্দেহ হয়েছিল। টাকা বের করে তারান্নুম শক্ত কণ্ঠে বলল, ‘ভাড়া নেন। রিকশা থামান।’ রিকশাওয়ালা মুখটা খিটমিটে করে বলল, ‘টাকার দিমাক দেখায়েন না। বলসি নিয়া যামু। না, কথা কইলে বিশ্বাস করে না।’ রিকশাটা থামিয়ে সে ওর ব্যাগটা বরাবর থু মারল। ‘আপনার টাকায় আমি থু-ও মারি না।’ অসভ্য রিকশাওয়ালার কথা শুনে গা জ্বলে যাচ্ছিল তারান্নুমের। কথা না বাড়িয়ে ও হাঁটতে শুরু করল। একটু যেতেই ‘মা ফার্মেসি’ দেখে ও ‘যাক বাবা, বাঁচা গেল’ বলে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। এই গলি দিয়েও যে আসা যায় এত দিন ও জানতই না। ওর জানার পরিমাণটা এত ক্ষুদ্র, ভাবতেই আরও বেশি মন খারাপ হয়ে গেল তারান্নুমের।

বাসায় এসেও লাভ নেই। গল্প করার কেউ নেই। বাবা-মা দুজনেই তাঁদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তাঁদের দম ফেলারও সময় নেই।

হাত-মুখ ধুয়ে তারান্নুম গেল ব্যাগ পরিষ্কার করতে। অসভ্য লোকটার থুতু ধুয়ে ফেলতে হবে। ব্যাগটা হাতে নিয়েই চমকে উঠল ও। ব্যাগের চেইনটার কাছে থুতু ছিল, সেখানে একটা সুতোয় বাঁধা আয়না ঝুলছে! ব্যাপারটা কী?

‘ফ্যানটা অফ করেন, ঘর ঝাড়ু দিমু’। কাজের খালা রুমে ঢুকতেই আয়নাটা লুকিয়ে ফেলে তারান্নুম। খালা ঝাড়ু দিতে থাকেন একমনে। তখন ও আবার আয়নাটা হাতে নেয়। এবার যেন আরও অবাক হওয়ার পালা ছিল। আয়নাটায় ও স্পষ্ট দেখতে পেল, কাজের খালা টাকা সরাচ্ছেন ওর টেবিলের ওপর পড়ে থাকা পার্স থেকে। তারান্নুমের রুমে তিনি যখন তখনই আসেন। ও কখনো খেয়ালও করে না তিনি কী করেন। কাজের খালার দিকে তাকিয়ে দেখে, সে টেবিল গোছানোর ভান করে খুবই আড়ালে পার্স থেকে টাকা নিচ্ছেন। নিশ্চয়ই এমন কাজ তিনি আগেও করেছেন। এবার তারান্নুম হাসি আটকে বলল, ‘খালা, আপনি কী করেন?’ কথাটা শুনে তাঁর হাত থেকে পার্সটা পড়ে গেল। আমতা আমতা করে বললেন, ‘টেবিল গুছাইগো।’ কথা শেষে আবার ঝাড়ু দিতে লাগলেন।

‘ফাটাফাটি!’ মনে মনে আনন্দে একটা চিত্কার করল ও। একটা জাদুর আয়না পেয়ে গেছে! এটা কীভাবে কাজ করে সেটা দেখতে বাবার রুমে উঁকি দিল ও, ‘বাবা, কী করো?’ বাবা কিছু একটা বললেন, সেটা ঠিক শুনতে পেল না। আয়নার দিকে মনোযোগ তারান্নুমের। কিন্তু সেখানে তাকেই দেখা যাচ্ছিল।

হতাশ হয়ে সে মায়ের পাশে খানিকক্ষণ ঘুরঘুর করল। আয়নাটা তখনো কিছু দেখাচ্ছিল না। আরও হতাশ হয়ে ও টিভি ছেড়ে বসল। টিভি খুলে আবার আয়নাটার দিকে তাকিয়ে রইল। ব্যাপারটা কী? ও কি তখন ভুল দেখল? একটু থামতেই সে আয়নায় দেখতে পেল এক নেতা গাড়ি কিনছেন। ব্যাপারটা এত গোলমেলে যে ও কিছুই বুঝতে পারছিল না। ঠিক তখনই কানে এল, ‘আমাকে দেখেন। আমার নিজের কোনো গাড়িও নাই। আমি যা বেতন পাই, তা দিয়ে গাড়ির কথা চিন্তাও করতে পারি না। দেশের মানুষের টাকা মেরে তমুক দলের নেতা নতুন নতুন গাড়ি কিনেন। আমরা কি জানি না?’ কথাটা শুনে চোখ ফেরাতেই তারান্নুম আয়নায় দেখা নেতাকে আবিষ্কার করতে পারল। টিভিতে তাঁর বক্তৃতার অংশ শুনে আয়নায় তাঁর কর্মকাণ্ডের ছবি ভেসে উঠেছে। আয়নাটা হাতে নিয়ে তারান্নুম সাত-পাঁচ ভাবতে শুরু করল। বারাক ওবামার ছবির পাশে আয়নাটা রাখলেই কি আয়না তার কর্মকাণ্ড দেখাতে শুরু করবে? আয়না এসব দেখিয়ে কী বোঝাতে চায়? ভালো-মন্দ? সবকিছু গড়বড় লাগে ওর!

আয়না হাতে পায়চারি করতে থাকে তারান্নুম। ডাইনিংরুমের কাছে আসতেই শুনতে পায়, ‘হিন্দি সিরিয়াল আমার দুচোখের বিষ। আমি জীবনেও দেখি না’। কে কথা বলছে দেখতে উঁকি দিতে হয় না ওর। আয়নায় দেখতে পায় পাশের বাসার আন্টি হিন্দি সিরিয়াল দেখছেন।

মানুষের করা অন্যায়-অসংগতিগুলো দেখায় হয়তো আয়নাটা। একটু ভাবল ও। মনে মনে খুশি হয়ে গেল এই ভেবে যে তার আব্বু-আম্মু নেহাতই ভালো মানুষ। আয়নাটা তাই হয়তো কিছু দেখায়নি।

কালকে স্কুলে আয়নাটা নিয়ে যাবে ও। কে কেমন সব বুঝতে পারবে। তখন আর কাউকে বিশ্বাস করে ধরা খেতে হবে না তার। বেশ মজা হবে।

ঘুম ভাঙতেই বালিশের পাশে হাত দেয় তারান্নুম। কিছু পায় না ও। রাতে এখানেই রেখে ঘুমিয়েছিল। কিন্তু কোথায় আয়নাটা? ‘আম্মু...’। চিত্কার দেয় ও। প্রায় ছুটে আসে আম্মু। ‘কী হয়েছে?’ ভীত কণ্ঠে প্রশ্ন করেন তিনি।

‘আমার আয়না কই?’ কাঁদো কাঁদো কণ্ঠ তারান্নুমের।

‘কীসের আয়না, তারা?’ আম্মু অবাক।

‘আরে ওই যে, কোন মানুষটা কেমন যেই আয়নাটা দেখায়। আমি এখানেই রেখেছিলাম, এখন তো খুঁজে পাচ্ছি না। নিশ্চয়ই খালা চুরি করেছে’, অস্থির হয়ে বলতে থাকে তারান্নুম।

‘ছি! খালা শুনলে কত কষ্ট পাবেন। কী বলছ উল্টাপাল্টা?’ আম্মু বোঝাতে থাকেন।

‘আরে আমি নিজে দেখেছি উনি টাকা চুরি করেন। তুমি বুঝবে না। আমি একটা আয়না পেয়েছি।’, ঘটনা বলতে থাকে ও। আম্মু আর বাধা দেন না। এক নাগাড়ে বলে যায় তারান্নুম। ওর কথা শেষ হতেই আম্মু একটু চিন্তিত হওয়ার ভঙ্গি করে বলেন, ‘আয়নাটা থাকলে তুমি তো উইকিলিকসের মতো কিছু একটা হয়ে যেতে! মানুষের সব কুকর্ম ফাঁস করে দিতে পারতে, তাই না?

‘তুমি ঠাট্টা করছ?’ রাগ হয় ওর।

আম্মু এবার হাসি থামিয়ে বলেন, ‘যদি তুমি আয়নাটা পেয়ে হারিয়েও ফেলো, তাতেও মন খারাপ করার কিছু নাই। আয়না কি কখনো কে কেমন মানুষ বলতে পারে? সেটা তো নিজেকে বুঝে নিতে হয়। আর দশটা মানুষ যেমন আয়না ছাড়াই নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে বের করে কে কেমন, সেটা তো তোমাকেও শিখতে হবে। তাই না?’

তারান্নুম একটা কথাও বলে না। মন খারাপ করে উঠে পড়ে, স্কুলের জন্য তৈরি হতে।

স্কুলের বাস চলতে শুরু করে। ইলেকট্রিকের তারে অনেকগুলো শালিক বসা। তারান্নুমের মন খারাপ ভাবটা হঠাত্ই কেটে যায়। আয়নাটা হয়তো তার কল্পনা। কিন্তু, এটা তো ঠিক অনেক মানুষই আছে, যারা মুখে এক কথা বলে আর মনে অন্য কথা রাখে। মুখের কথায় এখন থেকে ও আর কাউকে বিশ্বাস করবে না। নিজের বুদ্ধি দিয়ে পরখ করে নেবে। নিজেকে আত্মবিশ্বাসী মনে হয় ওর। আয়নাটার আর দরকার নেই।