লেখকের শীতনিদ্রা!

এমনও সময় গেছে, এক দিনেই কয়েকটি লেখা লিখেছি। শব্দসংখ্যার বিচারে কয়েক হাজার তো হবেই। কিন্তু গত কয়েক মাস হলো লেখালেখিতে একদম মন নেই। বসব বসব করেও কি-বোর্ডে আর হাত চলে না। বাঁ হাত চললেও বেশি দূর যায় না। মোটকথা, লেখা আর শেষ হয় না। লিখতে বসলেও ভালো আইডিয়ার অভাবে অনেক সময় ইচ্ছেদের অপমৃত্যু হয়।

তবে আমি তো চুনোপুঁটি লেখক। তাই বলে এটা বিচ্ছিন্ন কোনো সমস্যা নয়। বিখ্যাত বিখ্যাত সব লেখকদেরও এমন অনুর্বর সময় পার করতে হয়েছিল। স্কট ফিজারেল্ডের নাম নিশ্চয়ই শুনেছ। জীবদ্দশায় সমালোচকদের বাহবা না পেলেও বর্তমানে তিনি বিংশ শতকের অন্যতম সেরা আমেরিকান লেখক হিসেবে স্বীকৃত। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাসগুলোর মধ্যে রয়েছে দিস সাইড অব প্যারাডাইস, টেন্ডার ইজ দ্য নাইট। তিনিও একটা সময় অনুর্বর সময় পার করছিলেন। ভুগছিলেন লেখালেখির শীতনিদ্রায়।

একই সমস্যায় পড়েছিলেন আরেক বিখ্যাত লেখক জোসেপ মিচেলও। দ্য নিউ ইয়র্কার ম্যাগাজিনে লেখালেখি করে প্রচুর সুনাম কুড়িয়েছিলেন তিনি। এমন খ্যাতিমান মানুষটিই অনুর্বর সময় পার করার জন্য সবচেয়ে বেশি পরিচিত। তাঁর মৃত্যু ১৯৯৬ সালে। ১৯৬৪ সাল থেকে শুরু করে তাঁর মৃত্যুর দিন পর্যন্তও তিনি প্রতিদিন অফিস করেছিলেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, এই তিন দশকেরও বেশি লম্বা সময়ে তিনি বলার মতো কিছুই লেখেননি। কী অবিশ্বাস্য, তা–ই না?
চার্লস স্কুলজের কথাই ধরো। তাঁকে সর্বকালের অন্যতম সেরা কার্টুনিস্ট ধরা হয়। কমিক স্ট্রিপ পিনাটস–এর জন্য তিনি সবচেয়ে বেশি পরিচিত। বাড়ি আমেরিকার মিনেসোটায়। শীতনিদ্রায় পেয়েছিল তাঁকেও। হারম্যান মেলভিলও তাঁর বিখ্যাত মবি-ডিক উপন্যাস লেখার পর কয়েক বছরের জন্য ঝিমিয়ে পড়েছিলেন। এ ধরনের শীতনিদ্রা গীতিকারদেরও গ্রাস করতে পারে। ইংরেজ গীতিকার ও গায়িকা অ্যাডেলও এমন সমস্যায় আক্রান্ত।

কিন্তু সমস্যাটি কেন হয়? মনোবিজ্ঞানে সমস্যাটির কেতাবি নাম রাইটার্স ব্লক। বিষয়টি যে একেবারেই হেলাফেলার বিষয় নয়, তার প্রমাণ মেলে এটা নিয়ে বিস্তর গবেষণা থেকে। ১৯৭০ ও ১৯৮০–র দশকের শেষ দিকে এ নিয়ে হয়েছিল অনেক গবেষণা। তবে সমস্যাটির বর্ণনা প্রথম দেন মনোবিশ্লেষক এডমন্ড বার্গলার। ১৯৪৭ সালে।

রাইটার্স ব্লক বা লেখালেখির অনুর্বরতার পেছনে অনেকগুলো মনোবৈজ্ঞানিক কারণ আছে। বড় কারণের মধ্যে রয়েছে উত্সাহের অভাব ও বিভিন্ন ঘটনা দ্বারা প্রভাবিত হওয়া। মজার ব্যাপার হলো, এই শীতনিদ্রা নিয়েও কিন্তু গল্প-উপন্যাস রচিত হয়েছে। জর্জ অরঅয়েলের কিপ দ্য অ্যাসপিডিস্ট্রা ফ্লায়িং এমন একটি উপন্যাস। উপন্যাসের নায়ক গর্ডন কমস্টক একটি মহাকাব্য লিখতে গিয়ে বারবার হোঁচট খাচ্ছিলেন। এখানে অনুর্বরতার কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে ওপরের দুটি বিষয়কে।

কারণ অন্য রকমও হতে পারে। সেটা হতে পারে অসুস্থতা, বিষণ্নতা, সম্পর্কের ভাঙন বা অর্থনৈতিক চাপ। আবার অনেক সময় নিজের অপছন্দের বিষয়ে লেখার জন্য চাপ প্রয়োগ করা হলেও সমস্যাটি দেখা দিতে পারে। মেডিকেল সায়েন্সের মতে, তাই রাইটার্স ব্লক নিছক একটি মানসিকতার ব্যাপার নয়। চাপের মুহূর্তে মানব মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণ সেরেব্রাল কর্টেক্স থেকে লিম্বিক সিস্টেমে চলে আসে। সেরেব্রাল কর্টেক্স হলো মস্তিষ্কের সেরেব্রাল অংশের নিউরাল টিস্যুর বাইরের স্তর। স্মৃতি ধরে রাখা, মনোযোগ, অনুধাবন, সচেতনতা, চিন্তা ও ভাষার বিনিময়ের ক্ষেত্রে সেরেব্রাল কর্টেক্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অন্যদিকে লিম্বিক সিস্টেমের অবস্থান হলো সেরেব্রালের মাঝামাঝি অবস্থান থেকে নিচের দিকে। থ্যালামাসের দুই পাশজুড়ে। এর প্রধান কাজ হলো আবেগ, আচরণ, মোটিভেশন, দীর্ঘমেয়াদি স্মৃতি ও ঘ্রাণে সহায়তা করা।

এখন কথা হলো, মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণ সেরেব্রাল কর্টেক্স থেকে লিম্বিক সিস্টেমে চলে এলে কী হয়? লিম্বিক সিস্টেম কাজ করে মানুষের সহজাত গুণাবলি ও আচরণ নিয়ে। অন্যদিকে সেরেব্রাল কর্টেক্স সৃজনশীলতার বিকাশ নিয়ে কাজ করে। ফলে সেরেব্রাল কর্টেক্সের ভূমিকা সীমিত হয়ে পড়ায় সৃজনশীলতা বাধার মুখে পড়ে। সেটার বদলে আচরণগত ও সহজাত গুণাবলিগুলো প্রবল হয়ে ওঠে। স্নায়ুবিজ্ঞানী অ্যালিস ফ্ল্যাহার্টির মতে, রাইটার্স ব্লকের কারণ মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট কিছু অংশের প্রভাব। এ বিষয়ে আরও আরও জানতে তাঁর বইটি পড়ে নিতে পারো দ্য মিডনাইট ডিজিস: দ্য ড্রাইভ টু রাইট, রাইটার্স ব্লক, অ্যান্ড দ্য ক্রিয়েটিভ ব্রেইন।

তাহলে ধরো, তুমিও রাইটার্স ব্লকে আক্রান্ত হয়ে গেলে। তাহলে উপায়? খুশির খবর হলো, অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে ব্লক পার করেই লেখকেরা দারুণ কিছু তৈরি করে ফেলেছেন। তবে এ ব্লক থেকে উদ্ধার পাওয়ারও অনেকগুলো প্রস্তাবিত উপায় আছে। এর মধ্যে আছে গ্রুপ আলোচনা, ব্রেইনস্টর্মিং, লিস্ট তৈরি ইত্যাদি। অনুর্বরতার কারণ যেহেতু লেখকভেদে আলাদা হতে পারে, তাই সমাধানও হতে পারে ভিন্ন ভিন্ন।

লেখালেখির বিখ্যাত জার্নাল, জার্নাল অব রিডিং–এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে জোসেফ অলিভার বলেন, এই সমস্যা থেকে মুক্ত করতে লেখকদের প্রশ্ন করে করে তাঁদের লেখালেখির প্রক্রিয়াটিকে সচল করতে হবে। অনুর্বরতা দূর করতে লেখকেরা নিজেরা কী করেন, সেটা জানতে ২০১৬ সালে একটি জরিপ পরিচালিত হয়। এখানে সমাধান হিসেবে দেখা গেছে দিনে লেখার সময় পরিবর্তন ও সময়সীমা নির্ধারণ করে লেখা।

জস হেইজ তো নতুন করে লেখালেখির উপায় বলতে গিয়ে একটি বইই লিখে ফেলেছেন: রাইটিং দ্য ন্যাচারাল ওয়ে। লিখতে লিখতে কখনো খেই হারিয়ে ফেললে ওপরের কোনো একটি বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে আবার শুরু করে দাও লেখালেখি।

সূত্র: বিবিসি, স্টপপ্রোক্র্যাস্টিনেটিংঅ্যাপ ডট কম, জার্নাল অব রিডিং