শাহবাগে বৃষ্টি

অলংকরণ: নাবিদুর রহমান

সারা আকাশ মেঘে ঢাকা। বাতাস বন্ধ হয়ে গেছে। চারদিকে এমন গুমট, যেন ঢাকা মহানগর দম বন্ধ করে নিশ্চুপ হয়ে আছে।

শুধু বাতাসই বন্ধ হয়নি, যানবাহন চলাচলও বন্ধ। পশ্চিমে কাঁটাবন থেকে পুবে রমনা পার্ক পর্যন্ত সড়কটা একদম ফাঁকা। একই বিরান দৃশ্য দক্ষিণে টিএসসি থেকে উত্তরে ফার্মগেট পর্যন্ত। কোনো সড়কেই কোনো যানবাহন নেই। সড়কের দুই ধারে ফুটপাত দিয়ে যেসব লোক হেঁটে চলাচল করছিল, পুলিশের সদস্যরা তাদের থামিয়ে দিয়েছে। কারণ, এখন এই পথ দিয়ে একজন ভেরি ইমপরট্যান্ট পারসন যাবেন। মানে, তাঁর গাড়িবহর যাবে। পুলিশ মাঝেমধ্যেই জনতার উদ্দেশে বলে উঠছে, ‘ভিআইপি যাবে। অয়েট করেন।’

নিরুপায় দাঁড়িয়ে থাকা লোকদের মধ্যে যারা একটু বেয়াড়া ধরনের, যারা সমাজের ও রাষ্ট্রের নিয়মকানুন খুব একটা মানতে চায় না, যারা মনে করে একটুখানি জোর খাটালেই সবকিছু করা যায়, তারা রাস্তার এপার থেকে ওপারে যাওয়ার জন্য যে-ই না একটু নড়েচড়ে উঠছে, অমনি পুলিশের সদস্যরা বাঁশি বাজাতে বাজাতে, লাঠি উঁচিয়ে চিৎকার করতে করতে তেড়ে যাচ্ছে তাদের দিকে। বেয়াড়া লোকগুলো তখন অগত্যা থেমে যাচ্ছে, কেউ কেউ জিবের ডগা দিয়ে দাঁতের গোড়ায় ধাক্কা দিয়ে ‘ৎচু -চা’ শব্দ তুলে বিরক্তি প্রকাশ করছে।

এভাবে অনেকক্ষণ পেরিয়ে গেল। কিন্তু কিসের ভিআইপি, কিসের কী! কোনো গাড়িবহর দেখা গেল না। লোকজন অধৈর্য হয়ে হইহল্লা শুরু করে দিল। এ দেশে যখন অনেক লোক একসঙ্গে শোরগোল আরম্ভ করে, তখন পুলিশের সদস্যরা ধমকাধমকি আর হম্বিতম্বির পথ ছেড়ে ভদ্রভাবে কথা বলে তাদের শান্ত করার চেষ্টা করে। এবার তারা অধৈর্য জনতাকে সান্ত্বনা দিতে লাগল:

‘আর একটু ধৈর্য ধরেন। আর মাত্র পাঁচ মিনিট!’

আরও পাঁচ মিনিট পেরিয়ে গেল। ছয় মিনিট পেরিয়ে গেল, সাত মিনিট, আট মিনিট, দশ মিনিট। কিন্তু ভিআইপির নামগন্ধ নেই। পুলিশের সদস্যরা তবু ‘পাঁচ মিনিট! পাঁচ মিনিট!’ করেই চলল।

হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দে কোথাও বজ্রপাত হলো, সঙ্গে সঙ্গে বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়া শুরু হলো। সবাই ভীষণ অবাক হয়ে গেল, কারণ তারা দেখল যে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো কালো। আকাশ থেকে টপাটপ শব্দে ঝরে পড়ছে পানি নয়, যেন আলকাতরার বড় বড় ফোঁটা। প্রথমে ফাঁকা ফাঁকা হয়ে, তারপর ফোঁটাগুলো ক্রমেই ঘন হয়ে পড়তে লাগল। ঘন হতে হতে একপর্যায়ে এমনই ঘন হয়ে এল, যেন আকাশ থেকে গলগল করে নেমে আসছে আলকাতরার ঢল। যেন আলকাতরাভরা বিশাল একটা কড়াই কেউ উপুড় করে ধরেছে পৃথিবীর ওপর। ঢলের মতো নেমে আসা সেই আলকাতরায় ভিজতে ভিজতে ভূতের মতো কালো হয়ে গেল রাস্তার দুই পাশের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকা পথচারী লোকজন ও পুলিশের সদস্যরা। ভীষণ অবাক হয়ে গেল সবাই। অনেকে প্রচণ্ড

ভয়ও পেল। ভয় আর বিস্ময় মেশানো কণ্ঠে তারা বলাবলি করতে লাগল:

‘এইডা কী আরম্ভ হইল?’

‘ও আল্লাহ! বিষ্টির পানি কালা ক্যান?’

‘হায় হায়! মনে তো হয় অ্যাসিড বৃষ্টি হচ্ছে!’

‘কী?’ একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল কয়েকজন।

‘অ্যাসিড! অ্যাসিড রেইন!’

‘আরে কী বলেন? অ্যাসিড রেইন কালো হয় নাকি?’

‘অ্যাসিডের সঙ্গে মিশেছে কার্বন, ডিজেল ইঞ্জিনের কালো ধোঁয়া। ঢাকার চারপাশে হাজার হাজার ইটভাটায় কয়লা পোড়ানো হয়, সেসব কয়লার ছাই। বাসায় ফিরে বেসিনে থুতু ফেললে কী বের হয় দেখেন না? কালি বের হয় না?’

‘আঙ্কেল, আপনে কি সায়েন্টিস্ট?’

‘ওরে সুলেমান! বিষ্টি লয় রে! আকাশতেথ বলে অ্যাসিড পড়িচ্ছে!’

‘তাইলে তো আমাগো ছাল-চামড়া পুইড়া কিছু থাকব না।’

‘অ্যাসিড-ফ্যাসিড যা-ই কন, এইডা হইল গিয়া  গজব। পাপে পাপে জরাজীন্ন হইয়া গেছে এই দ্যাশ। গজব নামব না ত কী নামব?’

‘কী ব্যাপার? সব পাবলিক খাড়াইয়া রইছে ক্যান? এই কালা কুচকুচা বৃষ্টিতে ভিজ্জা কী যে রোগবালাই হইব আল্লাহ মালুম!’

‘আরে ভিআইপির গুষ্টি কিলাই! চলেন সকলে, যে যার বাড়ি যাইগা।’ এই কথা বলে এক লোক বাংলামোটরের দিকে হাঁটা শুরু করলে তার দেখাদেখি অন্যরাও এদিক-সেদিক পা বাড়াল। কিন্তু তাই দেখে পুলিশ কনস্টেবলরা বাঁশিতে ফুঁ দিতে দিতে চিৎকার আরম্ভ করে দিল, ‘কেউ নড়চড়া করবেন না। যে যেইখানে আছেন, সেইখানে খাড়ায়া থাকেন। আর মাত্র পাঁচ মিনিট!’

‘আরে রাখেন আপনাদের পাঁচ মিনিট! এক ঘণ্টা ধরে পাঁচ মিনিট পাঁচ মিনিট করতেছেন! আর এদিকে আমরা কালি-বিষ্টিতে ভিজ্জা ভূত হইয়া গেলাম গিয়া! অফিস যাইতে দিলেন না, না দিলেন, তাই বলে বাসায়ও যাইতে দিবেন না? কী পাইছেন আপনেরা?’ চিৎকার করে বলল থলথলে ভুঁড়িওয়ালা লম্বা-চওড়া দশাসই এক লোক। তার পরনে ছিল ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি, সেটা এখন কুচকুচে কালো। আর তার মুখটা এমনই কালো, যেন সে জ্বলজ্যান্ত একটা ভূত।

কিন্তু পুলিশের লোকেরা তার কথা কানেই নিল না। তারা তাদের হাতের লাঠিগুলো বাগিয়ে তেড়ে এল ফুটপাতের লোকজনের দিকে। চিৎকার করে বলল, ‘কেউ এক পা-ও নড়াচড়া করবেন না। যে যাঁর জাগায় খাড়ায়া থাকেন। ভিআইপি অক্ষণই যাইব গা।’

ফুটপাতের কিনারে লাঠি আর বাঁশি নিয়ে পাহারায় দাঁড়িয়ে রইল পুলিশের লোকেরা। ফুটপাতের লোকেরা তাদের উদ্দেশে, আর তাদের সেই ভিআইপির উদ্দেশে গালি দিতে শুরু করল। তাদের গালির ভাষা ক্রমেই ভদ্রতার সীমা ছাড়িয়ে যেতে লাগল। একপর্যায়ে তাদের গালিগুলো অতি জঘন্য হয়ে উঠল। সেসব কুিসত গালি শুনতে শুনতে তিরিক্ষি হয় পুলিশ কনস্টেবলদের মেজাজ। কারণ, তাদের মনে হলো লোকজন আসলে গালিগুলো ছুড়ে দিচ্ছে তাদেরই দিকে। অবশেষে তালপাতার সেপাইয়ের মতো হ্যাংলাপাতলা এক পুলিশ কনস্টেবল হুংকার দিয়ে বলে উঠল, ‘গালিগালাজ বন্ধ করেন! নাইলে কিন্তু লাঠিচার্জ আরম্ভ করা হইব!’

সেই থলথলে ভুঁড়িওয়ালা লোকটা প্রতিবাদ করে বলল, ‘মিয়া, মগের মুল্লুক পাইছেন? আপনেগো বেতন-ভাতা দেওয়া হয় আমাগো ট্যাক্সের পয়সায়। আপনেগো ওই লাঠিগুলানও কিনা হইছে আমাগো ট্যাক্সের ট্যাকায়। লজ্জা করে না? এক ঘণ্টা ধরে আমাদের আটকায়া রাখছেন, আপনাদের শরম লাগে না?’

বিপরীত দিকের ফুটপাতে দাঁড়ানো এক পুলিশ ভুঁড়িওয়ালা লোকটার কথাগুলো শুনছিল, এইবার সে রেগেমেগে ফায়ার হয়ে দাঁত কিটমিট করে নেমে এল রাস্তায়। পুলিশটার কোমরে বেল্টের সঙ্গে বাঁধা হোলস্টারে একটা পিস্তল। সে ডান হাতে পিস্তলটা বের করে ভুঁড়িওয়ালা লোকটার ভুঁড়ি তাক করে বলল, ‘খুব ট্যাক্সওয়ালা হয়ে গেছেন, তাই না? মিয়া, আর একটা কথা বলবেন তো গুলি করে আপনার ভুঁড়ি ফুটা করে দিব!’

ভুঁড়িওয়ালা লোকটা তাতে মোটেও ভয় পেল না। বরং ভিড় ঠেলে এগিয়ে এসে দাঁড়াল ফুটপাতের কিনারে। ইয়া বড় ভুঁড়িটা পুলিশটার দিকে বাগিয়ে দিয়ে বলল, ‘করেন, গুলি করেন! আপনে কত্ত বড় পুলিশ অফিসার হইছেন, আজ আমি দেইখ্যা ছাড়ব!’

ঠিক এই সময় আকাশে ঝলকে উঠল বজ্রবিদ্যুৎ, সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড কড়াৎ শব্দে ফেটে চৌচির হয়ে গেল আকাশ। পুলিশের অফিসারটা এমনভাবেই চমকে উঠল যে তার হাত থেকে পিস্তলটা ছিটকে পড়ে গেল কালো পিচঢালা রাস্তায়, তাই দেখে ফুটপাতের সব লোক হো হো শব্দে অট্টহাসি হেসে উঠল। লজ্জায় অফিসারের মাথাটা হেঁট হয়ে এল, তাই দেখে এক তরুণ পুলিশ কনস্টেবল ছুটে গিয়ে রাস্তা থেকে টুক করে তুলে নিল তার স্যারের পিস্তল এবং তার স্যারকে সেটা দিতে দিতে বিড়বিড় করে কিছু বলল। ফুটপাতের লোকেরা সেটা শুনতে পেল না, কিন্তু তারা জোরে জোরে হাসাহাসি শুরু করে দিল। তাদের এমন তাচ্ছিল্যভরা হাসাহাসিতে পুলিশ অফিসারের এমনই লজ্জা বোধ হলো যে বেচারা ফুটপাতের কিনারে বসে মাথা নিচু করল।

তবু বৃষ্টি থামল না, বাতাস বইল না; গাছের পাতারা নড়ল না। কালো বৃষ্টিতে ভিজে গাছের পাতাগুলো কালো হয়ে গেছে; কালো হয়ে গেছে পিজি হাসপাতাল, বারডেম হাসপাতাল, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালসহ আশপাশের সব ইমারত। রাস্তায় জমে উঠেছে কালো পানি, ফুটপাতের মেঝেও হয়ে গেছে কুচকুচে কালো।

হঠাৎ বৃষ্টি থেমে গেল। একদম হঠাত্। যেন সুইচ টিপে বন্ধ করে দেওয়া হলো আকাশের কল। পুলিশের সদস্যরা থেমে গেল। দক্ষিণ দিক থেকে হিমেল বাতাস বয়ে এল।

কেউ চিৎকার করে উঠল, ‘ওইটা কী রে?’

পুলিশের সদস্যরা ফিরে তাকাল। সবাই এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল। দেখা গেল রাস্তার পুব পাশের দুটো বিল্ডিংয়ে মাঝখানের চিপা থেকে বেরিয়ে আসছে একটা বেজি। ছোট ছোট চারখানা পায়ে গুটগুট করে হেঁটে এসে দাঁড়াল রাস্তার একদম মাঝখানে। ফুটপাতের লোকেরা ও পুলিশের সদস্যরা অবাক হয়ে দেখতে পেল, বেজিটার গায়ে এক ফোঁটা বৃষ্টিও পড়েনি। তার লোমগুলো ধূসর রঙের, কালো পানির একটু স্পর্শও লাগেনি।

ভেজা কালো পিচঢালা সড়কটার একদম মাঝখানে ছটফটে চঞ্চল এক বেজি! উলুক-ভুলুক তাকায় এদিক-ওদিক, তারপর রাস্তার ভেজা পিচ শোঁকে, তারপর সরু মুখটা তুলে ছোট ছোট চোখে তাকায় বাংলামোটরের দিকে।

ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকা ভূতের মতো কালো কালো লোকেরা এবং পুলিশের সদস্যরা উৎসুক চোখে দেখতে থাকে বেজিটাকে।

হঠাৎ পুলিশের বাঁশি বেজে উঠল। দূর থেকে এক পুলিশ অফিসার তার অধস্তনদের উদ্দেশে বাজখাঁই গলায় হুংকার ছাড়ল, ‘রাস্তায় বেজি ক্যান? সরাও সরাও! অক্ষণই ভিআইপি যাইব!’

একসঙ্গে বেজে উঠল অনেক বাঁশি, পুলিশের হুইসেল। এক পুলিশ কনস্টেবল ফুটপাত থেকে লাঠি উঁচিয়ে ধেয়ে গেল বেজিটার দিকে। বেজিটা সুচালো মুখ তুলে তাকাল পুলিশ কনস্টেবলের দিকে। স্থির চোখে চেয়ে রইল সোজা তার চোখের দিকেই। বেচারা পুলিশ কনস্টেবল বাইশ-তেইশ বছরের এক হ্যাংলাপাতলা তরুণ। কালো বৃষ্টিতে ভেজা হাড্ডিসার এক তালপাতার সেপাই যেন, যাকে দেখলে মনে হবে এইমাত্র আলকাতরার ড্রামে ডুব দিয়ে উঠে এসেছে। থমকে দাঁড়াল সে; মনে মনে বলল, ‘হালায় কামড় দিব না তো?’ সে বাঁ হাতে লাঠি উঁচিয়ে ডান হাতে ধরা মুখের বাঁশিতে খুব জোরে ফুঁ দিল। তার ফলে বাতাসে শিস কেটে যে শব্দ বেজে উঠল, আর সেই হুইসেলের শব্দে রাস্তার পাশের সেই দুটি বিল্ডিংয়ের চিপা থেকে বেরিয়ে এল ইয়া লম্বা এক গোখরো সাপ।

বেচারা তালপাতার সেপাই পুলিশ কনস্টেবলটা ‘ওরে বাপ রে’ বলে আর্তনাদ করে রাস্তা থেকে পড়িমরি ফিরে গিয়ে উঠল উল্টো দিকের ফুটপাতে। ভয়ার্ত চোখে চেয়ে রইল সাপটার দিকে। সাপটা কিন্তু তার দিকে এল না; সে ছুটে গেল বেজিটার দিকে। বেজিটা এগিয়ে এল সাপের দিকে। সাপ ফণা তুলল, বিশাল তার ফণা। বেজিটাকে দেখে ফুটপাতের লোকটার মনে হলো সে ভীষণ মজা পেয়েছে। সে সাপটার চারপাশে ঘুরতে শুরু করল। সাপটাও বেজিটার চারপাশে ঘুরে ঘুরে তার ফণা দোলাতে থাকল।

সাপ মাঝে মাঝে ছোবল মারে বেজিটার মুখ লক্ষ্য করে, কিন্তু বেজিটা বিদ্যুৎগতিতে সরে যায় ডানে কিংবা বাঁয়ে। শূন্যে বৃথা যায় সাপের বিষাক্ত ছোবল। ক্রোধে সাপটার ফণা আরও উঁচু হয়, আরও ফুলে ওঠে এবং পদ্মপাতার মতো দোলে। বেজিটা মজা করার ভঙ্গিতে গুটি গুটি পায়ে আবার সাপটার কাছে এগিয়ে যায়, তার চারপাশে ঘুরে ঘুরে চক্কর খায়; আর হঠাৎ সিরিয়াস হয়ে সাপটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযোগ খোঁজে। সাপটা আবার ফোঁস শব্দে ছোবল মারে, কিন্তু বেজি তড়াক করে লাফিয়ে উঠে সরে যায় বাঁয়ে কিংবা ডানে।

রাস্তার দুই পাশের ফুটপাতের লোকগুলো ও তাদের পথরোধকারী পুলিশের সদস্যরা ফুটপাতের কিনারে আরও ঘন হয়ে আসে। তারা এখন ভূতের মতো কালো, সবার চেহারা একই রকমের। তাদের কালো কালো মুখমণ্ডলে চোখের সাদা অংশটা অস্বাভাবিক রকমের সাদা দেখায়। তাদের মধ্যে যারা ভয় পেয়েছে এবং অনেকক্ষণের বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডায় কেঁপেছে, তাদের চোখগুলো লাল হয়েছে বটে, তবে সেই লাল লাল চোখেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে অপার বিস্ময়, অনাবিল কৌতুক।

তারা দেখতে পাচ্ছে একটা সাপ ও একটা বেজি যুদ্ধের মহড়া করছে। এই দৃশ্য দেখে তারা ভীষণ মজা পাচ্ছে। তারা নিজ নিজ অফিস, ব্যবসা বা অন্যান্য কাজের কথা ভুলে গেছে। তারা ভুলে গেছে যে এই রাস্তা দিয়ে ভিআইপি যাবে বলে ট্রাফিক পুলিশের লোকেরা তাদের ফুটপাতে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। মনে মনে তারা প্রত্যেকে ফিরে গেছে নিজ নিজ শৈশবে, যখন তারা সাপ ও বেজির গল্প শুনেছিল।

এখন তারা অপেক্ষা করছে কখন সত্যিকারের যুদ্ধটা শুরু হয়। তারা অনুমান করতে চাইছে, এই যুদ্ধে কে হারবে আর কে জিতবে। তারা জানে, সাপ কামড় দিলে বেজি মরে না, কারণ বেজির জানা আছে কী করে বিষমুক্ত হতে হয়। তাদের কেউ কেউ জানে, সাপ বেজিকে ছোবল দিলে বেজি সঙ্গে সঙ্গে ছুটে যায় জঙ্গলে। এমন গাছের সন্ধান বেজির জানা আছে, যা তাকে বিষমুক্ত করে।

কিন্তু এখানে, ইট-সিমেন্টের এই পাষাণ মহানগরে তো কোনো জঙ্গল নেই। তাহলে, সাপ যদি বেজিটার গায়ে অন্তত একটা ছোবল বসাতে পারে, বেজিটা নিজেকে বাঁচাবে কী করে?

এই সময় হঠাৎ সবাই দেখতে পেল, শাহবাগ মোড়ের সড়কদ্বীপে দাঁড়িয়ে আছে এক অদ্ভুত লোক। ভীষণ লম্বা, কমপক্ষে সাত ফুট। এত লম্বা লোক এই বাংলাদেশে আর একজনও আছে কি না সন্দেহ। সম্পূর্ণ খালি গা, কালো বৃষ্টিতে ভিজে তার সমস্তটাই ভীষণ কালো: মাথায় বাঁধা কাপড়টা কালো, পরনের লুঙ্গিটাও কালো। লুঙ্গিটা এত খাটো যে তার হাঁটুর নিচে নামতে পারেনি। লুঙ্গির নিচ থেকে খোলা দুই পায়ের পেশি ফুটবল খেলোয়াড়দের মতো। লুঙ্গিটা কোমরে বেশ শক্ত করে বাঁধা, কোমরে এক রত্তি মেদ নেই। পেটটা যেন শুকিয়ে ভেতরে সেঁধিয়ে আছে। বুকটা ভীষণ চওড়া, পাঁজরের হাড়গুলোর আভাস পাওয়া যাচ্ছে। হাত দুটো এত লম্বা যে হাঁটু পর্যন্ত ঝুলছে। হাতের পেশিগুলো দড়ির মতো পাকানো; কবজি কাঠের মতো চৌকো।

কিন্তু লোকটা হঠাৎ কোথা থেকে আবির্ভূত হলো? চারদিকে পুলিশের এত পাহারার মধ্যে সে কেমন করেইবা রাস্তা পেরিয়ে ট্রাফিক আইল্যান্ডে গিয়ে দাঁড়াল? পুলিশের সদস্যরা একসঙ্গে বাঁশি বাজাতে শুরু করল; একজন চিৎকার করে লোকটাকে বলল, ‘ওই মিয়া, কী করেন ওইখানে? জলদি সরেন! জলদি জলদি ফুটপাতে গিয়া ওঠেন।’

কিন্তু লোকটা যেন একেবারেই ভ্রুক্ষেপ করল না; মনে হলো, পুলিশ কনস্টেবলের চিৎকার সে শুনতেই পায়নি। নির্বিকার ভঙ্গিতে সে হেঁটে এগিয়ে চলল উত্তর দিকে, যেখানে সাপ আর বেজিতে যুদ্ধের মহড়া চলছে। তালগাছের মতো সোজা আর লম্বা লোকটা হেঁটে যাচ্ছে ফাঁকা সড়কের ঠিক মাঝখান দিয়ে। সব পুলিশ কনস্টেবল এবার একসঙ্গে আরও জোরে জোরে বাঁশি ফুঁকতে লাগল; কয়েকজন লাঠি উঁচিয়ে ধেয়ে গেল লোকটার দিকে। তাদের অফিসার চিৎকার করে উঠলেন, ‘ঘাড় ধরে নিয়া আসো লোকটারে!’

কিন্তু লম্বু লোকটার কোনোই ভ্রুক্ষেপ নেই। সে নির্বিকারভাবে সোজা হেঁটেই চলল সাপ ও বেজির যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে। ফুটপাতের লোকেরা নিজেদের মধ্যে নানা কথা বলতে শুরু করল,

‘আরে, এইটা কেমুন লোক? কানে শোনে না নাকি?’

‘হালায় মনে হয় বয়রা!’

‘ওই মিয়া, রাস্তা থিকা সইরা আসেন জলদি জলদি!’

‘আরে হালায় তো পুলিশের গুলি খাইয়া মরব দেখা যায়!’

লাঠি হাতে তিন পুলিশ লোকটার প্রায় কাছে পৌঁছে গেল। একজন লাঠি তুলল তার পিঠে বাড়ি মারার জন্য। ঠিক তক্ষুনি হিস হিস শব্দ করে তিরের মতো ছুটে এল সেই ভয়ংকর সাপটা। তিন পুলিশ হাতের লাঠি ফেলে দিয়ে ‘মা গো, আব্বা গো!’ বলে চিৎকার করতে করতে উল্টো দিকে ঘুরে প্রাণ হাতে নিয়ে দৌড়াতে শুরু করল। তাদের অফিসার কোমরের পিস্তল ডান হাতে নিয়ে সাপটাকে লক্ষ্য করে পরপর তিনটা গুলি করল।

কিন্তু তিনটা গুলিই নষ্ট হলো।

ফুটপাতের লোকদের ভিড়ের মধ্য থেকে কেউ একজন টিটকারির সুরে চিৎকার করে বলে উঠল, ‘লাগে নাই! একখান গুলিও লাগাইতে পারে নাই!’

পুলিশ অফিসার লজ্জা পেল। তার পিস্তলে আরও তিনটা বুলেট আছে। আবার সাপটার দিকে পিস্তল তাক করল। সাপটা তখন লম্বু লোকটার পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে পুলিশ অফিসারের দিকে চেয়ে ফণা দোলাচ্ছে আর ঘন ঘন জিব দেখাচ্ছে।

পুলিশ অফিসার হঠাৎ দ্বিধান্বিত হলো। ভাবল, ‘সাপটাকে মারতে গিয়ে যদি গুলি লাগে লোকটার গায়ে? ফুটপাতে এত লোক, তারা তো চেয়ে চেয়ে সবই দেখছে। গুলি যদি লোকটার গায়ে লাগে, তাহলে তো লোকজন মিডিয়াকে বলবে, আমি একজন নিরীহ নিরস্ত্র লোককে গুলি করে মেরে ফেলেছি। আর মিডিয়ার লোকেরা তো পুলিশের একটা কিছু পেলেই একদম ঝাঁপিয়ে পড়ে!’

লোকজন দেখছে, পুলিশ অফিসার দুই হাতে পিস্তল ধরে সাপটার দিকে তাক করে আছে, কিন্তু গুলি করছে না। লোকেদের কারও কারও মনে হলো পুলিশ অফিসারটার হাত বুঝি একটু একটু কাঁপছে। তারা বলাবলি শুরু করল,

‘কী রে? পিস্তল তাক কইর্যা খাড়াইয়া রইছে ক্যান?’

‘হইলোডা কী? গুলি করে না ক্যান?’

‘মনে হয় পিস্তলের গুলি শ্যাষ হইয়া গেছে!’

‘আরে না! ডরাইছে! পুলিশ ডরাইছে রে!

এসব কথাবার্তা শুনে পুলিশ অফিসার ভীষণ লজ্জা পেল। পুলিশ অফিসার তার ওপরের পাটির দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে চোখ দুটো ছোট ছোট করে সাপটাকে লক্ষ্য করে একটা গুলি ছুড়ল। ফুটপাতের লোকজন হাততালি দিয়ে উঠল।

কিন্তু সেই গুলি যে কোথায় গিয়ে লাগল সেটা পুলিশ অফিসার বা ফুটপাতের লোকজন বুঝতেই পারল না। তবে এই গুলির একটা ফল সবাই দেখতে পেল। সেটা হলো, গুলির শব্দের সঙ্গে সঙ্গে সাপটার ফণার উচ্চতা ঝট করে বেড়ে গেল কমপক্ষে এক ফুট। আগে সাপটাকে দেখা যাচ্ছিল লম্বু লোকটার হাঁটুর একটু নিচ বরাবর ফণা মেলে দুলতে। এখন দেখা যাচ্ছে, তার ফণা উঠে এসেছে লোকটার হাঁটুর বেশ ওপরে।

পুলিশ অফিসার আবার গুলি করল। সাপের ফণা আরও এক ফুট উঁচু হয়ে উঠল।

পুলিশ অফিসারের রোখ চেপে গেল। তার নাকের ফুটোগুলো বড় বড় হয়ে গেল, আর সাপের মতো ফোঁস ফোঁস শব্দে গরম নিশ্বাস বের হতে লাগল। পুলিশ অফিসার নিচের ঠোঁট আরও জোরে কামড়ে ধরে দুই ভুরুতে তিরের মতো ভাঁজ তুলে চোখ দুটো আরও ছোট ছোট করে আবার গুলি চালাল সাপটাকে লক্ষ্য করে। সঙ্গে সঙ্গে সাপটা এত জোরে একটা লাফ মারল যে লোকজনের মনে হলো ওটা যেন উড়ে গিয়ে পড়ল পুলিশ অফিসারটার গায়ের ওপৎকার ছেড়ে দৌড়ে পালাতে আরম্ভ করল। কিন্তু পারল না, কারণ ভীষণ লম্বা আর মোটাসোটা সাপটা এরই মধ্যে পেঁচিয়ে ধরেছে তার দুই পা। বাতাসে সাঁই সাঁই শব্দ তুলে ভীষণ দ্রুতগতিতে সাপটা তার পা থেকে বুক পর্যন্ত পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলল। তারপর তার কপালের সামনে ফণা মেলে দুলতে লাগল।

নিজের নাকের ডগায় সাপের অত বড় ফণা দেখে ভয়ে পুলিশ অফিসারটার মুখ হাঁ হয়ে গেল। সেই মুখ থেকে বেরিয়ে এল এক বিঘত লম্বা জিব। তার চোখের মণি দুটি লাটিমের মতো ঘুরতে ঘুরতে সাদা হয়ে গেল। তার সারা শরীর থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে ফুটপাতের ওপর ধপাস করে পড়ে গেল গোড়া কাটা কলাগাছের মতো।

এই দৃশ্য দেখে সব পুলিশ আর রাস্তার দুই পাশের ফুটপাতের সব মানুষ একদম স্তম্ভিত হয়ে গেল। কারও মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হলো না। কেউ একচুল নড়তেও পারল না। প্রত্যেকের মুখ হাঁ হয়ে আছে; বিস্ময়ে ফেটে বেরিয়ে আসছে তাদের চোখের মণিগুলো। তারা চেয়ে আছে সারা শরীর সাপে প্যাঁচানো পুলিশ অফিসারের শরীরটার দিকে।

এবার শরীরটা গড়াতে শুরু করল, যেভাবে একটা ড্রাম গড়িয়ে নিয়ে যাওয়া যায়।

পুলিশ অফিসারের শরীরটা গড়াতে গড়াতে যাচ্ছে, আর সাপটার প্যাঁচ খুলে খুলে যাচ্ছে। এভাবে গড় গড় করে গড়াতে গড়াতে শরীরটা ফুটপাত থেকে গিয়ে পড়ল রাস্তায়। সাপটা পুরোপুরি মুক্ত হয়ে এঁকেবেঁকে ফিরে যেতে লাগল রাস্তার মাঝখানে দাঁড়ানো সেই লম্বু লোকটার দিকে।

লোকজন এবার দেখতে পেল লোকটার বাঁ কাঁধে এখন ঘাপটি মেরে বসে আছে সেই বেজিটা। সাপটা গিয়ে লোকটার পায়ের কাছে থামল, তারপর তার পা বেয়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ওপরের দিকে উঠতে লাগল। লোকটা এক হাতে সাপটাকে ধরে নিজের গলায় বেড় দিয়ে পেঁচিয়ে নিল। সাপটা তার গলায় মালার মতো ঝুলতে লাগল। তার বাঁ কাঁধে বসা বেজিটার তাতে অসুবিধা হচ্ছে বলে সে উঠে গেল লোকটার মাথার ওপর।

লোকটা এবার তাকাল উত্তর দিকে। তার দেখাদেখি ফুটপাতের সব লোকও সেই দিকে তাকাল। তারা দেখতে পেল রাস্তাটা আগের মতোই ফাঁকা। যানবাহন আর লোকজন তো দূরের কথা, একটা নেড়ি কুকুর, একটা কাক কিংবা একটা ইঁদুর পর্যন্ত নেই। কালো পিচ কালো বৃষ্টিতে ভিজে আরও কালো হয়ে গেছে। সড়কের দুই পাশের সব দালানকোঠা কালো, গাছপালা কালো, টেলিফোন ও বিদ্যুতের খুঁটিগুলোও কালো। কালো ছাড়া আর কোনো রং কোথাও নেই।

লোকটা তাকিয়ে রইল উত্তর দিকে। তার মাথায় বসা বেজিটাও সরু মুখ বাড়িয়ে চেয়ে রইল সেই দিকে। লোকটার গলায় ঝুলন্ত সাপটাও ফণা তুলে চেয়ে রইল একই দিকে। ফুটপাতের প্রতিটি লোকের দৃষ্টিও সেই দিকে। ফুটপাতের সবাই মনে মনে বলছে, এখন আবার কী আজব কাণ্ড ঘটতে যাচ্ছে।

তাকিয়ে থাকতে থাকতে তারা হঠাৎ দেখতে পেল, ফাঁকা সড়কের ঠিক মাঝখান দিয়ে বাংলামোটরের দিক থেকে টকা টক শব্দ তুলে বিদ্যুৎগতিতে ছুটে আসছে বিশাল একটা কালো ঘোড়া। তীব্র গতিতে ছুটে আসার ফলে বাতাসে টান টান হয়ে গেছে তার ঘাড়ের চকচকে কালো কেশর।

চোখের পলকে ঘোড়াটা এসে দাঁড়াল লম্বু লোকটার সামনে। লোকটা তার মাথার বেজি ও গলার সাপটাকে নিয়ে এক লাফে উঠে বসল সেই ঘোড়ার পিঠে। ঘোড়াটা পেছনের পা দুটির ওপর দাঁড়িয়ে সামনের দুই পা শূন্যে তুলে তীব্র চিঁহিহি শব্দে একবার ডেকে উঠল, তারপর চক্কর খেয়ে ঘুরে দাঁড়াল যেদিক থেকে এসেছিল সেই দিকে মুখ করে।

তারপর ভেজা কালো পিচের ওপর টকা টক শব্দ উঠল। বেজি ও সাপসুদ্ধ লম্বু লোকটাকে পিঠে নিয়ে কেশর দুলিয়ে বিদ্যুৎগতিতে ছুটতে শুরু করল কালো ঘোড়া। ফুটপাতের লোকেরা হাঁ করে বস্ফািরিত চোখে চেয়ে রইল সেই দিকে। তাদের চোখের সামনে ঘোড়াটা ধীরে ধীরে ছোট হতে হতে অবশেষে মিলিয়ে গেল।