ঘরবন্দি ছুটি

অলংকরণ : আরাফাত করিম

কুয়াকাটা সাগর পাড়ে একটি বেঞ্চিতে শুয়ে আছি। শো শো বাতাস বইছে। মাথায় হ্যাট, চোখে সানগ্লাস আর হাতে কমলার জুস নিয়ে দেখছি সাগরের উন্মাদনা। চমৎকার এক অনুভূতি। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, হ্যাট-সানগ্লাস পরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমাকে পুরো বিষয়টা কল্পনা করে নিতে হচ্ছে। সং সেজে বসে থাকার কোনো মানে হয় না। এভাবে কি আর সমুদ্রসৈকতের মজা পাওয়া যায়?

এসএসসি পরীক্ষার পর লম্বা ছুটি পাওয়া যায়। কিন্তু এ সময়ে শিক্ষার্থীরা এখন লম্বা ছুটি কাটাচ্ছে। দেশজুড়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আমার এসএসসি পরীক্ষা–পরবর্তী ছুটিতে ছাই ফেলে দিয়েছে। সময় কাটাতে হচ্ছে ঘরে বসে। কত ইচ্ছা ছিল, এই ছুটিতে কুয়াকাটা গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে সমুদ্রস্নান করব। সমুদ্রস্নানের বদলে এখন বাথটাবের পানিতে লবণ মিশিয়ে গোসল করতে হচ্ছে। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাচ্ছি আর কি।

পরিকল্পনামাফিক এ সময় আমার পুরো দেশজুড়ে ঘুরে বেড়ানোর কথা। পরীক্ষার দুই মাস আগে থেকে প্ল্যান করছি কোথায় কোথায় ঘুরতে যাব। কক্সবাজার, সিলেট, কুয়াকাটা, কিশোরগঞ্জসহ আরও কত কত জায়গায় ঘুরব বলে প্ল্যান করে রেখেছিলাম। লঞ্চ ভ্রমণ, ভাসমান পেয়ারার বাজার দেখা, সমুদ্রসৈকত দেখা—সব প্ল্যান বাতিল। বিশাল এক ছুটি শুরু হওয়ার আগেই শেষ!

পৃথিবীর প্রায় সবাই এখন ঘরে বন্দী। তবে আমি ঘরবন্দী বছরের একদম শুরু থেকেই। এসএসসি পরীক্ষা শেষে দুই মাস ‘হোম কোয়ারেন্টিন’–এ থাকার পর একটু বের হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। কিছুদিন পরই আবার ঘরবন্দী। ‘হোম কোয়ারেন্টিন’ আমার কাছে পুরোনো জিনিস হয়ে গেছে। পরীক্ষার দিনগুলোতে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে পারিনি। তাই পরীক্ষা শেষে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা আর ঘোরাঘুরি করব—এমনটাই ভেবে রেখেছিলাম। কিন্তু এ অবস্থায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার একটাই উপায়, ভিডিও কল। ভিডিও করলে আড্ডায় কি আর বন্ধুদের মাথায় চাটি মারা যায়? পিঠে কিল দিয়ে বলা যায় ‘কী রে, কী অবস্থা?’ আড্ডা হচ্ছে, কিন্তু ঠিক জমছে না।

পরীক্ষার সময় ঘরে বসে থেকে আমার ওজন অনেকটা বেড়ে গিয়েছে। খুব শক্তভাবে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, এবার ওজন কমাবই। পরীক্ষা শেষে প্রতিদিন ভোরে রমনায় হাঁটতেও বেরিয়েছি। অল্প কয়েক দিন পরই আবার ঘরবন্দী হয়ে পড়েছি। পুরো পরিকল্পনা প্রায় বাতিলের পথে। এ দফায় ঘরে থেকে যে স্বাস্থ্যের কী হবে, তা কল্পনা করতে পারছি। যদিও মাঝেমধ্যে ঘরেই একটু একটু ব্যায়াম করার চেষ্টা করছি। মনে হচ্ছে না খুব একটা কাজ হচ্ছে। ঘরবন্দী থাকায় সাইকেলও চালাতে পারছি না। লম্বা ছুটিতে কয়েকটি রাইডে যাওয়ার খুব ইচ্ছা ছিল। প্রতিবছর স্বাধীনতা দিবসে ভোরবেলায় মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ থেকে বিশাল এক সাইকেল রাইড শুরু হয়। প্রতিবারের মতো এবারও খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু এ বছর স্বাধীনতা দিবস রাইডও বাতিল। 

লম্বা এ ছুটিতে বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে একটা সিনেমা বানাব বলে ঠিক করেছিলাম। এ কাজও কিছুটা আটকে গেল। তবে ঘরে বসে স্ক্রিপ্ট তৈরিসহ অন্যান্য কাজ করছি, যেন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই শুটিংয়ে নেমে পড়তে পারি।

সারা দিন ঘরে থাকার সবচেয়ে ভালো দিক হচ্ছে, প্রচুর বই পড়তে পারছি। পরীক্ষার ব্যস্ততায় না পড়া কয়েকটি বই জমে গিয়েছে। বইগুলো পড়ে ফেলছি এ সময়। বইমেলার শেষ সময়ে কেনা বইগুলোও পড়ছি। বাসার বিভিন্ন জায়গা খুঁজে খুঁজে কিছু পুরোনো বই পেয়েছি। সেগুলোও পড়ে শেষ করব।

ঘরে বসে অনলাইন কোর্সের মাধ্যমে নতুন দক্ষতা অর্জন করছি। শেখার চেষ্টা করছি নতুন ভাষা। সিনেমা দেখছি। প্রতিদিন বিকেলে ছাদে যাই। প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কটা শক্ত হচ্ছে। বারান্দার মাধবীলতাগাছটা একটু বেশি যত্ন পাচ্ছে। নিয়মমতো সকাল-সন্ধ্যা পানি দিই। শহরের দূষণ অনেকটা কমে গেছে। অনেক সতেজ হয়ে উঠেছে গাছটা। ফুল-পাতা সমান হারে বেড়ে চলেছে। আমার বারান্দা সবুজ হয়ে উঠছে।

কঠিন এ দিনগুলো শেষ হবে একদিন। এ শহর হয়ে উঠবে চিরচেনা ঢাকা। আবারও একদিন সাইকেল চালাব, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেব অথবা বেরিয়ে পড়ব কোথাও ঘুরতে।