শৈশব রাঙানো দুই কারিগরের প্রস্থান

ছোট্ট ইঁদুর জেরি প্রাণ হাতে নিয়ে দৌড়াচ্ছে। পেছনে বিড়াল টম তাকে তাড়া করছে। টমের থেকে রক্ষা পেতে জেরি দৌড়ে পালাচ্ছে। ‘টম অ্যান্ড জেরি’ কার্টুনের এ দৃশ্য আমাদের সবারই পরিচিত। আবার, একগাদা শাক খেয়ে একাই অনেকগুলো গুন্ডাপাণ্ডাকে কাবু করা ‘সেইলর ম্যান’ পপাইকে নিশ্চয়ই মনে আছে। আমাদের শৈশবকে সুন্দর করে তোলা এ কার্টুন সিরিজ দুটির পরিচালক জেইন ডিচ। গত ১৬ এপ্রিল রাতে তিনি মারা যান। ৯৫ বছর বয়সী জেইন ডিচ চেক প্রজাতন্ত্রের প্রাগ শহরে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন।

জেইন ডিচের জন্ম আমেরিকার শিকাগো শহরে। বেড়ে ওঠা ক্যালিফোর্নিয়ায়। একসময় তিনি ছিলেন আমেরিকার বিমানবাহিনীর ডিজাইনার। কাজ করেছেন সামরিক বাহিনীর প্রশিক্ষক হিসেবেও। ১৯৪৪ সালে তিনি স্বাস্থ্যগত কারণে চাকরিচ্যুত হন। এরপরই কার্টুন ও অ্যানিমেশনের জগতে আসেন জেইন ডিচ।

জেইন ডিচ
জেইন ডিচ

জেইন ডিচ ১৯৫০ সালে ‘ইউনাইটেড প্রোডাকশন অব আমেরিকা’ অ্যানিমেশন স্টুডিওতে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ‘টেরিটুন’ অ্যানিমেশন স্টুডিওতে ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর হন। টেরিটুন থেকেই তিনি তৈরি করেন ‘সিডনি দ্য এলিফ্যান্ট’, ‘গ্যাস্টন লে ক্রেয়ন’, ‘ক্লিন্ট ক্লোবার’ ও ‘টেলিবল থম্পসন’–এর মতো জনপ্রিয় সব কার্টুন চরিত্র। ১৯৫৮ সালে নিউইয়র্কে তিনি তাঁর নিজস্ব স্টুডিও গড়ে তোলেন। ১৯৬০ সালে তিনি পপাই ও টম অ্যান্ড জেরি সিরিজের অনেকগুলো পর্ব নির্মাণ করেন।

৭০টির বেশি অ্যানিমেটেড সিনেমা ও ৭টি টেলিভিশন সিরিজ নির্মাণ করেছেন এই নির্মাতা। তিনি অ্যানিমেটর ও ইলাস্ট্রেটরের ভূমিকায়ও প্রচুর ছবিতে কাজ করে সুনাম কুড়িয়েছেন। আইএমডিবির তথ্যমতে, প্রায় ১৫টি ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকায় তিনি কাজ করেছেন।

১৯৫৫ সালে ‘সিডনিস ফ্যামিলি ট্রি’ ছবিটির জন্য তিনি প্রথমবার অস্কারে মনোনয়ন পান। ১৯৬০ সালে তিনি ‘মুনরো’র জন্য ‘বেস্ট অ্যানিমেডেট শর্টফিল্ম’ বিভাগে অস্কার জিতে নেন। ১৯৬৪ সালে একই বিভাগে তাঁর ‘হিয়ারিজ নাদনিক’ ও ‘হাউ টু অ্যাভয়েড ফ্রেন্ডশিপ’ ছবি দুটি মনোনয়ন পায়।

’ফাইন্ডিং নিমো’র একটি দৃশ্য
’ফাইন্ডিং নিমো’র একটি দৃশ্য

জেইন ডিচের ‘পপাই’ সিরিজের ভক্ত অ্যানিমেটর রব গিবস। তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা ক্যালিফোর্নিয়া শহরেই। ‘ফাইন্ডিং নিমো’ ছবিতে হারিয়ে যাওয়া নিমো, ‘ইনক্রিডিবল টু’ সিনেমার অদ্ভুত সেই পরিবার, ‘টয় স্টোরির জীবন্ত খেলনা শেরিফ উডি ও তাঁর বন্ধুদের মতো জনপ্রিয় সব চরিত্র অ্যানিমেডেট হয়েছে রব গিবসের আঁকার হাত ধরেই। গত ২৪ তারিখ পরপারে চলে গেলেন পরিচালক ও শিল্পী রব গিবস।

রব গিবস
রব গিবস

২২ বছরের ক্যারিয়ারে রব গিবস প্রথম কাজ করেন ডিজনি স্টুডিওতে। ১৯৯৮ সালে তিনি পিক্সারে যোগ দেন। সেখানেই তিনি সৃষ্টি করেন একের পর এক মাস্টারপিস। পিক্সার স্টুডিওতে কাজের মাধ্যমে তিনি তাঁর অপূর্ব কল্পনাগুলোর প্রকাশ ঘটান। চমৎকার সব অ্যানিমেশন সিনেমাগুলোই তাঁর প্রমাণ।

‘মনস্টার্স আইএনসি’ তাঁর সেরা সৃষ্টিগুলোর একটি। পুরো ছবিতে অ্যানিমেশন ডিপার্টমেন্টে কাজ করেন তিনি। এই ছবিতে ‘বু’–এর চরিত্রে কণ্ঠ দেন তাঁর মেয়ে মেরি গিবস। ‘মনস্টার্স আইএনসি’তে অ্যানিমেটর হিসেবে কাজ করলেও এ ছবির সিকুয়্যেল ‘মনস্টার্স অ্যাট ওয়ার্ক’ টিভি সিরিজটির পরিচালক তিনি। স্টোরি আর্ট ও অ্যানিমেশন বিভাগে তিনি কাজ করেছেন, ‘ব্রেভ’, ‘মনস্টার্স ইউনিভার্সিটি’, ‘আপ’, ‘ওয়াল-ই’, ‘ইনসাইড আউট’সহ আরও অনেক ছবিতে। গিবসের পরিচালনায় ‘হাম্প’ ছবিটির কাজ শেষ হওয়ার আগেই তিনি চলে গেলেন চিরতরে।

মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে হারিয়ে গেলেন অ্যানিমেশন জগতের দুই নক্ষত্র। ‘টম অ্যান্ড জেরি’ থেকে শুরু করে ‘টয় স্টোরি’, তাদের সৃষ্টিগুলো আমাদের শৈশবকে রাঙিয়েছে। অ্যানিমেশন জগতের এই দুজন কিংবদন্তিকে তাঁদের কাজগুলো চিরদিন বাঁচিয়ে রাখবে।

তথ্যসূত্র : কার্টুন ব্রিউ ও কমিকবুক