পোর্ট্রেট

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

কারওয়ান বাজারের দিকে গিয়েছিল মামুন। বিশেষ দরকারে। সবজির আড়তের একখানে দেখল জনসভা টাইপ ভিড় জমে আছে। ঘটনা কী? মাদক ব্যবসায়ী ধরা পড়েছে নাকি খুনখারাবির মতো কিছু ঘটেছে? বিচিত্র কিছু না। এলাকা ভয়ংকর। আরও ভয়ংকর কিছু ঘটাও সম্ভব। কথা হলো, ভিড় টানে মানুষকে। মামুন ভিড়ের অন্তর্গত হলো এবং বিচিত্র দৃশ্য দেখল। ছবি আঁকছেন একজন আর্টিস্ট। পোর্টে৶ট। সম্ভবত মধ্যবয়স্ক ডাবঅলা লোকটার। বিক্রিবাট্টা রেখে তার ডাবের গাড়ির সামনে দণ্ডবৎ হয়ে আছে লোকটা। ভিড় করে তা-ই দেখছে মানুষজন। বিস্ময়ের সঙ্গে দেখছে। দেখতে দেখতে এটা-ওটা মন্তব্যও করছে।
‘চউখ দুইটা পুরা মিলছে!’
‘নাকও মিলছে! যত্খ্যান চ্যাপটা তত্খ্যানই হইছে।’
‘ও মিয়া, হাসো না এটটু। হাসিমুখের ছবি না সোন্দর?’
‘হাসব কি, হের তো দাঁত নাই দুইটা।’
সমবেত হা! হা! হো! হো! হি! হি!
এমন অবস্থার মধ্যে ছবি আঁকা কঠিন। তবে এই আর্টিস্ট সাহেব মনে হয় অভ্যস্ত। এত ক্যাওসে তার কোনো রকম সমস্যা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। নিবিষ্ট মনে আঁকছেন।
ছবি তুলছে অনেকে মুঠোফোনের ক্যামেরায়। মামুনের ফোনসেটটা সস্তা। ক্যামেরা, ইন্টারনেটের কায়কারবার নেই। থাকলে সেও কি ছবি তুলত?
হাঁচি দিল মডেল। ডাবঅলা।
‘আরে! আরে! আরে! হাঁচি দেয় ক্যান? হাঁচি বন্ধ।’
হা। হা! হা!
হো! হো! হো!
মডেলও বিব্রত হয়ে হাসল।
মামুন এতক্ষণে তার সাবজেক্টের একটু কাছাকাছি হতে পারল। আর্টিস্ট সাহেবের। ব্রাউন পেপারে বাঁধাই ড্রয়িং খাতা, চাংহুয়া সিক্স-বি লেখা নীল উড পেনসিল, কাঁধে ঝোলা, সবুজ পাঞ্জাবি, খাকি রঙের প্যান্ট, চোখে চশমা। বয়স কত হবে আর্টিস্ট সাহেবের? পঞ্চাশ, বায়ান্ন? বিখ্যাত কোনো আর্টিস্ট? দিশু বলতে পারত এখন এখানে থাকলে। দুনিয়ার সব কবি, আর্টিস্ট, নাটকের লোকজন দিশুর বন্ধু। দিশু ক্রিটিক। বই এবং শিল্প সমালোচনা লেখে। কবিতা, পেইন্টিং, নাটক, সিনেমার।
আর্টিস্ট সাহেবের কাজ প্রায় শেষ। মন্তব্য চলছে।
‘পুর্রা মিলছে!’
‘হানড্রেড পারসেন্ট!’
জনগণের বিবেচনা আছে। যা বলছে ঠিক। পোর্টে৶ট হানড্রেড পারসেন্ট মিলেছে। মামুনও দেখল। জলজিয়ন্ত মনে হচ্ছে একদম।
আঁকা শেষ। আর্টিস্ট সাহেব খাতা-পেনসিল ঝোলায় রেখে উঠে দাঁড়ালেন। চশমা খুলে পাঞ্জাবির হাতায় চশমার কাচ মুছলেন। মাঝারি হাইটের মানুষটা। বিমর্ষ চেহারা। বিমর্ষ চোখে একবার জমায়েত দেখে মাথা নিচু করে হাঁটা ধরলেন। জমায়েতও ফাঁকা হয়ে গেল লহমায়। দেড়-দুই মিনিটের মাথায় মামুন খেয়াল করল, সে ফলো করছে আর্টিস্ট সাহেবকে। কেন?
আর্টিস্ট সাহেব ফিলিপস বিল্ডিংয়ের দিকে হাঁটছেন। বিমর্ষ, নিমগ্ন। এবং দ্রুত।
মামুন লম্বা। বকের ঠ্যাঙে হেঁটেও পারল না। মেইন রোডে পৌঁছে আর্টিস্ট সাহেব একটা বাসে উঠে পড়লেন। মাত্র সিগন্যাল ছেড়েছে। মামুনের নাকের ডগা দিয়ে আর্টিস্ট সাহেবকে নিয়ে চলে গেল ‘নিরিবিলি’। বাসের নাম ‘নিরিবিলি’! বাসের নাম ‘ইলিশ’ও আছে। চিন্তা করা যায়! বায়ান্ন সিটের ‘ইলিশ’।
ডাবঅলা লোকটার নাম জলফু। জলফু মাতবর। বয়স ছেচল্লিশ। চার দিন পর জানতে পারল মামুন। নিউজস্ট্যান্ডে আটকানো পত্রিকায় দেখে। ছবি দিয়ে নিউজ করেছে, কারওয়ান বাজারে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী খুন। চেনা একজন মানুষ খুন হয়ে গেছে, এ রকম মনে হলো মামুনের। আর্টিস্ট সাহেবের কথা মনে পড়ল। আর্টিস্ট সাহেব কি নিউজটা দেখেছেন?
মাস তিনেক পর হবে, মামুন আবার আর্টিস্ট সাহেবকে দেখল। বাস থেকে। মগবাজারে জ্যামে আটকে ছিল বাস। ফুটপাতে কিছু মানুষের জটলা। জানালার পাশে সিট বলে মামুন জটলার কারণও দেখল। সেই পাঞ্জাবি, সেই খাকি প্যান্ট, সেই ঝোলা। আর্টিস্ট সাহেব ফুটপাতে বসে এক পানবিড়িঅলার পোর্টে৶ট আঁকছেন। সেই নীল উড পেনসিল এবং সেই ব্রাউন পেপারে বাঁধাই খাতায়। বাস থেকে নেমে পড়ল মামুন। কথা বলবে আর্টিস্ট সাহেবের সঙ্গে।
কথা হলো জলজিয়ন্ত পানবিড়িঅলার মুখ আঁকা হওয়ার পর।
‘ভাই সাহেব?’
‘জি?’
‘আমি মামুন। আমি আগে একদিন আপনাকে দেখেছি। কারওয়ান বাজারে। আপনি এক ডাবঅলার একটা অসাধারণ পোর্টে৶ট করেছিলেন।’
‘অ।’
‘সেই ডাবঅলা খুন হয়ে গেছে, জানেন?’
‘অ।’
‘পত্রিকায় নিউজ হয়েছিল।’
‘অ, আমি পত্রিকা পড়ি না।’
মামুনকে আর সুযোগ দিলেন না বিমর্ষ আর্টিস্ট সাহেব। চশমা খুলে পাঞ্জাবির হাতায় চশমার কাচ মুছে রোড ক্রস করে চলে গেলেন। ডিভাইডারে দাঁড়িয়ে একবার ফিরে তাকালেন অপ্রত্যাশিতভাবে। মামুনকে দেখলেন?
দিশুর কবি-বন্ধু শিহাব নূর কড়া জর্দা দিয়ে পান খায়। তার সঙ্গে দেখা হতে পারে সন্ধ্যায়। পানবিড়িঅলার কাছ থেকে শিহাব নূরের জন্য দুই খিলি পান নিল মামুন। এটা-সেটা কিছু কথাও বলল। পানবিড়ির বাক্সে লেখা আছে, ‘সমেজ বেপারির মাতৃ পানভান্ডার’। মামুন বলল, ‘বেপারি ভাই?’
‘কিতা? বলেন?’
‘দ্যাশ কোথায় আপনার?’
‘ওই তো, কটার কোনো।’
‘কটার কোনো!’
‘জি অয়। থানা, মনু। জিলা কুলাউড়া।’
কটার কোনোর সমেজ বেপারি খুন হলো এর ১৩ দিন পর। তার বউটার আহাজারিসহ নিউজ ছাপা হলো পত্রিকায়। রোজ এ রকম কত খুন হচ্ছে। এই ঘটনা নিয়ে কোনো কথা হলো না, তবে আজিজ মার্কেটের সিঁড়িতে বসে মামুন আর্টিস্ট সাহেবের বর্ণনা দিল দিশুকে। সমেজ বেপারি হত্যাকাণ্ডের পরদিন সন্ধ্যায়। দিশু বলল, ‘পোর্টে৶ট আঁকে? মাসুক ভাই?’
‘মাসুক ভাই কে? মাসুক হেলাল? না। মাসুক হেলালকে আমি দেখেছি।’
তাহলে কে?
দিশু কিছু দিশা দিতে পারল না। মাসুক হেলাল ছাড়া এ রকম আর কাউকে চেনে না সে।
বিনা পয়সায় দিশু একটা উপদেশ খয়রাত করল মামুনকে, ‘মোবাইলে ক্যামেরা থাকা এ জন্য ভালো। ছবি তুলে রাখতে পারতি।’
‘ক্যামেরাঅলা মোবাইল কি তোর বাপ কিনে দেবে?’
পত্রিকায় খুনের নিউজ ছাপা হয় না এমন একটা দিনও কি যায়? আরও অনেক খুনের নিউজ পড়ল মামুন। স্কুলছাত্রী, কবি, ছাত্রনেতা, দরজি, মহল্লার মাস্তান, কত রকম মানুষ খুন হয় প্রতিদিন। গত সাত মাসেই দুই হাজার ছয় শ উনসত্তর জন মানুষ খুন হয়েছে দেশে। প্রতিদিন গড়ে তেরো জন করে। সিনসিটি হয়ে যাচ্ছে দেশ।
ভুলে গিয়েছিল কিংবা সেই আর্টিস্ট সাহেবকে আর দেখবে বলে ভাবেনি মামুন। দেখল। বছর খানেক পর। জারুল ফুল ফুটেছে পার্কে। সেই ফুল বা আর কিছু দেখতে পার্কে ঢুকেছিল সে। সেখানে আর্টিস্ট সাহেবকে দেখল। একটা জারুলগাছের নিচে বসে এক চা-উলি মেয়ের পোর্টে৶ট করছেন।
গোটা দশেক মানুষ অত্যন্ত কৌতূহল নিয়ে ব্যাপারটা দেখছে।
আর্টিস্ট সাহেবের কি পাঞ্জাবি একটাই? প্যান্ট একটাই? সেই একই রকম আছেন দেখতেও। বিমর্ষ। আঁকা শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন। চশমা খুলে পাঞ্জাবির হাতায় চশমার কাচ মুছলেন। মানুষজন হাঁটা দিল যে যার ফিকিরে। চা-উলি মেয়েটা বলল, ‘চা দিমু, মামা? রং চা?’
‘চা খাবেন?’
মামুন আর্টিস্ট সাহেবকে বলল।
প্রস্তাব নাকচ হলো, ‘না।’
‘এক কাপ দে...আপনি কি আমাকে চিনতে পেরেছেন?’
‘হ্যাঁ, আপনি মামুন সাহেব।’
‘ধন্যবাদ। আপনি কি জানেন মগবাজারের সমেজ বেপারি খুন হয়ে গেছে?’
‘সমেজ বেপারি? কে?’
‘মগবাজারের পানবিড়িঅলা। কারওয়ান বাজারের ডাবঅলার মতো এরও একটা পোর্টে৶ট করেছিলেন আপনি। বছর খানেক আগে।’
‘অ। কত মানুষ রোজ খুন হয়ে যায়।’
‘আপনি কে?’
‘মানে?’
‘মানে, কিছু মনে করবেন না। আর্টিস্টদের আমি খুব একটা চিনি-টিনি না। এ জন্য আপনাকে চিনতে পারছি না।’
‘আমি তেমন বিখ্যাত কেউ না।’
‘এত অদ্ভুত পোর্টে৶ট করেন আপনি। আপনার ফোন নম্বরটা কি...?’
‘না। স্যরি। অর্ডার দেবেন? অর্ডারের কাজ আমি করি না।’
‘অর্ডার না, মানে...।’

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

‘স্যরি।’
‘অ। আমার কার্ডটা কি রাখবেন কাইন্ডলি?’
‘কেন?’
কেন, কিছু বলল না মামুন। কার্ড বের করল হিপপকেট থেকে।
দিশু প্রিন্ট করিয়ে দিয়েছে কার্ডটা। মাগনা। সেল নম্বর আর মামুনের নাম লেখা শুধু।
আর্টিস্ট সাহেব দয়া করে কার্ডটা নিয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে, দেখা হবে।’ বলে মাথা নিচু করে হাঁটা দিলেন। মামুন বলল, ‘শোনেন।’
চা-উলি মেয়েটা বলল, ‘চা নেন, মামা।’
‘ও, হ্যাঁ।’
চা নিল মামুন। চায়ে এক চুমুক দিয়ে তাকিয়ে আর আর্টিস্ট সাহেবকে দেখল না। কোন দিকে চলে গেলেন মানুষটা?
‘চায়ে চিনি ঠিক আছে, মামা?’
হেসে ফেলল মামুন। রেডিমেড চা, তার আবার চিনি কম-বেশি।
‘হাসেন ক্যান, মামা?’
‘এমনি হাসি। তোর নাম কিরে?’
‘নিলুফার।’
নিলুফারের বয়স তেরো-চৌদ্দ হবে। পরীবাগ বস্তিতে থাকে। বাপ পঙ্গু। মা চলে গেছে আরেক বিয়ে করে। নিলুফার কখনো বিয়ে করবে না। সারা জীবন দেখে রাখবে পঙ্গু বাপকে। বলল। কিন্তু তা হলো না আর। কিছুদিন পর তাদের বস্তির ঘরেই নির্মম, নৃশংসভাবে খুন হলো নিলুফার। ঘটনার সময় তার বাপ ঘরে ছিল না। পঙ্গু হাসপাতালে গিয়েছিল। রাত আটটায় বস্তিতে ফিরে দেখে গলা কাটা লাশ হয়ে গেছে মেয়ে। নিউজস্ট্যান্ডের পত্রিকায় মামুন নিলুফারের ছবি দেখল এবং বক্স নিউজটা পড়ল।
এই শীতকালের এক রাতে। ঘুম ধরে গেছে, ঘুমিয়ে পড়বে, এই সময় ফোন বাজল মামুনের। আননোন নাম্বার। মামুন ধরল, ‘হ্যালো?’
‘মামুন সাহেব?’
‘বলছি। আপনি কে বলছেন, প্লিজ?’
‘আমি...।’ কী বলল বোঝা গেল না। নেটওয়ার্কে সমস্যা। মামুন পরের কথাটুকু শুনল, ‘আপনি কি কাল বাসায় থাকবেন? দুপুরের পর, বিকেলের দিকে?’
‘থাকব।’
‘দেখা হচ্ছে তাহলে।’
পরদিন বাসায় থাকতে পারল না মামুন। শীতকালের টাঙ্গুয়ার হাওর দেখতে সুনামগঞ্জ চলে গেল দিশুদের সঙ্গে। আট দিন পর ব্যাপক কুয়াশা, হাওর, পাখির উড়াল আর জোছনা মাথায় নিয়ে ফিরল।
রাতে জার্নি করে ফিরেছে। ফিরে আর ঘুম ধরেনি সকালে। ধরল দুপুরে। কতক্ষণ ঘুমাল? এক-দেড় ঘণ্টা? আরও ঘুমাত। ঘুম ভাঙল দরজায় টোকা দেওয়ার শব্দে। উঠে বিরক্ত হয়ে দরজা খুলল মামুন। বিস্ময়ে বিরক্তি থাকল না। আর্টিস্ট সাহেব! সেই খাকি প্যান্ট, সবুজ পাঞ্জাবি ইত্যাদি।
আর্টিস্ট সাহেব বললেন, ‘মামুন সাহেব?’
‘জি! জি, জি!’
‘নয় দিন আগে আমি আপনাকে ফোন করেছিলাম। রাতে। পরদিন আমার আসার কথা ছিল। এসেছিলাম।’
ইনিই তবে...? মামুন বিব্রত হয়ে বলল, ‘স্যরি। আমি হঠাৎ বাইরে চলে গিয়েছিলাম। আপনি ভেতরে এসে বসুন, প্লিজ।’
‘ধন্যবাদ।’
সোফা-চেয়ার নেই মামুনের ঘরে। ফ্লোরমেটে বসার ব্যবস্থা।
ঝোলা রেখে বসে আর্টিস্ট সাহেব বললেন, ‘জানতাম না তো। এই কয়দিন ধরে রোজ এই সময় একবার করে আপনার খোঁজ নিয়ে গেছি। দু-এক দিন দুই-তিনবারও।’
‘স্যরি। আমি স্যরি। আপনি একটা ফোন করলে পারতেন।’
‘তা পারতাম। কিন্তু বয়স হয়ে গেছে। আপনাকে ফোন করার পরদিনই ফোন থেকে সব নম্বর ডিলিট করে ফেলেছি। ভুল করে। কী যে মুশকিলে পড়েছি! খুব চেনা কেউ কল করলেও প্রথমে ধরতে পারি না। দুই-চার কথা বলার পর ধরতে পারি কে। আপনার কার্ডটাও কোথায় যে রেখেছি। কিছুতে পেলাম না।’
ক্লান্ত মনে হলো আর্টিস্ট সাহেবকে। এত কথা বলে ক্লান্ত। মামুন বলল, ‘স্যরি। আরেকটা কার্ড আমি আপনাকে দিচ্ছি।’
‘তার আর দরকার হবে না।’
‘জি?’
‘ফোন টাওয়ারের রেডিয়েশনে অনেক পাখি মরে যাচ্ছে, জানেন?’
কী কথা থেকে কী কথা!
মামুন বলল, ‘অ। কফি খাবেন?’
‘চিনি ছাড়া।’
মামুন কফি বানাতে উঠল।
আর্টিস্ট সাহেব ঝিম মেরে থাকলেন।
ধোঁয়া ওড়া কফি সহযোগে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা শুরু হলো আবার। আর্টিস্ট সাহেব ঝোলা থেকে তাঁর ড্রয়িং খাতাটা বের করলেন। কফি তাঁকে চাঙা করতে পারেনি। বিমর্ষ থাকলেন। ক্লান্ত গলায় বললেন, ‘এই খাতায় সাতচল্লিশজন মানুষের পোর্টে৶ট আছে।’
‘এরা সবাই খুন হয়ে গেছে?’ মামুন বলল।
আর্টিস্ট সাহেব বললেন, ‘জি।’
মামুন বলল, ‘কেন?’
‘আপনি জানেন। আর একটা পোর্টে৶ট আমি আঁকব। তাহলে এই খাতা শেষ হয়ে যাবে।’
‘এ রকম আরও খাতা আছে আপনার?’
‘জি।’
‘এই খাতার শেষ পোর্টে৶টটা কি আমার হতে যাচ্ছে?’
‘জি।’
‘আমি খুন হয়ে যাব?’
‘আপনি জানেন।’
‘জানি। কিন্তু এই ঘটনা কী করে ঘটে?’
‘বলতে পারব না। হঠাৎ এটা আমি আবিষ্কার করি। আট-নয়টা ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর। ধরতে পারি আমি কোনো মানুষের পোর্টে৶ট আঁকলেই মরে যায় সেই মানুষটা। অপঘাতে মরে, খুন হয়ে যায়।’
‘বিরত হলেন না কেন?’
‘বিরত হব? বিরত হব কেন? কী আশ্চর্য! এটা কি বিশেষ একটা ক্ষমতা না? এই ক্ষমতা পৃথিবীর আর কোনো মানুষের আছে?’
‘কিন্তু এটা অনিষ্টকর। আপনার অদ্ভুত ক্ষমতার কারণে কিছু মানুষ খুন হয়ে যাচ্ছে! আপনি দায় এড়াতে পারবেন না।’
‘দায় কিসের? খুনের? আমি কি একটা খুনও করেছি? প্রমাণ করা যাবে?’
‘না, প্রমাণ করা যাবে না।’
‘তাহলে?... আপনি এটা কী করে ধরলেন? আর কেউ না, একমাত্র আপনি।’
‘এ জন্য আপনি আমার পোর্টে৶টটা করতে চান?’
‘জি।’
‘আপনি আসলে কে?’
বিমর্ষ মানুষটা এই প্রথম অল্প হাসলেন, ‘আমি? বলতে পারেন, এনজেল অব ডেথ।’
‘অ।’
‘আমি কি এখন আপনার পোর্টে৶টটা ধরব?’
মামুন বলল, ‘ধরেন।’
ব্রাউন পেপারের মলাট। আর্টিস্ট সাহেব ড্রয়িং খাতাটা খুললেন। ঝোলা থেকে পেনসিল, ইরেজার নিলেন। শেষ পাতায় আঁকবেন মামুনের পোর্টে৶টটা। চশমা খুলে চোখ হাফসাইট করে একবার দেখলেন মামুনকে।
মামুন বলল, ‘আমি কীভাবে মরব?’
‘খুন। কেন?’
‘আপনি নিশ্চিত আর কিছু ঘটবে না?’
‘নিশ্চিত। প্লিজ!’
আর্টিস্ট সাহেব কতক্ষণ ধরে মামুনের পোর্টে৶টটা আঁকলেন? আধঘণ্টা? পৌনে এক ঘণ্টা? বিকেল ফুরিয়ে গেল এর মধ্যে। সন্ধ্যার রং ধরল আকাশে। মামুন এখন আর্টিস্ট সাহেবের খাতায়। জলজিয়ন্ত।
মামুন বলল, ‘শেষ?’
‘হুঁ।’
‘কফি?’
‘কষ্ট করবেন?’
‘কষ্ট কিছু না। লাইট জ্বালিয়ে দেব?’
‘না, থাক।’
‘কফি বানাই তবে।’
‘না, থাক।’
‘কেন? কী হয়েছে?’
সন্ধ্যার আবছা অন্ধকার ঘরে।
আর্টিস্ট সাহেবকে আরও বিমর্ষ দেখাল। কী হয়েছে? আর্টিস্ট সাহেব মামুনের পোর্টে৶টটা দেখছেন। মামুনের? ...না! ...এই ঘটনা কী করে ঘটল? এ সম্ভব? কী করে? কীভাবে? আরও বিমর্ষ এবং ফ্যাকাশে দেখাল আর্টিস্ট সাহেবকে। কেন নয়? এতক্ষণ ধরে, এত যত্ন করে আঁকা পোর্টে৶টটা... এটা মামুনের পোর্টে৶ট হয়নি... হয়েছে তাঁর...তাঁর সেলফ পোর্টে৶ট! জলজিয়ন্ত বিমর্ষ আত্মপ্রতিকৃতি।
মামুন কফি বানাতে যায়নি, দাঁড়িয়ে আছে, আবার বলল, ‘স্যরি, কী হয়েছে? পোর্টে৶ট মেলেনি?’
আর্টিস্ট সাহেব বিড়বিড় করে কিছু বললেন। কী বললেন, বোঝা গেল না।