লাতু পুতু

দুদিকে দুপা ছড়িয়ে দিয়ে আলেক কাঁদছে।  ‘তোমার আবার কী হলো?’ অবাক হয়ে জানতে চায় শৌনক।

‘আমার লাতু ফুতুরে ফাইরাম না।’

‘লাতু পুতু আবার কারা?’

‘তুমি লাতু ফুতুরে দ্যাকসো না? আমার হাঁস?’

শৌনক বুঝতে পারে না, কী বলে সান্ত্বনা দেবে আলেককে।

শৌনক এরই মধ্যে জেনে নিয়েছে আলেকের পুরো নাম আলেকজান্ডার। সেই মেসিডোনিয়ার দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডারের নামে ওর নাম রাখা হয়েছে। এরই মধ্যে সতেরো বছর বয়সী শৌনকের সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গেছে ক্লাস ফাইভপড়ুয়া আলেকের। আলেক যখন শৌনককে ওর বাড়ি দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল, তখন থেকেই ওর মুখে কথার খই ফুটছে। বড়রা সুখাই জমিদারবাড়ি নিয়ে কথাবার্তা বলছিল, কিন্তু তা এত ভারী ভারী কথা যে শৌনকের শুনতেই ইচ্ছে করছিল না। তখনই আলেককে নিয়ে শৌনক বেরিয়ে এসেছিল ওখান থেকে। আলেকই জানাল, ও জমিদারবাড়ির নায়েবের ছেলে। সুখাই জমিদারবাড়িটা এখন পোড়োবাড়ি। বহুদিন সেখানে কেউ বাস করে না। পাশেই একটা ছোট্ট বাড়িতে থাকে আলেকরা। আলেকদের বাড়ির সব আসবাব পুরোনো। কোনো কোনোটা নাকি দেড় শ বছরের পুরোনো। নতুন কিছুই নেই।

কেন নতুন কিছু নেই, সে কথাও আলেক বলে দিয়েছে শৌনককে। ‘আমরার তো ট্যাকাপয়সা নাই। আমরা কিচ্চু কিনতে ফারছি না।’

জরাজীর্ণ বাড়িটায় কোনোমতে থাকে আলেকরা। জমিদারবাড়ির মানুষদের অবস্থাও খুব ভালো নয়। আসলে হাওরের মাঝে দ্বীপের মতো এই ভূখণ্ডটির মানুষ খুব গরিব। একটাই ফসল হয় বছরে, এবার তা ভেসে গেছে বানের জলে।

আলেক কাঁদতে কাঁদতে শৌনককে বলে, ‘আমরার হাঁস তুকাইয়া দ্যাও।’

আগের কথা

কথা ছিল, সুনামগঞ্জ থেকে এবড়োখেবড়ো পথে লেগুনায় করে তাহিরপুর যেতে হবে। সেখান থেকে উঠতে হবে বোট ‘রূপাবই’তে। কিন্তু রাত সাড়ে বারোটায় ঢাকা থেকে রওনা দেওয়া মাইক্রোবাসটা আশুগঞ্জে পৌঁছাতেই প্যাকেজ ট্যুর কোম্পানির আসাদ সাহেবের ফোন, ‘হ্যালো, আপনাদের জন্য সুসংবাদ আছে।’

‘তাই নাকি! বলুন।’ শৌমিক মাহমুদ জানতে চান।

‘সুনামগঞ্জ থেকে আপনাদের তাহিরপুর যেতে হবে না। বর্ষায় পানি বেড়েছে। আমাদের বোট সুনামগঞ্জের শাপবাড়ি ঘাট থেকেই আপনাদের তুলে নেবে।’

সুখবরটা জনে জনে ছড়িয়ে দেওয়া হলো। খুশিতে সবার মুখ ঝিকমিক। বর্ষার এ সময়ের হাওর নাকি দারুণ সুন্দর। সেখানে দুরাত কাটাবে বলে নয়জনের দলটা চলেছে সুনামগঞ্জ। নানা বয়সের এ দলটির প্রত্যেকের মনে উত্তেজনা! দলের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য শৌনক এবার এসএসসি পাস করেছে। পরীক্ষার পর আর কোথাও যাওয়া হয়নি, তাই ওর উত্তেজনা তুলনাহীন। বড় বোন ভার্সিটিপড়ুয়া সনকাকে কানে কানে ও বলল, ‘আমি কিন্তু রাতে ঘুমাব না। সারা রাত জেগে রাতের তারা দেখব।’

সনকা দিল বকা। ‘বর্ষাকালে তুই তারা দেখবি কী করে? আকাশে মেঘ থাকলে কি তারা দেখা যায়?’

একেবারেই দমে গেল না শৌনক। বলল, ‘মনের আকাশে মেঘ থাকে না।’

ওর পাকামিতে হো হো করে হেসে উঠল বড়রা। বড়রা মানে দুই পরিবারের সাতজন। শৌমিক মাহমুদ, ইলোরা মাহমুদ, সনকা আর শৌনক। অন্য পরিবারের ড. অনল রায়হান, সাগরিকা রায়হান আর তাঁদের মেয়ে দীপালি। দীপালি আগামীবার এসএসসি দেবে। সুমন্ত আহসান অনল রায়হানের বন্ধু। মাইক্রোবাসে তিনি যখন ‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’ গাইতে শুরু করলেন, তখন ওরা সবাই স্বীকার করে নিল, হাওরে এই সুরেলা কণ্ঠের গান ওদের ভালো লাগবে। আর আছে দীপ্ত। অনল রায়হানের দূরসম্পর্কের ভাগনে। আগামী বছর ওর এইচএসসি। হাতসাফাইয়ের খেলা দেখাতে পারে।

শাপবাড়ি ঘাটে সত্যিই দাঁড়িয়ে ছিল রাজহাঁসের মতো রূপাবই নামের বোটটি। মাইক্রোবাস সেখানে পৌঁছাল ভোর সাড়ে পাঁচটায়। সাড়ে ছয়টায় বোট চলতে শুরু করল। সামনের দুদিন এই বোটই ওদের বাড়ি। এখানেই থাকা, এখানেই খাওয়া। মেন্যু দারুণ। দিনের বেলায় ঘাট থেকে কেনা তাজা মাছ। রাতে মুরগি বা হাঁসের মাংস। সকালে ভুনা খিচুড়ি আর ডিম।

ওদের প্রথম গন্তব্য সুখাই জমিদারবাড়ি। সেখানে পৌঁছানো গেল বেলা সাড়ে এগারোটায়। নেমেই আলেকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল শৌনকের।

সিদ্ধান্ত

শৌনক আর আলেক নায়েববাড়ি থেকে বের হলো। জমিদারবাড়িতে তখন বড়দের কথাবার্তা শেষ হয়েছে। সেখানে অন্যদের সঙ্গে ছিলেন আলেকের বাবা-মা। আলেক এসে বাবাকে বলল, ‘আমার লাতু ফুতুরে ফাইরাম না।’

ওর বাবা ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘তাইলে খিতা? আবার নতুন হাঁস কিনিয়া দিমু তুমারে।’

‘না। আমি আমার লাতু ফুতুরে চাই।’

বাবা বললেন, ‘আইচ্চা, আমি তুকাইয়া দেকমু। তুমি তুকাইছো না?

‘তুকাইছি। ডাকছি। লাতু ফুতুয়ে শব্দ করসে না।’

বাবা আর কথা বলেন না। মাকে নিয়ে বেরিয়ে যান। আলেকও চোখের পানিতে গোসল করতে করতে তাদের পিছু ধরে।

ওই ভিড়ের মধ্যেই শৌনক সনকাকে খুঁজে পেল। কানে কানে বলল, ‘সনকা আপু! আলেকের দুইটা হাঁস চুরি হয়ে গেছে।’

সনকা পাত্তা দেয় না। বলে, ‘এখন তো দুপুর। কোথাও নিশ্চয় গেছে। সন্ধ্যার আগে ফিরে আসবে।’

শৌনক দুদিকে মাথা নেড়ে বলে, ‘না। এর আগে নাকি কখনো এমন হয়নি। আলেক ওদের নাম ধরে ডাকলেই ওরা প্যাঁক প্যাঁক করে উঠত।’

মনমরা শৌনক একা একাই হাঁটা দেয় জমিদারবাড়ির দিকে। আগাছায় ছেয়ে যাওয়া বাড়ির ঘরগুলোয় যায়, দেখে হাঁস আছে কি না।

শৌনক ভাবতে থাকে, হঠাত্ বলা নেই কওয়া নেই, হাঁস দুটো গায়েব হয়ে গেল কেন? কী হতে পারে? কে চুরি করতে পারে হাঁস?

ওরা সুখাই জমিদারবাড়ি আসার পর যারা ওদের অভ্যর্থনা জানাতে এসেছিল, তাদের মধ্যে কি সন্দেহজনক কেউ আছে? জমিদারবাড়ির কেয়ারটেকার রঘু মিয়া বলেছিল, এই গ্রামে অনেক দিন কেউ ভালো খেতে পায় না।

রঘু মিয়ার একটা চোখ পাথরের। এক চোখ দিয়ে কখন কার দিকে তাকায়, তা বোঝা যায় না। শৌনকের মনে হয়, রঘু মিয়াই আলেকের হাঁস দুটো সরিয়ে ফেলতে পারে।

জমিদারবাড়ির ছাদে আগাছা সাফ করছিল রঘু মিয়া। শৌনক তার কাছাকাছি হতেই রঘু মিয়া বলে, ‘কিতা অবস্থা দ্যাকসো নি? আমরার আলেকোর হাঁস দুইটা তুকাইয়া ফারনা। ফুয়াটায় খালি কান্দেভ তুমি তার কাছে একটু যাও না। হে ফুড়ুত্তা মানুষ। একটু হাতাইয়া মাতাইয়া রাখো তারে।’

না। রঘু মিয়া হাঁস চুরি করেনি। চুরি করলে এত মমতামাখা স্বরে কথা বলত না।

হঠাত্ জমিদারবাড়ির পাশের সেলুনের আলী মিয়ার কথা মনে হয়। আলী মিয়া বলেছিল, ‘বউতদিন বালা কিচ্চু খাইসি নারে বা। আজকে একটু বালা-মন্দ কাইমু।’

কেন এ কথা বলেছিল আলী মিয়া? সে কি আলেকের হাঁসগুলো চুরি করেছে?

আলী মিয়ার চেহারাটা ভেসে ওঠে শৌনকের চোখে। খুবই নিরীহ গোবেচারা সে। অপরাধীদের চেহারা এ রকম নিরীহ হয়। প্রথমে ধরা যায় না তারা কত বড় অপরাধী। কিন্তু ধরা পড়ার পরই কেবল বোঝা যায় নিরীহ চেহারার আড়ালে কেমন সে লোক!

শৌনক আস্তে আস্তে আলী মিয়ার সেলুনে যায়। আলী মিয়া তখন একটি ছেলেকে ন্যাড়া করার কাজে ব্যস্ত। সামনে আয়না লাগানো চেয়ারে গিয়ে বসে শৌনক। একটু চুল আঁচড়ায়। তারপর আলী মিয়াকে জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি কি আলেককে চেনেন?’

‘খ্যানে ছিনতাম না? নোয়াববাড়ির ফোয়া।’ তারপর রহস্যময় হাসি হেসে বলে, ‘আলেক হইল আমরার লাতু ফুতুর মা। হাঁস দুইটারে ছাড়িয়া হেক্কিবারে থাকতে পারে না।’

‘ওর হাঁস দুইটা কোথায়?’

‘আলেকরে জিগাও। মনে অয় তার লগেউ আছে।’

বলে আবার চুল কাটায় মন দেয় আলী মিয়া।

যেন হঠাত্ মনে পড়ল, এমনভাবে শৌনক আলী মিয়াকে প্রশ্ন করে, ‘আপনি আজ ভালো কিছু খাবেন কোথায়?’

‘আমি? আমি আজকে আমার চাচার চল্লিশা খাওয়ার লাগি জাইমু। ওনো বালা খাওয়ার ব্যবস্থা থাকব। পেট ভরিয়া ভাত খাইমুরে বা!’

খুব লজ্জা পেয়ে যায় শৌনক। এ রকম একজন সাদাসিধা মানুষকে চোর ভেবে বসে আছে ও!

আবার জমিদারবাড়ির কাছে ফিরে আসে। 

‘কী, একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছ?’ দীপ্ত কখন এসে শৌনকের পাশে দাঁড়িয়েছে, টেরই পায়নি ও।

‘আমি ভাবছি আলেকের কথা।’

‘খুব ভালো ছেলেটা।’ দীপ্ত ওর তারিফ করে। ‘যাওয়ার আগে ওকে একটা হাতসাফাইয়ের খেলা দেখিয়ে যাব! একটা পেনসিল বের করব ওর গলা থেকে।’

শৌনকের চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে, ‘তুমি কি হাতসাফাই করে ওর হাঁস দুইটা নিয়ে আসতে পারো?’

দীপ্ত অবাক চোখে তাকিয়ে বলে, ‘কী হয়েছে ওর হাঁসের?’

কাঁদো কাঁদো গলায় শৌনক বলে, ‘আলেক ওর হাঁস দুটো খুঁজে পাচ্ছে না।’

দীপ্ত খুব মনমরা হয়ে বলে, ‘হাতসাফাই মানে তো কোনো কিছু লুকিয়ে রেখে অন্যের চোখে ধুলো দিয়ে তা বের করা আনা। কিংবা তা ভ্যানিশ করে দেওয়া। আমি তো হাঁস দুটো লুকিয়ে রাখিনি।’

‘কী হয়েছে রে?’ দীপ্তকে প্রশ্ন করে ওদের দিকে এগিয়ে আসে দীপালি। সনকাও আসে ওর সঙ্গে।

দীপ্তর কাছ থেকে আলেকের হাঁস চুরির কথা শুনে দীপালি বলে, ‘ছেলেটা খুব কষ্ট পাচ্ছে।’

সনকা বলে, ‘ওর জন্য আমাদের কিছু একটা করতে হবে।’

‘ঠিক। হাঁসগুলো খুঁজে না পেলে ওকে কি আমরা দুটো হাঁস কিনে দিতে পারি না?’ শৌনক বলল।

‘খুব ভালো আইডিয়া!’ বলল দীপ্ত। আমি মামার কাছ থেকে টাকা চেয়ে নেব।’

‘আমি বাবার কাছে চাইব।’ বলল সনকা।

নিজেদের সিদ্ধান্তে নিজেরাই খুব খুশি হলো ওরা। ভাবল, এখনই খবরটা জানাতে হবে আলেককে।

আলেকের কান্না থামে না

নায়েববাড়ির কাছে গিয়ে ওরা আলেককে ডাকতে লাগল। ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন আলেকের মা। তাঁর চোখেও পানি। ছেলের কান্না সহ্য করতে পারছেন না তিনি।

‘আলেক কোথায়?’ শৌনক জিজ্ঞেস করে।

‘খানতে খানতে গুমাই গেসে।’

‘হাঁস আর পাওয়া গেল না?’

অসহায় কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘খ্যামনে পাওয়া যাইব?’

ওরা তখন ওদের ভাবনাটা বলে দেয়, ‘আমরা যদি আপনাদের দুটো হাঁসের টাকা দিই, তাহলে তো আলেকের জন্য হাঁস কিনে দিতে পারবেন!’

আলেকের মায়ের চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে, ‘অয় অয়, খিনতে পারমু।’

‘তাহলে আজ বিকেলে আমরা চলে যাওয়ার আগে আপনার হাতে টাকা দিয়ে যাব।’ বলে দীপালি।

‘না।’ চিত্কার ভেসে আসে ঘর থেকে। ওরা অবাক হয়ে লক্ষ করে, এতক্ষণ ওদের কথাবার্তা শুনেছে আলেক। ও বাইরে এসে মায়ের আঁচল ধরে দাঁড়ায়। তারপর খুব শান্তস্বরে বলে, ‘আমার লাতু ফুতুকে আইন্যা দ্যাও। আমি অইন্য হাঁস নিতাম নায়।’

তারপর এক ছুটে জমিদারবাড়ির ভেতরে চলে যায় আলেক। জমিদারবাড়ির ভেতর থেকে ওর চিত্কার শোনা যায়, ‘লা...তু..., ফু...তু...

মাছ

জমিদারবাড়ির ঘাটে এ সময় এসে থামে ছোট্ট একটা জেলে নৌকা। সদ্য হাওর থেকে ধরে আনা হয়েছে মাছ। ছোট ছোট পাঁচমিশালি মাছ। একটা বড় রুইও আছে। রূপাবইয়ের গাইড বেলাল কোত্থেকে ছুটে আসে। মাছের দরদাম করতে থাকে। শৌনকের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘এই ছোট মাছের চচ্চড়ি করলে যা মজা লাগবে! তুমি খাবে তো?’

শৌনক অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘আমি শুধু মাংস আর বড় মাছ খাই। ছোট মাছ খাই না।’

বেলাল বলল, ‘আজ রাতে একটু খেয়ে দেখো, তোমার মন ভরে যাবে।’

ইলোরা মাহমুদ আক্ষেপ করে বললেন, ‘আর বলবেন না, বেলাল। শৌনককে ছোট মাছ খাওয়ানোর কত চেষ্টা করেছি, একদম খেতে চায় না।’

গাইড বেলাল রুই মাছ আর পাঁচমিশালি মাছ কিনে ঘাটে ভেড়ানো রূপাবইয়ের দিকে চলে যায়। বাবুর্চির হাতে দিতে হবে মাছ। একটু পর চুলোয় আগুন জ্বলবে। একটু পর ওরা আবার চলে যাবে মাঝহাওরে। সেখানে একটা জায়গায় সবাই গোসল করার জন্য নামবে। সেই অবসরে রান্না হয়ে যাবে।

ছোটদের দল রূপাবইতে ফিরে যায়। ওদের মন ভালো না।

ওদের সামনে দিয়ে বাবুর্চি মেহরাজ চলে যায়। একটু পর রান্নাবান্না শুরু করবে।

হঠাত্ শৌনক লাফ দিয়ে ওঠে। বলে, ‘সনকা আপু, চলো আলেকের কাছে।’  

চমকে ওঠে সনকা, ‘হাঁস দুটো পাওয়া গেছে?’

‘জানি না, কিন্তু আমার একটা সন্দেহ হচ্ছে। ওকে এখানে নিয়ে আসতে হবে।’

দীপ্ত আর দীপালিও উঠে দাঁড়ায়। ওরা চারজন নেমে পড়ে রূপাবই থেকে। দৌড়ে চলে যায় নায়েববাড়ির দিকে।

জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে ছিল আলেক। সনকা বলে, ‘আলেক, শিগগির আমাদের সঙ্গে এসো।’

আলেক কিছু বুঝতে পারে না। কিন্তু কিছু একটা ঘটতে চলেছে বুঝে দ্রুত চলে আসে ওদের সঙ্গে। ততক্ষণে বড়রাও উঠে এসেছে রূপাবইয়ে।

আলেককে নিয়ে ওরা চারজন ফিরে এসেছে দেখে বড়রা ওদের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। শৌনক ছাড়া বাকি তিনজনও জানে না, কী কারণে আলেককে রূপাবইয়ে নিয়ে আসা হয়েছে।

শৌনক এবার আলেককে বলল, ‘আলেক, তুমি লাতু পুতুকে ডাকো তো!’

আলেক ফ্যালফ্যাল করে শৌনকের দিকে তাকিয়ে থাকে।

শৌনক আবার বলে, ‘ডাকো!’

ভয়ে ভয়ে আলেক খুবই নিচুস্বরে ডাকে, ‘লাতু ফুতু...’

সবাই নিশ্চুপ হয়ে গেছে। কিন্তু কোনো সাড়া পাওয়া যায় না।

শৌনক এদিক-ওদিক মাথা নাড়ে। বলে, ‘জোরে ডাকো।’

এবার শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে আলেক চিত্কার করে ডাকে, ‘লা...তু,ফু...তু...

এবং তখন সবাইকে চমকে দিয়ে বোটের একেবারে পেছন থেকে আওয়াজ আসে, ‘প্যাঁক প্যাঁক প্যাঁক, প্যাঁক প্যাঁক প্যাঁক...’

আলেকের চোখ আনন্দে জ্বলে ওঠে। ও চিত্কার করে ওঠে, ‘আমার লাতু, আমার ফুতু...’

শৌনক বলে, ‘আমাদের বোটের রান্নাঘরে আছে লাতু পুতু। শিগগির ওদের এখানে নিয়ে আসুন।’

এ কথা বাবুর্চি মেহরাজের কানে যায়। সে অবাক হয়ে বলে, ‘হাঁসগুলোকে নিয়ে আসব কেন? ও দুটো হাঁস তো আজ রাতে রান্না করা হবে।’

‘কোনো কথা বলবেন না।’ শৌনক চেঁচিয়ে ওঠে, ‘ওদের এখনই আলেকের হাতে দিয়ে দিন।’

মেহরাজ বড়দের দিকে তাকায়। তারা শৌনকের কথামতো কাজ করতে বলে।

বিরক্ত হয়ে মেহরাজ হাঁস দুটি আলেকের হাতে তুলে দেয়। আলেক ওদের হাতে পেয়ে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিতে থাকে। তারপর নেমে পড়ে রূপাবই থেকে। ছেড়ে দেয় নিচে। ওরা আলেকের পেছন পেছন হেলেদুলে চলে যায়।

রাতের খাবার কী হবে?

‘তোমার কেন মনে হলো, হাঁস দুটি এখানে থাকতে পারে?’ প্রশ্ন করলেন অনল রায়হান।

‘বোটে ওঠার আগেই আমরা জেনেছিলাম আমাদের দিনের মেন্যু মাছ, রাতের মেন্যু মাংস। হঠাত্ আমার মনে হলো, আলেকের হাঁস দুটোকেই তো রাতের খাবার হিসেবে কিনে আনা হতে পারে। আমরা যখন আলেকের মাকে লাতু পুতুর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি বললেন, কীভাবে পাওয়া যাবে? আলেকের বাবা বলেছিলেন, আলেককে নতুন হাঁস কিনে দেবেন।’ তাতে মনে হলো, তাঁরা জানেন হাঁস দুটো আর ফিরবে না। তাই আর কিছু না ভেবে আমি আলেককে ডেকে আনলাম।’

ইলোরা মাহমুদ বললেন, ‘যাক, আলেকের আনন্দ দেখে মন ভরে গেল।’

দীপ্ত বলল, ‘শৌনক, রাতে তো তোমাকে তাহলে উপোস থাকতে হবে। আমাদের তো আর রাতে খাবার জন্য মাংস নেই।’

শৌনক বলল, ‘পাঁচমিশালি মাছটা রাতের জন্য করতে বলে দাও। ওটা নাকি দারুণ মজা!’

বাবুর্চি মেহরাজের কাছে জানা গেল, আলেকের বাবাই অভাবের কারণে আলেককে না বলে হাঁস দুটি বিক্রি করে দিয়েছিলেন। সে কথা জেনে আলেকের বাবার প্রতি কোনো রাগ জন্মাল না কারও মনে; বরং একটা মমতায় ভরে উঠল মন।

সনকা শৌমিক মাহমুদকে বলল, ‘বাবা, হাঁস কেনার টাকা আর ফেরত নিয়ো না।’

এ কথায় যে সবার সায় আছে, তা ওদের মুখের দিকে তাকিয়েই বোঝা গেল।

অলংকরণ: নাশাদ সাকেব