রুখে দাঁড়াতে শেখো কারাতে

ছবি : সাফা জেরিন
ছবি : সাফা জেরিন

সেদিন ঊষণ তাঁর ভাবির সঙ্গে বের হয়েছিলেন কিছু কেনাকাটা করবেন বলে। ভাবির ছোট শিশুটি ছিল তাঁর কোলে। এমন সময় একটা ছেলে উষণকে বাজেভাবে ধাক্কা দিয়ে হাসতে হাসতে চলে গেল সামনে। ঊষণ ভাবির কোলে শিশুটিকে দিয়ে দৌড়ে গিয়ে শক্ত করে চেপে ধরলেন ছেলেটির হাত।

—কেন করেছ এ কাজ?

—কই কিছু করিনি তো! দাঁত কেলিয়ে তখনো হাসছে ছেলেটি।

শুরু হলো বাগিবতণ্ডা। ঊষণের দাবি, ক্ষমা চাইতে হবে ছেলেটিকে। ছেলেটি তখনো নোংরাভাবে যা তা বলে যাচ্ছে ঊষণকে। বাগিবতণ্ডার একপর্যায়ে ঊষণ খেয়াল করলেন, চারপাশ থেকে তাঁকে ঘিরে ধরেছে ছেলেটির বন্ধুরা। একপর্যায়ে তারা ঊষণের হাত চেপে ধরল পেছনে। প্রথম ছেলেটি এবার এগিয়ে এসেছে।  ঊষণকে ‘মেয়ে হয়েও প্রতিবাদ করার শিক্ষা’ দেবে বলে। কার্জন হলের মোড়ে তখন ভরদুপুর। রাস্তাভর্তি মানুষ যেন দেখেও দেখছে না। একটু দূরে ঊষণের ভাবি ফ্যাকাশে মুখে কোলের শিশুটিকে চেপে ধরে অসহায় চোখে চেয়ে আছেন ঊষণের দিকে। কী হবে এখন?

এমন সময় ‘হাইইইইয়াহ!’— মেয়েকণ্ঠের তীব্র চিত্কার শোনা গেল একটা। অবাক হয়ে মানুষ দেখল বখাটে ছেলেটি যেন বাতাসে উড়ে আছড়ে পড়েছে শক্ত ফুটপাতে। নিমেষেই ঊষণ পা ব্যবহার করে শূন্যে উঠে কারাতের শক্ত একটি লাথি বসিয়ে দিয়েছেন বখাটের বুকে। ওরা কি আর জানত, ঊষণ জুডো আর কারাতে দুটোতেই ব্ল্যাকবেল্ট পাওয়া মেয়ে? হতভম্ব দলটা নিমেষেই ছত্রভঙ্গ। বিজয়ী ঊষণ এগিয়ে এসে আবার  কোলে নিলেন শিশুটিকে। মানুষ দেখল, এবারের দৃশ্যটি ভিন্ন। হাসছেন ঊষণ আর শিশুটি।

ভাবছ বানিয়ে বলছি? মোটেই না। সন্দেহ থাকলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের বর্তমান লেকচারার ঊষণকে নিজেই জিজ্ঞেস করতে পারো কোনো দিন দেখা হলে। বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জুডো ও কারাতে সেন্টারে কোনো দিন কারাতে শিখতে গেলেও দেখা হয়ে যেতে পারে। শুধু ঊষণ নন, এমন অনেক সাহসী ছেলেমেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্বও হয়ে যাবে কারাতের যেকোনো প্রশিক্ষণকেন্দ্রে গেলে। একবার খালি হাতে আত্মরক্ষার কৌশল বা মার্শাল আর্ট শিখে গেলে পৃথিবীর যে কোনাতেই যাও, কখনোই নিজেকে মনে হবে না অসহায়, একা। মার্শাল আর্ট তোমার সামনে খুলে দিতে পারে নতুন এক পৃথিবীর দরজা। যেখানে কেউ তোমার কোনো ক্ষতি করে ফেলতে পারে—ওই ভয়ের লেশমাত্র নেই।

‘যে কেউ, যেকোনো বয়সে শুরু করতে পারে মার্শাল আর্টের চর্চা।’ বলছিলেন ঊষণের মতো অসংখ্য মেয়ে ও ছেলের কোচ বা সেন সি সামসির আলম ভূঁইয়া। বললেন, ‘শুধু আত্মরক্ষা নয়। মার্শাল আর্টের চর্চা বাড়িয়ে দেবে তোমার মনের জোর, যেকোনো লক্ষ্যের প্রতি একাগ্রতা, আত্মবিশ্বাস ও আত্মসংযম।’ যোগ করলেন, মাঠ না পেয়ে ঘরে বসে শিশু ও কিশোরদের মধ্যে সারাক্ষণ স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকার প্রবণতা খুব বেড়ে গেছে এখন চারদিকে।  বাড়ছে ওবেসিটি বা ওজন বাড়ার হার। এ ক্ষেত্রে মার্শাল আর্ট হতে পারে মুক্তির পথ। ‘কেউ অসত্ভাবে প্রয়োগ না করে থাকলে বলা যায়, হাজার বছর ধরে মার্শাল আর্ট টিকে থাকার একমাত্র কারণ হলো এর কোনো ক্ষতিকর দিক নেই।’

কথাটা সত্যি কি না পরখ করতে নিজেই ঢাকার মিরপুর ইনডোর স্টেডিয়ামে গিয়েছিলাম কারাতে ও জুডো শেখে এমন কিছু ছেলেমেয়ের সঙ্গে কথা বলতে। কথা হলো সৈয়দা নূর-ই-সাবার সঙ্গে। তিনি তাঁর সেন সিকে প্রশিক্ষণে সহায়তা করেন। জানালেন, ‘আমাকেও ছোট থেকে শেখানো হয়েছে নরম হয়ে চলতে, কোনো ঝামেলায় না জড়াতে। বাস্তবতা হলো, বিপদে পড়তে মেয়েদের কখনোই আলাদা করে কিছু করতে হয় না। কিন্তু এখন জানি যে বিপদে পড়ে গেলেও ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমিও ফাইট দিতে পারি।’ তাঁকে সমর্থন দিলেন গৃহিণী আরিফা রহমান। বললেন, ‘ছয় মাস হলো শিখছি। এর মাঝেই আমার প্রায় ৪০ বছর ধরে জমানো ভয়গুলো কাটতে শুরু করেছে। আমি নিজেই নিজের জন্য যথেষ্ট, এই আত্মোপলব্ধিটাই মার্শাল আর্টের প্রথম ও অন্যতম মূল ভিত্তি।’ সাফা, আলিফ ফাহী, জুয়ায়েদ, সাব্বির ও আহমেদ অবশ্য শিখছে, খেলোয়াড় হয়ে একদিন দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনবে বলে। বলে রাখি, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মার্শাল আর্টে আমাদের বেশ কিছু স্বর্ণপদকও কিন্তু আছে। 

মার্শাল আর্টের আছে হরেক ধরন। কারাতে, কুংফু, জুডো, জুজুত্সু, ব্রাজিলিয়ান জুজুত্সু, তায়কোয়ান্দো, ফেন্সিং, বক্সিং এমন আরও কত। আমাদের দেশি জব্বারের বলীখেলা এবং লাঠিখেলাও কিন্তু মার্শাল আর্টেরই কিছু ধরন। কিন্তু কোথায় শিখবে এসব? খরচই-বা কেমন!

‘একদমই স্বল্প।’ জানালেন বাংলাদেশ তায়কোয়ান্দো ফেডারেশনের জেনারেল সেক্রেটারি মাহমুদুল ইসলাম। বললেন, ‘খালি হাতে আত্মরক্ষার তায়কোয়ান্দো কৌশল ছড়িয়ে দিতে আমরা ঢাকা ও ঢাকার বাইরের প্রতিটি জেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফ্রি কোর্স করাচ্ছি। যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য সুযোগটি উন্মুক্ত থাকছে। ইতিমধ্যে আমরা ঢাকার পাশাপাশি বান্দরবান, সিলেট ও বগুড়ায় কাজ শুরু করেছি।’

সবশেষে একটা তালিকা দিচ্ছি। তোমরা এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে খুবই নগণ্য খরচে মার্শাল আর্ট শিখতে পারবে। কে জানে, পত্রিকায় আসা সহিংসতার ভয়াবহ শিরোনামগুলো উল্টে দিয়ে একদিন তুমিই হয়ে উঠবে আমাদের অনুপ্রেরণা!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জুডো-কারাতে সেন্টার

যে কেউ ভর্তি হতে পারবে। ঠিকানা: শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্র, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা। ফোন: ০১৭১৫৯১৪০৫৭।

বাংলাদেশ কারাতে দো

প্রতিদিন সকাল-বিকেল কারাতে শেখার সুযোগ আছে। ঠিকানা: ২৭৮/৩ (দ্বিতীয় তলা) এলিফ্যান্ট রোড, কাঁটাবন, ঢাকা। ফোন: ০২-৮৬২৫৩৫৮। ওয়েবসাইট: www.bd-karate-do.com।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী ইনডোর স্টেডিয়াম

যোগাযোগ: ০১৭১৭১১৩৩৪৩

ইয়াং ড্রাগন মার্শাল আর্ট

প্রতি শুক্রবার সকালে প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগ আছে। ঠিকানা: মহাখালী আইপ্যাক স্কুলের সামনের মাঠ। ফোন: ০১৭২৯৭৭০২৩৯

বাংলাদেশ কারাতে ফেডারেশন

কক্ষ: ২৩৬-২৩৭, মাওলানা ভাসানী হকি স্টেডিয়াম, ঢাকা। ফোন: ০১৭১২২২৯১১৭, ০১৯১১৫৯৬৩৬৭। ওয়েব: www.bkf-bd.com।

বাংলাদেশ জুডো ফেডারেশন

কক্ষ ২৩২, মাওলানা ভাসানী জাতীয় হকি স্টেডিয়াম। ফোন: ০১৫৫২৪৯৯৯০৭।

বাংলাদেশ তায়কোয়ান্দো ফেডারেশন

জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ভবন, পুরানা পল্টন। ফোন: ০১৭১৫৩০১৮৪৭, ০১৭১১৩৫৫৭২০। ওয়েব: http://www.bantkd.com।

বাংলাদেশ সিতোরিউ কারাতে দো ইউনিয়ন

এরা বেশ নাম করেছে দেশের বাইরে। ঠিকানা: জাতীয় ক্রীড়া কাউন্সিল জিমনেসিয়াম, ৬২/৩ পুরানা পল্টন, ঢাকা। ০২-৯৫৬৯১৪৩, ০১৭১১৮৩৯৩৪৫। ওয়েব: www.bsku.net। 

চট্টগ্রাম মার্শাল আর্ট একাডেমি

ফোন: ০১৭১৩৬০৩৩৩১

যারা ঢাকার বাইরে থাকো, তারা বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা সদরের স্টেডিয়াম এবং জিমনেসিয়ামগুলোতে তায়কোয়ান্দো, কুংফু, কারাতে ও জুডো শিখতে পারো। আর মার্শাল আর্টের সুবিধা না থাকলে ওপরে দেওয়া ফেডারেশনগুলোতে নির্দ্বিধায় যোগাযোগ করে আবেদন জানাতে ভুলো না যেন।