পিক্সারের অ্যানিমেশন দুনিয়া

নিমোকে চেনো তো?
নিমোকে চেনো তো?

মাঝে মাঝেই কি তোমার মনে হয়, আরে আমি তো বড় হয়ে গেছি। এখন আমার অ্যানিমেশন দেখার বয়স আছে নাকি! ওয়েট, ওয়েট, কী বললে, অ্যানিমেশন দেখার বয়স পার হয়ে গেছে তোমার? হাসি পেল কিন্তু আমার। কারণ, অ্যানিমেশনের দুনিয়ায় ডুব দেওয়ার আসলে কোনো বয়স ঠিক করা নেই। অ্যানিমেশন এখন ছেলে-বুড়ো সবারই।
অ্যানিমেটেড ছবি তৈরিতে অলিখিতভাবেই প্রথম হয়ে আছে ‘পিক্সার অ্যানিমেশন স্টুডিও’, সোজাভাবে ‘পিক্সার’। টয় স্টোরির শেরিফ উডি, মনস্টার ইঙ্ক-এর বু, ফাইন্ডিং নিমোর ডোরি আর নিমো, ওয়াল-ইর পিচ্চি রোবট ওয়ালিকে কি এত্ত সহজে ভোলা যায়? এ ছবিগুলোই তৈরি করেছে পিক্সার। পিক্সার স্টুডিও থেকে এ পর্যন্ত বেরিয়েছে ১৪টি অ্যানিমেশন ছবি আর ২০টির মতো শর্টফিল্ম। এই তো কিছুদিন আগে, ২০১১ সালে পিক্সার পালন করল তার ২৫তম জন্মদিন।

১৯৮৬ সালে পিক্সার কিনে নিয়েছিলেন স্টিভ জবস
১৯৮৬ সালে পিক্সার কিনে নিয়েছিলেন স্টিভ জবস

পিক্সারের শুরুটা কিন্তু সহজ ছিল না। পিক্সারের যাত্রা শুরু হয় ১৯৭৯ সালে, ‘লুকাসফিল্ম’-এর কম্পিউটার ডিভিশনের গ্রাফিকস গ্রুপ হিসেবে। পরে ১৯৮৬ সালে অ্যাপলের সহপ্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস এর অধিকাংশ শেয়ার কিনে নেন। এরপর ২০০৬ সালে ‘ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানি’ পিক্সার কিনে নেয়। পিক্সারের ঘাঁটি ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যামেরিভিলে। স্টিভ জবস অ্যাপল ছাড়ার পর যখন পিক্সারের শেয়ার কেনেন তখন পিক্সারের ভরাডুবি অবস্থা। ব্যবসা বাঁচাতে স্টিভ তাঁর বিনিয়োগ বাড়াতে বাড়াতে একসময় পুরো পিক্সারেরই মালিক বনে যান। এ সময় পিক্সার বাইরের প্রতিষ্ঠানের জন্য অ্যানিমেটেড বিজ্ঞাপন নির্মাণ শুরু করে এবং সাফল্য পায়। ১৯৯১ সালে পিক্সার ওয়াল্ট ডিজনি স্টুডিওর সঙ্গে কাজ শুরু করে, কিন্তু তবু লোকসান এড়ানো যাচ্ছিল না। স্টিভ জবস ১৯৯৪ সালে পিক্সার মাইক্রোসফটের কাছে বিক্রি করে দেওয়ারও চিন্তা করেছিলেন। কিন্তু ১৯৯৫ সালে বের হওয়া টয় স্টোরির সাফল্য সব হিসাব পাল্টে দেয়! টয় স্টোরি বিশ্বব্যাপী মোট আয় করে ৩৬১ মিলিয়ন ডলার এবং রাতারাতি পিক্সারের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। অনেকেই মনে করে পিক্সার (P.I.X.A.R) শব্দটি কম্পিউটার-সংক্রান্ত কতগুলো শব্দের আদ্যক্ষর দিয়ে তৈরি। ব্যাপারটা আসলে তা নয়। পিক্সার শব্দটি নেওয়া হয়েছে একটি কল্পিত স্প্যানিশ শব্দ থেকে, যার বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘পিক্সেল বানানো’ বা ‘ছবি বানানো’।

এ বাগস লাইফ দেখে মুগ্ধ না হওয়ার কোনো উপায় নেই
এ বাগস লাইফ দেখে মুগ্ধ না হওয়ার কোনো উপায় নেই

পিক্সার স্টুডিওতে কাজ করা অনেকটাই স্বপ্নের ব্যাপার। অন্য অফিসে কর্মীরা একত্র হয়ে গল্প করেন কফি মেশিন বা ওয়াটার কুলারের পাশের এক চিলতে জায়গায়। পিক্সারই সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র অফিস, যেখানে কর্মীদের গল্প করার জায়গা আস্ত একটা ফ্রি সিরিয়াল বার! এ বারেই সিরিয়াল খাওয়ার সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে তৈরি হয়েছে অনেক অসাধারণ অ্যানিমেশন ছবির গল্প! কী, অবাক হচ্ছো খুব? পুরো পিক্সার স্টুডিও সাজানো হয়েছে এমন মজা আর আনন্দের সঙ্গে কাজ করার মতো করে। এ স্টুডিওতে প্রত্যেক কর্মীরই স্বাধীনতা আছে নিজের মতো করে তাঁর কাজের জায়গা সাজিয়ে নেওয়ার! সেটা ওয়েস্টার্ন ছবির বার বা বাড়ির গ্যারেজের মতো হলেও আপত্তি নেই! আর তাই এখানকার কর্মীরাও অনেক সৃজনশীল, কাজপাগল আর পরিশ্রমী। পিক্সারের ছবি ফাইন্ডিং নিমোতে তৈরি করা অ্যানিমেটেড সমুদ্রের পরিবেশ এতটাই বাস্তব হয়েছিল যে অ্যানিমেটররা বাধ্য হয়েছিলেন নতুন করে আবার সমুদ্রের আবহ তৈরি করতে! আর এ কারণেই পিক্সারের ঝুলিতে আছে ২৭টি অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড, সাতটি গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ড, ১১টি গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডসহ আরও অসংখ্য পুরস্কার।

অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডে ২০০১ সাল থেকে শুরু হওয়া শ্রেষ্ঠ অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্র বিভাগে পিক্সারের প্রায় সব ছবিই মনোনয়ন পেয়ে আসছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, ১৯৯৪ সালে পিক্সার স্টুডিওতে দুপুরের খাবারের ফাঁকে মাত্র এক ঘণ্টার একটা ছোট্ট মিটিংয়ে আ বাগস লাইফ, মনস্টার ইঙ্ক, ফাইন্ডিং নিমো আর ওয়াল-ই ছবির পুরো গল্প, প্লট আর মূল চরিত্র সাজানো হয়ে গিয়েছিল, পরে ওয়ালি ছবির ট্রেইলারে এ মিটিংটি দেখানো হয়। পিক্সারের ইতিহাসে এ মিটিং বিখ্যাত হয়ে আছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় পিক্সার স্টুডিওর ফটক
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় পিক্সার স্টুডিওর ফটক

পিক্সারের ছবি মানেই একদম অন্য ধরনের, অন্য রকম মজাদার কিছু আনন্দ। পিক্সার তার প্রায় প্রতিটি ছবিতেই পরবর্তী ছবির চরিত্রগুলোর আগাম একটি সংকেত রাখে। যেমন মনস্টার ইঙ্ক ছবির শেষের দিকে বু-এর হাতে খেলনা পুতুল হিসেবে দেখা যায় ফাইন্ডিং নিমোর নিমোকে, ফাইন্ডিং নিমো বের হয়েছিল এরও দুই বছর পর। দ্য ইনক্রেডিবলস বাদে পিক্সারের প্রতিটি ছবিতেই আছে পিজা প্ল্যানেট ট্রাক, যদিও দ্য ইনক্রেডিবলস ভিডিও গেমে আছে এই ট্রাকটি! পিক্সারের প্রায় সব ছবিতেই লাইসেন্স প্লেট নম্বর, ক্যামেরার মডেল নম্বর বা ক্লাসরুম নম্বর হিসেবে দেখা যায় ‘এ১১৩’ লেখাটি। এটি হলো ক্যালিফোর্নিয়া আর্ট ইউনিভার্সিটির প্রথম বর্ষের ক্লাসরুম নম্বর, যেখানে পিক্সার স্টুডিওর প্রায় সব অ্যানিমেটরই ক্লাস করেছেন।

টয় স্টোরি সিরিজের অন্যতম চরিত্র বাজ লাইটইয়ারের চেহারা তৈরি করা হয়েছে অনেকটা ছবির পরিচালক জন লেসেটারের মতো করে। পিক্সারের ছবিতে কণ্ঠ দিয়েছেন টম হ্যাঙ্কস, রবার্ট ডি নিরো, টিম অ্যালেন, জন র‌্যাটজেনবারজার, ওয়েন উইলসনের মতো তারকারা। মজার বিষয় হলো, জন র‌্যাটজেনবারজার পিক্সারের প্রথম ছবি টয় স্টোরির ‘হ্যাম’ চরিত্র থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত সব ছবিতেই কোনো না কোনো চরিত্রের কণ্ঠ দিয়েছেন। কারণ, পিক্সার তাকে ছবির জন্য শুভ হিসেবে মনে করে!

পিক্সারের বিখ্যাত ছবির মধ্যে আছে টয় স্টোরি, মনস্টার ইঙ্ক, ফাইন্ডিং নিমো, দ্য ইনক্রেডিবলস, কারস, ওয়ালি, রাটাটুলি, আপ, ব্রেভ ইত্যাদি। সামনে বের হবে দ্য গুড ডাইনোসর, ইনসাইড আউট, ফাইন্ডিং ডোরি। সিক্যুয়েল হিসেবে বের হওয়ার কথা রয়েছে টয় স্টোরি ৪ আর দ্য ইনক্রেডিবলস ২। শর্টফিল্মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নিক-ন্যাক, জেরিস গেম, ফর দ্য বার্ডস, ওয়ান ম্যান ব্যান্ড, লিফটেড, পার্টলি ক্লাউডি, ডে অ্যান্ড নাইট, প্রেস্টো। এ ছাড়া দেখতে পারো পিক্সার অ্যানিমেশন স্টুডিওর ইতিহাস নিয়ে ২০০৭ সালে তৈরি ডকুমেন্টারি ছবি দ্য পিক্সার স্টোরি।

ইতিমধ্যে বের হওয়া ছবিগুলো বসুন্ধরা সিটি, রাইফেলস স্কয়ারসহ যেকোনো বড় সিডি-ডিভিডির দোকানে পেয়ে যাবে। এ ছাড়া শর্টফিল্মগুলোর জন্য ইউটিউবেও ঢুঁ মারতে পারো। আর যদি নিজের সংগ্রহে রাখার মতো একটা কপি চাও, তাহলে কিনে ফেলো পিক্সার শর্টফিল্মস কালেকশন ভলিউম ওয়ান। এটা বাংলাদেশে পাবে না, বাইরে থেকে আনিয়ে নিতে হবে। বাইরে থাকা আত্মীয়দের কাছে জন্মদিনের উপহার হিসেবে চেয়ে নিয়ো সময় করে!

নাজিয়া শারমিন