স্মরণীয় বিদায়

‘তোমার বাড়ির রঙের মেলায় দেখেছিলাম বায়োস্কোপ/ বায়োস্কোপের নেশায় আমায় ছাড়ে না।’ সঞ্জীব চৌধুরীর গাওয়া এ গানের মূল উপজীব্য প্রেম। সেই প্রেম হতে পারে কারও চোখের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকায় কিংবা কারও উড়ো চুলে। নেশা বড্ড খারাপ জিনিস, কিন্তু ভালোবাসার নেশায় একবার পড়লে তা কি আর ছাড়া যায়?
অবসর মানে সেই ভালোবাসাকে ছেড়ে যাওয়া, একজন খেলোয়াড়ের জীবনের একটা অংশ ছেড়ে চলে যাওয়া। এত বছরের সাধনা, পরিশ্রম, আরাধনা—এরপর থেকে আর কখনোই কাজে আসবে না, কখনোই নামা হবে না সেই জায়গায়, যেখানে নামার জন্য গত ১৫-২০ বছর কঠোর সাধনা করতে হয়েছে। অবসরজীবন এভাবেই আঘাত করে একজনের মনে। এসএসসির পর একটা অলস সময় যেভাবে বিরক্ত করে, তেমনি অবসরজীবনও আঘাত হানে মনে। অনেকেই তা সহ্য করতে পারেন, অনেকে পারেন না। ফেরত আসেন পুরোনো জায়গায়। আজকের গল্পটা সেসব খেলোয়াড় নিয়েই, যাঁরা ফেরত এসেছিলেন ভালোবাসার টানে। 

মাইকেল জর্ডান

মাইকেল জর্ডান
মাইকেল জর্ডান

মাইকেল জর্ডান এমন এক নাম, জীবনে যদি বাস্কেটবলের নাম না–ও শুনে থাকো, তবু লোকমুখে তাঁর নাম কানে আসবেই। মাইকেল জর্ডান শুধু একজন খেলোয়াড় নন, সারা বিশ্বের মানুষের কাছে একজন আইকন মাইকেল জর্ডান। ১৫ বছর বয়সে তাঁকে স্কুল বাস্কেটবল দল থেকে বাদ দেওয়া হয়। কারণ, তিনি যথেষ্ট প্রতিভাবান নন। সেই কলেজ পেরিয়ে ২১ বছর বয়সে পা রাখেন এনবিএতে। সেখান থেকে শুরু বিশ্বজয়। এনবিএর সর্বকালের সেরা খেলোয়াড় হয়ে যান প্রথম ধাপেই। টানা ৯ বছর কাঁপিয়েছেন এনবিএ। আর নিজের সেরা খেলাটা দেখিয়েছেন ১৯৯১ থেকে ১৯৯৩। টানা তিন বছর হ্যাটট্রিক শিরোপা জেতান শিকাগো বুলসকে। টানা তিন বছর জিতে যেন অবসাদ ভর করেছিল, তাই তো ৩০ হতে না–হতেই অবসরের ঘোষণা দেন মাইকেল জর্ডান। বাস্কেটবল ছেড়ে বেসবলে নাম লেখানোর সূক্ষ্ম ইচ্ছেও ছিল। কিন্তু প্রথম প্রেম যার সনে, তাকে কি ছাড়া যায়?
মাত্র এক বছর কোর্ট ছেড়ে থাকতে পারলেন, এরপরই ১৯৯৫ সালে আবার ফিরে আসেন শিকাগো বুলসের জার্সিতে। এক বছর বিরতি নিয়ে যেন শাণিত করেছেন জর্ডান। ফিরে এসে আবারও হ্যাটট্রিক শিরোপা জেতান শিকাগো বুলসকে। তাঁর ২৩ নম্বর জার্সি যেন আইকন হয়ে যায় সারা বিশ্বের কাছে। ৩৪–এ এসে তাঁর মনে হয়, এবার সময় জার্সি তুলে রাখার। ১৯৯৮ সালে দ্বিতীয়বারের মতো অবসর নেন মাইকেল জর্ডান। 
জর্ডান বাস্কেটবল ছাড়লেন, বাস্কেটবল যেন তাঁকে ছাড়ে না। ২০০১ সালে আবারও ঘোষণা দিলেন কোর্টে ফেরার। টুইন টাওয়ার দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত সবার সাহায্যার্থে আবার বাস্কেটবলে ফেরেন জর্ডান। এবার ফিরেছিলেন ওয়াশিংটন উইজার্ডসের জার্সিতে। তবে বয়স আর ইনজুরির চোটে তেমন কিছু অর্জন করতে পারেননি। তবে যে সাহায্যার্থে এগিয়ে এসেছিলেন, তা হয়েছিল ঠিকই। ২০০৩ সালের পর তাঁকে কোর্টে দেখা যায়নি বটে, কিন্তু মাইকেল জর্ডান ফেডারেশন থেকে লাখো অসহায় বাস্কেটবল খেলোয়াড় হওয়ার স্বপ্ন দেখা তরুণদের স্বপ্ন জিইয়ে রাখছেন ‘এমজে’।

মাইকেল ফেল্‌প্‌স

মাইকেল ফেল্‌প্‌স
মাইকেল ফেল্‌প্‌স

কেউ তাঁকে ডাকে ‘বাল্টিমোর বুলেট’ বলে, কেউবা ডাকে ‘ফ্লাইং ফিশ’ বলে। আবার অনেকের কাছে তিনি সাঁতারের সুপারম্যান। মাইকেল ফেল্‌প্‌স নাম শুনলেই সবার আগে ভেসে উঠবে সুইমিংপুলে সবার আগে পার হয়ে যাওয়া একজনের দৃশ্য, যিনি ঘুরে তাকিয়ে আছেন অন্যদের ফিনিশিং লাইনে পৌঁছানোর অপেক্ষায়। মাত্র ১৫ বছর বয়সে অলিম্পিকের মঞ্চে নাম লেখানো ফেল্‌প্‌স ৭ বছর পর্যন্ত পানিতেই নামেননি। কিন্তু ২০০৪ থেকে যে গল্প লেখা শুরু, তা কোনো বিশেষণেই বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়।  
২০০৪ সালের এথেন্স অলিম্পিকে ৬ স্বর্ণ, ২ ব্রোঞ্জে ৮টি। ২০০৮ সালে বেইজিং অলিম্পিকে অন্য কোনো পদকে নজরই যায়নি। সেবার সাঁতারের ৮টি স্বর্ণই নিজের গলায় ঝুলিয়েছিলেন ফেল্‌প্‌স। কিংবদন্তি সাঁতারু মার্ক স্পিৎজের ৩৬ বছর আগে গড়া এক অলিম্পিকে তাঁর স্বর্ণের রেকর্ড তুড়ি দিয়ে উড়িয়ে দিলেন ফেল্‌প্‌স। তাঁর সামনে শুধু ছিলেন জিমন্যাস্ট লারিসা লাতিনিনা। অলিম্পিকে মোট ১৮ পদক পেয়ে সবার ওপরে বসে ছিলেন এই রাশিয়ান। ২০১২ লন্ডন অলিম্পিকে নামার আগে আবার তাঁর ঘোষণা, সব রেকর্ডে থাকবে শুধু ফেল্‌প্‌সের নাম। কথার বিন্দুমাত্র হেরফের হলো না। ৪ স্বর্ণ ও ২ রৌপ্য পদকসহ অলিম্পিকে তাঁর ২২-এ। ৪৮ বছর ধরে টিকে থাকা লাতিনিনার রেকর্ড যেন মোমের পুতুল। 
লন্ডন অলিম্পিক শেষে সর্বজয়ী ফেল্‌প্‌স ঘোষণা দেন সুইমিংপুল ছাড়ার। অলিম্পিকে সব রেকর্ড ভাঙচুর করার পর আর কিছুই বাকি ছিল না তাঁর জন্য। কিন্তু অবসরের পর থেকেই যেন যত সমস্যা ভর করে তাঁর ওপর। জেলেও যেতে হয় দুবার। এরপর ঘোষণা দেন ফেরার, সুইমিংয়ে। ‘আমি নিজেকে ভালোবাসি না, শুধু সাঁতারকেই ভালোবাসি।’
৩১ বছর বয়সী ফেল্‌প্‌সকে নিয়ে সব আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন সবাই। ক্যারিয়ারের পড়ন্ত বিকেলে কারও পক্ষেই যে আর ভালো করা সম্ভব নয়। কিন্তু সব রেকর্ড ভাঙতেই ক্যারিয়ার গড়েছেন ফেল্‌প্‌স। রিও অলিম্পিকে তাই সব আশাই ছেড়েই দিয়েছিল। কিন্তু লন্ডনে যেখানে ছেড়েছিলেন, সেখান থেকেই শুরু করলেন ফেল্‌প্‌স। নিন্দুককে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে জিতে নেন ৬টি পদক, যার মধ্যে ৫টি স্বর্ণ, ১টি রৌপ্য। এরপরই সুইমিংপুল থেকে অবসরের ঘোষণা দেন ফেল্‌প্‌স। নিজের অলিম্পিক ক্যারিয়ার শেষ করেন ২৩ স্বর্ণপদকসহ ২৮ পদক নিয়ে। আর সব মিলিয়ে মোট ৬৫টি সোনার পদকসহ ৮২টি পদক গলায় নিয়ে।

জিনেদিন জিদান

জিনেদিন জিদান
জিনেদিন জিদান


সভায় সবার শেষে যেমন প্রধান অতিথি আসেন, তেমনি সেরা খেলোয়াড়ের আগমন সবার শেষে। এই তালিকা যেন জিনেদিন জিদান ছাড়া অসম্পূর্ণ। ফিরে এসে তাঁর মতো আভিজাত্য আর কেউই দেখাতে পারেননি। যদিও জিদানের বিরতি সাময়িক খেলা থেকে ছিল না, ছিল জাতীয় দল থেকে। 
২০০৪ ইউরোতে গ্রিসের জয় সবাইকে যেমন থমকে দিয়েছিল, তেমনি থামিয়ে দিয়েছিল ফ্রান্সের জার্সিতে জিদানের পথচলা। গ্রিসের কাছে অপ্রত্যাশিত বিদায়ের পর জাতীয় দলের জার্সি তুলে রাখেন জিদান। যদিও খেলা চালিয়ে যাচ্ছিলেন রিয়ালের অল হোয়াইটস জার্সিতে। অন্যদিকে ফ্রান্সের তখন তথৈবচ অবস্থা। ম্যাকেলেলে, থুরাম, জিদানকে হারিয়ে বিশ্বকাপ খেলাই তখন অনিশ্চিত ফ্রান্সের। কোচ-ফ্যান এমনকি স্বয়ং প্রেসিডেন্টের আহ্বানে আবার ফ্রান্সের জার্সিতে ফেরেন জিদান। ঘোষণা দেন, বিশ্বকাপই হবে তাঁর জীবনের শেষ ফুটবল ম্যাচ। 
বিশ্বকাপ স্কোয়াডে তাঁর সঙ্গে যোগ দেন থুরাম-ম্যাকেলেলে। কিন্তু তথৈবচ অবস্থা কাটে না। প্রথম দুই ম্যাচ ড্র, দুই হলুদ কার্ড পেয়ে পরের ম্যাচ নিষিদ্ধ। সবাই ভেবে নিয়েছিল, জিদানকে মনে হয় গ্রুপ পর্ব থেকেই টাটা বাই বাই বলতে হবে। কিন্তু জিজ্জুর অপেক্ষা ছিল নকআউট রাউন্ডের। নকআউট রাউন্ড আসতে না আসতেই শুরু হলো জিদানের ভেলকি। স্প্যানিশ সতীর্থদের খুব ভালোভাবেই চিনতেন জিদান, তাই তাঁদের বিপক্ষে সহজাত খেলাটা দেখাতে কোনো বেগই পেতে হলো না তাঁকে। একাই মাঝমাঠ ধরে রাখলেন, আর যা দেখানোর দেখালেন অঁরি-রিবেরি। শেষ মুহূর্তের এক গোলে বিশ্বকাপে গোলের খাতা খোলেন জিদান। 
কোয়ার্টার ফাইনালে সামনে পরাশক্তি ব্রাজিল—এই ব্রাজিল সেই ব্রাজিল, যে ব্রাজিলের তখন গোলবারের নিচ থেকে অন্য গোলবারের সামনে পর্যন্ত তারকা। দিদা, কাফু, রবার্তো কার্লোস থেকে শুরু করে কাকা, রোনালদিনহো, রোনালদোরা। অথচ এত তারকার ভিড়ে বিপরীতে পার্থক্য হয়ে দাঁড়ালেন একা জিদান। হলদে ব্রাজিলকে বিষে নীল করে দেওয়ার দায়িত্ব একা হাতে নিলেন জিদান। ব্রাজিলের স্টারে ভরপুর দল এক ম্যাকেলেলের কাছে ধরাশায়ী, আর সেখান থেকেই শুরু জিদানের। তারকাভর্তি দল নিয়ে মাত্র একবার অ্যাটাক করতে পেরেছিল ব্রাজিল। জিদানের প্রভাব এতটাই ছিল সে ম্যাচে। বিশ্বকাপে সর্বকালের সেরা কয়েকটি শোর মধ্যে একটি অবশ্যই এটি। থিয়েরি অঁরির গোলে বলও বানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। 
সেমিতে পর্তুগালের বিপক্ষে পেনাল্টিতে একমাত্র গোল করে দলকে নিয়ে যান ফাইনালে। আর ফাইনালে পরাক্রমশালী ইতালি। যারা পুরো বিশ্বকাপ খেল দেখিয়েছে নিজেদের নিশ্ছিদ্র রক্ষণ দিয়ে। সে রক্ষণকে ৭ মিনিটের মাথায় ভেঙে দিলেন জিদান। তাঁকে থামাতে গিয়ে পেনাল্টি, সেখান থেকে গোল করে দুই বিশ্বকাপ ফাইনালে গোল, এমনকি বিশ্বকাপ ফাইনালের সর্বোচ্চ গোলদাতাও হয়ে উঠলেন তিনি। এরপরও ম্যাচে নিজের খেল দেখানো ছাড়েননি, জিয়ানলুইজি বুফনের অসামান্য কৃতিত্ব না থাকলে হয়তো ম্যাচটা সহজেই জিতে যেত ফ্রান্স। সর্বকালের সেরা ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে জিদানের নামটা সবার ওপরেই থাকত। কিন্তু ইতালি কাজে লাগাল তাদের নোংরা ট্যাকটিস। ক্রমাগত বাজে কথা বলে উত্তেজিত করে তুলল জিদানকে। ফলাফলে ১১০ মিনিটে মাতারেজ্জিকে ঢুস মেরে বসলেন জিদান। হাতছোঁয়া দূরত্বে রেখে হতাশ হয়ে ফিরতে হলো জিদানকে। নাবিক হারিয়ে দিশেহারা ফ্রান্সও পৌঁছাতে পারেনি তীরে। পেনাল্টিতে হার মানতে হয় ফ্রান্সকে, কিন্তু ফুটবলজগতে এখনো স্মরণীয় হয়ে আছেন জিদান, তাঁর ফাইনাল দিয়েই।