যেভাবে কাটছে সময়...

ঘরে থাকার এই সময়টা কিশোর আলোর পাঠকেরা কে কীভাবে কাটাচ্ছে? সেটাই জানতে চেয়েছিলাম আমরা। অনেক লেখা এসেছে। নির্বাচিত কয়েকটি ছাপা হলো এখানে।

১.

বই পড়ি, ছবি আঁকি

করোনার ভয়ে বাইরে যাওয়া যাচ্ছে না। বাসায় বসে বিরক্ত হচ্ছি। কিন্তু বাসায় বসে আমি সঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছি গল্পের বই আর ছবি আঁকাকে। আমার ‘কিআ’ মার্চ সংখ্যাটি গত ১৭ তারিখের মধ্যে পড়া শেষ। তারপর আমি পড়া শুরু করেছি আমিরুল ইসলামের বৃষ্টি নিয়ে বিশটি গল্প বইটি। বইটি খুবই সুন্দর। কারণ, আমি বৃষ্টি খুব পছন্দ করি।

আমি ছবি আঁকতে পছন্দ করি। গ্রামাঞ্চলের বিস্তৃত সবুজ মাঠ, কৃষকের কৃষিকাজ ও নদীর পাড়ের মানুষের জীবনযাত্রা আমার খুবই পছন্দ। কিআতে পাঠানোর জন্য এ রকম একটি ছবিও এঁকেছি।

সবাইকে করোনাভাইরাস থেকে রক্ষার জন্য বিশেষজ্ঞ ও সরকারের নির্দেশনা যথার্থভাবে মেনে চলার জন্য বিনীত অনুরোধ করছি।

সারাফ নাওয়ার

ষষ্ঠ শ্রেণি, সিদ্ধেশ্বরী উচ্চবালিকা বিদ্যালয়

অলংকরণ : আরাফাত করিম
অলংকরণ : আরাফাত করিম

২.

শুরু করেছি মাঙ্গা আঁকা

৩১ মার্চ ২০২০। হোম কোয়ারেন্টিনের আজ চতুর্দশ দিন চলছে আমার। ১৪ দিন ধরে বাড়িতে। আমি শেষবার বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম ১৭ মার্চ আমাদের কিআ বুক ক্লাবের মাসিক সভার উদ্দেশে। তারপর রাতে টিভিতে দেখলাম আগামীকাল থেকে সব স্কুল বন্ধ। কোচিংয়ের ভাইয়া মেসেজ দিয়ে জানাল, কোচিংও বন্ধ, সঙ্গে প্রাইভেটও। তারপর থেকে শুরু হলো মজা। আমি আগে থেকেই আন্দাজ করেছিলাম এ রকম কিছু একটা হবে, তাই বন্ধুদের থেকে নিয়ে জমানো শুরু করে দিয়েছিলাম গল্পের বই। সঙ্গে জমিয়েছি কয়েকটা গেম আর অনেকগুলো অ্যানিমে, বিভিন্ন মুভি। এখন এগুলো নিয়েই দিন কাটছে। গল্পের বই পড়তে পারছি ইচ্ছেমতো, পাঠ্যবইয়ের পড়া কম পড়লেও আম্মি কিছু বলছে না, অ্যানিমে ও গেমের জন্য যথেষ্ট সময় পাচ্ছি, গ্রাফিকস ডিজাইনিং ও কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের জন্য সময় পেয়েছি, মাঙ্গা (জাপানিজ কমিকস) আঁকা শুরু করেছি। এরই সঙ্গে আবার নামাজ পড়া শুরু করে দিয়েছি। সবচেয়ে ভালো লাগার একটা বিষয় হলো, আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে দুপুরের খাবার খাচ্ছি। সবাই বাইরে যাওয়া নিয়ে আফসোস করলেও আমার মনে কোনো কষ্ট নেই। এত দিন পর একটা ছুটি পেয়েছি, যেখানে কোচিং আর প্রাইভেট নেই। কে জানে, এটাকেই হয়তো বলে আসল ছুটি, যেটা আমি অনেক দিন থেকে খুঁজে আসছি। প্রতিদিন স্কুল, কোচিং আর প্রাইভেটের জন্য বাড়ির বাইরে কাটিয়েছি প্রায় ১২ ঘণ্টা করে। তাই এখন চাই আমার বিছানাটায় গা ছেড়ে দিয়ে বই পড়তে। একটু বিশ্রাম নিতে!

মুনিফ মর্ত্তুজা

অষ্টম শ্রেণি, রংপুর জিলা স্কুল, রংপুর

৩.

ক্যালিগ্রাফিতে কাটছে সময়

বাংলাদেশের শিক্ষার ইতিহাসে আমরাই সবচেয়ে দুর্ভাগা ব্যাচ, যারা মাধ্যমিক পরীক্ষার পরবর্তী তিন মাসের বন্ধ কয়েদিদের মতো ঘরে বসে কাটাচ্ছি। বড় ভাই–আপুরা বলত, এই বন্ধে নাকি স্বর্গের সুখ পাওয়া যায়! এ রকম বন্ধ আর এই জীবনে কোনো দিন পাব না। জীবনের যত শখ–আহ্লাদ সব যেন এই তিন মাসেই মিটিয়ে ফেলি। তারপর ইন্টারের যুদ্ধ শুরু হলে আর চন্দ্র–সূর্যের মুখ দেখতে পাব না। আমরাও পরীক্ষার আগে পড়াশোনার প্রতি এতটাই অতিষ্ঠ বোধ করছিলাম যে পরীক্ষার চেয়ে বেশি চিন্তায় ছিলাম পরীক্ষার পরে কী করব তা নিয়ে। আব্বু সিঙ্গাপুর–থাইল্যান্ডের ভিসা আর টিকিট নিয়ে এসে আম্মু আর আমাকে চমকে দিল। ফ্লাইট ছিল ২০ মার্চ সকাল ১০টায়। তখন চীন ছাড়া অন্য কোথাও করোনা ছড়ায়নি। তাই এটা নিয়ে তেমন ভ্রুক্ষেপ করেনি কেউ। দিন যেতে লাগল। পরীক্ষা শেষ হলো। প্রতিদিন ইউটিউবে সিঙ্গাপুরের হোটেল, ম্যারিনা বের সুইমিংপুল, ব্যাংককের নাইট সিটি ট্যুর, ফুকেটের বিচ নিয়ে লেখা ব্লগ ঘাঁটি। কাছে–দূরে সব বন্ধুদের বাসায় এক দিন করে আড্ডা দেওয়ার রুটিন বানালাম। পড়াশোনার রুটিন বাস্তবায়িত না হলেও এটা ঠিকই হলো। কিন্তু এর মধ্যেই ব্রেকিং নিউজগুলোতে একে একে সারা বিশ্বে করোনা ছড়ানোর গুরুতর তথ্য সবাইকে ভয় পাইয়ে দিল। চীনের উহান থেকে ১৪টি দেশ, তারপর মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে শতাধিক দেশে ছড়িয়ে পড়ল করোনা। দ্বিতীয় সপ্তাহের শেষে একজন করোনায় আক্রান্ত হলেন। আম্মু ভয় পেয়ে আব্বুকে ফ্লাইট ক্যানসেল করতে বলল। টিকিট ক্যানসেল করল আব্বু। ভিসা–টিকিটের কোনো টাকাই ফেরত এল না। এদিকে ঢাকা শহর ফাঁকা হতে লাগল। শুরু হলো হোম কোয়ারেন্টিনে দিন গোনা। এসএসসির জন্য বুকশেলফের গোটা ত্রিশেক বই আমার না পড়া ছিল। বই আর মুভি দেখা চলতে লাগল সমানভাবে। ভাবলাম আরও কিছু করা দরকার। ভয়ে ভয়ে বাইরে বের হলাম। পাশের গলিতেই লাইব্রেরি ছিল। গোটা দশেক বিভিন্ন রঙের জেল পেন আর আর্ট পেপার এনে ঘরে ডুডল আর ক্যালিগ্রাফি শুরু করলাম। তিন–চার দিন টানা একই ছাঁচের কাজ করতে ভালো লাগছিল না। প্রতিবেশীর বাসা থেকে অ্যাক্রেলিক রং ধার করে এনে শুরু করলাম কন্সেপচুয়াল আর্ট। এদিকে আব্বুর অফিস ছুটি দিয়ে দিল। যেদিন ছুটি দিল, সেদিন আব্বু ক্যারম কিনে নিয়ে এল। এখন প্রতি রাতে এক গেম খেলা হয়। আব্বুর ক্যারমের হাত পাকা। তার হাতেই আমার ক্যারম খেলা শেখা। আম্মু আমাদের সঙ্গে কাজের ফাঁকে যোগ দেয়। সে স্ট্র্যাটেজি না মেনেই জোরে জোরে মারে, তাতেই আমাদের সবাইকে ছাড়িয়ে যায়। এর মধ্যেই আমি ১৫টি বই আর ২০টির বেশি সিনেমা দেখে ফেলেছি। কন্সেপচুয়াল আর্টগুলো মনমতো হচ্ছে না দেখে ছিঁড়ে ফেলে দিচ্ছি। প্রতিদিন নতুন ২০টি করে ইংরেজি শব্দ শিখছি। উইকিপিডিয়া থেকে ইতিহাস, দেশ ও আন্তর্জাতিক ঘটনা নিয়ে পড়ছি। প্রথম আলোর প্রতিদিনের সুডোকু আর শব্দের সমাধান তো আছেই! সব মিলিয়ে সময় কেটে যাচ্ছে। বন্ধুদের সঙ্গে সামনাসামনি আড্ডা দিতে পারছি না, তাই মেসেঞ্জারের ভিডিও কলেই তা সারতে হচ্ছে। এই পৃথিবীটা আবার একদিন সুন্দর হয়ে উঠবে, তখন আমরা সব বন্ধু মিলে রমনার ঘাসের ওপর বসে আড্ডা দেব, শিশু একাডেমির লাইব্রেরিতে বই পড়ব, শাড়ি পরে সরোবরে সব বন্ধুরা মিলে ছবি তুলব। একদিন এই পৃথিবীটার মতো আমরাও সব দূষণ আর বিষাদ থেকে মুক্তি পাব, এই আশা নিয়েই কেটে যাচ্ছে একেকটি দিন।

উম্মুল খয়ির ফাতিমা

এসএসসি পরীক্ষার্থী, ঢাকা

অলংকরণ : আরাফাত করিম
অলংকরণ : আরাফাত করিম

৪.   

বইয়ের দুনিয়ায় ডুব

চারদিকে করোনাভাইরাসের ভয়। আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। প্রয়োজন ব্যতীত বাইরে বেরোনো নিষেধ। জনজীবন হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়েছে। মানুষ নিজ ঘরে বন্দী হয়ে আছে। সবার মতো আমিও ঘরে বসেই দিন কাটাচ্ছি। নিয়মিত হাত ধোয়া ও মুখে হাত না দেওয়ার অভ্যাস করছি। মুখে হাত না লাগিয়ে থাকাটা বেশ অস্বস্তিকর! অবসর সময় বই পড়ে কাটাচ্ছি। বাসায় অনেকগুলো বই পড়ে ছিল। পড়ব পড়ব করে পড়া হচ্ছিল না।এখন হাতে অফুরন্ত সময়। করোনার আতঙ্ক ভুলে বইয়ের দুনিয়ায় ডুবে যাই আমি। ইউটিউব থেকে প্রোগ্রামিং শিখছি। সারাক্ষণ বাসায় থাকতে ভালো লাগে না বলে ছাদে গিয়ে সময় পার করি। দৈনন্দিন জীবনের ব্যস্ততা থেকে মুক্ত হয়ে শখের কাজ করে সময় পার করা তেমন মন্দ নয়।

মোঃ আহারার ইয়াসির

সপ্তম শ্রেণি, ধানমন্ডি গভ. বয়েজ হাইস্কুল, ঢাকা।