শব্দগুলো মজার অনেক

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে আমরা বাক্য তৈরি করি। সেসব শব্দের অবশ্যই অর্থ থাকতে হয়। তবে একটি শব্দের অর্থ একাধিকও হতে পারে। সত্যি বলতে কী, একাধিক অর্থ নেই—এমন শব্দ খুব বিরল। আবার অধিকাংশ শব্দের অর্থ চিরকাল এক রকম থাকে না। বদলে যায়। বদলাতে থাকে। এই বদলটা ঘটে নানা কারণে, নানান ঘটনায়। একসময় সাহস বলতে বোঝাত হঠকারিতা, এখন বোঝায় বীরত্ব। এই যে অর্থের বদলে যাওয়া, তার পেছনে কাজ করে মানুষের বিচিত্র সব চিন্তাভাবনা। আমরা এখানে শুনব এমনই কিছু শব্দের বদলে যাওয়া অর্থের গল্প।

এদিকে, বাগ্ধারার যে শব্দ বা শব্দগুচ্ছ, তার কোনোটারই আসলে মনে খুঁজে পাওয়া যায় না বাগ্ধারার মধ্যে। তেল ও বেগুন যখন বাগ্ধারায় তেলেবেগুনে হয়, তখন তার মধ্যে তেল বা বেগুন কোনোটাই থাকে না।

‘অভিধানের গল্প’ অর্থ বদলে যাওয়া নির্বাচিত কিছু শব্দ এবং বহুল ব্যবহূত কিছু বাগ্ধারা নিয়ে। শব্দের অর্থ বদল হওয়ার কাহিনি বেশ মজার। বাংলা ভাষার পণ্ডিত ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এ রকম মজাকে বলেছিলেন, অভিধানে আমোদ।

তেলেবেগুনে

মানুষ হঠাৎই তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে। এর পেছনে একটি কারণ থাকতে পারে, আবার অনেক কারণও থাকতে পারে। তবে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠা মানুষ অল্পেই নিজ থেকে শান্ত হয়ে যায়। তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠা বলতে আমরা সাধারণভাবে বুঝি হঠাৎ অতিশয় ক্রুদ্ধ হওয়া।

তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠা বাগ্ধারাটি রান্নাঘর থেকে পাওয়া। চাকা চাকা করে কাটা বেগুন কড়াইয়ের গরম তেলে ঢেলে দিলে অকস্মাৎ যে ধরনের শব্দ ও দৃশ্যের সৃষ্টি হয়, তা থেকেই এই বাগ্ধারার উৎপত্তি।

ধুরন্ধর

মানুষের মতো শব্দও মাঝেমধ্যে দুর্গতির মধ্যে পড়ে। রোধ করা যায় না। টাউট, শয়তান, ধড়িবাজ লোককে আমরা এখন বলি ধুরন্ধর। অথচ ষাট-সত্তর বছর আগেও ধুরন্ধর শব্দটার এমন দুর্গতি ছিল না। তখন নেতা থেকে শুরু করে যেকোনো প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে অনায়াসে ধুরন্ধর বলা যেত।

এভাবে আগে যেকোনো দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী সবাই তখন ধুরন্ধর বিবেচিত হতেন। অনেক গুণ না থাকলে ধুরন্ধর হওয়া যায় না। তাই বহু গুণে গুণান্বিত ব্যক্তিকেও ধুরন্ধর বলা যেত। উপাচার্য, অধ্যক্ষ, মহাপরিচালক, অধ্যাপক, নায়ক, লেখক—সবাইকেই তখন অনায়াসে ধুরন্ধর বলা সম্ভব ছিল।

ধুরন্ধর শব্দের সেদিনের সেই গৌরবের কথা মনে রেখে আজ যদি কেউ সভামঞ্চে দাঁড়িয়ে বলেন, আমাদের প্রাণপ্রিয় অতি ধুরন্ধর নেতা আপনাদের সামনে এখন ভাষণ দেবেন, তাহলে তার পরিণতি কী হবে, তা ভেবে বলা যায়, না ভেবেও বলা যায়। একালের ধুরন্ধরেরা হয়তো তখন ঘোষককে পিটিয়ে লাশ বানিয়ে দেবেন।

ধুরন্ধর শব্দের মূল অর্থ হলো ভারবাহী বা ভারবাহক। ধুরন্ধর শব্দের আদি পর্বে ঘোড়া, গাধা, হাতি ছিল প্রকৃত ধুরন্ধর। কারণ, তারা তখন মানুষের ভারী বোঝা বহন করত। কিন্তু মানুষ গাধা-ঘোড়াকে ধুরন্ধর শব্দের ভার দীর্ঘদিন বইতে না দিয়ে নিজেরাই একদিন ধুরন্ধরকে পিঠে তুলে নেয়। শুরু হয় ধুরন্ধর শব্দের আলংকারিক প্রয়োগ। যিনি অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে যেকোনো দায়িত্ব অনায়াসে বহন করতে পারেন, তিনি হন ধুরন্ধর। পরিতাপের কথা, একালে এসে ধুরন্ধর শব্দটা অর্থগত ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। চতুর, ধড়িবাজ ও ঘড়েলরা হয়ে পড়ে ধুরন্ধর।

নগর

নগর শব্দটি তৈরির পেছনে মানুষের মনে বিশেষ এক দৃশ্যের কথা মনে পড়েছিল। নগরের সঙ্গে আমাদের প্রায় প্রাত্যহিক পরিচয় থাকায় নগর শব্দটির প্রকৃত অর্থ নিয়ে আমরা মাথা ঘামাই না। নগর বলতে আমরা সাধারণভাবে বুঝি, যেখানে উঁচু উঁচু দালানকোঠা রয়েছে, বহু লোক বাস করে, রয়েছে অফিস-আদালত ও শিল্প-কারখানা।

নগ বলে একটি শব্দ রয়েছে, আমাদের অভিধানে। শব্দটি বহুল প্রচলিত নয়। শব্দটির অর্থ পাহাড় বা পর্বত। ব্যাকরণের দিক থেকে এই নগ শব্দের সঙ্গে নগরের অচ্ছেদ্য সম্পর্ক। নগ থেকেই তৈরি হয়েছে নগর শব্দ। নগর শব্দের মূল অর্থ, যেখানে বাড়িঘর নগ অর্থাৎ পাহাড়-পর্বতের মতো উঁচু।

সিংহভাগ

সিংহভাগ শব্দটা আমাদের জীবনের অত্যন্ত পরিচিত একটা শব্দ। খবরের কাগজে মাঝেমধ্যেই দেখতে পাওয়া যায় সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের খরচের সিংহভাগই চলে যাচ্ছে ভুলভাল খাতে। অথবা শুনি, সংসারের বাজেটের সিংহভাগই চলে যাচ্ছে বাড়িভাড়ায়। সিংহভাগ বাগ্ধারাটির অর্থ হলো অধিকাংশ কিংবা প্রায় সমস্তটা।

বাংলা সিংহভাগ কথাটি ইংরেজি ‘লায়নস শেয়ার’ বাগ্ধারার অনুবাদ। এই বাগ্ধারা তৈরির মূলে রয়েছে ঈশপের একটি গল্প। ঈশপের গল্পে রয়েছে, একদা এক সিংহ ও এক শিয়ালে মিলে একটা হরিণ শিকার করে। শিকার ভাগ করার দায়িত্ব নিল সিংহ। শিয়ালকে বলল, তুমি চুপচাপ বসে থাকো, আমি একেবারে ন্যায্য ভাগ করে দিচ্ছি। এই বলে সিংহ হরিণটাকে সমান তিন ভাগ করল।

হরিণ-ভাগের শুরু থেকেই শিয়াল উসখুস করছিল। অবশেষে অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, হুজুর, আমরা তো মোটে দুজন প্রাণী, কিন্তু হরিণটাকে তিন ভাগ করলেন যে?

উত্তরে সিংহ বলল, তোমাকে তো আমরা পণ্ডিত বলেই জানি। কিন্তু এখন তো দেখছি তোমার যথেষ্ট জ্ঞান থাকলেও কাণ্ডজ্ঞান একেবারেই নেই। শোনো, প্রথম ভাগটা আমি নেব। বনের রাজা হিসেবে এই ভাগটা আমার পাওনা। দুজনে মিলে শিকার করলাম বলে বাকি দুটো ভাগের একটা তোমার, একটা আমার। আমার ভাগটা এই আমি নিলাম। এখন তোমার পাওনা ভাগ। তবে কথা হলো, এই ভাগটা আমার সামনে থেকে তুমি কি নিয়ে যাওয়ার সাহস করবে?

স্তম্ভিত

আমরা যখন স্তম্ভিত হই, তখন হতবাক কিংবা হতভম্ব এবং ক্ষেত্রবিশেষে মুগ্ধ বা আবিষ্ট হয়ে পড়ি। স্তম্ভিত একটি উপমাঘটিত শব্দ। মূল অর্থ হলো স্তম্ভবৎ, অর্থাৎ স্তম্ভের মতো। স্তম্ভ শব্দের অর্থ ঘরের থাম।

ঘরের থাম যেমন নড়াচড়া করে না, আমরাও হতবাক বা হতভম্ব হলে তেমনি হঠাৎ কিছুক্ষণের জন্য নড়াচড়া বন্ধ করে দিই। স্তম্ভের নট নড়নচড়ন অবস্থাই হলো মানুষের স্তম্ভিত অবস্থা।