কীভাবে বাঘ গোনে?

ছোটবেলা থেকেই ‘বাঘমামা’র সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল ছড়া-গল্পে। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের জার্সিতে, সার্ক গেমসের মাস্কট অদম্যে, চারুকলার পয়লা বৈশাখের শোভাযাত্রার বাঘের মুখোশে—সব মিলিয়ে বাংলাদেশের আর দশজনের মতো ‘বাংলার বাঘ’ আমার জন্যও একই সঙ্গে গর্বের আর প্রচণ্ড কৌতূহলের একটি বিষয় ছিল। পড়াশোনার পাট চুকিয়ে ফেলার পর হঠাৎ করেই ‘ওয়াইল্ড টিম’ নামের একটি বিচিত্র প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুযোগ হলো। শুধু যে পরিবেশ নিয়ে তাদের কাজ-কারবার তা-ই নয়, ওয়াইল্ড টিমের মনোযোগের জায়গা বাঘ আর বাঘের বাড়ি সুন্দরবন!

বাঘ নিয়ে ভাবাভাবি শুরু করার পর বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে অনেক বিচিত্র নাম শোনা শুরু করলাম, ‘বাঘের মাসি’, ‘বাঘ বাঁচাও কর্মী’ ইত্যাদি ইত্যাদি (সত্যি কথা বলতে গেলে বেশ মজাই লাগে শুনতে!)। ওয়াইল্ড টিমের বেশির ভাগ কাজকর্ম করে কম বয়সী মানুষজন, তাদের সঙ্গে সুন্দরবনে যাওয়া, কোন কাজ কীভাবে হবে, তা নিয়ে নানা বিচিত্র গবেষণা, অদ্ভুত সব ‘আউট অব দ্য বক্স’ সমাধান। সব মিলিয়ে আমাদের ‘বাঘ বাঁচাও’ কাজকর্ম কখনোই ঝিমিয়ে পড়ে না!

ওয়াইল্ড টিমের জঙ্গুলে চাকরিতে ঢুকে পড়ার পরে বাঘ নিয়ে অনেক মজার মজার তথ্য জানতে শুরু করলাম। সবচেয়ে অবাক হলাম যখন শুনলাম যে শুধু সুন্দরবনেই নয়, ঢাকা শহরের পাশেও দেখা মিলত বাঘের! এ বাঘ এখন আছে মস্ত বড় বিপদে। ক্রমে কমে আসছে বাঘের সংখ্যা। সুন্দরবন আছে কিন্তু তার গহিন থেকে বাঘের গর্জন ভেসে আসছে না, এ কি ভাবা যায়?



আমাদের দেশে যেমন বাঘের আনাগোনা সময়ের সঙ্গে কমে এসেছে, ঠিক তেমনি অবস্থা পুরো পৃথিবীতেই। ১০০ বছর আগেও যেখানে বিশ্বে প্রায় এক লাখ বাঘ ছিল, সেখানে সংখ্যাটি এখন কমতে কমতে হাজার তিনেকের কিছু বেশিতে এসে ঠেকেছে। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটানে আছে বেঙ্গল টাইগার; কম্বোডিয়া, লাওস, থাইল্যান্ড আর ভিয়েতনামে পাওয়া যায় ইন্দো-চায়নিজ টাইগার; মালয়েশিয়া আর মিয়ানমারে মালায়ান টাইগার; ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রায় সুমাত্রান টাইগার; রাশিয়ান হিমশীতল তুন্দ্রায় সাইবেরিয়ান বা আমুর টাইগার আর চীনে আছে সাউথ চায়না টাইগার। এই ১৩টি দেশকে বলা হয় ‘টাইগার রেঞ্জ কান্ট্রি’। তবে বাংলাদেশের জন্য একটি ভালো খবর হলো, একক বনগুলোর মধ্যে সুন্দরবনেই বাঘের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি!

বাঘ নিয়ে যেহেতু কাজ করি, একটি প্রশ্ন মাঝেমধ্যেই শুনতে হয়, ‘সুন্দরবনে কয়টি বাঘ আছে?’ বা ‘তোমরা কি বাঘ গোনো, কীভাবে গোনো?’ প্রশ্নটা শুনতে বেশ সোজা মনে হয়। ঢাকায় কতগুলো গাড়ি আছে, এটি যেহেতু একটু কাগজপত্র ঘাঁটলে বলে ফেলা যায়, বাঘের সংখ্যা বলা কি এমন কষ্ট? সমস্যা হলো, নির্দিষ্ট অঙ্কের ফর্মুলা দিয়ে বা দেখে দেখে এক-দুই করে বাঘ গুনে ফেলা যায় না।

একটু আগে হেঁটে গেল একটি বাঘ
একটু আগে হেঁটে গেল একটি বাঘ

সিংহ যেমন বড় দলে থাকতে পছন্দ করে, বাঘের ক্ষেত্রে তেমনটি নয়। একটি বাঘ একাই একটা নির্দিষ্ট এলাকাজুড়ে থাকে, যাকে বলা হয় তার টেরিটরি। সেটি ২৫ থেকে ১০০ বর্গকিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে! বাঘ শিকারও ধরে ওই নিজের টেরিটরি থেকেই। বাঘের এই বিক্ষিপ্তভাবে থাকার অভ্যাসের কারণে বনের বাঘগুলোকে এক জায়গায় পেয়ে ‘মাথা গোনা’ (বা লেজ গোনা!) সম্ভব নয়। আর ঝামেলা তৈরি করে বাঘের চমৎকার ডোরা, যা তাকে খুব সহজেই ঘন পাতার সঙ্গে মিশে যেতে সাহায্য করে। যে কারণে বাঘের দেখা পাওয়াও যথেষ্ট কঠিন।

তবে সমস্যা থাকলে তার সমাধান খোঁজাই মানুষের অভ্যাস। এ ক্ষেত্রেও বহু বছর ধরে মানুষ অনেক রকম চিন্তাভাবনা করেছে। প্রায় ১০০ বছর আগে, রাশিয়ান বিজ্ঞানীরা ভাবলেন, বরফে ভরা এ বনে বাঘের পায়ের ছাপ হয়তো তাদের সংখ্যা সম্পর্কে তথ্য দিতে পারবে। বিচরণক্ষেত্রের আয়তন অনুযায়ী দুটি আলাদা ধরনের পায়ের ছাপ আলাদা করে তাদের সংখ্যা হিসাবের এ পদ্ধতি অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। পায়ের ছাপ বা টাইগার ট্র্যাক গোনার মূল সমস্যা হলো, বনের কয়টি বাঘ আদৌ গোনা হয়নি বা কয়টি একবারের বেশি গোনা হয়েছে, তা বোঝার আসলে কোনো উপায় নেই। প্রায় কাছাকাছি সময়ে ভারতে আরেকজন এ পদ্ধতিটিই একটু বদলে ব্যবহার করতে চাইলেন। তিনি বাঘ যেসব জায়গা থেকে পানি খায়, তার আশপাশের ট্র্যাকগুলো গুনলেন। তবে এর জন্য বাঘের বিচরণক্ষেত্রের এলাকা, আর কত ঘন ঘন বাঘ পানি খেতে পারে—এ নিয়ে একটি আন্দাজ করতে হয়েছিল তাঁর।

মেপে দেখা হচ্ছে ‘পাগমার্ক’মেপে দেখা হচ্ছে ‘পাগমার্ক’
মেপে দেখা হচ্ছে ‘পাগমার্ক’মেপে দেখা হচ্ছে ‘পাগমার্ক’

১৯৭০ সালে আরেকটি উপায়ে বাঘ গোনার চেষ্টা হয়েছিল। এক বনরক্ষক ধারণা করলেন যে প্রতিটি বাঘের পায়ের ছাপ বা ‘পাগমার্ক’- ই আলাদা। বনকর্মীরা পায়ের ছাপের ছাঁচ তৈরির জন্য নেমে গেলেন। এ পদ্ধতিকে বলা হতো পাগমার্ক সেনসাস। কিন্তু সময়ের সঙ্গে এটি স্পষ্ট হয়ে যায় যে শুধু পাগমার্ক দেখে যদিও একটি বনে বাঘ আছে কি নেই তা বোঝা যায়, কিন্তু বহুদিন ধরে একটি বনের প্রতি ইঞ্চিতে ছাপ সংগ্রহ, মাপা এবং পরীক্ষা না করে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যা বলা প্রায় অসম্ভব।

এক বাঘের ডোরাকাটা ছাপের সঙ্গে অন্য বাঘের ডোরাকাটা ছাপ মেলে না
এক বাঘের ডোরাকাটা ছাপের সঙ্গে অন্য বাঘের ডোরাকাটা ছাপ মেলে না



তাহলে উপায় কী? পায়ের ছাপ থেকে সহজে তাদের আলাদা করা যায় না সত্যি, কিন্তু প্রতিটি বাঘের গায়ের ডোরার নকশা একেবারেই আলাদা। একজনের সঙ্গে অন্যজনের মেলে না। কিন্তু নিভৃতচারী বাঘের ডোরা পরীক্ষা করবে কীভাবে? এ চিন্তা থেকেই শুরু হলো ক্যামেরা ট্র্যাপের ব্যবহার। ফটোগ্রাফাররা বহুদিন থেকেই বিভিন্ন প্রাণীর দুর্লভ ছবি তোলার জন্য বনের মধ্যে বিশেষ ক্যামেরা রেখে আসতেন। ১৯৮০ সালের দিকে বিখ্যাত বাঘ সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞ উল্লাস করন্থ ভারতের নগরহোল বনে বিশেষভাবে তৈরি অসংখ্য ক্যামেরা ছড়িয়ে দেন। ক্যামেরায় ধরা পড়ে বাঘের নিজস্ব জীবনের অদ্ভুত সব ছবি। আর সবচেয়ে চমৎকার বিষয় হলো, অবশেষে সেই গানটির মতোই ‘ডোরাকাটা দাগ দেখে বাঘ চেনা’ হয়ে গেল!



সুন্দরবনে বাঘ গোনা অন্য যেকোনো বন থেকে অনেক বেশি কঠিন। প্রতিদিন দুবার জোয়ার এ বনকে ডুবিয়ে দিয়ে যায়। সুন্দরবনের ঘন গাছপালা, চারদিকে ছড়িয়ে থাকা ধারালো শ্বাসমূল মিলে এ বনকে এতই দুর্গম করেছে যে বনের মধ্যে ঢুকে পায়ের ছাপ সংগ্রহ অথবা সবখানে ক্যামেরা লাগিয়ে আসা, কোনোটিই আসলে পুরো বনে সম্ভব নয়। সুন্দরবনের জন্য তাই একটা নতুন নিয়ম তৈরি করা হলো, যাকে আমরা বলি ‘খাল সার্ভে’। ছোট ছোট নৌকায় করে বাঘ গোনা বাহিনী ছড়িয়ে পড়ে সুন্দরবনে জালের মতো বিছিয়ে রাখা অসংখ্য খালে, আর খালের ধারের বাঘের পায়ের ছাপ গুনে ফেলে তারা। 

বাঘের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের জন্য বসানো হচ্ছে ক্যামেরা
বাঘের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের জন্য বসানো হচ্ছে ক্যামেরা

এ ছাপের সংখ্যা কিন্তু অবশ্য বাঘের মোট সংখ্যা নয়, কিন্তু প্রতিবছর খাল সার্ভের ফলাফল তুলনা করে জানা যায় যে সুন্দরবনে বাঘের ঘনত্ব একই রকম আছে কি না। তবে দুটি বছরে খুব পার্থক্য পাওয়া গেলেও তার মানে এটা না-ও হতে পারে যে বাঘের সংখ্যা বদলে গেছে। কোনো কারণে তাদের চলাফেরার এলাকা বদলে যেতে পারে, তারা কোন খাল থেকে পানি খাচ্ছে তা বদলে যেতে পারে। খাল সার্ভের ফলাফল তাই ‘কয়টি বাঘ আছে’ এটি আমাদের পুরোপুরি না বলতে পারলেও ‘বাঘেরা সুন্দরবনে কোথায় কোথায় আছে’ এটি বলতে পারে। প্রথম প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য খাল সার্ভের সঙ্গে এখন থেকে শুরু হচ্ছে সেই ক্যামেরা ট্র্যাপিং। সুন্দরবনের গহিনে রেখে আসা হবে ক্যামেরা, যার ছবিতে ধরা পড়বে রহস্যময় বাঘের অমূল্য সব ছবি, একেকটি বাঘের জন্য একেক রকম! এ ছাড়া বাঘের গলায় রেডিও কলার পরিয়ে তাদের টেরিটরি কতখানি, একেকটি বাঘ কতবার একটি খাল পার হচ্ছে, সব মিলিয়ে তাদের আচরণ সম্পর্কেই আরও নতুন অজানা তথ্য জানা যাবে।

বাঘ গোনার জন্য এমন ক্যামেরাই ব্যবহৃত হয়
বাঘ গোনার জন্য এমন ক্যামেরাই ব্যবহৃত হয়

পৃথিবীর নানা দেশে বাঘ রক্ষার জন্য অনেক চমৎকার কাজ হচ্ছে, অনেক মানুষ তাঁদের সারা জীবন বাঘ সম্পর্কে জানা আর মানুষকে জানানোর জন্য কাটিয়ে দিচ্ছেন। তাঁদের কাজ কতটা সফল হচ্ছে, এটি বোঝার জন্য আসলে বাঘ কমছে, একই রকম সংরক্ষিত আছে, নাকি ধীরে ধীরে বাড়ছে, তা জানা দরকার। সুন্দরবনেও বাঘ গুনে আমাদের বাঘেরা কেমন আছে, এটাই জানার চেষ্টা করা হয়।

সুন্দরবন আসলেই সুন্দর, সেই সুন্দর জায়গাটায় বেড়াতে গিয়ে আমরা যেন ময়লা-আবর্জনা না বাড়িয়ে ফিরে আসতে পারি, কেউ খুব আগ্রহ করে আমাদের হরিণের মাংস খেতে বললে আমরা যেন জোর গলায় জানাতে পারি যে, এটি বাঘের খাবার, আমাদের না খেলেও চলবে। এসব ছোটখাটো কাজকর্ম করতে করতে আমরাও বাঘকে তার নিজের মতো বন্য পরিবেশে বেঁচে থাকার জন্য বড় একটা সাহায্য করে ফেলতে পারি, এটি ভাবলে কিন্তু আসলেই দারুণ অনুভূতি হয়!