এ বি সি ডি

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

এই শব্দটা প্রথম শুনেছি অনেক বছর আগে যখন প্রথম উত্তর আমেরিকায় পাড়ি জমাই। শব্দটির অর্থ American born confused deshi. প্রথম প্রথম শব্দটার অর্থ খুব একটা হৃদয়ঙ্গম করতে পারতাম না। যত দিন গেছে একটু একটু করে এই শব্দটা আমার কাছে অনেক বেশি পরিষ্কার হয়েছে। আমেরিকায় জন্ম নেওয়া দ্বিতীয় প্রজন্মের শিশুরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিজের আইডেনটিটি নিয়ে এক ধরনের দোলাচলে ভুগতে থাকে। জন্মের পর থেকে যত দিন তারা বাইরের পরিবেশ না পায়, বাসায় মা-বাবারা হয়তো তাদের সঙ্গে বাংলায় কথা বলে। নিজেদের সংস্কৃতি, খাওয়া, ধর্ম—এগুলোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে থাকে প্রাত্যহিক কাজের মাধ্যমে। বাইরের প্রভাব কম থাকে বলে শিশুরা কিছুটা শিখতেও শুরু করে। তবে এ ক্ষেত্রে অন্তরায় হলো টিভি। যেহেতু বাচ্চা দেখাশোনার জন্য পরিবার-পরিজন বা অন্য কোনো সাহায্য নেই, বাচ্চাদের ব্যস্ত রাখতে অনেক বাবা-মাকেই তাদের অনেকটা সময় টিভির সঙ্গে কাটাতে দিতে হয়। আমেরিকান কার্টুন দেখে তারা ইংরেজি ভাষার সঙ্গে সঙ্গে শিখতে থাকে তাদের কালচার। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো কার্টুন দেখা এই বয়সী বাচ্চারা সবাই একটা বিশেষ টোনে কথা বলে, এমনকি বাংলাও। সেই টোনটা হলো কার্টুনের চরিত্ররা যে টোনে কথা বলে অবিকল সেই টোন।
বাচ্চা ডে কেয়ারে বা স্কুলে যাওয়া শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের মধ্যে বিশাল পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। নিজের মনের অজান্তেই তারা ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে থাকে, বাংলার সঙ্গে ইংরেজির মিশেল বাড়তে থাকে দ্রুত। তাদের খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন আসে। ভাত, মাছ, তরকারির চেয়ে বার্গার, পিৎজা আর অন্যান্য ফাস্ট ফুডের প্রতি আকর্ষণ বাড়তে থাকে। হলুদ রঙের যে কোনো তরকারির ওদের কাছে একই পরিচয় ‘কারি’। এই বয়স পর্যন্ত বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারা আইডেনটিটি নামক জটিল সমস্যাটা নিয়ে বোধ হয় খুব একটা মাথা ঘামায় না যদি না কোনো চরম ঘটনার শিকার হয়। দেশি বাবা-মা তাদের সকার গেম, বাস্কেট বল গেমে খেলতে নিয়ে যায় ঠিকই, কিন্তু অন্য দেশি বাবা-মারা যখন জমিয়ে সেই গেমে চিৎকার করে উৎসাহ দিতে থাকে, দেশি শিশুটি দেখে তার মা বা বাবা এককোনায় বসে বসে সেল ফোনে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করছে। নিজের মনের গভীরে সে টের পায় এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা। গেম শেষে অন্যান্য দেশি বাবা-মারা যখন নিজেদের মধ্য আলাপচারিতা, হাসিঠাট্টায় মগ্ন, তার মা-বাবা তাকে নিয়ে ছুটছে সানডে স্কুল নামের ধর্মীয় স্কুল বা বাংলা ভাষা শিক্ষার স্কুলে। এই সব সানডে স্কুলের শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে তাদের প্রচলিত স্কুলের শিক্ষা ব্যবস্থার আকাশ-পাতাল ব্যবধান। অনেক সময় তাদের শিশু মনের কোমলতা ঠিকমতো না বুঝে এখানে তাদের সঙ্গে কঠোর আচরণ করা হয়। যেটা তাদের মনে বিরূপ ভাব সৃষ্টি করে, তারা আর সেই সব স্কুলের প্রতি কোনো আকর্ষণ বোধ করে না। এই সব মুক্ত মনা শিশুরা প্রকৃত অর্থেই মুক্তমনা এবং প্রবল যুক্তিবাদী। এদের ঝাপসা ব্যাখ্যা দিয়ে কোনো কিছু বোঝান বা বিশ্বাস জন্মানো প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। প্রয়োজনীয় যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা ছাড়া তাদের যদি পাতার পর পাতা কিছু মুখস্থ করতে বলা হয়, তারা সম্পূর্ণ বেঁকে বসে। শুরু হয় প্রচলিত ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি অনীহা।
ছুটির দিন সন্ধ্যায় আমেরিকান পরিবার যখন পারিবারিক সময় কাটায় ঘনিষ্ঠজনের সঙ্গে, আমরা তখন সেই অভাব পূরণ করতে জড়ো হই বিভিন্ন দাওয়াতে। বিদেশি পার্টির দেশি ভার্সন। বড়দের মন ভরে গল্পে, আড্ডায়, সাজে ও খাওয়ায়, সেই সঙ্গে ক্ষীণ আশা থাকে ছোটগুলো কিছুটা হলেও শিখে নেবে নিজেদের কালচার, পছন্দ করবে পোলাও, কোর্মা, ঝোল, রসগোল্লা, কালজাম। কিন্তু হায়, ছোটদের আর বড়দের রাজ্য হয়ে পড়ে বিভক্ত। একদিকে বাংলায় দেশের রাজনীতি, সমস্যা নিয়ে তর্কের ঝড় ওঠে, অন্য দিকে কোনো এক কোনার বিচ্ছিন্ন বেডরুমে চলে ইলেকট্রনিকসের প্যারালাল গেম, সেই সঙ্গে টুকটাক ইংরেজি আড্ডা নতুন গেম, গান, ইউটিউব ভিডিও এসব নিয়ে। খাওয়ার সময় ওরা টেবিলে পিৎজা খোঁজে, ঝোল বাঁচিয়ে সযত্নে তুলে নেয় মাংসের টুকরা, দেশি মিষ্টির আশেপাশে ঘুরে ফিরে চলে যায় এক টুকরো কেক বা এক স্কুপ আইসক্রিম নিয়ে। বড় মায়া হয় আমার এই বাচ্চাগুলোর জন্য। স্কুলে যে পার্টির গল্প এরা শোনে বন্ধুবান্ধবের কাছে তার সঙ্গে কোনো মিল নেই এই সব পার্টির। উপরন্তু নিমন্ত্রণ করে এনে তাদের জোরাজুরি করা হয়। খানিকটা ভদ্রতার চাপেই খেতে হয় তাদের জন্য ততটা লোভনীয় নয় খাবার।
স্কুলে আরেক সমস্যা শুরু হয় যখন অন্য দেশিরা আমাদের নির্দ্বিধায় ভারতীয় ভেবে বসে। বাচ্চাগুলো অনেক কষ্ট পায়—আমি তো ইন্ডিয়ান না, আমি বাংলাদেশি। তবে কেন ওরা আমাদের ইন্ডিয়ান বলে? যতই বোঝান হোক, আমেরিকান আর কানাডীয়দের যেমন আমাদের একরকম লাগে, ওদেরও আমাদের ইন্ডিয়ানদের মতো লাগে, ততই অভিমান বাড়ে—‘কই ইন্ডিয়ানদের তো বাংলাদেশি বলে না?’ বিদেশে বড় হওয়া এই শিশুগুলোর কাছে তখনো তাদের দেশের সঙ্গে একমাত্র বন্ধন তাদের জাতীয়তা। তারা জানে তাদের আদি পরিচয় তারা বাংলাদেশি, এই পরিচয়টুকু বড় মূল্যবান তাদের কাছে।
দিন গড়ায়, প্রাথমিক স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে ওরা এসে পড়ে মিডল স্কুলে। যতক্ষণ জেগে থাকে, তার বেশির ভাগ সময় ওরা কাটায় স্কুলে, আফটার স্কুল কেয়ারে আর বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলা, শিল্প, সাহিত্যচর্চায় যারা বেশির ভাগ এ দেশের সংস্কৃতিভিত্তিক। রাতের খুব অল্প কয়েক ঘণ্টা তারা পায় সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী এক কালচার, পরিবেশ। ওরা ঈদে ছুটি পায় না, রোজাতেও না, পূজাতেও না, বাঙালি নববর্ষেও না। বাসায় দেখে রোজার মাসে মা-বাবা ঠিকই কাজে যাচ্ছে নিয়মিত, রোজা রাখছে, সেই সঙ্গে শখ করে মাঝে মাঝে বাচ্চারাও। স্কুলের শেষে ইফতারের সময় বিকেলে চলে এক যুদ্ধ—ইফতার করবে, মসজিদে যাবে নাকি হোম ওয়ার্ক শেষ করবে। ঈদ মানে শুধু ঈদের দিনটা স্কুল ফাঁকি দিয়ে নতুন জামা পরে মসজিদে যাওয়া, বাবা-মার পারিবারিক বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানো এবং পরের দিন স্কুলে গিয়ে আগের দিনের বাড়তি হোমওয়ার্ক আর ক্লাস টেস্টের জন্য বাড়তি খাটা। অপর দিকে ক্রিসমাসের কথা তো বাদই দিলাম। হ্যালোইন, থ্যাংকস গিভিংসেও সাজ সাজ রব, স্কুল-পথে ঘাট-বাজারে, শুধুই উৎসবের আমেজ। অক্টোবরের শেষ থেকেই পুরো দেশের চেহারা পাল্টে যায়। স্বাভাবিকভাবেই শিশু মনগুলো পরিচিত হয়ে যায় থ্যাংকস গিভিংসের টার্কি, হ্যালোইনের কস্টিউম, ক্যান্ডি, ক্রিসমাসের সান্তাক্লজ, গিফট, ট্রি এগুলোর সঙ্গে, এগুলোই হয়ে যায় ওদের উৎসব, ওদের কাছে বেশি আপন। ক্রিসমাসে আশা করে থাকে গিফটের জন্য।
বারো-তেরো বছর হতে হতে প্রতিটা মানুষেরই ব্যক্তিত্বের বিকাশ শুরু হয়। তারা নিজেকে প্রশ্ন করতে শুরু করে কে আমি? আমার পরিচয় কি? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে এই বাচ্চাগুলো একবার তাকায় বাবা-মার দিকে যাদের সঙ্গে জন্মসূত্রে গভীর বন্ধন, বড় বেশি আপন তারা, কিন্তু অনেক দূরের মানুষও বটে। অনেক কিছুই তো তাদের সঙ্গে মেলে না, চিন্তা, চেতনা, পোশাক, খাদ্য, বিশ্বাস, ভালো লাগা, খারাপ লাগা, স্বপ্ন, মূল্যবোধ। তাহলে কী তাদের পরিচয় তাদের বাবা মায়ের পরিচয় থেকে ভিন্ন? এই ভিন্নতা এক ধরনের শূন্যতা তৈরি করে। ‘তাহলে আমরা কে? আমরা কাদের মতো?’ দ্বিধা আর সন্দেহ নিয়ে তাকায় বন্ধুদের দিকে। ভারতীয় বা উপমহাদেশীয় বন্ধুদের সঙ্গে হয়তো কিছুটা মিল আছে, কিন্তু তারাও ওদের মতো সংশয়ে দোদুল্যমান। যতক্ষণ বাড়ির বাইরে, ততক্ষণ আমেরিকান আর যতক্ষণ বাসায় ততক্ষণ বাংলাদেশি।
তবে কী আমরা আমেরিকান? না, পুরোপুরি তাও না। আমেরিকান বাচ্চারা অনেক স্বাবলম্বী। মা-বাবার ডিভোর্স, সেপারেশন ও সম্পূর্ণ ভিন্ন মূল্যবোধের কারণে এরা বাচ্চাদের অতিরিক্ত আদর দিয়ে নির্ভরশীল বানায় না। ওদের মানসিক পরিপক্বতাও অনেক বেশি অনেক ছোট বয়স থেকেই। আমেরিকান বাচ্চারা অনেক বাস্তববাদী, সবকিছুর শেষ ভরসা বাবা-মা এই ধরনের কোনো ভরসার ওপর নির্ভর করে তারা জীবন চালায় না। তাই ওদের সঙ্গেও পুরোপুরি মেলে না আমাদের এই বাচ্চাগুলোর। এ ছাড়া পরিবার আরোপিত বিভিন্ন বিধিনিষেধ তো আছেই। এ ধরনের পোশাক গ্রহণযোগ্য না, এত অল্প বয়সে ডেট করা যাবে না বা নির্দিষ্ট ধর্ম বা জাতির পাত্রপাত্রী ছাড়া বিয়ে করা যাবে না, অ্যালকোহল নিষেধ, বারে যাওয়া যাবে না, পই পই করে ছোটবেলা থেকে এগুলো ওদের মাথায় ঢোকানোর চেষ্টা করা হয়। বয়ঃসন্ধির দুর্বোধ্য মানসিক অবস্থায় যদি কারও প্রতি কোনো ভালো লাগা তৈরি হয়েও থাকে বাবা-মা কষ্ট পাবে এই ভয়ে সেটাকে চেপে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করা সহজ কাজ নয়। প্রেম, ভালো লাগা এগুলো কী আর অত জাতপাত মেনে করা সম্ভব? কিন্তু উপায় নেই। আমাদের বাচ্চারা জানে পারিবারিক মূল্যবোধ কতখানি বেশি গুরুত্বপূর্ণ আমাদের কাছে।
হাই স্কুল, ইউনিভার্সিটিতে এসব দেশে অবাধ মেলামেশা। আজকে এই নাচের প্রোগ্রাম, তো কালকে সেই ইভেন্ট। দেশি বাবা-মার দুশ্চিন্তায় ঘুম হারাম। আমেরিকান বাবা-মা যেটাকে সাবালকের লক্ষণ ভেবে সুখী, সেই একই কারণে চিন্তায় পড়ে দেশি বাবা-মা। মানসিকতা ও মূল্যবোধের এই আকাশ-পাতাল ব্যবধানের মাঝখানে শূন্যে ভাসতে থাকে এই বাচ্চাগুলো। হয়তো শেষ পর্যন্ত নিজেকে কোনো এক দিকে থিতু করে, নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দেয়, ‘আমি বাংলাদেশিও না, আমি আমেরিকানও না। যারা আমাকে ব্রাউন না কালারড বলে দ্বিধায় থাকে, তারা আসলে জানে না, আমি একটা আলাদা জাতি, আমি আন্তর্জাতিক।’