শুরুই যখন শেষ

টস হয়েছে, ব্যাট হাতে দুজন ওপেনার ইনিংসের গোড়াপত্তন করতে মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন। এঁদের মধ্যে একজন খেলবেন ম্যাচের প্রথম বল। কিন্তু কী দুর্ভাগ্য! প্রথম বলেই আউট হয়ে সাজঘরে ফিরতে হচ্ছে তাঁকে। মাথা নিচু করে এগোতে থাকা ব্যাটসম্যানটির নাম ততক্ষণে ছোট্ট একটি রেকর্ডের তালিকায় উঠে গেছে, ম্যাচের প্রথম বলে আউট হওয়ার রেকর্ড। লজ্জার এই রেকর্ডে নাম আছে অনেক বাঘা ব্যাটসম্যানের। এক দিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে এ তালিকা বেশ দীর্ঘ, সে তুলনায় দীর্ঘ ইতিহাসসমৃদ্ধ ক্রিকেটের প্রসিদ্ধ ফরম্যাট টেস্টে এ রেকর্ড অল্প কয়েকজনের। তাঁদের মধ্যে চেনাজানা কয়েকজনকে নিয়েই আজকের এ লেখা।


ডিন এলগার


তালিকায় সর্বশেষ যুক্ত হওয়া নাম ডিন এলগার। দক্ষিণ আফ্রিকান এই বাঁহাতি ওপেনার এখন পর্যন্ত ৬৩টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন। তাতে ১২টি সেঞ্চুরিসহ ৩৮.৪৯ গড়ে রান করেছেন ৩৮৮৮। দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে টেস্টে নিয়মিত ওপেন করা এলগার ২০১৯-এর ডিসেম্বরে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেঞ্চুরিয়ান টেস্টের প্রথম বলে আউট হন। বিপক্ষ দলের কিংবদন্তি পেসার জেমস অ্যান্ডারসনের বলে উইকেটরক্ষকের হাতে ক্যাচ তুলে বিদায় নেন তিনি।


লোকেশ রাহুল

ভারতীয় এই স্টাইলিশ ব্যাটসম্যান ক্রিকেট বিশ্বের নজরে এসেছিলেন আইপিএলে ভালো খেলে। তারপর জাতীয় দলে ডাক পাওয়া এবং ভালো পারফরম্যান্সে জায়গা পাকাপোক্ত করা। বর্তমান ভারতীয় দলে রাহুল বেশ নির্ভরশীল একজন ব্যাটসম্যান। কিন্তু ২০১৭ সালের নভেম্বরে, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে কলকাতা টেস্টে পেসার সুরঙ্গা লাকমালের বলে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে রেকর্ডবুকে ঢুকে যান তিনি। ষষ্ঠ ভারতীয় হিসেবে কোনো টেস্ট ম্যাচের প্রথম বলে আউট হন রাহুল।


ক্রিস গেইল


টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে একচ্ছত্র রাজত্ব করা ক্রিস গেইলকে সর্বশেষ টেস্ট খেলতে দেখা গেছে ২০১৪ সালে। গেইল কিন্তু টেস্টেও দুর্দান্ত ব্যাটসম্যান ছিলেন। শতাধিক টেস্ট খেলা গেইলের ঝুলিতে আছে ১৫টি টেস্ট সেঞ্চুরি, সঙ্গে একটি ট্রিপল সেঞ্চুরিও। কিন্তু ওয়ানডের পাশাপাশি টেস্টেও ম্যাচের প্রথম বলে আউট হওয়ার রেকর্ডে নাম আছে তাঁর। ২০১০-এর ডিসেম্বরে পালেকেল্লেতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম বলে লেগ বিফোর উইকেটের শিকার হন। অফস্ট্যাম্পের বল সুইং করে এসে মিডল স্ট্যাম্প সোজা প্যাডে আঘাত করে। বোলার ছিলেন সুরঙ্গা লাকমাল, এই রেকর্ডে মাত্র তৃতীয় বোলার হিসেবে তিনি একাধিকবার টেস্ট ম্যাচের প্রথম বলে উইকেট নেওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেন। 



অ্যান্ড্রু স্ট্রস


তাঁকে নিঃসন্দেহে ইংল্যান্ডের অন্যতম সেরা ওপেনার বলা যায়। ২১টি টেস্ট সেঞ্চুরিতে সাত হাজার রানের সমৃদ্ধ টেস্ট ক্যারিয়ার। জোহানেসবার্গ টেস্টে ২০১০-এর জানুয়ারিতে প্রতিপক্ষ অধিনায়ক গ্রায়েম স্মিথের সঙ্গে টসে জিতে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেন ইংল্যান্ড অধিনায়ক অ্যান্ড্রু স্ট্রস। দক্ষিণ আফ্রিকান গতি তারকা ডেল স্টেইনের করা প্রথম বলে ব্যাট চালালেন, কিন্তু ভাগ্যের কী নিষ্ঠুরতা! বল ব্যাটের কোণায় লেগে ব্যাকওয়ার্ড শর্ট লেগ অঞ্চলে দাঁড়ানো ফিল্ডার হাশিম আমলার হাতে দুর্দান্তভাবে জমা পড়ল। ম্যাচের প্রথম বলে আউট হয়ে ফিরলেন দলের ওপেনার-ক্যাপ্টেন।


ওয়াসিম জাফর


ভারতের প্রসিদ্ধ টেস্ট ইতিহাসে ওয়াসিম জাফরকে ঠিক তারকা বলা যাবে না, তবে তৎকালীন সময়ে তাঁর দৃষ্টিনন্দন ব্যাটিং ক্রিকেটবোদ্ধাদের প্রশংসা কুড়িয়েছিল। ২০০৭-এর মে মাসে বাংলাদেশের বিপক্ষে টেস্টে প্রথম বলে আউট হন তিনিও। চট্টগ্রামে তাঁকে আউট করেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। প্রায় ১৩ মাস পর ক্রিকেটে ফেরা মাশরাফি ম্যাচের প্রথম বলটি করেন গুড লেংথে। জাফর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে শুরুর বলটি ছেড়ে দেওয়ার জন্য ব্যাট উঁচু করেন। কিন্তু অফস্ট্যাম্পের বাইরে পড়া বল সুইং করে আঘাত করে অফস্ট্যাম্পের উপরিভাগে। রেকর্ডে নাম উঠে যায় জাফরের।


হান্নান সরকার


তালিকায় একমাত্র বাংলাদেশি হিসেবে নাম রয়েছে সাবেক এই ওপেনারের। কিন্তু একবার, দুবার না; তিন-তিনবার টেস্ট ম্যাচের প্রথম বলে আউট হয়েছেন তিনি। তিনবারই প্রতিপক্ষের নাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং বোলারের নাম পেড্রো কলিন্স। এটা বোধ হয় ক্রিকেটের সবচেয়ে অদ্ভুতুড়ে রেকর্ডও। প্রথমবার ঢাকায় ২০০২ সালের ডিসেম্বরে, কলিন্সের বলে উইকেট ভেঙেছিল হান্নান সরকারের। দ্বিতীয়বার ২০০৪ সালের মে মাসে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে সেবার কলিন্সের বলে লেগ বিফোর উইকেটের ফাঁদে পড়েছিলেন। এরপরের টেস্টেই তৃতীয়বার এই রেকর্ডের মালিক হন হান্নান, কিংস্টনে কলিন্সের বলেই ফের লেগ বিফোরের শিকার হন তিনি। এর মধ্য দিয়ে ক্রিকেট ইতিহাসের দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে তিনবার কোনো টেস্ট ম্যাচের প্রথম বলে আউট হওয়ার রেকর্ড গড়েন। তবে একই বোলার এবং প্রতিপক্ষকে হিসাবে আনলে, এমন রেকর্ড আরেকটিও নেই!


সনাথ জয়সুরিয়া

ক্রিকেটবোদ্ধারা জয়সুরিয়াকে ক্রিকেটের কিংবদন্তিদের ছোট্ট তালিকায় চোখ বন্ধ করে হিসাব করেন। ওয়ানডেতে তেরো হাজারের বেশি এবং টেস্টে প্রায় সাত হাজার রান করেছেন তিনি। কিন্তু তিনিও টেস্ট ম্যাচের প্রথম বলে আউট হয়েছিলেন। তখন শ্রীলঙ্কান ক্যাপ্টেন ছিলেন ‘মাতারা হারিকেন’-খ্যাত এই খেলোয়াড়। ১৯৯৯ সালের সেপ্টেম্বরে গলের মাঠে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টসে জিতে ব্যাট করতে নেমেছিলেন সতীর্থ ওপেনার আতাপাত্তুর সঙ্গে। সে ম্যাচে প্রথম বলে মার্ক ওয়াহকে ক্যাচ দিয়ে সাজঘরে ফিরেছিলেন জয়সুরিয়া। উইকেটটি নিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ান কিংবদন্তি গ্লেন ম্যাকগ্রা।


গ্যারি কারস্টেন

দক্ষিণ আফ্রিকান কিংবদন্তি ওপেনার কারস্টেনের সংগ্রহে আছে ২১টি টেস্ট সেঞ্চুরি ও ৭২৮৯ রান। কোচ হিসেবে ভারতকে জিতিয়েছেন ২০১১ সালের বিশ্বকাপ। ভূষিত হয়েছেন বিভিন্ন ক্রিকেটীয় সম্মানেও। একই সঙ্গে নাম লিখিয়েছেন গোল্ডেন ডাকের এই রেকর্ডে। কেপটাউনে ১৯৯৯-এর জানুয়ারিতে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান কিংবদন্তি স্যার কার্টলি অ্যামব্রোসের বলে উইকেটের পেছনে ক্যাচ তুলে আউট হয়েছিলেন। 


সুনীল গাভাস্কার


তালিকার সব থেকে বড় নাম বোধ হয় এটিই। কেননা, গাভাস্কারই প্রথম ব্যাটসম্যান, যিনি হান্নান সরকারেরও আগে তিনবার টেস্ট ম্যাচের প্রথম বলে আউট হওয়ার রেকর্ড করেছেন। টেস্টের সর্বপ্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে ১০ হাজার রান করেছিলেন ভারতীয় এই কিংবদন্তি। একসময় সর্বোচ্চসংখ্যক টেস্ট সেঞ্চুরির মালিক ছিলেন, ৫১-এর বেশি গড়ে করা ১০১২২ রান নিঃসন্দেহে তখনকার প্রেক্ষাপটে ঈর্ষণীয় এবং টপকানো অসম্ভব বলে মনে করা হতো। এত সব রেকর্ড তৈরি করা সুনীল প্রথমবার টেস্টের প্রথম বলে আউট হন ১৯৭৪ সালের জুলাই মাসে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে আরনল্ডের বলে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে আউট হয়েছিলেন। দ্বিতীয়বার একইভাবে আউট হন কলকাতায়, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ম্যালকম মার্শালের বলে, সাল তখন ১৯৮৩। প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে তৃতীয়বার এই রেকর্ডের পুনরাবৃত্তি করেন ১৯৮৭ সালে। পাকিস্তানের বিপক্ষে জয়পুর টেস্টে জাভেদ মিঁয়াদাদের হাতে ক্যাচ তুলে বিদায় নেন গাভাস্কার। বোলার ছিলেন কিংবদন্তি অধিনায়ক ইমরান খান। 


তথ্য ও উপাত্ত: ক্রিকইনফো