ভয়

রাইসাকে আমি দিনে দশবার ফোন করি। অন্যদিন সাত-আটবারের পর তার রাগ কমে। আজ তা হচ্ছে না। সে রুক্ষ গলায় বলে, ‘কি! বারবার ফোন করো কেন?’ তার ফোন ধরতে পারিনি তখন। কারণটা বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করি। সে কিছুই শুনতে রাজি না। বলে, ‘ফাজলামো করো, আমি বুঝি না কিছু?’

‘কী বোঝো?’

‘কী বুঝব? মিথ্যুক কোথাকার!’

সে ফোন রেখে দেয়। আমাকে এখন বারবার ফোন করতে হবে। রিংটোন বাজা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ফোন ধরে রাখতে হবে।

কিন্তু আজকে তা হবে না। আমি তাকে আর ফোন করব না। এসব নাটক করার ইচ্ছে হয় না আজ। ফোন আমি মিস করতেই পারি। একটা কলেজের শিক্ষক আমি। চাকরি পেয়েছি মাত্র কয়েক মাস। বেসরকারি কলেজ। ক্লাস নিতে নিতেই আমার জান বের হয়ে যায়! ক্লাসে থাকলে তার ফোন ধরব কীভাবে?

আগে ফোন ভাইব্রেশনে দিয়ে রাখতাম। তার ফোন এলে দৌড়ে বাইরে গিয়ে কথা বলতাম। আমার ছাত্রছাত্রীরা হাঁ করে এসব দেখত। ফিরে এলে দেখতাম ওয়্যারলেসওয়ালা পুলিশের মতো সবার হাতে মোবাইল ধরে রাখা।

সেটি সমস্যা না। সমস্যা হচ্ছে একদিন একটা ফাজিল মেয়ে আমাকেই ফোন করে ফেলে। ফোন করে বলে, ‘মিয়াও!’ আমি চমকে উঠে বলি, ‘কে!’ সে আবার বলে, ‘মিয়াও মিয়াও।’ হতবাক হয়ে ফোনের দিকে তাকাই। দেখি পুরো ক্লাস হাসিতে হুটোপুটি খাচ্ছে। কে মিয়াও বলল কিছুই বুঝতে পারি না। এরপর থেকে আমি ফোন ধরি না। রাইসাকে বলেছি কখন কখন আমার ক্লাস টাইম। সে বলল, ‘তাহলে তুমি ক্লাসই করো। ক্লাসেই বিয়ে করো, ওসবই করো।’

ওসব মানে খুবই খারাপ কিছু। সে মাঝেমধ্যে এত খারাপ কথা বলে যে এটি সে তুলনায় কিছুই না। কিন্তু আমার এসব পাত্তা দিলে হবে না। বহু কষ্টের চাকরি আমার। ক্লাসে ফোন ধরে তা হারাতে পারি না।

আমার চাকরি হয়েছে কলেজ মালিকের হাতেপায়ে ধরে। তিনি আগের আমলে বিরাট ছাত্রনেতা ছিলেন। এত দাপট থাকলে এখন বিশ্ববিদ্যালয় বা টিভি চ্যানেল দিয়ে দেওয়া যায়। তিনি দিয়েছেন কলেজ। আমি তাঁর ক্যাডার ছিলাম। দশ-বারোটা মামলা খেয়ে জামিন পেতে পেতে ফকির হয়ে গেছি। দয়া করেই তিনি চাকরিটা দিয়েছেন আমাকে। বারবার সাবধান করে দিয়েছেন, আগের জীবন যেন ভুলে যাই। এখন শিক্ষক—এটাই যেন মনে রাখি।

আমি তা-ই করি। এই চাকরি আছে বলে এড়িয়ে থাকতে পারি মিটিং-মিছিল। এটা আছে বলে কোনোমতে খেয়ে–পরে বেঁচে আছি। চাকরিটি আমি হারাতে পারি না। রাইসাকেও আমি হারাতে পারি না। সে বড়লোকের মেয়ে। স’না সাম্বা কী কী যেন করা জীবন তার। আমার টিমটিমে জীবনের একমাত্র গ্ল্যামার সে। তাকে আমি যতটা ভালোবাসি, এই গ্ল্যামারটি তার চেয়েও বেশি।

কিন্তু তবু তাকে ফোন করিনি আজ। করার মতো মনও নেই আমার। সকালে যে বিশ্রী ব্যাপারটি ঘটেছে, কেন যেন তা ভুলতে পারছি না। সকালে কলেজের মালিক বসেছিলেন আমাদের সঙ্গে। তিনি অনেকটা দোকানদার টাইপের লোক। টাকা ছাড়া অন্য কিছু বোঝেন না। কেন তাঁর কলেজে ছাত্র ভর্তি হচ্ছে না বেশি—এ নিয়ে রাগারাগি করেছেন সব শিক্ষককে ডেকে।

সূর্যের চেয়ে বালুর উত্তাপ বেশি। তিনি চলে যাওয়ার পর প্রিন্সিপাল রাগারাগি শুরু করেন আমাদের সঙ্গে। তিনি ছিলেন একটা সরকারি কলেজের বাংলার শিক্ষক। কিন্তু রাগারাগিটা করেন ইংরেজিতে। তাও ভুল ইংরেজি। তিনি চোখ গরম করে বলেন, ‘এভরি টিচার মাস্ট সেল মিনিমাম টেন স্টুডেন্ট।’ সেল মানে বিক্রি করা। আমি বললাম,‘স্যার, আমরা তো বিক্রয় প্রতিনিধি না! আমরা ছাত্র সেল করব কীভাবে?’

আমার এই কথায় হেসে ওঠেন কেউ কেউ। তিনি খেপে যান। খেপে যা-তা বলতে থাকেন। শেষে হঠাৎ বলে বসেন, ‘যত সব গুন্ডাপান্ডা ঢুকিয়েছে কলেজে। ছাত্র আসবে কীভাবে?’

কথাটি তিনি বলেন আমাকে উদ্দেশ করে, আমার দিকে তাকিয়ে। আমার কী যে হয় এসব শুনে। তীব্র গলায় বলি, ‘আপনি তো পণ্ডিত! আপনাকে দেখে ছাত্র আসে না কেন?’

তিনি কর্কশ শব্দে পেছনে চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ান। রাগে কাঁপতে কাঁপতে কিছু একটা বলেন। তারপর মুষ্টিবদ্ধ দু-হাত সামনে ছুড়ে আমার দিকে এগোতে থাকেন।

তিনি মিথ্যে বলেননি। আমার গায়ে গুন্ডার রক্তই আছে। না হলে হুংকার দিয়ে আমিও তেড়ে যাই এমন! ভাগ্য ভালো, আমাদের দুজনকেই অন্যরা জাপটে ধরেন। আমাকে প্রায় পাঁজাকোলা করে বের করে নিয়ে আসেন কয়েকজন।

শিক্ষকদের বসার ঘরটায় নিজের টেবিলে ফিরে আসি আমি। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। কয়েক গ্লাস পানি খাই। অস্থির হয়ে বাথরুমে যাই। ক্লাসে ঢোকার সময় ফোনটা বন্ধ করতে পর্যন্ত ভুলে যাই। তখনই রাইসা ফোন করে আমাকে। কী যে বিরক্ত লাগে আমার। ফোনটা আছড়ে ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে করে।

ক্লাস থেকে ফিরে অনেকবার ফোন করেছি রাইসাকে। সে মিথ্যুক-টিথ্যুক—এসব বলে ফোন রেখে দিয়েছে। আমার সাহস বা ইচ্ছে কোনোটাই হয় না তাকে আসল ঘটনা জানাতে। তাকে এমনকি আর ফোন করার ইচ্ছেও হয় না।

তাকে আমি ফোন করি না আর। সেই ঘটনার পর চার-পাঁচ দিন হয়ে গেছে। আমি ফোন করি না, সেও না। এমন না যে আমার ফোন করার ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু চাকরি নিয়ে এমন দুশ্চিন্তায় থাকি, ফোন করতে ইচ্ছে হয় না।

দুশ্চিন্তার কারণ আছে। প্রিন্সিপাল এমনিতেই আমাকে দেখতে পারেন না। সেদিনের ঘটনার পর বিরাট সুযোগ পেয়েছেন তিনি। সবাইকে নাকি বলে বেড়াচ্ছেন আমাকে কলেজ থেকে না তাড়িয়ে ছাড়বেন না। শহীদ আমাকে বলেছে এটা। দার্শনিকদের মতো গলায় এও বলেছে যে সেদিন এতটা রেগে যাওয়া আমার ঠিক হয়নি। ওকে একটা থাপ্পড় মারতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু তার কথা শুনে আমারই থাপ্পড় খাওয়ার মতো অবস্থা। ভরসা হতে পারতেন কলেজের মালিক। কিন্তু আমার গুন্ডামির কথা শুনলে তিনিই হয়তো চলে যেতে বলবেন আমাকে।

এক রাতে আমি ভয়াবহ একটা স্বপ্নও দেখে ফেলি। দেখি আমি পুরো ন্যাংটা হয়ে কলেজে চলে এসেছি। ন্যাংটা যে এটা আমি বুঝি কলেজের টয়লেটে ঢোকার পর। টয়লেটে তুমুলভাবে ধাক্কাধাক্কি করছে কেউ। আমি সিটিয়ে পড়া গলায় বলি, কে, কে?

আমাকে হতবাক করে দিয়ে প্রিন্সিপাল বলেন, আজিজ মিয়া, তুমি লুকিয়ে আছ কেন বাথরুমে?

কই! কই লুকিয়ে!

দরজা বন্ধ কেন তোমার? খোলো।

তিনি এটা বলার সঙ্গে সঙ্গে বাথরুমের দরজা খুলে যায়। আমি ভয়ে-আতঙ্কে চিৎকার করে উঠি। ঘুম ভেঙে প্রথমেই হাতড়ে হাতড়ে নিজের কাপড়চোপড় ঠিক আছে কি না দেখি। আমি থাকি খালার বাড়িতে লজিং মাস্টারের মতো। দেখি ছোট কাজিনটা অবাক হয়ে তাকিয়ে আমার দিকে। তারপর সেও হঠাৎ পিলে চমকে দেওয়া একটা চিৎকার দিয়ে ছুটে বের হয়ে যায়।

কলেজে আসি অবসন্ন মনে। কালকে আমার বিভাগের সব শিক্ষককে নিয়ে প্রিন্সিপাল মিটিং করেছেন। এ রকম মিটিং তিনি করেন মাঝেমধ্যে। কালকের মিটিংয়ের সময় আমার ক্লাস ছিল। আমাকে বাদ দেওয়ার জন্যই কি ঠিক সে সময় তিনি মিটিংটি করেছেন?

ক্লাসে মন দিতে পারি না ঠিকমতো। মিয়াও মিয়াও কোন মেয়েটি করেছিল আমি এখন তা জানি। সে আমাকে বলে, ‘স্যার, আপনার কি শরীর খারাপ?’

আমার হয়তো শরীর খারাপই। ক্লাস তাড়াতাড়ি শেষ করে টেবিলে ফিরে যাই। এক গ্লাস পানি খাই। পানির গ্লাসটা মুখ থেকে সরাতেই গনগনে আগুন রঙের একটা ওড়না চোখ ঝলসে দেয়। আমার সামনে রাইসা দাঁড়িয়ে। সত্যি সত্যি রাইসা!

আমার ঠোঁটের কোণ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। চট করে দু-হাত দিয়ে প্যান্টটা ধরে দেখি আছে নাকি! রাইসা ঘন কণ্ঠে বলে, কী হয়েছে সোনা!

কিছু না তো!—আমি ধপ করে বসে পড়ি। হঠাৎ এমন ঘুম আসে আমার। ঘুম ঘুম চোখে আমি তাকে দেখি। সেও বসেছে এখন, একদম আমার দিকে তাকিয়ে। তার চোখে ভিজে যাচ্ছে অল্প অল্প। সে কান্নামাখা গলায় বলে, তুমি কি মরে গেছ!

আমি আস্তে আস্তে মাথা নাড়ি, মরিনি!

রাইসা বলে, তাহলে?

রাইসা আরও কত কিছু বলে আদরমাখা গলায়। আমার বিশ্বাস হয় না কিছু। বুভুক্ষুর মতো তাকিয়ে থাকি তার দিকে। এই কাঠফাটা রাগী মেয়েটার ভেতরটা এত নরম! ইচ্ছে হয় ছুটে বের হয়ে যাই তার সঙ্গে। ঘন সবুজ কোনো মাঠে বসি। প্রবল বাতাসে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি তাকে। কিন্তু সেটা সম্ভব না।

রাইসা চলে যায় একসময়। ঘোর লাগা মানুষের মতো বসে থাকি কিছুক্ষণ। ঘাড় তুলতেই দেখি আমার সহকর্মীরা তাকিয়ে আছে। আঠালো চোখে দেখছে আমাকে, যে আঠায় আটকে গেলে মশা-মাছির জীবন শেষ!

আঠা থেকে পা ছোটাতে হবে আমাকে। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, প্রিন্সিপালের কাছে মাফই চাইব আমি। না হলে এই চাকরি চলে গেলে করব কী? রাইসাকে কী বলব? তার ফ্যামিলির কাছে কোন মুখে দাঁড়াব?

প্রিন্সিপালের রুম তিনতলায়। ভাঙাচোরা ধাপের নোংরা একটা সিঁড়ি। সেটা আর শেষই হচ্ছে না আজ। তিনতলায় উঠে মুখ শুকিয়ে যায় আমার। আবার পানি খাওয়ার ইচ্ছে হয়। আমি কি এখন চলে যাব নিচতলায় আবার?

প্রিন্সিপালের রুমের সামনে দারোয়ান বসে থাকে। আজ সে নেই। প্রিন্সিপালও কি নেই রুমে? রুমেই থাকার কথা তাঁর। হয়তো দারোয়ানকে পাঠিয়েছেন কোথাও।

আমি তাঁর কাঠের দরজার সামনে এক মুহূর্ত দাঁড়াই। এই দরজার অন্য পারেই তিনি। সেখানে ঢুকে আমি যদি হঠাৎ মিয়াও মিয়াও করতে থাকি? আচমকা এটা মনে হতেই আতঙ্কে আমার হাত-পা অবশ হয়ে যায়। সত্যি যদি ভুলে করে ফেলি!

সজোরে মাথা ঝাঁকিয়ে ঝেড়ে ফেলি এসব চিন্তা। মিয়াও মিয়াও করলে নিশ্চিত আমার চাকরি চলে যাবে। চাকরি গেলে মারা যাব আমি। মনে মনে একটা সুরা পড়ি। হাত রাখি তাঁর দরজায়। ভেতরে ছোট একটা রুমের এক কোণে বসেন তিনি। সেখান থেকে বেশ জোরে ফ্যান চলার শব্দ হচ্ছে। আমার ছোঁয়াতেই কি না জানি না, কাঠের দরজা ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে ওঠে! ভেতর থেকে প্রিন্সিপাল হাঁক দেন, ‘কে ওখানে?’

দম বন্ধ হয়ে আসে আমার। দরজা ঠেলে ছুটে যাই তাঁর টেবিলের দিকে। তিনি মাথা গুঁজে কি যেন করছেন। তাঁর উল্টোদিকের চেয়ারটা ধরে টান দিই বসার জন্য। আমার জুতার মুখ সজোরে গুঁতো খায় সেখানে। তিনি হকচকিত হয়ে বলেন, ‘কী ব্যাপার!’

বসার কথা ভুলে যাই আমি। স্থির চোখে দেখি তাঁকে। ভয় পেয়েছেন, আবার তা আড়াল করার জন্য চোখ মুখ কুঁচকে আছেন। কঠোর গলায় এবার বলেন তিনি, ‘এখানে কেন?’

তাঁর গলা শুনে আমার ভয় পাওয়া উচিত। ভয় দেখানোর মতো করেই তিনি তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। কিন্তু আমার একটুও ভয় লাগে না, বরং হঠাৎ হাস্যকর লাগে সব কিছু। তাঁর সামনে মুখ বাড়িয়ে বলি, ‘মিয়াও!’

‘মানে!’

‘মিয়াও! মিয়াও!’

তিনি এবার ‘এইক এইক’—এ ধরনের একটা শব্দ করে দাঁড়িয়ে যান। দু-হাতের পাঁচ আঙুল বাঁকিয়ে তাঁর সামনে ধরি। জোরে জোরে বলি, ‘মিয়াও! মিয়াও!’

তিনি পিছু হটেন, আমি এগোই। শেষে তিনি পা ভাঁজ করে চেয়ারে গুটিসুটি হয়ে বসেন। দু-হাত আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে ধরেন মুখের সামনে। তাঁর চোখ বন্ধ, চশমা এক পাশে ঝুলে গেছে। মুখ থেকে গোঁ গোঁ শব্দ বের হচ্ছে।

আমার চেয়েও বহু গুণে ভীতসন্ত্রস্ত একজন মানুষ তিনি এখন। আমারই সামনে বসে! কী যে শান্তি লাগে তাঁকে দেখে আমার।