রকহপার পেঙ্গুইনটা কোথায়?

কাচ্চি খেলে এক ধরনের আনন্দ হয়, আবার খেলায় জিতলে হয় আরেক ধরনের আনন্দ। পছন্দের বইটা কিনলে আনন্দ হয়, আনন্দ হয় পরীক্ষায় পাস করলেও। ঠিক তেমনি একটা অবর্ণনীয় আনন্দ হয় কোনো সমস্যা সমাধান করলে। যে আনন্দ সব আনন্দের চেয়ে ভিন্ন।

তুমি আসলে এই জীবনে অনেকবার সমস্যা সমাধান করেছ এবং আমি নিশ্চিত করতে পারি, তোমার জীবনে এই আনন্দ অনেকবারই এসেছে। হয়তো তুমি জানোওনি কোনটাকে সমস্যা বলে, কিন্তু অনুভূতিটা পেয়ে গেছ। আজ তোমাকে জানিয়ে দিই সমস্যা আসলে কোনগুলো? ইংরেজিতে যাকে বলে প্রবলেম।

শুধু সমস্যাকে বোঝা কঠিন। সমস্যা আর অনুশীলনী একসঙ্গে করলে তুলনা করে বুঝতে সুবিধা হয়। সমস্যা এবং অনুশীলনী, দুই ক্ষেত্রেই আমরা কোনো একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজি। উত্তরটা পাওয়াই সমাধান।

অনুশীলনী হলো সেসব প্রশ্ন, যেগুলোর উত্তর খোঁজার পদ্ধতি তুমি কারও কাছে একদম স্টেপ বাই স্টেপ শিখেছ। যেমন ধরো দুইটা সংখ্যার যোগ করা। কীভাবে দুইটা সংখ্যা যোগ করতে হবে, চিন্তা করে দেখো, প্রতিটি স্টেপ তুমি শিখেছ। স্টেপগুলো অনুসরণ করলেই তুমি উত্তর পেয়ে যাবে।

সমস্যা কিন্তু তা নয়। সমস্যা হলো এমন প্রশ্ন, যার উত্তর বের করার স্টেপ বাই স্টেপ কোনো পদ্ধতি তোমাকে কেউ শেখায়নি। বরং ওই ধাপগুলোও তোমাকে নিজেকেই খুঁজে বের করতে হবে। যেমন ধরো ধাঁধা। অধিকাংশ ধাঁধা সমাধানের পদ্ধতি তোমাকে কেউ শেখায়নি। ওই ধাঁধাগুলো তোমার জন্য সমস্যা।

সাধারণত আমাদের ক্লাসের বইয়ের প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে, বিশেষ করে গণিত বইয়ের অধ্যায়ের শেষে অনেকগুলো অনুশীলনী থাকে, ওই অনুশীলনীর সমাধান বের করলে তোমার নিশ্চয় কিছুটা আনন্দ হয়, তবে কতগুলো স্টেপ অনুসরণ করতে আসলে খুব ভালো লাগে না। কারণ একদম নির্ধারিত ধাপ অনুসরণ করে কাজ তো যন্ত্রও করতে পারে, মানুষ তো আর যন্ত্র নয়।

কিন্তু তুমি যখন সমস্যা সমাধান করো, তখন তোমার নিজেকেই পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে হয়। এবং ওই পদ্ধতিতে যখন সমাধানটা পাওয়া যায়, তখন আসলে তোমার আনন্দ হয়। এই আনন্দই সমস্যা সমাধানের আনন্দ। যন্ত্র এই আনন্দ পায় না, কারণ সে সমাধানের ধাপগুলো তৈরি করে না।

সমস্যা সমাধানের যেমন নির্দিষ্ট ধাপ নেই, তেমন সমস্যার রকমফেরও নির্দিষ্ট নয়। একটা গাড়ি কীভাবে চলে তা বোঝার চেষ্টা করাও যেমন সমস্যা সমাধান, পদ্মা সেতু বানাতে কীভাবে নদীর স্রোতকে নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, তা–ও একধরনের সমস্যারই সমাধান। তো এমনই কতগুলো সমস্যা তোমাদের এই লেখার সঙ্গে দিচ্ছি।

এই লেখার সঙ্গে দেওয়া ৬টা ছবির উৎস বৈজ্ঞানিক জার্নাল ‘নেচার’–এর দৈনিক ব্রিফিং। এই ছবির প্রতিটিতে একটি রকহপার পেঙ্গুইন লুকিয়ে আছে। তোমাদের কাজ হলো পেঙ্গুইনটাকে খুঁজে বের করতে হবে।

প্রথম প্রশ্ন হলো খুঁজে বের করার পদ্ধতি কী? আসলে ধাপে ধাপে বলে দেওয়ার মতো কোনো পদ্ধতি তোমাকে শেখানো হয়নি। তার মানে পেঙ্গুইনটাকে খুঁজে পাওয়া একটা সমস্যা সমাধান করা। আমি নিশ্চিত করছি, একটি ছবিতে পেঙ্গুইনটাকে খুঁজে পাওয়ার পরে তোমার আনন্দ হবে, ওই আনন্দই সমস্যা সমাধানের আনন্দ।

কোন কোন ছবিতে পেঙ্গুইনটা খুঁজে পেতে তোমার খানিকটা সময় লাগতে পারে, এর মানে সমস্যাটা হয়তো একটু কঠিন, তাই সময় লাগছে। যত কঠিন সমস্যা সমাধান করবে, তোমার আনন্দ তত বেশি হবে। যত বেশি সময় তুমি একটা সমস্যা নিয়ে চিন্তা করবে, তোমার তত বেশি সময় লাগবে। এবং আনন্দও তত বেশিই হবে।

এবার রকহপার পেঙ্গুইন নিয়ে একটু বলি। অন্য সব পেঙ্গুইনের তুলনায় এই পেঙ্গুইন মজার একটা পেঙ্গুইন। এমনিতে সবার মতো এদেরও পেটের দিকটা সাদা, বাকি পুরো শরীর কালো পশমে ঢাকা। নামেই দেখতে পাচ্ছ, রক বা পাথর আছে। এরা থাকেও পাথুরে অঞ্চলে। পাথুরে অঞ্চলে থাকে বলে আর সব পেঙ্গুইনের মতো পেটের ওপর স্লিপ কেটে চলতে পারে না। আহা, একটা পেঙ্গুইন, সে যদি স্লিপ কাটতে না পারে, তার দুঃখটা ভাবো। এমনিতেই পেঙ্গুইন একধরনের পাখি, পাখি হয়েও বেচারা উড়তে পারে না, আবার স্লিপও কাটতে পারে না। যেহেতু স্লিপ কাটতে পারে না, তাই লাফিয়ে লাফিয়ে চলে এক পাথর থেকে আরেক পাথরে।

রকহপার পেঙ্গুইন অন্য সব পেঙ্গুইনের তুলনায় বেশ ছোট। বুড়ো বয়সেও এদের উচ্চতা হয় মাত্র ২০ ইঞ্চি, মানে বড় মানুষের এক হাতের সমান। তাই ওদের বামন পেঙ্গুইনই বলা চলে। ওদের আরেক বৈশিষ্ট্য, চোখ লাল। মানে সব সময় রাগী চোখেই থাকে মনে হয়। মাথায় ঝুঁটি আছে, হলুদ আর কালো রঙের।

আমি নিজে জেনে সবচেয়ে অবাক হয়েছিলাম, একটা রকহপার পেঙ্গুইন দেখে বাইরে থেকে বোঝার কোনো উপায় নেই কোনটা ছেলে আর কোনটা মেয়ে। দুটোই দেখতে ঠিক একই রকম। ছেলেমেয়ে আলাদা করতে নাকি ডিএনএ টেস্ট করা লাগে।

যাহোক, তোমাদের এখন এই ছবিতে রকহপার পেঙ্গুইন খুঁজতে হবে। সব ছবিতেই কিন্তু একই পেঙ্গুইন আছে। এই পেঙ্গুইন খোঁজার মজার কাজে অনেকেই আনন্দ পাওয়ায় নেচার–এর একটা নামও দিয়েছে। লিফ পেঙ্গুইনসন (Leif Penguinson)। তো তোমাকে আসলে খুঁজতে হবে লিফ পেঙ্গুইনসনকে।

এবার সমস্যা সমাধান নিয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলোর একটা বলি। একটা সমস্যা আসলে একবারই সমাধান করা যায়। একবার সমাধান করে ফেললে আজীবন তোমার জন্য তা একটা অনুশীলনী। যদি না তুমি সমস্যাটা সমাধানের পদ্ধতি একদম বেমালুম ভুলে যাও।

লিফ পেঙ্গুইনসনের ছবিগুলো আমি আমার ফেসবুক প্রোফাইলে দিয়েছিলাম। অন্যরা খুঁজে পায় কি না দেখতে। একদিন একটা ছবিতে আমার বিশ্ববিদ্যালের জুনিয়র অরণি সেমন্তি খান কমেন্ট করল, ‘অদ্ভুত, একবার পেঙ্গুইনটা দেখার পর আর “অদেখা” করতে পারছি না।’ তুমিও যদি ছবিগুলোতে একবার তাকে খুঁজে পাও, একবার দেখে ফেলো, তুমি তাকে আর অদেখা করতে পারবে না। আবার নতুন করে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করতে পারবে না।

সমস্যা সমাধান এমনই। তুমি যদি একবার কোনো সমস্যা সমাধানের পদ্ধতি বের করে ফেলো বা দেখে ফেলো, তাহলে তা আর সমস্যা থাকবে না। তাই সমস্যা সমাধানের আনন্দ পেতে চাইলে তোমাকে নিজেকেই সমাধানের চেষ্টা করতে হবে, না পারলে আরও চেষ্টা করতে হবে। তুমি চাইলে সহজেই বিষয়টি পরীক্ষা করতে পারো। এই ছবিগুলো থেকে যেকোনো একটা অন্য কাউকে সমাধান করে তোমাকে উত্তরটা অর্থাৎ লিফ পেঙ্গুইনসন কোথায় আছে দেখিয়ে দিতে বলো। একবার যদি দেখিয়ে দেয়, দেখবে তুমি নিজে আর খুঁজতে পারছ না। এবং সমাধান করার আনন্দও তুমি পাওনি।

সমস্যা সমাধানের এই আনন্দ পেতে আরও অনেক সমস্যা খুঁজে বের করো। এবং আনন্দে মেতে থাকো।

তবু তোমার মাথায় নিশ্চয় প্রশ্ন আসছে, সমস্যা সমাধানে দক্ষ হওয়ার কোনো উপায় আছে কি না। নির্দিষ্ট সমস্যার সমাধানে কোনো পদ্ধতি নেই, কিন্তু পুরো সমস্যা সমাধানেই দক্ষ হয়ে উঠতে কিছু উপায় আছে, ভবিষ্যতে হয়তো সেগুলোও লিখব।

ছবি : উইকিপিডিয়া

লেখক: সদস্য, সম্পাদনা দল, বিজ্ঞানচিন্তা