বিপনুর বাঁ পায়ে একটু সমস্যা আছে। ছোটবেলা থেকেই তার এই সমস্যা।
পোলিও হয়েছিল। তার পর থেকেই সে একটু টেনে টেনে হাঁটে। এবং খুব দ্রুত সে হাঁটতে পারেও না। নতুন যে স্কুলটায় সে ভর্তি হয়েছে, সেখানে ঠিক এই কারণে তার একটু সমস্যাও হচ্ছে। দুটো সমস্যা—
সমস্যা-১: সে স্কুলে প্রায় প্রতিদিন টিফিন মিস করছে, টিফিন খেতে পারছে না।
সমস্যা-২: তাকে তার ক্লাসের একটা বদ টাইপের ছেলে ল্যাংড়া বলে ডাকে। টিফিন খেতে পারছে না, এটাকে তেমন গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সে মনে করছে না। কিন্তু তাকে যে ল্যাংড়া ডাকে একটা ছেলে, সে এটা মেনে নিতে পারছে না।
ছেলেটা তার চেয়ে বেশ বড়সড় এবং একটু মাস্তান টাইপের। তা ছাড়া ছেলেটা নাকি এলাকার এক নেতার ছেলে। তাই স্যাররাও এই ছেলেটাকে ঠিক ঘাঁটান না। যেমন কিছুদিন আগে এই ছেলেটা (ছেলেটার নাম রবীন। তার আবার একটা পার্টনার আছে, তার মতোই সাইজ তার, নাম বল্টু। সেও একই ক্লাসে পড়ে) আরেক ক্লাসের এক ছেলেকে স্কুলে সামান্য একটা ঘটনা নিয়ে পিটিয়েছিল। সেই মার খাওয়া ছেলেটার বাবা স্কুলে এসে হেডস্যারকে নালিশও করেছিলেন; কিন্তু কিছু হয়নি শেষ পর্যন্ত।
এবার আসা যাক বিপনুর টিফিন মিস করার বিষয়টায়।
বিপনুর এই নতুন স্কুলে টিফিনের ঘণ্টা বাজলে, মানে চতুর্থ পিরিয়ডের ঘণ্টা বাজলে সবাই হুড়মুড় করে ছুটে যায় তাদের ক্যানটিনে, এটাই এখানকার নিয়ম। সেখানে খালি প্লেট নিয়ে বসতে হয় সবাইকে। তারপর টিফিন ম্যানেজার স্যার তাঁর সহকারীদের নিয়ে তাদের প্রত্যেকের প্লেটে টিফিন দিয়ে যান। টিফিনও বেশ সুস্বাদু। একেক দিন একেক আইটেম। কখনো লাড্ডু আর কেক, কখনো প্যাটিস-সন্দেশ, কখনো পরোটা-ভাজি... বেশ ভালো ব্যবস্থা। প্রথম দিকে বিপনু টিফিন পেত। যদিও পা টেনে টেনে সে ক্যানটিনে পৌঁছাত সবার পেছনে, তার পরও সে টিফিন পেত। কিন্তু ইদানীং সে পায় না। যাওয়ার পর দেরি হওয়ার কারণেই কি না টিফিন শর্ট পড়ে যায়। টিফিন ম্যানেজার স্যার নিজেও অবাক হন, টিফিন কেন শর্ট পড়ল খোঁজখবর লাগান, পরে তাকে একটা ধমক লাগান, ‘দেরি করে কেন এসেছ?’ এর পর থেকে স্যারের ধমক খাওয়ার ভয়ে সে আর স্যারকে জানায় না। এক গ্লাস পানি খেয়ে কেটে পড়ে। তবে সে যে একাই টিফিন মিস করে তা নয়, সে দেরি করে আসে বলে সে তো মিস করেই, আরও অনেকেই নাকি করে। তার মানে টিফিন নিয়ে একটা কিছু সমস্যা হচ্ছে, এটা বেশ বোঝা যাচ্ছে।
এর মধ্যে হঠাৎ স্কুলে ঘোষণা এল যে দুই সপ্তাহ পরে স্কুলে অ্যানুয়াল সায়েন্স ফেয়ার হবে। যারা আগ্রহী, তারা প্রজেক্ট জমা দেবে। প্রথমে যার যার প্রজেক্ট সম্পর্কে লিখে জমা দিতে হবে। বিপনু তো জমা দেবেই, সে অনেক আগে থেকেই একটা মজার বিষয় ভেবে রেখেছে। তার মাথায় দারুণ একটা আইডিয়া আছে। আইডিয়াটা পেয়েছে সে তার নানার কাছ থেকে। তার নানা ছিলেন ভূগোলের শিক্ষক। তারা যখন রাজশাহীতে নানার বাড়ি বেড়াতে যেত, তখন নানা তাকে নিয়ে মাঝে মাঝেই পদ্মার পারে বেড়াতে যেতেন। একদিন নানা বললেন,
দেখেছিস, নদী কেমন ভরে উঠেছে? বল তো কেন?
কেন?
কারণ, এখন জোয়ার।
ও
বল তো জোয়ার কেন হয়?
কারণটা বিপনু জানত, চাঁদের আকর্ষণে জোয়ার-ভাটা হয়, সে সেটাই ব্যাখ্যা করল। নানা খুশি হলেন।
বাহ্, তুই তো ভালোই জানিস। তবে তুই আরেকটা বিষয় কি জানিস?
কী?
তোর কি মনে হয় পৃথিবীর সব নদীতেই জোয়ার-ভাটা হয়?
হ্যাঁ, কেন হবে না?
না... হয় না। পৃথিবীর সব নদীতে জোয়ার-ভাটা হয় না। নানা তখন এক গল্প বললেন তাকে।
তখন মোগল আমল। এক নবাব তাঁর রাজ্যটা নিয়ে বিশেষ চিন্তিত। কী করে এই রাজ্যের উন্নতি করা যায়। প্রজারা ঠিকমতো খাজনা দেয় না। নবাবও একটু নরমসরম টাইপের। তখন নবাবের এক মন্ত্রী তাঁকে বুদ্ধি দিল, আপনি আপনার রাজ্যে সম্রাটকে দাওয়াত করুন।
তাতে কী হবে?
ওনাকে আপনার নদীর পাড়ে রাখার ব্যবস্থা করুন।
তাতে কী হবে?
উনি আপনার রাজ্যের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে দেখবেন। আপনাকে সব ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা করবেন। আপনাকে মোগল সাম্রাজ্যের আওতায় নিয়ে আসবেন।
তা-ই? বুদ্ধিটা খারাপ না।
তখন সেই নবাব সত্যিই নদীর পাড়ে সুন্দর করে তাঁবু গেড়ে সম্রাটকে একদিন মহাসমাদরে দাওয়াত করলেন। সম্রাট এলেন। তাঁবুতে থাকলেন দুই দিন। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে সৌন্দর্য উপভোগ করলেন। তারপর তৃতীয় দিনে তিনি ঘোষণা দিলেন, তিনি ফিরে যাবেন। এখানে আর এক মুহূর্ত নয়।
কেন, মহান সম্রাট, আপনার কি আমার রাজ্য পছন্দ হয়নি?
পছন্দ হয়েছে। তোমার রাজ্য অনেক সুন্দর, নদী সুন্দর, বন সুন্দর, প্রান্তর সুন্দর... সবই সুন্দর।
তাহলে কেন চলে যাবেন? আরও কটা দিন থাকুন।
আমি আসলে তোমার রাজ্যের দায়িত্ব নিতে পারব না, তুমি যে উদ্দেশ্যে আমায় দাওয়াত করেছ। তোমার প্রজাদের শাসন করা আমার পক্ষে সম্ভব না।
কেন, মহান সম্রাট?
কারণ, তোমার রাজ্যের নদী সকালে যায় ডানে আর বিকেলে যায় বাঁয়ে। যে দেশে নদীই শাসন করা যায় না, সে দেশের মানুষকে আমি কীভাবে শাসন করব?
তার মানে সেই সম্রাট নদীর জোয়ার-ভাটা সম্পর্কে জানতেন না? বিপনু বলে।
না, হয়তো জানতেন না। সেটা বিষয় না, এর মধ্যে একটা দর্শন আছে, সেটা তোর এখন না বুঝলেও চলবে। ফেরার পথে নানা বললেন, আসলে পৃথিবীর সব দেশে কিন্তু নদীর জোয়ার-ভাটা হয় না। যেমন ধর আমেরিকার কলোরাডো নদী, সেখানে জোয়ার-ভাটা নেই। এত দূরে যাওয়ার দরকার কি, নেপালের গোমতী নদীতেও জোয়ার-ভাটা নেই। অর্থাৎ যেসব নদী সমুদ্রের সঙ্গে যুক্ত নয়, সেসব নদীতে জোয়ার-ভাটা হয় না। সমুদ্রের পানি পূর্ণিমায় চাঁদের আকর্ষণে ফুলে-ফেঁপে উঠে তার সংযুক্ত নদীতে পানি প্রবাহিত করে। ফলে নদীতে নদীতে জোয়ার-ভাটা হয়। তার মানে সেই প্রাচীনকালের সম্রাটকে তুই দোষ দিতে পারিস না। তিনি হয়তো জোয়ার-ভাটা হয় এমন নদী দেখেননি কখনো।
তো নদীর এই বিষয়টা জানার পরই বিপনুর মাথায় আইডিয়াটা আসে। সে স্কুলের সায়েন্স ফেয়ারে নদীর এই জোয়ার-ভাটা নিয়ে একটা প্রজেক্ট করবে।
তারপর একদিন সে লিখিতভাবে তার নদীবিষয়ক সায়েন্স প্রজেক্ট জমা দিল স্যারের কাছে। প্রজেক্টের নাম ‘নদীর জোয়ার-ভাটা’। সবাই জমা দিচ্ছে মজিদ স্যারের কাছে। মজিদ স্যার অবশ্য বাংলা পড়ান। প্রজেক্ট জমা নেওয়ার কথা বিজ্ঞান স্যারের। বিজ্ঞান স্যারের ডেঙ্গু হয়েছে বলে স্যার কদিন ধরে আসতে পারছেন না। মজিদ স্যার ভ্রু কুঁচকে তার বিষয়টা পড়লেন। তারপর মাথা নাড়লেন।
তুই শিওর তো, পৃথিবীর সব নদীতে জোয়ার-ভাটা হয় না?
শিওর স্যার।
সত্যি হলে তোর বিষয়টা ইন্টারেস্টিং। দেখিস জেনেশুনে প্রজেক্ট বানাস। আমি অবশ্য সায়েন্স অত বুঝি না।
স্যার কাগজপত্র জমা নিলেন।
কাগজপত্র জমা দেওয়ার পর বিপনু যথেষ্ট উত্তেজনা বোধ করল। সে বাসায় জিনিসটা বানানোর পরিকল্পনা নিল। সে ভেবেছে, তার প্রজেক্টটায় সে একটা পাহাড় বানাবে। পাহাড় থেকে নেমে আসছে নদী। সেটা সমুদ্রে মিশছে... এক ধরনের নদী। আরেক ধরনের নদী হবে সমুদ্র বিচ্ছিন্ন, যেখানে জোয়ার হয় না। সে ঠিক করেছে, একটা হার্ডবোর্ডের ওপর মাটি দিয়ে প্রথমে একটা স্ট্রাকচার বানাবে। তারপর সেখানে নদী, পাহাড়, সমুদ্র—এসব তৈরি করতে হবে। এর জন্য বেশ কিছু মাটিও লাগবে। মাটি পাওয়া যায় কোথায়? তখনই তার মনে পড়ল তাদের স্কুলে ক্যানটিনের পেছনে অনেক মাটি জমে আছে। লাল মাটি। সেখান থেকে মাটি নেওয়া যেতে পারে।
এবং একদিন সেই মাটি সংগ্রহ করতে গিয়েই সর্বনাশটা হলো—
দিনটা ছিল রোববার। থার্ড পিরিয়ডে সমাজ স্যার আসবেন না। ক্লাসে সবাই গুলতানি মারছে। সেই ফাঁকে বিপনু বেরিয়ে গেল মাটি সংগ্রহে। ক্যানটিনের পেছনে চলে গেল। নতুন বিল্ডিং হওয়ার কারণে এখানে লাল মাটি টাল দেওয়া আছে। পকেটে করে একটা ছোট ব্যাগ আগেই এনেছিল। পকেট থেকে ব্যাগটা বের করতেই কোথাও একটা শব্দ হলো কট করে। তাকিয়ে দেখে রবীন। রবীনের সঙ্গে তার সাগরেদ বল্টু। সে একটা ভাঙা টুলের ওপর দাঁড়িয়ে ক্যানটিনের পেছনের একটা জানালা খুলছে। সেই জানালা খোলার শব্দ। টুলটা ধরে আছে বল্টু। বিপনু আশ্চর্য হয়ে দেখল। ক্যানটিনের জানালা দিয়ে রবীন টিফিনের প্যাকেট চুরি করছে। ঠিক ওই জানালাটার পাশেই একটা টেবিলে টাল করে রাখা সব টিফিন। একটা, দুইটা, তিনটা, চারটা...অনেক প্যাকেট তারা একটা ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলল। ওরা টুল থেকে নেমে আসবে যখন, তখন একটা মাটির ঢিবির আড়ালে সরে যাওয়ার চেষ্টা করল বিপনু। তখনই দুর্ঘটনাটা ঘটল। দ্রুত সরতে গিয়ে পা পিছলে ধপাস করে পড়ল বিপনু। শব্দে ওরা দুজন ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। বিপনুকে দেখে দুজনেই মনে হলো হকচকিয়ে গেল। দ্রুত এগিয়ে এল দুজন। বিপনু তখন উঠে দাঁড়িয়েছে। হাত দিয়ে ঝেড়ে নিজেকে পরিষ্কার করছে। রবীন এসে কলার চেপে ধরল বিপনুর—
ওই ল্যাংড়া, তুই এখানে কেন?
ল্যাংড়া বলায় বিপনুর মাথায় একটা বিস্ফোরণ হলো যেন।
তোমরা এখানে কেন?
আমরা একটা কাজে এসেছি।
আমিও একটা কাজে এসেছি।
তুই কিছু দেখেছিস?
দেখেছি।
কী দেখেছিস?
দেখেছি, তোমরা দুজন টিফিন চুরি করলে।
না, তুই দেখিসনি।
দেখেছি। ওই ব্যাগে টিফিন আছে। অনেক প্যাকেট।
রবীন চোখ দিয়ে বল্টুকে কিছু ইশারা করল। বল্টু পেছন থেকে বিপনুর দুই হাত চেপে ধরল। বিপনু হালকা-পাতলা ছেলে। সে তুলনায় ওরা দুজন বেশ বড়সড়। রবীন হাতের আস্তিন গুটিয়ে ঘুষি পাকিয়ে বলল,
ওই ল্যাংড়া, বল, তুই কিছু দেখিসনি?
দেখেছি...তোমরা স্কুলের টিফিন চুরি করেছ।
রবীন এবার সত্যি সত্যি সিনেমা স্টাইলে বিপনুর পেটে একটা ঘুষি মারল। ককিয়ে উঠল বিপনু।
এই ল্যাংড়া, বল, তুই কিছু দেখিসনি?
দেখেছি...তোরা টিফিন চুরি করেছিস। দাঁতে দাঁতে চেপে কোনোমতে বলল বিপনু।
তৃতীয় ঘুষি খেয়ে বিপনু চোখে যেন সত্যি সত্যি সরষে ফুল দেখল। এবার সে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল,
আমি দেখিনি...আমি দেখিনি...
কাউকে বলবি?
না।
ঠিক তো?
ঠিক।
বললে একদম স্কুল থেকে টিসি দিয়ে বিদেয় করে দেব। আমার বাবাকে চিনিস? এই স্কুলের সেক্রেটারি। এক কথায় এই স্কুল থেকে তোকে বিদেয় করে দেব, মনে থাকবে?
মাথা নাড়ে বিপনু। তার পেটে তখন প্রচণ্ড ব্যথা করছে। ওরা এবার ছেড়ে দিল। পেট চেপে ধরে বসে পড়ল বিপনু। রবীন ওকে একটা লাথি মেরে বল্টুকে নিয়ে চলে গেল।
এরপর যেটা হলো, বিপনু যখন একা থাকে ক্লাসে, রবীন আর বল্টু তখন কাছে এসে ফিসফিস করে বলে, ‘মনে আছে তো? তুই কিন্তু কিছু দেখিসনি...’ মাথা নাড়ে বিপনু।
এভাবেই চলছিল। একটা অসম্ভব যন্ত্রণা নিয়ে বিপনুর দিন কাটে। একে তো সে টিফিন পায় না। তার কারণটাও সে জানে, কেন পায় না। আর যার কারণে টিফিন খেতে পায় না, উল্টো তার কাছে মার খেতে হলো। বিষয়টা বুঝতে পেরেই কি না কে জানে একদিন বিপনুর ক্লাসের বেস্ট ফ্রেন্ড পলাশ এসে বলল—
কিরে বিপনু, তোর কিছু হয়েছে?
কী হবে?
নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে।
মানে?
আমি খেয়াল করেছি।
কী খেয়াল করেছিস? তুই যখনই একা থাকিস তখনই রবীন আর বল্টু এসে তোকে কিছু বলে আর তুই মাথা নাড়িস। ওরা কী বলে?
কই না তো। এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে বিপনু।
আসলে বিপদ যখন আসে তখন নাকি চারদিক থেকে আসে। বিপনুর মনঃকষ্টের আরেকটা ঘটনা ঘটল। সেদিন স্কুলে গিয়ে শুনল স্কুলের নোটিশ বোর্ডে যারা যারা সায়েন্স ফেয়ারে প্রজেক্ট জমা দেওয়ার পারমিশন পেয়েছে, তাদের নাম দেওয়া হয়েছে। সবাই ছুটে গেল। বিপুনও গেল সবার শেষে। নোটিশ বোর্ডে গিয়ে দেখে সবার নাম আছে শুধু তার নাম নেই। সে হতভম্ব হয়ে গেল। এমন কি রবীন আর বল্টুর নামও আছে। প্রত্যেকের নামের পাশে তাদের সায়েন্স প্রজেক্টের নামও দেওয়া আছে। রবীন আর বল্টুর নামের পাশে সায়েন্স প্রজেক্টের নাম ‘বার্গার অ্যালার্ম’!!
বিপনু তখনই বিজ্ঞান স্যারের কাছে গেল। স্যার কী সব কাগজপত্র ঘাঁটছিলেন। সম্ভবত সায়েন্স প্রজেক্টের কাগজপত্রই হবে।
স্যার?
স্যার চোখ তুলে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন
কী ব্যাপার?
স্যার, সায়েন্স প্রজেক্টে আমার নাম নেই।
তুই কোন ক্লাস?
স্যার, এইট।
প্রজেক্টের নাম কী?
স্যার, ‘জোয়ার-ভাটার নদী’।
স্যার চোখ তুলে তাকালেন। তারপর হঠাৎ খেঁকিয়ে উঠলেন, ‘ও তুমি সেই গর্দভ?... গাঁজা খাস?’
স্যারের কথা শুনে হকচকিয়ে গেল বিপনু। স্যার এবার মোটামুটি হুংকার দিয়ে উঠলেন।
বলি পৃথিবীতে সব নদী-সমুদ্রে জোয়ার-ভাটা হয় চাঁদের কারণে। আর এই সামান্য সায়েন্সটাও তুই জানিস না। আর তুই এসেছিস সায়েন্স প্রজেক্ট নিয়ে...সব নদীতে জোয়ার-ভাটা হয় না...এই তথ্য তোকে কোন গাধা দিয়েছে? অ্যাঁ...?
বিপনু দুর্বল গলায় কিছু বলার চেষ্টা করে কিন্তু তার গলা দিয়ে আওয়াজ বের হয় না। কষ্টে তার চোখে পানি চলে আসে। আর তখনই স্যার শেষ হুংকারটা দেন, ‘গেট আউট!’
মুখ কালো করে সে বের হচ্ছে এমন সময় পলাশ ছুটে আসে।
স্যার কী বলল?
বলল যে আমার তথ্য নাকি ভুল।
সত্যি, তাই বলল?
হু।
আসলে কি ভুল?
না।
তুই এক কাজ কর।
কী?
তুই আমার প্রজেক্টটায় চলে আয়, তুই আর আমি মিলে প্রজেক্টটা করি।
তোর প্রজেক্টটা কী?
‘পাথরকুচি পাতা থেকে বিদ্যুৎ’। বিপনু কিছু বলে না। আসলে এই বিজ্ঞান প্রজেক্ট থেকেই তার মনটা উঠে গেছে। সে বইখাতা নিয়ে স্কুল থেকে বিদায় নেয়। তার মনে হয় এমন যদি হতো এই স্কুলে আর আসতে হবে না। তাহলে বেশ হতো। ঈশ্বর যেন বিপনুর এই ইচ্ছেটা শুনলেন। বাসায় ফিরে বিপনু জ্বরে পড়ল। পরীক্ষা করে দেখা গেল তার ডেঙ্গু হয়েছে। তার রক্তের প্লাটিলেট দেড় লাখ থেকে নেমে এসেছে ৫০ হাজারে। ডাক্তার বলেছেন, আরও নামলে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। এখন শুয়ে শুয়ে পানি আর রসাল ফল খেতে হবে আর ফুল রেস্ট! ...ব্যস, কর্মসারা! স্কুলে যাওয়া বন্ধ, সারা দিন শুয়ে থাকা। মা খুব ব্যস্ত হয়ে গেলেন ছেলের জন্য। বাবা অফিস থেকে ছুটি নিয়ে ফেললেন। বিপনুর ভালো লাগল তার জন্য বাবা-মা কত ব্যস্ত আর স্কুলে...। সে আর ভাবতে চায় না। স্কুলের কথা চিন্তা করলে যেন মাথা ধরে যায়। এই বরং ভালো হলো ডেঙ্গুতে পড়ে স্কুলে যেতে হচ্ছে না। সায়েন্স ফেয়ারটা পার হয়ে যাওয়াই ভালো। যে সায়েন্স ফেয়ারে সে সুযোগই পেল না, সেখানে সে থাকতে চায় না। সে গল্পের বই পড়ে শুয়ে শুয়ে, মাঝে মাঝে বাবা আসেন।
কিরে বিপনু, কেমন আছিস?
ভালো।
তোর ডেঙ্গুর কারণে তোর সায়েন্সের প্রজেক্টটা মার খেলরে।
হু।
মন খারাপ?
না।
তোর নদীর আইডিয়াটা কিন্তু বেশ ভালো ছিল।
হু। বিপনুর মনোযোগ বইয়ে, সে মনোযোগ দিয়ে একটা অ্যাডভেঞ্চার বই পড়ছে।
তোর জন্য একটা গিফট আছে।
গিফট?
হ্যাঁ। বাবা মিটিমিটি হাসেন।
বিপনু বই বন্ধ করে কৌতূহল নিয়ে তাকায়। বাবা একটা প্যাকেট এগিয়ে দেন।
কী এটা?
খুলেই দেখ।
খুলে দেখে হতভম্ব হয়ে যায় বিপনু। একটা ছোট্ট হ্যান্ডি মুভি ক্যামেরা। যেটাতে সর্বোচ্চ ১০ মিনিট পর্যন্ত রেকর্ড করা যায়। কী আশ্চর্য, তার জন্য এত দামি গিফট?
তুমি কিনেছ?
না।
তাহলে?
আমার বন্ধু সালেককে ম