প্রক্সির পরে

অলংকরণ : আবু হাসান
অলংকরণ : আবু হাসান

সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন। মল্লিক স্যারের খোলামুখটা আস্তে আস্তে বাড়তে বাড়তে ৪০ পারসেন্ট হাঁ হয়ে গেল। আর চোখ দুটোর আচরণ হলো ব্যস্তানুপাতিক। দুই চোখ আস্তে আস্তে বুজতে থাকল, আটকে গেল ৩০ পারসেন্টে এসে। স্যারের চোখ এখন প্রায় বোজা। পিটপিট করে তাকাচ্ছেন আর হালকা করে বাতাস টানছেন নাক দিয়ে। শ্যালো ইঞ্জিন স্টার্ট দেওয়ার সময় প্রথম দিকে যেমন থেমে থেমে ভক ভক-টাইপের একটা আওয়াজ হয়, এ অবস্থায় নাক দিয়েও এ রকম থেমে থেমে একটু একটু করে বাতাস টানা হয়। নাকের আওয়াজটা কেবল হয় না। স্যার এখন সেই স্টেজে আছেন।

আমাদেরও প্রস্তুতি নেওয়া সারা। ক্লাসের অনেকেই দুই কানের ফুটো আঙুল দিয়ে বন্ধ করে ফেলেছি। কেননা, এখনই হবে সেই গগনবিদারী আওয়াজ। গগনবিদারী যদি নাও হয়, ভবনবিদারী তো বটেই! মল্লিক স্যারের মতো দশাসই পুরুষের হাঁচি বলে কথা! হাঁচির গতিবেগ নাকি ঘণ্টায় ১৬০ কিলোমিটার। এটা যদি সাধারণ মানুষের হাঁচি হয়, তাহলে স্যারেরটার গতি কত হবে? কথিত আছে (মানে, সিনিয়র ছাত্রদের কাছে শোনা) একদা ক্লাসরুমের ঘুলঘুলিতে বসবাসরত দুটি চড়ুই দাম্পত্যকলহে রত ছিল। এমন সময়ই বিকট আওয়াজে স্যারের হ্যাঁ..চ..চো...। সেই হাঁচিতে একটা চড়ুই পড়িমরি করে উড়ে পালাল। আর দ্বিতীয়টা জ্ঞান হারিয়ে টুপ করে পড়ে গেল ক্লাসরুমের মেঝেতে। বেচারা হয়তো ভেবেছিল বন্দুকের আওয়াজ! অবশ্য মাটিতে পড়েই তার জ্ঞান ফিরে আসে, সঙ্গে সঙ্গে উড়ে পালায়। এই গল্পটা অবশ্য আমরা বিশ্বাস করি না। বড় ভাইদের বানানো রসিকতাও হতে পারে।

কিন্তু সমস্ত আয়োজনের পরেও তা ভুল হয়ে গেল। এ রকম হয় না, যে সব কেনাকাটা, সাজসজ্জা, রান্নাবান্না, অতিথি খাওয়ানোর পর দেখা গেল যে বর নিজেই আসেনি? হাঁচির ক্ষেত্রেও এমন হয়। আকছারই হয়। উভয় ক্ষেত্রেই এই পণ্ড হওয়ার ঘটনা দুঃখজনক। এতে মেজাজ খারাপ হয়। মল্লিক স্যারেরও মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। খারাপ মানে চরম খারাপ। পাইপলাইন, থুড়ি...নাসিকালাইন থেকে হাঁচিটা উঁকি মেরেও এভাবে টা-টা দিয়ে চলে গেলে মেজাজ তো খারাপ হওয়ারই কথা!

আজ আমাদের ‘খাতা দেওয়া’ হবে। এই ‘খাতা দেওয়া’ মানে কিন্তু লেখার জন্য মাগনা মাগনা নতুন খাতা বিতরণ করা না। এই খাতাটা লেখায় ভরা, নতুন করে আর লেখার উপায় নাই। এর মানে হচ্ছে—পরীক্ষার খাতায় আমরা কে কী লিখেছি, কত নম্বর পেয়েছি...তা হাতে ধরিয়ে দেওয়া। ফলাফল জানানো। আজ দেওয়া হবে প্রথম সাময়িক পরীক্ষার ফল। কয়েক বছর আগেও আমরা এই ‘সাময়িক’ পরীক্ষাকে বলতাম—সামরিক পরীক্ষা! এখন নামটা ঠিক বলতে পারলেও ঠিকঠাকমতো নম্বর তুলতে পারছি না। এখানেই সমস্যা।

স্কুলের নিয়ম হচ্ছে খাতা দেওয়ার দিন সব ছাত্রছাত্রী ক্লাসে আসবে। কোনো হোমওয়ার্ক থাকবে না। সুতরাং স্যারদের হাতে নাজেহাল হওয়া বা শাস্তি পাওয়ারও ভয় নেই। প্রতিটি ক্লাসের শুরুতেই রোলকল করার পর স্যার বান্ডিল খুলে একটা করে পরীক্ষার খাতা তুলবেন। আর সেই খাতা থেকে পরীক্ষার্থীর রোল নম্বর ও নাম ধরে ডাকবেন। ছাত্রছাত্রীরা এক এক করে বেঞ্চ থেকে উঠে গিয়ে স্যারের হাত থেকে যার যার খাতা নিয়ে আসবে। এ সময় স্যার ঘোষণা করবেন, সে কত নম্বর পেল।

এই ব্যাপারটা ক্লাসের বইপোকা কয়েকজন বাদে বেশির ভাগের কাছেই খুব একটা সুখকর নয়। কারণ, খাতা হাতে তুলে দেওয়ার আগে স্যার তা উঁচু করে ক্লাসের সবাইকে দেখান। নম্বর কম পেলে নানা রকম মন্তব্য করেন। খুবই নিষ্ঠুর মন্তব্য। সেই মন্তব্য শুনে পরীক্ষায় খারাপ করা ফাঁকিবাজদের চোখ-মুখ লাল হয়ে যায়। কথায় বলে—মুখ নাকি লজ্জায় লাল হয়। আমাদের অবশ্য এই গুণটা নেই। এই যুগে লজ্জা অচল। তবে লজ্জা না থাকলেও আমাদের সেই রকম একটা ভাব ধরতে হয়। কাঁদো কাঁদো ভাবের লালপানা মুখ। নাহলে স্যার বলে বসবেন, ‘দেখেছিস কত বড় বেহায়া!’ এতেও হাসির রোল পড়বে। কিছু ছেলেমেয়ের জন্মই হয়েছে যেন অপরের বিপদে প্রাণ খুলে হাসতে পারার জন্য। এদের দিলে কোনো রহম নেই।

হাঁচি মিস করা খারাপ মেজাজ নিয়ে মল্নিক স্যার হাজিরা খাতা খুলে রোল কল শুরু করলেন। সবাই হাজির। এমনকি নিয়মিত ক্লাস কামাই দেওয়া ‘দেইল্যা’ মানে দেলোয়ারও আজ উপস্থিত। রোল কল শেষে স্যার খাতা দেওয়া কার্যক্রম শুরু করলেন। বান্ডিলটা মাত্র খুলেছেন, এমন সময় দরজায় এসে দাঁড়ালেন আমাদের নতুন হেডস্যার, আবদুল কাদির এমএবিএড। কিছুদিন আগে জয়েন করেছেন তিনি।

: আসতে পারি? ক্লাসে ঢোকার অনুমতি চাইলেন হেডস্যার। এটাই নিয়ম।

: অবশ্যই স্যার, আসুন। হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানালেন মল্লিক স্যার। এবার বোধ হয় তাঁর হাঁচিবিষয়ক মেজাজ খারাপ ভাবটা দূর হলো।

নতুন হেডস্যার যথেষ্ট বয়স্ক। সব সময় সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরেন। স্বভাবে নরমসরম। ধীরে কথা বলেন। মুখে হাসি লেগেই থাকে। দেখলেই বোঝা যায়, এই চোখ অনেক অভিজ্ঞ, ফাঁকি দেওয়া সহজ কম্মো নয়।

: কোন পরীক্ষার খাতা দেওয়া হচ্ছে মল্লিকবাবু? হেডস্যার জানতে চাইলেন।

: গণিত পরীক্ষার, স্যার।

: ছাত্রছাত্রী সবাই এসেছে?

: জি স্যার, সবাই উপস্থিত।

: খাতা দেওয়ার পদ্ধতিটা কী?

: প্রথমে হাইয়েস্ট মার্কসপ্রাপ্ত খাতা আলাদা করে রাখি। তারপর রোল নম্বর অনুযায়ী সবাইকে ডেকে খাতা হাতে তুলে দিই। সবশেষে দেওয়া হয় হাইয়েস্ট মার্কসের খাতা।

: বেশ, তাহলে আজকের খাতাটা কি আমি বিতরণ করতে পারি? হেডস্যারের এই প্রশ্নে মল্লিক স্যার তো বটেই, আমরাও সোত্সাহে সমর্থন জানাই। আমাদের খুশির বড় কারণ হচ্ছে—কম নম্বর পেলে হেডস্যার কোনো মানহানিকর মন্তব্য করবেন না। বড়জোর ভবিষ্যতে ভালো করার পরামর্শ দেবেন।

বান্ডিল থেকে হেডস্যার বেছে বেছে দুটো খাতা বের করে আলাদা রাখলেন। আমরা বুঝে নিলাম—এবার হাইয়েস্ট মার্কস পেয়েছে দুজন। খোরশেদ, শাহনাজ, দিদার, সামিয়ারা—এই চারজনের কপালেই সাধারণত হাইয়েস্ট মার্কস আসা-যাওয়া করে। এবার এদের মধ্যে কোন দুজন পেল কে জানে!

খোরশেদের রোল নম্বর এক। হেডস্যার দুই থেকে খাতা দেওয়া শুরু করলেন। তার মানে সৌভাগ্যবান দুজনের একজন খোরশেদ। তারপর একে একে শাহনাজ, দিদার, সামিয়ারাও খাতা পেয়ে গেল। তাহলে দ্বিতীয়জন কে? পুরো ক্লাস মাথা ঘামাতে লাগল। রোল নম্বর ৩৫, ৩৬, ৩৭-ও খাতা পেয়ে গেল, তবু দ্বিতীয় হাইয়েস্ট মার্কের দেখা নেই। ওমা! হেডস্যার ৩৭-এর পর রোল নম্বর ৩৯-কে খাতা নিতে ডাকলেন। তার মানে দ্বিতীয় হাইয়েস্ট মার্কস পেয়েছে রোল নম্বর ৩৮!

এ কীভাবে সম্ভব? সারা ক্লাসে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। ৩৮ তো আমাদের ‘দেইল্যা’ মানে দেলোয়ারের রোল নম্বর। সপ্তাহে অন্তত দুই দিন স্কুল কামাই না দিলে দেইল্যার পেটের ভাত হজম হয় না, চাল থেকে যায়। সব সাবজেক্টে টেনেটুনে পাস করতে পারলেই ও আমাদের মিষ্টি খাওয়ায়। সেই ছেলে কীভাবে হাইয়েস্ট মার্কস পায়! তা-ও আবার অঙ্ক কষে! পুরো ক্লাস, বিশেষ করে মূল দাবিদার চারজন ঘন ঘন দেলোয়ারের দিকে তাকাচ্ছে। চোখ-মুখ কুঁচকে মল্লিক স্যারও তাকিয়ে আছেন দেলোয়ারের দিকে। যেন দৃষ্টি দিয়েই এক্স-রে করে ফেলছেন। এত কাণ্ডের মাঝখানে পড়ে দেইল্যার অবস্থা কাহিল। ফ্যানের নিচে বসেও ঘামছে বেচারা! ওদিকে হেডস্যার ডেকেই চলেছেন ৬২, ৬৩, ৬৪ ...। ৭৩-এ গিয়ে থামলেন স্যার। আলাদা করে রাখা দুজন বাদে বাকিরা খাতা পেয়ে গেছে।

এবার হেডস্যার মুচকি হেসে একটি খাতা তুলে ডাকেন—রোল নম্বর এক, খোরশেদ আলম, তুমি পেয়েছ ৯৩। খোরশেদ বিনয়ের সঙ্গে স্যারের হাত থেকে খাতা নিয়ে আসে। এত সাবধানে হাতে নেয়—যেন ওটা হাওয়াই মিঠাই! চাপ লাগলেই গলে যাবে! এবার দ্বিতীয়জনকে ডাকলেন স্যার—রোল নম্বর ৩৮, দেলোয়ার হোসেন। আসো।

পুরো ক্লাসে আবার মৃদু গুঞ্জন শুরু হয়। দেলোয়ার পায়ে পায়ে দ্বিধা নিয়ে এগিয়ে আসে। কী জানি কী হয়!

: তোমার রোল নম্বর ৩৮? বিজয়ীর সঙ্গে যেন মজা করছেন অনুষ্ঠানের উপস্থাপক।

: জি স্যার। আমতা-আমতা করে দেলোয়ার জবাব দেয়।

: নাম দেলোয়ার হোসেন? আবারও হেডস্যারের মজার প্রশ্ন। আমরা হেসে উঠি। দেলোয়ারও হাসে।

: জি স্যার।

: এই ক্লাসে তুমি একাই দেলোয়ার? নাকি আরও কেউ আছে?

: না স্যার, আর কেউ নেই।

এইবার হেডস্যার দেলোয়ারকে ছেড়ে আমাদের দিকে তাকান। নরম অথচ গম্ভীর কণ্ঠে বলতে থাকেন, ‘কিছুদিন আগে, আমি যেদিন জয়েন করলাম, প্রথমেই তোমাদের ক্লাস নিয়েছিলাম। মনে আছে তোমাদের?’

: মনে আছে স্যার। সমস্বরে জবাব দিই আমরা।

: ওই দিন রোল নম্বর ৩৮-এ ‘প্রেজেন্ট স্যার’ বলে দাঁড়িয়েছিলে চারজন। এটা মনে আছে তো?

এতক্ষণে আমাদের কাছে গোটা ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়। এই না হলে হেডস্যার! আমরা চুপ মেরে থাকি।

হেডস্যার বলতে থাকেন, ‘আজ যেহেতু কেউ অনুপস্থিত নেই, তাহলে সেই দেলোয়ার চতুষ্টয়কে আরেকবার দেখি তো! এগিয়ে এসো।’

যাকে বলে একেবারে ছাই দিয়ে ধরা। ফসকানোর উপায় নেই। তাই সুড়সুড় করে চার আসামি যার যার অবস্থান থেকে বেরিয়ে এল। বসির, রানা, মামুন, আসাদ—এই চারজন ওই দিন দেলোয়ারের প্রক্সি দিয়েছিল। ওরা নতমুখে গিয়ে দাঁড়াল হেডস্যারের সামনে। স্যার দেলোয়ারের খাতাটা ওর হাতে দিয়ে বললেন, ‘নাও, তুমি পেয়েছ উনচল্লিশ। এবার সত্যি করে বলো তো বাবা, ওই দিন চার বন্ধুকে চার্জ বুঝিয়ে দিয়ে তুমি কোথায় চল্লিশ হয়েছিলে?’ বেকায়দায় পড়ে দেলোয়ার হড়বড় করে বলে দেয়, ‘স্যার সিনেমা দেখতে গেছিলাম। ওদেরকে বলছিলাম প্রক্সি দিতে। কিন্তু কাজটা কে করবে—এইটা ওরা আগে ঠিক কইরা রাখে নাই।’

‘প্রবাদে আছে—চোরের দশ দিন, গৃহস্থের এক দিন’—বলে মুচকি হাসেন হেডস্যার। ‘বুদ্ধিটা ভালোই করেছিলে, তবু শেষমেশ ধরা পড়তেই হলো। আচ্ছা, তোমাদের তো চালাক-চতুর বলেই মনে হয়, এই বোকামিটা কীভাবে হলো?’

স্যারের মেজাজ ভালো বিধায় মামুন সাহস করে বলল, ‘আসলে স্যার, সামান্য ভুলে ফুলপ্যান্ট থেকে হাফপ্যান্ট হয়ে গেছে।’

: সেটা কী রকম? চোখ গোল গোল করে হেডস্যারের কৌতূহলী প্রশ্ন।

: না, মানে, এ রকম একটা গল্প আছে স্যার। মিনমিন করে মামুন।

: বলে ফেলো গল্পটা, শুনি। আজকে তো আর পড়া নেই।

মামুন শুরু করে, ‘এক লোক রেডিমেড একটা ফুলপ্যান্ট কিনেছিল। বাসায় এনে দেখে, সেটা লম্বায় ইঞ্চি দুয়েক বড়। তাদের ছিল যৌথ পরিবার। তাই বেচারা একে-ওকে যাকে পায়, তাকেই অনুরোধ করে—সময় পেলে যেন তার ফুলপ্যান্টটা দুই ইঞ্চি কেটে কমিয়ে দেয়। নিজের স্ত্রী, দুই মেয়ে, ছোট তিন বোন, দুই ভাইঝি...এভাবে বারো-চৌদ্দজনকে অনুরোধটা করে বেচারা অফিসে চলে গেল। ভরসা ছিল, কেউ না কেউ কাজটা করে দেবে। রাতে অফিস থেকে ফেরার পর সেই ফুলপ্যান্টটা পরতে গিয়ে তো তার আক্কেলগুড়ুম! আস্ত ফুলপ্যান্ট দুই ইঞ্চি করে কমতে কমতে একেবারে হাফপ্যান্ট হয়ে গেছে। আসলে, সবাই দুই ইঞ্চি করে কেটেছিল।

দুই স্যারসহ গোটা ক্লাসরুম হাসিতে ফেটে পড়ল। হেডস্যার যাওয়ার আগে শুধু বললেন, ‘একটু-আধটু দুষ্টামি করতে পারো, তবে নিজেকে ঠকিয়ো না। লেখাপড়ায় কখনো ফাঁকিবাজি করবে না।’